• ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
logo
রমজানে দরিদ্রের প্রতি আওয়ামী লীগের সহানুভূতি ও বিএনপির ইফতারের রাজনীতি
প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি / ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি
ঢাকার আগারগাঁওয়ে সরকারি এক একর জমির উপর অবস্থিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)। বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করে দেওয়া স্থাপনায় এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, বাইগাম এ বিগত কয়েকটি কার্যনির্বাহী কমিটির দূর্নীতি ও অনিয়মতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের পথে।  লাগামহীন দূর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম সেই মুহূর্তে আশার আলো হয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর এগিয়ে আসে এবং একজন প্রশাসক নিয়োগ দেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে কাজ এখনো কাজ চলছে।  প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ (লটারি ফান্ড ৪ কোটি ১০ লক্ষ এবং মেম্বার সাবক্রিপশন ফান্ড ৮৮ লক্ষ টাকা) বিগত কমিটিগুলো পূর্বেই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তসরুপ করে খরচ করে ফেলেছে। এখন শুধুমাত্র কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো জমা রয়েছে। কার্যনির্বাহী কমিটিগুলোর লাগামহীন দুর্নীতি (৭২ লক্ষ টাকা সাব-স্টেশন স্থাপন বাবদ, ৪৩ লক্ষ টাকায় পিকনিক বাবদ, ২৫ লক্ষ টাকা কার্যনির্বাহী কমিটির সিটিং ও মিটিং ভাতাবাবদ, ২২ লক্ষ টাকা এজিএম বাবদ, ৬৮ লক্ষ টাকা ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন বাবদ, ২২ লক্ষ টাকা প্যাথলজি বিভাগে মেশিন ক্রয় বাবদ এবং কোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য ও ২০২৫ সালের লটারি দূর্নীতি ৪৭ লক্ষ টাকা) এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে গত দুই অর্থ বছর ধরে বাইগাম এর জন্য বরাদ্দকৃত সরকারী অর্থ এখন পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। ফলশ্রুতিতে আমরা বাইগামের কর্মকর্তা কর্মচারিরা গত ১ (এক) বছর যাবৎ বেতন ভাতা পাচ্ছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কি অবস্থা হবে সে বিষয়েও আমরা চিন্তিত।  বাইগাম আগারগাঁয়ে সরকারি ১(এক) একর জমির উপর সমাজসেবা অধিদফতর এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ভবনে এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় পরিচালিত হচ্ছে। বাইগামের প্রবীণ নিবাসকে (বৃদ্ধাশ্রম)  সাধারণ মানুষসহ সরকারি নানা মহলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবীণ নিবাস হিসেবেই চিনে থাকেন। বর্তমানে আমরা মাত্র ৪০ জন প্রবীণকে প্রবীণ নিবাসে জায়গা দিতে পারছি। কিন্তু প্রতিদিনই প্রবীণ আসছে এখানে আশ্রয়ের আশায়, আশাহত হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তারা অজানার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না।  বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে, বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রবীণ। গবেষণা বলছে ২০৪০-৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যায় ২২ শতাংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী থাকবে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো ইউনিসেফের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিতে ২য় স্থানে রয়েছে। সে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৯ সালে বাংলাদশ প্রবীণপ্রবন সমাজে পা দিতে যাচ্ছে এবং ২০২৯ সালে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিনত হবে। রাস্ট্রীয়ভাবে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাইগামকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রথম সারির প্রবীণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বন্ধপ্রায় প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন রুপে সাঁজিয়ে এখানে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।   এমতাবস্থায়, বাইগামে কর্মরত আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারিরা গত ১ বছর ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতরভাবে দিনপার করছি। আমরা বিশ্বাস করি, কার্যনির্বাহী প্রথা সিস্টেমটি বিলুপ্তি করে প্রতিষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হলে এটি একসময় বাংলাদেশে প্রবীণকল্যাণে রাস্ট্রীয়ভাবে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রবীণদের কল্যাণে তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠানটিতে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরির মাধ্যমে প্রবীণ কল্যাণে কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান রুপান্তিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করার সময়ে এসেছে।  ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন সরকারি অফিসে এবং ঢাকায় ৫ হাজার খোলা চিঠি বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার দিকে পথ চেয়ে বসে আছি। আমরা চাই উন্নত বিশ্বের আদলে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সেবায় ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ আপনি আমাদের উপহার হিসেবে তৈরি করে দিবেন এবং আমাদের চাকুরীসহ বেতন ভাতার নিশ্চায়তা প্রদান করবেন।    ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মানের মাধ্যমে প্রবীণসেবায় রোল মডেল হিসেবে যে সমস্ত কাজ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করতে পারে এবং আমাদের চাওয়াসমূহ – ১. বাইগাম পরিচালিত প্রবীণ নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম) বর্তমানে মাত্র ৫০ জন প্রবীণ বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিদিনই অসহায় প্রবীণ এখানে আসছে, আবাসনের অভাবে তাদের আমরা রাখতে পারছি না। অসহায় প্রবীণরা ব্যাগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে ফিরে যাচ্ছে। তাই এখানে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস তৈরি করার আবেদন/অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রবীণ নিবাসে বসবাস করার বর্তমান নিয়ম হচ্ছে, যাদের বয়স ৬০ এবং যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ প্রবীণ কেবলমাত্র তারাই থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু যারা শারিরীক ও মানসিক ভাবে সুস্থ নয়, তাদেরও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ২. ‘লং টার্ম কেয়ার সেন্টার’ তৈরি করা - উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও বাড়ছে ৮০ বছরের উর্ধ্বে বয়স্ক প্রবীণের সংখ্যা। এই বয়সে গেলে বেশিরভাগ মানুষই বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং তার পৃথিবী তৈরি হয় শুধুমাত্র একটি বিছানাকে কেন্দ্র করে। তাকে বিছানাতেই ফিজিওথেরাপি, খাওয়ানো, গোসল করানো ও টয়লেটিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব যেটাকে বলা হয় কেয়ার গিভিংয়ের দায়িত্ব নেবার পাইলট প্রকল্প চালু করে উন্নত বিশ্বের মতো একটি মডেল চালু করার সময় এসেছে এবং এই মুহূর্তে এটি বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন। ৩. প্রবীণ হাসপাতালের মাধ্যমে প্রবীণদের জন্য আউটডোর চিকিৎসাসেবা এবং আগারগাঁয়ে নির্মিত সরকারি টারশিয়ার লেভেলের হাসপাতালগুলোর (পঙ্গু হাসপাতাল, নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল দেশের উন্নয়নের অবকাঠামোতে যথারীতি রয়েছে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রবীণ নিবাসে বসবাসরত প্রবীণদের জন্য দ্রুত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এখানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট প্রবীণ হাসপাতাল পরিচালনা করা।  ৪. প্রবীণদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, ইন্ড লাইফ (মৃত্যপথ যাত্রী) কেয়ার সেন্টার ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। ৫. প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা কেন্দ্র স্থাপন করা এবং প্রতিষ্ঠানটি থেকে সরকারি হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বিপদে পড়লে পিতা-মাতার ভরণপোষন আইন-২০১৩ এর প্রয়োগ করা এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। ৬. ঢাকায় বসবাসরত অসুস্থ প্রবীণদের বাসায় গিয়ে কেয়ার গিভিং হোম সার্ভিসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৭. প্রবীণদের জন্য স্বল্পমূল্যে বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। ৮. দক্ষ প্রবীণবান্ধব সেবাকর্মী (জেরিয়েট্রিক কেয়ার গিভার) তৈরির উদ্দ্যেগ গ্রহন করা এবং বাংলাদেশে প্রবীণ সেবাকর্মীর চাহিদা মিটিয়ে উন্নত বিশ্বে দক্ষ জনবল হিসেবে তরুণদের কাজ করতে প্রেরণ করা। বাংলাদেশ থেকে উন্নতবিশ্বে এই জনবল পাঠানোর চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু সঠিক ট্রেনিংয়ের উদ্দ্যেগ গ্রহণের অভাবে আমরা প্রবীণ সেবাকর্মী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারছি না, এই উদ্যোগ গ্রহণ করাও এখন সময়ের দাবি।   মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) এ  বর্তমানে ১২০ জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রবীণ সেবায় দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি এক একর জমির উপর সরকারি অনুদানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত দূর্দশার ভিতর দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্ত গবেষণা ও তথ্য বলছে আগামীর বাংলাদেশ প্রবীণ নির্ভর বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্সে’ রুপান্তরিত করে প্রবীণ কল্যাণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন করে পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠানটিই হবে বাংলাদেশের প্রবীণকল্যাণে জন্য একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও, প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন-২০১৮ পাশ হয়েছে, ভবিষ্যতে ভিন্ন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে বাইগামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করে প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনটিও এখানে পরিচালনা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।    পরিশেষে বলা যায়, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আমাদের সদিচ্ছা এবং বাস্তবমূখী নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবীণদের বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্যার ব্যাপকতা কমিয়ে আনা অনেকাংশেই সম্ভব। তাই এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে এবং গতিশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সস্তিময় বার্ধক্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তরুনদের প্রবীণ কল্যাণে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে আজকের তরুনই আগামীকালকের প্রবীণ। সকলেরই বার্ধক্য সস্তিময় ও শান্তিময় হোক। আধুনিক বাংলাদেশ নির্মানের রুপকার গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমরা বিশ্বাস করি আপনার হাত দিয়েই বাংলাদেশের সেকেন্ড ক্যাপিটাল খ্যাত আগারগাঁয়ে সরকারী এই ১(এক) একর জমির উপর তৈরি হবে বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’।   লেখক :  বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক/ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী  ওজরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)  
পর্যটনের নতুন যুগে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা: করণীয় ও প্রস্তাবনা
বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী প্রচারের নেপথ্যে কি?
ব্যক্তিগত লোভের আগুনে পুড়েছে বেইলি রোড
বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ : অর্থনীতি সমৃদ্ধে গুরুত্বারোপ
‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ আইন প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের বিশাল সামুদ্রিক এলাকা থেকে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একজন সরকার প্রধানের সময় উপযোগী এই গুরুত্বারোপ দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধে কার্যকারী ভূমিকার পাথেয়।   ‘বাংলাদেশ’ ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে দক্ষিন এশিয়ার তথা বিশ্ব দরবারে রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিতর্কিত সামুদ্রিক এলাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক রায়ের (২০১২ সালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ভারত বিরুদ্ধে) পর, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা দাঁড়ায় প্রায় ১১৮,৮১৩ বর্গ কিমি (মূল ভূখণ্ডের ৮১ শতাংশ পরিমাণ), সাথে আছে ৩৭,০০০ বর্গ কিমি প্রসারিত মহীসোপান যার গড় গভীরতা ৫০ মিটার পর্যন্ত। ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার রয়েছে আমাদের। বাংলাদেশের এই সমুদ্র এলাকাকে মূলত দুটি প্রধান সিস্টেম বা অঞ্চল নিয়ে গঠিত যথা উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সেক্টর। উপকূল থেকে ৫০ মিঃ গভীরতা এবং উপকূলরেখা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ কিমি পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় উপকূলীয় অঞ্চল। অন্যদিকে ৫০ মিঃ এর অধিক গভীর থেকে গভীর সমুদ্র অঞ্চলকে ধরা হয় সামুদ্রিক সেক্টর। বাংলাদেশের উপকূলরেখা বিস্তৃত দক্ষিণ-পূর্বে জীবন্ত প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন পর্যন্ত মোট ৭১০ কিমি।  বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পরিবেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি আশির্বাদপুষ্ট অঞ্চল- এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বৈশিষ্ট্যযুক্ত উচ্চ বৃষ্টিপাত এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ নদী প্রবাহ দ্বারা সৃষ্ট। এই অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর মৎস্য উৎপাদনের সম্ভাবনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলাশয় বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ উত্পাদনশীল বাস্তুতন্ত্রের একটি। বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় রয়েছে জীবিত ও নির্জীব উভয় সম্পদের একটি সমৃদ্ধ রিজার্ভ। জীবিত সম্পদের (প্রাণী এবং উদ্ভিদ) মধ্যে মাছ, চিংড়ি, চিংড়ি, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, মলাস্ক, কচ্ছপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর পাখি, প্লাঙ্কটন ইত্যাদি।  বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, এই সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মাছ (IUCN ২০১৫), ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৬২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস, ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ও ১৫৬ প্রজাতির শৈবাল। নির্জীব সম্পদের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি সমৃদ্ধ বলে মনে করা হয় হাইড্রোকার্বন মজুদ। একটি ব-দ্বীপ হওয়ায় এবং একটি ছিদ্রযুক্ত এবং ভেদযোগ্য হাইড্রোকার্বন বহনযোগ্য বালির কাঠামো এবং ফাঁদের অনন্য অবস্থার কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই একটি প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত।  আমরা শুধু মৎস্য সম্পদের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায়, এই বিশাল প্রজাতির মধ্যে অনেক প্রজাতি এখনও আমাদের আহরণের মধ্যে আসেনি। এমনকি, গভির সমুদ্রে মৎস্য আহরণের সক্ষম উন্নত ভেসেল আমাদের নেই। আমরা জানিনা সত্যিকার আমাদের কত প্রজাতীর মৎস্য সম্পদ আছে, তাদের মজুদ কেমন। আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ এদিক থেকে অনেক আগিয়ে রয়েছে এবং সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার করে তারা তাদের অর্থনীতিতে গুরুতপূর্ন ভুমিকা পালন করছে। পৃথিবীর অনেক দেশ শুধু উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য চাষ করে তাদের মৎস্য উদপাদনে ভুমিকা রাখছে। সে হিসেবে আমাদের উপকূলীয় চিংড়ি চাষ ছাড়া উল্ল্যেখযোগ্য কোন মাছ চাষ নেই। সামুদ্রিক মাছ চাষের কথা বাদই দিলাম।  জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ, যদিও আয়তনে বিশ্বে ৯২ তম। ৬টি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশটির  বর্তমান জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৮৮৯ জন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১৪০ জন)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য মতে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি হিসেবে, মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ হেক্টরে। ২০৪১ সালে যখন জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২১ কোটিতে তখন মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কমে যাবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বিশাল জনসংখ্যার জীবন-জীবিকা নির্বাহের উৎস্য খুঁজতে হবে আমাদের। যদিও আমরা টেকনোলজি অথবা আইটি সেক্টরে আরো এগিয়ে যাব, তারপরও কৃষি নির্ভরতা আমাদের মূল চাবিকাঠি থাকবে বলে মনে করি। তাই ২০৪১ সালের উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে অন্যান্য খাতের সাথে তাল মিলিয়ে গুরুত্ব দিতে হবে সমুদ্র সম্পদ আরোহণ, টেকসই ব্যাবস্থাপনা, সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্যচাষ সহ অন্যান্য কৃষি শিল্পের দিকে। একইসাথে সমুদ্রের অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ যথা তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ আরোহণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আসতে পারে আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি।  সম্প্রতি আরভি মীন সন্ধানী (২০১৭-১৯) আমাদের সমুদ্রের উল্ল্যেখযোগ্য কিছু মাছের মজুদ ও আরোহণের উপর গবেষণা করেছে যদিও সঠিক ও নির্ভূল বৈজ্ঞানিক তথ্য পেতে দীর্ঘ দিনের সার্ভে দরকার। সেখানে দেখা গেছে অনেক প্রজাতির মাছ নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে অধিক ধরা হচ্ছে আবার অনেক প্রজাতি রয়েছে অধরা। আমাদের এই বিস্তৃত উপকূলীয় ও সমুদ্র জলে আমরা নতুন-নতুন প্রজাতি ও পদ্ধতি ব্যাবহার করে মৎস্য উৎপাদনকে বাড়াতে পারি অনেক গুন যেটা আমাদের একদিকে যেমন প্রানীজ আমিষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে অন্যদিকে রপ্তানী করে অর্জিত হবে বৈ্দেশীক মুদ্রা। তেমনি করে আমাদের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ ও উত্তোলনের পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। অদ্যবদি আমরা জানিনা গভীর সমুদ্রে তেল থাকার সত্যিকারের সম্ভাবনা এবং গ্যাস রিজার্ভ কি পরিমাণ আছে কারন এখনও মূল্যায়ন করা হয়নি। সম্প্রতিক সময়ে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যেমন, সাসটেন্যাবল কোস্টাল এ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’ যেটা বঙ্গপোসাগরের বিপুল মৎস্য সম্পদ আহরণে টেকসই মৎস্য মজুদ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা এবং উপকূলীয় প্রান্তিক জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদফতর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়ন করছে। এরই আওতায় আমাদের উপকূলীয় জলাশয়ে