• ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
logo
ভাষাবিদ ড. মাহবুবুল হক আর নেই
বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক হারুন-উর-রশীদ আসকারী
বাংলা একাডেমির নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মো. হারুন-উর-রশীদ আসকারী।  তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। বুধবার (২৪ জুলাই) তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  একাডেমির শহীদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষে হারুন-উর-রশীদ আসকারীকে সংবর্ধনা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সচিব নায়েব আলীসহ বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক ও কর্মকর্তারা। দায়িত্ব গ্রহণ করে হারুন-উর-রশীদ বলেন, দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকে, তবে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান একটিই। তাই জাতির সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য সবাই এই প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবার সহযোগিতা ও সমর্থন পেলে এই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বমানের গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে যোগদানের দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর মেয়াদে তাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে, গত ১৮ জুলাই হারুন-উর-রশীদ আসকারী নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।  
রকমারিতে মিলছে না জাফর ইকবালের বই
ছড়া ও গল্প প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করল কোয়ান্টাম
রায়হান কামালের বই ‘টাকার ব্যবহার’
ব্রাশস্ট্রোকস্ অব ফ্রেন্ডশিপ: পথচলার ৩০ বছর
ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী আজ
আজ ১৩ জুলাই, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।  ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে তার জন্ম। পিতা মফিজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম। পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচ্যে অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্মরণীয় উক্তি- ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যে কয়জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯০৪) এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (১৯০৬) পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন (১৯০৬-৮)। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১০) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) পাস করেন। দুবছর পর তিনি বি.এল (১৯১৪) ডিগ্রিও অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা সহকারী (১৯১৯-২১) হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে (১৯২১) যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তার জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদান কালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ (১৯২২-২৫) ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৫৩-৫৫) হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।  ভাষা আন্দোলনে শহীদুল্লাহ্ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানান। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক (১৯১১) ছিলেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা ও সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন (১৯১৭), ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্মেলন (১৯২৬), কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম যুবক সম্মেলন (১৯২৮), হায়দ্রাবাদে নিখিল ভারত প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন (ভাষাতত্ত্ব শাখা, ১৯৪১) এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন (১৯৪৮)। মাদ্রাজে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ট্রাডিশনাল কালচার ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া’ অনুষ্ঠানে তিনি ইউনেস্কোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার চেয়ারম্যান মনোনীত হন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনাসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু জটিল সমস্যার সমাধান করেন। বাংলা লোকসাহিত্যের প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো: সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৩৬), দীওয়ান-ই-হাফিজ (১৯৩৮), শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), রুবাইয়াত-ই-উমর খয়্যাম (১৯৪২), Essays on Islam (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), পদ্মাবতী (১৯৫০), বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড ১৯৫৩, ১৯৬৫), বিদ্যাপতি শতক (১৯৫৪), বাংলা আদব কী তারিখ (১৯৫৭), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৫৭), বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৫৯), কুরআন শরীফ (১৯৬৩), অমরকাব্য (১৯৬৩), সেকালের রূপকথা (১৯৬৫) ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই -এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan (১৯৬১) একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর Buddhist Mystic Songs (১৯৬০) গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত; এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তিনি ১৮টি ভাষা জানতেন; ফলে বিভিন্ন ভাষায় সংরক্ষিত জ্ঞানভাণ্ডারে তিনি সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান; তার ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে ধর্ম সম্পর্কে তার আন্তরিক বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে বক্তৃতা করতেন। জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’, ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্ট লেটার্স’ (১৯৬৭) উপাধিতে ভূষিত হন।  ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এ ছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।
বাবার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবি মাকিদ হায়দার
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি মাকিদ হায়দারের জানাজা শেষে পাবনা সদর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কবিকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলার কবি, সাহিত্যিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণ। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সকাল ৮টায় পাবনা সদর গোরস্থানে তৃতীয় ও শেষ জানাজা শেষে তার বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে বুধবার (১০ জুলাই) সকালে উত্তরার নিজ বাসায় মারা যান মাকিদ হায়দার। পরে বাদ জোহর প্রথম জানাজা শেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ দুপুর ২টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে রাখা হয়। সেখানে কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোকপাত করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান।
কবি আল মাহমুদের জন্মবার্ষিকী আজ
আজ ১১ জুলাই, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় প্রবাদপ্রতিম এই কবি জন্মগ্রহণ করেন। আল মাহমুদ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। ‘সোনালী কাবিন’খ্যাত বরেণ্য এই কবির নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার বাবার নাম মীর আবদুর রব ও মায়ের নাম রওশন আরা মীর। তার দাদা আবদুল ওহাব মোল্লা হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকারবিরোধী সংবাদপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন, তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি। ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন।’ ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধ তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল।’ কোনো কোনো তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বাসগ্রস্ততার কারণে তার বেশকিছু কবিতা লোকায়তিক সাহিত্যদর্শন দৃষ্টান্তবাদ দ্বারা অগ্রহণযোগ্য। তবে এ কথাও সত্য, কবিতায় দর্শন থাকে, কিন্তু দর্শন দ্বারা কবিতা নিয়ন্ত্রিত নয়, কবিতা আবেগের কারবার। আল মাহমুদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার ঝুলিতে রয়েছে একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দিন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৫), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১) ও বাসাসপ কাব্যরত্ন (২০১৭) । ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকায় একটি হাসপাতা‌লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
আজ ৩ জুলাই, বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, গবেষক ও অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ২০০৯ সালের আজকের এই দিনে ঢাকার নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।  আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা গাজী আব্দুস সোবহান ও মাতা আমেনা খাতুন। তিনি ১৯৪৭ সালে নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬-৬১), সিলেট এমসি কলেজ (১৯৬২-৬৮) এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ (১৯৬৪-৬৭)-এ অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এক বছর (১৯৭৪-৭৫) এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।  