• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আবেঘন স্ট্যাটাস দিলেন শাহরিয়ার নাফীসের মা

স্পোর্টস ডেস্ক, আরটিভি নিউজ

  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:২০
ছবি- শাহরিয়ার নাফীসের মা

‘রুটিন করে সপ্তাহে তিন দিন মাঠে নিয়ে যেতাম। সব মায়েরা যখন দুপুরের ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিতেন আমি তখন ওদেরকে মাঠে খেলতে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম।’

২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শাহরিয়ার নাফীসের টেস্ট অভিষেক হয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ওয়ানডের অভিষেকটাও একই বছরে (২১ জানুয়ারি ২০০৫) প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড আর টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক অধিনায়কত্ব দিয়ে ২০০৬ সালে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

আরও পড়ুন : ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি, নাফীসের স্ত্রীর আবেগঘন স্ট্যাটাস

উপরের এই অভিষেকের তারিখগুলো যত সহজে পড়া গেল সেটা অর্জন করতে কতই না শ্রম দিতে হয়েছে শাহরিয়ার নাফীসকে। আর এই শাহরিয়ার নাফীস হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছেন একজন মহীয়সী নারী, একজন মা। তিনি শাহরিয়ার নাফীসের ‘মা’ সালমা আঞ্জুম লতা। বর্তমানে থাকেন যুক্তরাষ্টের অঙ্গরাজ্য শহর অ্যারিজোনায়।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক অবসর নেন শাহরিয়ার নাফীস। ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও ক্রিকেট তাকে ছাড়েনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাকে পরিচালকের পদে বসিয়েছে।

শাহরিয়ার নাফিসের অবসরে যাওয়াটা আর সবার কাছে যতটা সহজ মনে হয়েছে ঠিক ততটা সহজ মনে হয়নি মা সালমা আঞ্জুমের কাছে। তিলে তিলে গড়ে তোলা নাফীসের অবসর নিয়ে লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেটাই তুলে ধরা হলো আরটি নিউজের পাঠকদের জন্য।

আরও পড়ুন : জয়ের অপেক্ষা ভারতের, অশ্বিন ছাড়িয়ে গেছেন সাকিব-সোবার্সকে

'একজন শাহরিয়ার নাফীস ।

১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২১।শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ জাতীয় দলের একসময়কার দুর্দান্ত বাঁহাতি ওপেনার শাহরিয়ার নাফীস আহমেদের (আবীর)ক্রিকেট ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া সব ধরণের ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে নিল অবসর।

জাতীয় দলে শাহরিয়ার নাফীসের জার্নিটা শুরু হয়ে ছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু এই জার্নির বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। শাহরিয়ারের ক্রিকেট জার্নি পনের বছরের হলেও মা হিসেবে আমার জার্নি ছিল দীর্ঘ পঁচিশ বছরের।

বিভিন্ন সেনানিবাসে বড় হওয়া তিন বাচ্চাকে নিয়ে যখন প্রথম ঢাকা মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করি তখন ওরা বিকেলে খেলতে পারতোনা, হাঁপিয়ে উঠত।

আরও পড়ুন : ভালোবাসা দিবসে নাসিরের বিয়ে, জেনে নিন স্ত্রীর পরিচয় (ভিডিও)

১৯৯৫ সালে প্রথম ওদেরকে নিয়ে আবাহনী মাঠে যাওয়া শুরু করি। প্রথমে বিসিবির অধীনে, তারপর সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ওয়াহিদুল গনির কাছে আমার দুই ছেলেই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। আমি চেয়েছিলাম ওরা লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকুক।

নাফীসের বয়স যখন দুই আড়াই তখন থেকেই ফুটবলের চাইতে ক্রিকেটের দিকে বেশি আগ্রহ ছিল। প্লাস্টিকের ছোট্ট ক্রিকেট ব্যাট আর পিংপং বল দিয়েই খেলতে পছন্দ করতো। খালাত ভাইদের বড় ব্যাট ধরার জন্য কান্নাকাটি করতো। সাড়ে তিন বছর বয়সে নাফীসকে প্রথম কাঠের ব্যাট কিনে দিয়েছিল আমার বড় বোন রত্না।

আমাদের পরিবারে ক্রিকেট খেলা ছিল খুবই জনপ্রিয়। নাফীসের মামারা ছাত্রাবস্থায় ক্রিকেট খেলতেন। খালাত ভাই ফারুক আহমেদ ছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়, অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচক।

আরও পড়ুন : আমি যা চেয়েছি সেটা হয়নি: পাপন

আমার অন্য ভাইগ্না ভাতিজারাও ক্রিকেট খেলত। নাফীসের আড়াই বছর বয়সেই প্রথম লক্ষ্য করি ও বাঁহাতি।