আশাবাদী সংগ্রামী মনোভাব তার রচনার বৈশিষ্ট্য। বর্তমান নাগরিক জীবনের বিকার উপস্থাপনেও তিনি বেশ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার প্রথম উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র ১৯৬০ সালে ছাপা হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদ একজন শাণিত ভাষার লেখক ছিলেন। তিনি ছিলেন বাস্তব জীবনের রূপকার। বাস্তবতার রূপ পরিগ্রহ করেছে তার ভাষা নির্মাণে। সংস্কৃতাশ্রয়ী শব্দ তিনি পরিহার করেছেন বলা চলে। তিনি প্রধানত মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের রূপকার। তার গল্প নাতিদীর্ঘ।  তার লেখা উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০), শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২), কর্ণফুলী (১৯৬২), ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), খসড়া কাগজ (১৯৮৬), শ্যাম ছায়ার সংবাদ (১৯৮৬), জ্যোৎস্নার অজানা জীবন (১৯৮৬), যেখানে দাঁড়িয়ে আছি (১৯৮৬), স্বাগতম ভালোবাসা (১৯৯০), অপর যোদ্ধারা (১৯৯২), পুরানা পল্টন (১৯৯২), অন্তরীক্ষে বৃক্ষরাজি (১৯৯২), প্রিয় প্রিন্স (১৯৯৫), ক্যাম্পাস (১৯৯৪), অনূদিত অন্ধকার (১৯৯১), স্বপ্নশীলা (১৯৯২), কালো জ্যোৎস্নায় চন্দ্রমল্লিকা (১৯৯৬) ও বিশৃঙ্খলা (১৯৯৭)। গল্পও লিখেছেন বেশ কিছু। ‘জেগে আছি’ তার লেখা প্রথম গল্প। এ ছাড়াও ‘ধানকন্যা’, ‘মৃগণাভি’, ‘অন্ধকার সিঁড়ি’, ‘উজান তরঙ্গে’, ‘যখন সৈকত’, ‘আমার রক্ত স্বপ্ন আমার’, ‘কবিতা’, ‘মানচিত্র’ বাংলা সাহিত্যে তুমুল পাঠকপ্রিয়। আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণ পদক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 
সাক্ষাৎকার : স্বপন নাথ / সময়কে যাপন ও ধরার চেষ্টা করেছি, কতটুকু পেরেছি পাঠকই বলতে পারবেন
স্বপন নাথ, একজন কবি প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। কাজ করে যাচ্ছেন নিজের আপন খেয়ালে। জন্ম ১৯৬৮ সালের ৪ মে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। লেখালেখির বিষয় কবিতা, কথাসাহিত্য, নৃতত্ত্ব, লোকসাহিত্য ও ইতিহাস ইত্যাদি। মনিপুরি ভাষা বিষয়ে গবেষণাও করেছেন। সম্প্রতি সাহিত্য, শিল্প ও সমাজবিষয়ক পত্রিকা লোকবৃত্ত সম্পাদনা করছেন। এই গুণী সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল। আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোথায়? সেখানকার পরিবেশ কতটা আপনার অনুকূলে ছিল?  আমার জন্ম হয়েছে ১৯৬৮ সালের ৪ঠা মে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ঘোলসা গ্রামে। তখন সে এলাকা ছিল নিভৃত গ্রাম। খুব আনন্দময় পরিবেশ-প্রতিবেশে আমরা বড় হয়েছি। চারদিকে সবুজের সমারোহ, টিলাভূমি, বিপুল ও চমৎকৃত নিসর্গের মধ্যেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে আনন্দে। আমার জন্মগ্রাম থেকে খুব দূরে নয়। চা-বাগান, নৃ-জনগোষ্ঠীর পাড়া, পাথারিয়া পাহাড়, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর। ছিল খাল, নালা, পুকুর বিস্তৃত কৃষি জমি। যদিও বিদ্যুৎ ছিল না, তবে প্রকৃতি পরিবেশ, প্রতিবেশী সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ছিল অত্যন্ত নিবিড় ও অনুকূলে। প্রতি বাড়িতে সাধারণ পূজা উৎসব ছাড়াও লোকপূজা লেগেই থাকতো। এসব পূজাপার্বন, ঈদ উৎসবে আমরা সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতাম। পূজাপার্বন ছাড়াও বিশেষ বিশেষ মাসের সংক্রান্তি উৎসবে সারা গ্রামের মানুষ মেতে উঠতো। এ ছাড়াও লোকগান, কীর্তনের আবহ ছিল খুব সমৃদ্ধ। কৃষিকাঠামোর মধ্যে যাকিছু বিনোদন সবই ছিল সেখানে। এসব থেকে সামাজিকায়নের মূল শিক্ষা গ্রহণ করেছি। যদিও তখন বুঝিনি কী কী বিষয়ে আমরা দক্ষতা আমরা অর্জন করেছিলাম। যেসব আমাদের মগজে অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। কোনও নির্দেশনার প্রয়োজন পড়েনি। ফলে এখন আর সামাজিকায়নের শিক্ষা আলাদাভাবে গ্রহণ করতে হয় না। যে স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করি, সে স্কুলের অবস্থান ও পরিবেশ ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ছিলেন খুব মেধাবী শিক্ষকবৃন্দ। ফলে স্কুল, লেখাপড়া নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হত না।  বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে সড়ক পথ এবং আসাম- বেঙ্গল রেললাইন (এখন নেই)। আমাদের শৈশব ও কৈশোরে এ সড়কটি পাকা ছিল না। কিন্তু সবই ছিল আমাদের বিকাশের পক্ষে সহায়ক। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন। কারণ কৃষি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল সমাজ ও পরিবার। এখন আর সে পরিবেশ নেই। কারণ শহরের সুবিধাগুলো ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে গ্রামে। চলে গেছে বাজার অর্থনীতির আকর্ষণীয়, বিচিত্র লোভনীয় বিষয়-আশয়। ফলে শৈশব কৈশোরের আন্তরিক পরিবেশ ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।  আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে? প্রথম বই কবে প্রকাশিত হয়? প্রথম বই প্রকাশের ঘটনা জানতে চাই? লেখালেখির শুরু স্কুলের পাঠ শেষ করার পর। তখন লিখতামও লুকিয়ে লুকিয়ে; এসব প্রকাশও করিনি। অনেক লেখাই তখন ছিঁড়ে ফেলেছি, সংগ্রহে রাখিনি। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। একইসাথে প্রবন্ধ ও কবিতা। আমার দু-একজন বন্ধুর কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। তারা প্রবাসে আছেন, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, কবি কাজল রশীদ এবং কবি মুজিব রহমান।  কবি মুজিব রহমান প্রথমে বই প্রকাশের প্রস্তাব করেন। তিনি জানান, ‘কবি কাজল রশীদ ও কবি আতাউর রহমান মিলাদ বিনিয়োগ করবেন এবং তারাই উদ্যোগী প্রকাশনার বিষয়ে, আপনার কোনও চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে দেবেন।’ আমি তখন ভাবছিলাম কী আর বই হবে। বই হওয়ার মতো প্রকাশযোগ্য লেখা কী আমার আছে। এমন সন্দেহ, ভয়, সংকোচ নিয়ে প্রকাশকের কাছে পাঠাই পাণ্ডুলিপি। প্রকাশিত হয় : কবিতা : ‘রৌদ্র ও বৃষ্টিতে মায়াহরিণ’; প্রবন্ধ : ‘চিন্তা ও জগৎ : সাহিত্য সংস্কৃতি’। সেই থেকে কেউ কেউ জানতে পারল আমিও লিখি।    আপনার তো অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আপনি কী মনে করেন প্রকৃত কবিতা চর্চার মানুষ কমে যাচ্ছে? না, কমছে না। কবিতাচর্চা ও কবির সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। যত বেশি চর্চা হবে তত সাহিত্যের জন্য উপকারী। প্রকৃত আর অপ্রকৃত কবিতা বলে কিছু আছে কি? আমি এ মার্জিনটা মানতে নারাজ। আপনারা হয়তো বলবেন, আমি কবি হতে পারিনি বলে সীমারেখা মানছি না। তা সত্য! তবে কাউকে অবহেলা করতে চাই না। আবার যদি মার্জিন সত্য হয়, তবে কেন খুঁজতে যাই গ্রামীণ লোককবিকে? নিজের যোগ্যতা প্রমাণে? বাণিজ্যিক ব্যবহারে?  আসলে লেখক বা কবি তাঁর লেখাটাই লিখেন। পাঠক পড়বে কিনা, এতে তাঁর দায় নেই। আর আমরা সার্টিফিকেটই দিতে যাব কেন?  কালিক সমস্যার ফলে সব বিষয়ে অনিশ্চিতি বেড়েছে। এ বিষয়ে পরে বলবো। আমি কবিতা লিখেছি বটে, তবে অন্য সকলের মতো বলছি না- তৃপ্ত নই। আসলেই বলছি- এসব লেখা কবিতা হয়ে ওঠেনি। আমি আসলে কবিতার শক্তিকে ধরতে পারছি না, এখনও আমার সীমাবদ্ধতা প্রচুর। আর সমকালে যেসব কবিতা পড়ছি, এর অধিকাংশই আমার ভালো লাগে না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কোনও ‘কারণে’ই আমি নিশ্চিত হয়ে বলছি না, অনুমান থেকে বলছি। এমনও হতে পারে কবি ও কবিতাচর্চা দুটোই সমস্যা। হতে পারে পঠন-পাঠনের অভ্যাস কমে গেছে। পাঠ করতে গেলে তো ক্ষমতা লাগে। হতে পারে, বাংলা কবিতা ও বিশ্বপরিসর সম্পর্কে আমাদের জানা খুবই কম। এ ক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত হয়ে যা বলতে পারি, আমরা সাড়া জাগানো কবিদের লেখা পাঠ করি না। উলটো কবি হয়ে ওঠার কাতরতা লক্ষণীয়। একইসাথে পাঠ করি না- মিথ, পুরাণ, ইতিহাস, সংস্কৃতির ধারা। এসব খোঁজখবর না রাখলে ভালো বা মন-মনন চঞ্চল করা কবিতা কীভাবে হতে পারে?     কবিতা লেখার চেয়ে কবিরা বেশি মিডিয়া নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়া কি কাউকে বড় কবি বানাতে পারে বলে মনে করেন? সমকালীন যন্ত্রণাবিদ্ধ একটি প্রশ্ন তুলেছেন। মিডিয়া কবি হয়ে ওঠার সহায়ক হতে পারে না। সকলক্ষেত্রেই মিডিয়া (সামাজিক মাধ্যমসহ)-র দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করছি। আমরা নিশ্চিত পপুলার কালচারের আগ্রাসন ঠেকানো যাবে না। এমন কামনা-বাসনা সকল সময়ই ছিল, শুধু মাত্রা ও মাধ্যম বদলে গেছে এই। মনে রাখতে হয় সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের বিচিত্র রসিকতা এবং নিওলিবারেলিজমের প্রভাব-ক্ষমতার রূপ ও রেখায় আমাদের চলাফেরা বাড়ছে। আমাদের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা ওইপথেই চলাচল করছে। আমরা এখন মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছি না, বরং মিডিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এর বিস্তার আমাদের শান্তি, স্বস্তি, দর্শনচর্চা ইত্যাদি থেকে উচ্ছেদ করছে; করছে অস্থির, আকৃষ্ট করছে চাকচিক্যের দিকে। ফলে মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে বৈ কমছে না। এ পরিস্থিতিতে মিডিয়া আক্রান্ত কবি ব্যর্থ হয়ে আবার ফিরবেন আপন ঠিকানায়- কবিতার ঘরে। এমন সিদ্ধান্তে ভাবনা স্থায়ী রাখা কঠিন।  বিশ্বের খ্যাত কবি যারা, তারা কবি হয়ে মঞ্চে গিয়েছেন। আর আমাদের সামনে যারা কবি, তারা খুব সরব, চঞ্চল। কবি হওয়ার আগে তাদের মঞ্চে বসার আগ্রহ বেশি। নিশ্চিত দোষারোপ করছি না। হয়তো এটা এ কালের বৈশিষ্ট্য। আমাদের কালে দেখছি, কীভাবে পুরস্কারের আশা-আকাঙ্ক্ষা-অনিশ্চিতি-প্রতিযোগিতার দৌড়ে কবি লেখকরা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। এসব কবিকে বড় করে না, কবি ও কবিতাকে অপমানিত করে। আবার মনে মনে ভাবি- ঠিকই আছে, না হলে কে কাকে স্থান, পরিসর দেয় বলুন।      বর্তমানে আমরা নানান সংকটাপন্ন জীবনযাপন করছি। কিন্তু বাংলাদেশের কবিতায় এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। কবি হিসেবে আপনার অভিমত কী? মনে রাখা দরকার মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মেরুকরণ হয়েছে। তখন আদর্শিক লড়াইও ছিল প্রবল। এর মধ্যে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও ছিল। কিন্তু প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়নের প্রচণ্ড চাপ-তাপে পৃথিবীর সবকিছু ভেঙে পড়া শুরু হলো। আবার এ মুহূর্তে কী ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে, তা আমরা সঠিক ঠার করতে পারি না। নিশ্চিত করে কিছু বলাও যায় না। এসব ঘটল বিশ্বে বাণিজ্যপুঁজির আগ্রাসী উত্থানের ফলে। মানুষের মন মননে এখন স্থিরতা নেই। কোথাও কোনও আদর্শের বালাই নেই। সবকিছুতে মুনাফা, উদ্দেশ্য ইত্যাদির হিসেব আগে করা হচ্ছে। হাইপার-বিশ্বায়ন সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে কোটেড চিন্তা-ভাবনা দৃশ্যায়ন করছে। নয়া পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যই হলো, সবকিছুকে ফ্লাট করে দেখা। গ্রান্ড ন্যারেটিভে এখন আর লতাগুল্ম খোঁজে পাওয়া মশকিল। যে কারণে উঁচুনিচু, সামাজিক বৈষম্য কোনোটারই এখন মূল্য নেই। যে যেভাবে পারছে, তার ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করছে।  ফলে এখন মানুষ নিজেকেও মূল্যায়ন করতে পারে না। গ্রান্ড হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় আপন অস্তিত্ব। পরিণামে সকলেই বাণিজ্যপুঁজির স্রোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। এই নয়া বিশ্বব্যবস্থায় মূল্যবোধ, ন্যায়বোধ, সমতা ইত্যাদি আর কেউ উচ্চারণ করে না। মঙ্গলাকাক্সক্ষা, শুভবোধকে গ্রাস করেছে মোটিভেশনাল বিদ্যাবুদ্ধি। এর পেছনের কারণ না জেনেই দৌড়াচ্ছে সকলে। জীবন যাপন, সংস্কৃতি এখন প্রোডাক্ট হিসেবে গণ্য। বাস্তবতা হলো বিশ্বের তাবৎ মানুষের চোখ, যা আছে তা দেখে না, যা নেই তা দেখে। এই ধাঁধাঁ লাগানো দুনিয়া হলো নয়া বিশ্বব্যবস্থা। এখন আর সাম্রাজ্যবাদের আগের কৌশল কি কেউ দেখে? দেখে না।  স্মরণীয় কলোনিয়ালিজম শব্দটি আমাদের অনেক কিছু ভাবতে পরিসর তৈরি করে দিয়েছে। এখন মাটি দখলের বিবিধ উপাচার দিয়ে কলোনিকে ব্যাখ্যা করা হয় না। কারণ নানাবিধ কলোনি মানুষের মনোজগতকে দখল ও নিয়ন্ত্রণ করে। অতএব এককভাবে কেউ আর মঙ্গলচিন্তাকে লালন করতে পারবে না। যেখানে চোখধাঁধাঁনো দুনিয়ার অশুভ তৎপরতার মহোৎসব চলমান।   ফলে একজন তাড়িত কবিও এ জৌলুসের বাতাসে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে চাকচিক্যের একজন ভাবতে থাকে। কিন্তু উন্মূল চরিত্র কী মুছে ফেলা যায়। একজন কবি কী এসব থেকে মুক্ত! মোটেও না। একজন কবিকে এসব সমস্যার গভীরে গিয়ে পৃথিবী ও সমাজের সংকট বুঝে নিতে হয়। তা কি কেউ করছে কিনা। আবার বিশ্বের এসব জটিলতা বোঝাপড়ার সামর্থ্য হয়তো অনেকের নেই। তুলি, কালি, পেনসিল ছাড়া ক্যানভাসে ছবি আঁকা যায় না। কিন্তু আমরা জোর করে আঁকতে চাই। আমি যদি ভূগোল, ইতিহাস, বিবর্তন, রূপান্তর না বুঝি, তা হলে কীভাবে রূপায়ণ করব সাহিত্যে। কেউ হয়তো কষ্ট পাবেন আমার বিবেচনা শুনে, পড়ে। এখন লেখালেখির জগতে অনেকেই সিরিয়াসলি এসব পাঠ করেন না। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, পঠনপাঠন বেড়েছে, তথ্যের অবাধ বিস্তার, প্রসার ও বিনিময় ঘটেছে, কিন্তু এ পঠনপাঠনের প্রতিফলন তেমন চোখে পড়ে না। হয়তো উপলব্ধির ভূগোলে অন্যকিছুর খেলা চলমান।      সমূহ সংকটের ফল ও পরিণাম সকল লেখক, কবির মধ্যে লক্ষ্যণীয়। তবে কীভাবে এসব বিবেচনা করছেন, তা ব্যক্তিগত উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে। অপ্রিয় সত্য হলো, অধিকাংশ ব্যক্তি, লেখক, কবি বিশ্বের এমন সমস্যা নিয়ে ভাবিত নন। যোগ্যতা, শক্তি না থাকলে বিচার বিবেচনা কি করা যায়? নেই বলেই মানুষের গভীরতর অসুখ লেখায় আসে না। প্রতিফলিত হয় না।         আপনার অনেকগুলো প্রবন্ধের বইও প্রকাশিত হয়েছে। একজন কবি স্বপন নাথ ও একজন প্রাবন্ধিক স্বপন নাথকে যদি আলাদা করে মূল্যায়ন করতে বলা হয়, তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? চমৎকার। ব্যর্থ দুটো অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলার তেমন কিছু নেই। আমি-স্বপন নাথ হিসেবে যেভাবে বিবেচনা করি, তা হলো- আমার কবিতা লেখা অভ্যাসগত; আর প্রবন্ধ আনন্দ থেকে লেখা। নিজেকে কবি হিসেবে ভাবতে ভালোই লাগে। সময়কে যাপন ও ধরার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি, তা পাঠকই বলতে পারেন। তবে এটুকু বলা যায়, কবি হিসেবে আমি পাঠকের অন্তর জয় করতে পারিনি।   প্রবন্ধের মধ্যে নতুন কিছু বলার চেষ্টা আছে। কিন্তু আমাদের মগজে-মননে অভ্যাসগত ত্রুটি থাকার ফলে নতুন কিছুকে স্বাগত জানাতে পারি না। আমি যেমন পাঠক হিসেবে অস্থির তেমনি বিচিত্র বিষয়ে লেখার চেষ্টা করছি। বলতে পারেন, কোনও কাঠামোর মধ্যে আমাকে রাখা যায় না। আমি জানি, যা একজন লেখকের জন্য ক্ষতিকর। সফল না হলেও স্বপন নাথ চর্চা করে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। আমার কাছে চর্চাই বড়, সফলতা নয়।  