আবাহনী মাঠ থেকেই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র নাফীসের ক্রিকেট যাত্রা শুরু। রুটিন করে সপ্তাহে তিন দিন মাঠে নিয়ে যেতাম। সব মায়েরা যখন দুপুরের ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিতেন আমি তখন ওদেরকে মাঠে খেলতে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। প্রথম দিকে আমি ছাড়া অন্য কোন মায়েরা মাঠে আসতেন না। বছর দেড়েক পরে অন্য মায়েরাও আসতে শুরু করেন।

প্রশিক্ষণ চলার বছর দু'এক পরেই শুরু হয় বয়স ভিত্তিক নানা টুর্নামেন্ট। দেশের বাইরে ভারতের শিলিগুড়িতে প্রতিবছর অনূর্ধ্ব-১৩ একটা টুর্নামেন্ট হত। ১৯৯৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৩ দলের হয়ে নাফীসের আগেই আমার মেঝ ছেলে ইফতেখার নাঈম আদীব খেলতে গিয়েছিল শিলিগুড়ি।

আরও পড়ুন : ‘ক্রিকেটে সঠিক অথবা ভুল সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই’

২০০০ সালে বড় ছেলে শাহরিয়ার নাফীস প্রথমবারের মত অনূর্ধ্ব -১৫ খেলতে যায় মালয়েশিয়া। অনূর্ধ্ব- ১৫, অনূর্ধ্ব- ১৭, অনূর্ধ্ব -১৯ সবগুলো বয়ঃভিত্তিক খেলাই খেলেছিল।

খেলার জন্য লেখাপড়ায় যাতে ভাটা না পড়ে সেদিকে ছিল আমার তীক্ষ্ণ নজর। মাঠে নিয়ে যাবার আগেই ওদেরকে শর্ত দিয়ে রাখতাম। তাছাড়া সেন্ট জোসেফ স্কুল এবং নটরডেম কলেজে নির্দেশ দেয়াই ছিল পরীক্ষায় খারাপ করলেই টিসি।

প্রতিটা টুর্নামেন্ট, প্রতিটা ট্যুর এ যাওয়ার আগে বেশ অনেকদিন থাকতে হত ক্যাম্পে। কমপক্ষে ১০/১৫ দিন।কখনো কখনো মাসব্যাপী।স্কুল কামাই হত। ক্যাম্পে, ট্যুর-এ বই দিয়ে দিতাম।

তখনকার সেসব পড়া,বাড়ির কাজ ম্যানেজ করতে হত আমাকেই। কতবার আমাকে ওর স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের মুখোমুখি হতে হয়েছে আর অপরাধীর মতো জবাবদিহি করতে হয়েছে তার হিসেব নেই।

আমার ছেলেরা লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল। ক্লাস সেভেন-এ একই সাথে নাফীস সেন্ট জোসেফ স্কুল এবং মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ-এ (লিখিত পরীক্ষায়) চান্স পেয়েছিল। শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলার জন্য ক্যাডেট কলেজে না দিয়ে সেন্ট জোসেফ স্কুল-এ ভর্তি করেছিলাম।

আরও পড়ুন : ক্রিকেটারদের সঙ্গে বলিউড তারকাদের ‘ব্যর্থ’ সব প্রেমের গল্প

আমি নাফীসকে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জোর করতে পারতাম। নিদেনপক্ষে বিবিএ, এমবিএ পাস করে ভাল কোনো জব করতে পারতো কিন্তু, আমি সেদিন ওর পছন্দকে মূল্য দিয়েছিলাম। নাফীস যে পথে হাঁটতে চেয়েছে সে পথের কাঁটাগুলো সরিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। ক্রিকেট এর প্রতি ওর ভালবাসা, ওর মেধা দেখে আমরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি কোনো একদিন নাফীসের গায়ে উঠবে লাল সবুজের জার্সি। প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলাদেশকে।

তৃতীয় বিভাগ থেকে শুরু করে প্রিমিয়ার লীগের খেলার জন্য ধূপখোলা মাঠ থেকে বিকেএসপি পর্যন্ত এমন কোনো মাঠ নেই ওকে নিয়ে যাইনি। কত দিন দুপুরে না খেয়ে কাটিয়েছি। প্রতিটা জাতীয় বয়ঃভিত্তিক টিম সিলেক্ট হওয়ার আগে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি।