আপনি সৃজনশীল বা মননশীল কাজের পাশাপাশি অনেকগুলো সম্পাদনার কাজ করেছেন মৌলিক ছাড়া সম্পাদনার কাজে কেনো আসলেন এবং কী কী বই সম্পাদনা করেছেন? তরুণ বয়স থেকেই ফোল্ডার, ভাঁজপত্র ও ছোটকাগজ সম্পাদনা করে আসা। এসব করতে করতে মনে হলো বই সম্পাদনা করা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়াজাগানো কোনো পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করতে পারিনি। আরও একটি সত্য কথা হলো, আমি নিজে তো সব বিষয়ে লিখতে পারি না, তাই আমার আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে অন্যদের লিখতে অনুরোধ করি। এ ধারণা থেকেই সম্পাদনার কাজ করা।  অন্যদিকে এমন কিছু বিষয় আছে, যা সম্পাদনা ছাড়া উপস্থাপন সম্ভব নয়। এমন বিষয় আছে, যা সম্পাদনা না হলে হয়তো বিষয়টি অনালোকিত থেকে যাবে। এমন চিন্তা থেকে সম্পাদনা-সংকলনের কাজে আসা। এই চর্চা বজায় রাখতে এ পর্যন্ত চারটি গ্রন্থ : অধ্যাপক মো. আবদুল খালিক সম্মাননাগ্রন্থ (২০২১), মুক্তি বনাম বন্ধন ও নির্বাচিত কবিতা মহামায়া চৌধুরী (২০২২), রকমারি খানাপিনা ও সংস্কৃতি (২০২৩), লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য (২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে। আরও দু-একটি কাজ ছাপাখানায় আছে। তবে এই সম্পাদনার কাজ করতে আনন্দ পেয়েছি।  আপনি ‘লোকবৃত্ত’ নামে একটি সাহিত্যের কাগজ করেন। এই কাগজ সম্পাদনায় এলেন কেন?  আসলে পত্রিকা বা ছোটোকাগজ সম্পাদনাকর্মে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও পরিকল্পনা ছিল না। আবার হুট করে যাওয়া যায় না কোথাও। এক সময় পরিচিতজনদের সাথে পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনা নিয়ে কথা বলি। তারা উৎসাহ দেন এবং অবশেষে করেই ফেলি।  আরেকটি কারণ- জেদ। অনেক বন্ধু কাগজ প্রকাশ নিয়ে বেশ গর্ববোধ করেন। কিন্তু পত্রিকাগুলো অধিকাংশই কবিতা ও গল্প দিয়ে ভর্তি। ওই কারণে প্রমাণ করা যে, আমি, আমরাও কাগজ প্রকাশ করতে জানি। হোক তা মানহীন, ভুল বা অশুদ্ধ। একদিন এক বন্ধু বলেই ফেললো- ‘ওগুলো সাহিত্যপত্রিকা হবে না, সংকলন হতে পারে’। আমিও উত্তর বলি, ‘হোক সংকলন, তবুও পত্রিকা করতে চাই’। সেই থেকে ‘লোকবৃত্ত’ পত্রিকা করে ফেলা। ২০২০ সালে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিষয় ছিল : লোকসাহিত্য। খাদ্য বিষয়ে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। শিক্ষা বিষয়ক তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। চতুর্থ সংখ্যার বিষয় ‘হাওর : জনপদ, জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতি’। কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশিত হবে।  সকলেই জানেন এখানে প্রবন্ধ লেখক কম। অন্যদিকে সকলেই শুধু বলতে পারে, মানে বক্তৃতা দেয়। তাদের উপদেশ, পরামর্শ, তত্ত্ব কপচানো দেখে-শুনে মনে হলো, এসকল বক্তাদের লিখতে বলি। এর উত্তরে তারা কীভাবে কেমন সাড়া দেন, তা দেখা। ওই বক্তাদের বারবার লিখতে অনুরোধ করি লেখা দিতে। অনেকেই দিলেন না, এখনও দেন না। কথা বলেই যান, লেখা যে হয় না। আবার যেসব লেখা পেয়ে থাকি, সেসব মুদ্রণের যোগ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল, ওই বুলি কপচানো, আড্ডার বক্তাদের ভুল প্রমাণ করা। বলা সহজ, লেখা কঠিন। মোদ্দা কথা, আমার উদ্দেশ্য সাহিত্যে বিপ্লব নয়, নিজের না জানা ভূগোলকে সমৃদ্ধ করতেই সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা ও প্রকাশ করা।  আপনি কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু ও দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে। অন্যদের থেকে আপনার কাজের বিশেষ্যত্ব কী? প্রথমেই বলে রাখি এ দুই মহাজন ভিন্ন এলাকার। একজন রাষ্ট্র ও জাতির নির্মাতা, আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। অন্যজন রাজনীতি সচেতন, নিসর্গ ও বাস্তুসংস্থান বিশেষজ্ঞ।  এদেশে সংখ্যা বিচারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। তবে গভীর লেখা খুবই সামান্য। দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে সম্পাদিত বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র কোনও বই প্রকাশিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।  স্মরণীয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার সবকিছু বোঝার বয়স ছিল না। সংকটকালে বঙ্গবন্ধুর নাম যখন মুখে আনা যেত না, তখন কীভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানা হলো, সেসব লিখেছি। সেই সময় সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবনা কেমন ছিল, দীর্ঘকাল অন্ধকারে কেমন ছিলাম, এসব পর্যবেক্ষণই উপস্থাপন করেছি।  বঙ্গবন্ধুর লেখালেখি অসাধারণ। বিশেষত বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি বই প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন প্রবন্ধে ব্যক্তি ও মনন আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। এসব লেখালেখি নিয়ে আমার নিজস্ব উপলব্ধি উপস্থাপন করেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত লেখা থেকে উপলব্ধি করেছি, তাঁর মতো কেউ গভীরভাবে বাঙালি ও বাংলাদেশকে দেখেনি, জানতে চায়নি। বাংলাদেশকে জানাবোঝার জন্য বঙ্গবন্ধুর এসব লেখা অপরিহার্য। এ জন্য বইয়ের নাম দিয়েছি, ‘বঙ্গবন্ধু : লেখক ও মানবসত্তা।’ দ্বিজেন শর্মা এদেশের প্রথম লেখক ও গবেষক, যিনি বিজ্ঞান, পরিবেশবিদ্যাকে জনপাঠ্য করে তুলেছেন। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখি অধিকাংশই জনপাঠের জন্য যোগ্য নয়। দ্বিজেন শর্মার সাথে ব্যক্তি-সম্পর্ক, তাঁর লেখালেখি এসবই আমাকে প্রভাবিত করে। তিনি কেমন, কীভাবে পরিবেশবিদ্যাকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন ইত্যাদি জানাবোঝা ছিল লক্ষ। এ বিশ্বে বাস্তুসংস্থান বিষয়ে কে কী ভেবেছেন, এখানে দ্বিজেন শর্মা কীভাবে দেখেছেন এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অন্য একটি বিষয়, তিনি দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়া অবস্থান করেছেন চাকরিসূত্রে। এক সময় গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রোইকা তিনি ভেতর থেকে দেখেছেন। সকলেই বলছে সমাজতন্ত্রের দিন শেষ। এই যে, সমাজতন্ত্রের নামে গড়ে ওঠা একটি বিশাল সাম্রাজ্য কী কারণে ভেঙে গেল এবং সমাজতন্ত্র উত্তর তাঁর প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলাবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং উত্তরণ সম্পর্কে তাঁর কিছু সুপারিশও আছে। এসব বিষয়ের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ রয়েছে দ্বিজেন শর্মা বিষয়ক ‘নিসর্গনন্দন দ্বিজেন শর্মা’ গ্রন্থে। প্রচারের জন্য বলছি না, বঙ্গবন্ধু ও দ্বিজেন শর্মা বিষয়ক গ্রন্থে রয়েছে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ।      বাংলা কবিতা কতদূর এগিয়েছে বলে মনে করেন? তরুণ কবিদের কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? বাংলা কবিতা এগুলো কি না, আমার এ বিষয়ে কোনও স্টাডি নেই। ফলে অন্যের কথা শুনে বা পড়ে বলার কোনও মূল্য নেই। তবে আমার ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ হয়তো আছে। কিন্তু তা নিয়েও আমি গবেষণা করিনি। কেবলই কবিতা নিয়ে না বলে, সাহিত্য নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আমি বলতে পারি, বাংলা সাহিত্য শুধু নয়, অনেক ভাষার সাহিত্য নিয়ে অনিশ্চিতি আছে।  যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল, তখন সাহিত্যে নানা জাতির রোম্যান্টিকতাও ছিল। ব্যক্তি আমি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা ভালোভাবে জানি না, তো লিখতে গেলে ওই ভাষাই আমার একমাত্র অবলম্বন। তবে সাহিত্য চর্চায় ভাষা ফ্যাক্টর হলেও শেষ কথা নয়। একটি ক্ষুদ্র ভাষায়ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যচর্চা হতে পারে। ফলে এটা বড় কোনও বাধা নয়। মূলত যে বিষয় ভাবা দরকার, বিশ্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক চরিত্র বদলে গেছে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে। অন্যদিকে দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তির ধাক্কায় সবকিছুর খোলনলচে পালটে যাচ্ছে। আমি ব্যক্তি হিসেবে সজাগ যে, প্রতিটি ভাষার রাজ্যে প্রযুক্তির ঘাত পড়ছেই। আমরা এখনও যে ভাষা ব্যবহার করছি, আগামীতে আর ব্যবহার করা নাও লাগতে পারে। কারণ এর ব্যবহার যোগ্যতা থাকবে  কিনা। যেক্ষেত্রে মানুষ প্রযুক্তির ভাষা ব্যবহার করবে। এসব বিবিধ বিষয়ের প্রেক্ষিতে বলা যায় সাহিত্যচর্চা অংশত এগিয়েছে। তবে এভাবে আর আগামীতে চলবে কিনা সন্দেহ।  একালের কবিতার মধ্যে দর্শন, যোগাযোগ স্থাপনের রস অংশত অনুপস্থিত। মনে রাখতে হয়, কবিতা পাঠের আনন্দ সবকিছু থেকে আলাদা। তা যদি না পায় পাঠক, তা হলে বিশে^র এত তত্ত্ব দিয়ে কী হবে কবিতার।         তরুণ কবিদের কবিতা নিয়ে জানতে চেয়েছেন। আমার সীমাবদ্ধতা হলো, তরুণ কবিদের কবিতা তেমন পাঠ করা হয় না। যেটুকু আমার বোঝাপড়া, একালের কবিতায় আত্মমগ্নতা, আত্মঘোষণা অতি বেশি এবং কবিরাও আত্মবিবরে নিমজ্জমান। তবে তারা স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। কবিতা পাঠে মনে হয় আমরা বাংলাদেশের কবিতাই পাঠ করছি।  আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ৯০দশকের পর কবিতা শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে বেশি। এতে স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে এ সংকট কবিরা বুঝতে পারছেন কিনা, জানি না। যে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ছিল ত্রিশোত্তর কালে। এখন কি আবার সেই সংকট ফিরে এলো?  কবিতার কাব্যিক ঝংকার আর কেউ মিস করেন কিনা জানি না, তবে আমি করি। শুধু শব্দ একযোগে গাথা হলো, ইমেজ তৈরি হলো না, বক্তব্য নেই, কী বলা হলো-তা স্পষ্ট নয়। একইসেঙ্গ আবার উত্তরাধুনিক পরিভাষা ব্যবহার হচ্ছে। কেমন বৈপরীত্য। যাক, কবিতার জগৎ কবিতাকেই বেছে নেবে। আলাদাভাবে উদাহরণ বা কোনও কবির নাম উচ্চারণ করছি না। কারণ, তরুণ কবিদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অতি প্রবল। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ভূগোলে আত্মঘোষিত শ্রেষ্ঠ কবি। ফলে নাম উচ্চারণে সংযমিত থাকলাম।  সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।  আপনাকেও ধন্যবাদ।   
কবি অসীম সাহা আর নেই
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা আর নেই। মঙ্গলবার বিকালে বিএসএমএমইউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। এর আগে তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) থেকে কবি ইউসুফ রেজা সংবাদ মাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ইউসুফ রেজা জানান, কবি অসীম সাহা বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তাকে টিউব দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছিল। গত ২১মে শারীরিক অবস্থার বেশি অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ইউসুফ রেজা আরও জানান, অসীম সাহা বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। এছাড়া পারকিনসন (হাত কাঁপা রোগ), কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়াবেটিস রোগেও ভুগছিলেন তিনি। কবি অসীম সাহা ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলায় তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস মাদারীপুরে। তার পিতা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন অধ্যাপক। অসীম সাহা ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন অসীম সাহা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
‘চরমপত্র’র কথক ও লেখক এম আর আখতার মুকুলের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
আজ ২৬ জুন,  সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’-এর কথক ও লেখক এম আর আখতার মুকুলের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০০৪ সালের ২৬ জুন তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।  এম আর আখতার মুকুলের জন্ম ১৯৩০ সালের ৯ আগস্ট বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের অন্তর্গত চিংগাসপুর গ্রামে। পুরো নাম মুস্তাফা রওশন আখতার মুকুল। পিতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক সা’দত আলি আখন্দ, মাতা রাবেয়া খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে একাধিকবার জেল খাটতে হয়েছে।   ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের তার রচনা ও কণ্ঠ প্রদান করা ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল৷ সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার থেকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একজন কলামিস্ট৷ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫টি৷ এম আর আখতার মুকুলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে। তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়েন। তার বাবা সরকারি চাকরি করার কারণে তারা দিনাজপুর চলে আসেন এবং ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। মুকুল দিনাজপুর রিপন কলেজ (ব্রাঞ্চ) থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৭ সালে৷ ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তিনি ১৯৪৮ সালে জননিরাপত্তা আইনে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ১৯৪৯ সালে জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেন৷  ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন৷ ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকের সময় যে ১১ জন ছাত্রনেতা উপস্থিত হন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। অন্যরা ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতানা, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন ও আনোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এম আর আখতার মুকুল সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন৷ সাপ্তাহিক ‘নও বেলাল’, ‘পাকিস্তান টুডে’, ‘দৈনিক আমার দেশ’ ও ‘দৈনিক সংবাদ’ ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের জন্মলগ্ন থেকে ১৯৬০ সালের জুলাই পর্যন্ত এই পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন৷ ১৯৬১ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এম আর আখতার মুকুল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউডিআই-এর ঢাকাস্থ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন৷  একইসঙ্গে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকায় এবং পরে দৈনিক পূর্বদেশেও চাকুরি করেন৷ এম আর আখতার মুকুল ১৯৭১ সালে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে যোগদান করে তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান৷ ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়রি তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এমআর আখতার মুকুল দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন৷