আম্মা, আমি টিমে চান্স পাবো তো? ছেলের অসহায় চেহারা দেখে একেকসময় মনে মনে আমিই হয়ে যেতাম নির্বাচক। জায়গা করে দিতাম পেসার, স্পিনার, উইকেট কিপারের সাথে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদের। ডানহাতি আর বাঁহাতি কম্বিনেশনের কথা মাথায় রেখে নাফীসকে বাদ দেয়া হয়ে যেত অসম্ভব। পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, তুমি দলে থাকবে ইন শা আল্লাহ।

আরও পড়ুন : নতুন নামে আসছে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব

আমার কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে ছেলে ঘুমিয়ে পড়তো।পরের দিন পেপারে ওর নাম দেখে পরম করুণাময়ের কাছে শুকরিয়া জানাতাম।

Image result for shahriar nafees

অনূর্ধ্ব- ১৯, যুবদল এর পর ২০০৫ সালের ২১শে জুন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল। ইংল্যান্ডের মাটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৭৫ রান করে হয়েছিল ‘ম্যান অব দ্যা ম্যাচ’। একই বছর ১২ই সেপ্টেম্বর সুযোগ পেয়েছিল স্বপ্নের টেস্ট ক্রিকেট খেলার।

২০০৬ সালের অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পায়। ২০০৬ ছিল নাফীসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল বছর।

১. আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের জন্য মনোনীত হয়েছিল

২. ২০০৬ সালের বিসিবির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়

৩. ২০০৬ সালের বিসিবির সেরা ব্যাটসম্যানও নির্বাচিত হয়

৪. নির্বাচিত হয় গ্রামীণ ফোন ও প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব।

টেস্ট ক্রিকেট -এ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৩৮ রানের ইনিংসটা ছিল একটা মাইলফলক। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওর ৪টা সেঞ্চুরির কথা ক্রিকেট প্রেমীরা মনে রাখবে অনেকদিন। ২০০৬ সালে নাফীস প্রথম বাংলাদেশী যে এক ক্যালেন্ডার বছরে ১,০০০ রান করার গৌরব অর্জন করেছিল।

বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়কত্ব করার দায়িত্ব পেয়েছিল। টি-টোয়েন্টিতেও সেঞ্চুরি করার সৌভাগ্য হয়েছিল নাফীসের।

একদিনের আন্তর্জাতিক, টেস্ট ক্রিকেট, টি টোয়েন্টি সহ নাফীস খেলেছে দু'দুটি বিশ্বকাপ।

আরও পড়ুন : ক্রিকেটারদের সঙ্গে বলিউড তারকাদের ‘ব্যর্থ’ সব প্রেমের গল্প

মা হিসেবে আমি চেয়েছিলাম যোগ্যতা অনুযায়ী খেলাধুলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ব্লু সম্মাননাটাও যেন পায়। সেটাও পেয়েছে।

বাংলাদেশকে হয়তো আরও অনেককিছু দিতে পারতো, আরো অনেককিছু দেয়ার যোগ্যতা ছিল কিন্তু, আমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস করি। ওর ভাগ্যে এতটুকুই ছিল। লেখাপড়া, ক্রিকেটের পাশাপাশি একজন ভাল মানুষ বানাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সততা, আন্তরিকতা এবং কৃতজ্ঞতা বোধের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি। জানিনা কতটুকু সফল হয়েছি।

যে কোন বিদায়ই হৃদয় বিদারক। তবু মেনে নিতে হয়। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার অনেক পরে আমরা উপলব্ধি করি কোথাও ভুল ছিল কিনা। আমি মা হিসেবে এই দু'আ করি এবং আশা করবো এরপর নাফীস যে কাজটাই করবে যেন সততার সাথে করে, আন্তরিকতার সাথে করে। দেশের অসংখ্য মানুষের, অগণিত ভক্তদের যে অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছে তার মর্যাদা যেন রাখতে পারে।

May be an image of 3 people

সবশেষে বলবো, শাহরিয়ার এর মা হিসেবে আমিও পেয়েছি অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসা। আমি সকলকে জানাই অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। অনেকেই আমাকে বলে আমি ‘রত্নগর্ভা’। আমি রত্নগর্ভা কী না জানি না তবে আমি অতি সাধারণ একটা ঝিনুক যার গর্ভে তিনটি অসাধারণ মুক্তোর জন্ম হয়েছিল। আমার সেই মুক্তোরা সব মানুষের প্রগাঢ় ভালবাসায় বেঁচে থাকুক।

শাহরিয়ার নাফীসের মা। অ্যারিজোনা থেকে। ১৫/০২/২০২১।'

এমআর/

মন্তব্য করুন

daraz
  • খেলা এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
টেস্ট অভিষেকেই আইসিসি থেকে সুসংবাদ পেলেন হাসান 
X
Fresh