নতুন-নতুন প্রজাতির বানিজ্যিক চাষের সক্ষমতা যাচাই হচ্ছে। সাথে-সাথে আমাদের গবেষণার উপর আরো জোর দিতে হবে এবং যেগুলো হচ্ছে তার প্রাপ্ত ফলাফল বা সুপারীশ রাষ্ট্রিয়ভাবে কার্যকারী করার পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণা লব্দ ফলাফল যেন শুধ কাগুজে না হয়। একই সাথে খনিজ সম্পদের মজুদ ও উত্তোলনের জন্য অভিজ্ঞলব্দ জনবল নিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্লু ইকোনমি সেল। এটির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বুকে ও তলদেশে যাবতীয় মৎস্য, জলজ সম্পদ ও তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং এসবের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে এই বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। দেশের সমুদ্রসম্পদ নিয়ে যেসব ইনস্টিটিউট/গবেষণা প্রতিষ্ঠান/বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে তাদেরকে একটা প্লাটফরমে আনতে হবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ আইন প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই বিষয়ের গুরুত্বারোপ একজন রাষ্ট্রনায়কের দূরদর্শীতার পরিচায়ক। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মানে আমাদের সমুদ্রসম্পদ ব্যাবহারের সক্ষমতার উপর অনেকটা নির্ভর করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আশা করি বর্তমানে গৃহীত পদক্ষেপের সাথে আরো কার্যকারী পদক্ষেপ ও বিদেশী বিনিয়োগের সমন্বয় ঘটাতে পারলে এই বিশাল সমুদ্রসম্পদ আমাদের অর্থনীতির অন্যতম পিলার হবে।      লেখক : ফিশারীজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর
একুশ বলে দেয় বর্ণমালার কথা
অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, প, ত, এ, ভ, ম শ- এই অক্ষরগুলোই আমাদের প্রাণ, জয়ের গান, বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দিতে যার ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের ভাষা কথাটির পেছনে অনেক রক্তঝরা শহীদের স্মৃতি বিজড়িত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সফিক, সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের মতো বাঙালির রক্তের বিনিময়ে আজ এ দিনটিকে আরও বেশি স্মরণীয় করে রেখেছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। যেমনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষও আজকের এই দিনে সম্মান জানাবে আমাদের এই ভাষা শহীদদের প্রতি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন শোষণের পর। আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলার মাটিতে এই মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি সেই রক্তঝরা শহীদদের আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানি জান্তারা বরাবরই বাংলার মেধাবীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল মেধাশূন্য করে উর্দু ভাষাকে পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব; বাংলা মায়ের সন্তানরা এতটা দেশপ্রেমী যেখানে যে কোনো পরাশক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি কালজয়ী সাক্ষী হয়ে আছে আজকের এই বাংলাদেশ। যেই দেশটিতে আজ সবাই মুক্ত মনে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে।  এই বাংলা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় আজ আমরা অনেক কিছুতে বিশ্ব দরবারে জানান দিতে পারছি মেধা বিকাশের মাধ্যমে। যেখানে আজ পৃথিবীর মানচিত্রে সিয়েরালিওন নামক রাষ্ট্রটি পর্যন্ত আজ আমাদের মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ঐতিহাসিক গানটি পরিবেশন করে। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা কিংবা পর্যালোচনার ইতিহাস সবারই জানা। তারপরও এই মাতৃভাষার ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করে রাখতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পুনরায় প্রকাশ করতে হলো এই প্রজন্মের কাছে। কারণ নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি দেশপ্রেমী চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে ইতিহাসকে স্মরণ করে। উৎখাত করতে হবে ১৯৫২, ১৯৭১’র সেই পাকিস্তানি অপশক্তিকে, যারা এখনো এই দেশের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের দোহাই দিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রগতিশীল ও সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তাই প্রায় ১৭ কোটি বাঙালি সজাগ থাকবে অপশক্তিকে প্রতিরোধ ও পরিহার করে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই স্মরণীয় দিনটিকে মনে রেখে। বাংলাদেশকে সঠিক গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে পৌঁছে দিতে এবং সরকারের পাশাপাশি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবারও সৃষ্টি করতে হবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সফলতার পটভূমি। ভাষার লড়াইয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা:- ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ওই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়- যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন।  পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালোভী, ঔদ্ধত্য শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। তাদের প্রথম টার্গেট ছিল কিভাবে কেড়ে নেবে এই বাংলা মায়ের মুখের ভাষা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। প্রখ্যাত লেখক ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন’ নামক বইয়ের ১৭০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষির আনুপাতিক হার পরিলক্ষিত হয়। যেখানে বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল ৫৪.৬ শতাংশ, পাঞ্জাবি- ২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দু-৬%, সিন্ধি-৪.৮% এবং ইংরেজি ভাষার আনুপাতিক হার ছিল ১.৪। তাহলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাভাষার আনুপাতিক হার ছিল সবচেয়ে বেশি। আর মাত্র শতকরা ৬ শতাংশ ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।  ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় একই ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারি ঢাকাতে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে ওই দিনই এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আর এই কমিটির মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ২১ ফেব্রুয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তখনকার গভর্নর নূরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল অগ্রসর হয় এবং কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসে ঠিক তখনি পুলিশ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে মিছিল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয় এবং রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র শহীদ হন। সরকারের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ছাত্রদের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথে নেমে আসেন এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।  ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের আপামর ছাত্রসমাজ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যে মাতৃভাষা অর্জিত হয়েছে তার গণ্ডি তখন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। ভাষার জন্য বাঙালি জাতির এ আত্মত্যাগ আজ নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এই মাসটিকে আর স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং সরকারিভাবে বাংলাভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করা হয় এই মহান চেতনাকে কেন্দ্র করে। আজ আমরা হাসি-আনন্দ, দুঃখ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করি মায়ের ভাষায়। তাই ভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের বিনিময়ে অকাতরে জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাভাষার মর্যাদা- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভুলিতে পারি।’ লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
জাতিসংঘের এই উদ্বেগ কতটা নৈতিক?
বাংলাদেশ নিয়ে আবারও উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ। এবারের ইস্যু ড. ইউনূস। জাতিসংঘের অফিসে মহাসচিব আন্থোনিও গুতেরেসের হয়ে তার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক তাদের নিয়মিত প্রেসব্রিফিংএ জনিয়েছেন এই উদ্বেগ। তিনি বলেন, ইউনূস জাতিসংঘের অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা চরম উদ্বেগের। এর একদিন আগে ঢাকায় ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমসহ আটটি প্রতিষ্ঠান দখল হওয়ার দাবি করে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, আমাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল হয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এখন নিজেদের মতো করে এসব প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে তালা মেরে রেখেছে। নিজের বাড়িতে অন্য কেউ যদি তালা মারে, তখন কেমন লাগবে? দেশে আইন–আদালত আছে কিসের জন্য? ঢাকার এই সংবাদে সম্মেলনে সূত্র ধরে জাতিসংঘের নিয়মিত প্রস ব্রিফিংএ প্রশ্ন করেন, সরকারের বিপক্ষে বিদেশিদের উস্কানোর সেই পরিচিত মুখ মুশফিক ফজল আনসারি। তিনি বলেন, সরকার সব গ্রামীণ কার্যালয় দখল করে নিয়েছে। ইউনূসের বিরুদ্ধে নতুন করে আরেকটি মামলা দায়ের করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। তার এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব কী অবগত রয়েছেন? জবাবে গুতেরেসের মুখপাত্র ডুজারিক বলেন, তারা সব জানেন। জাতিসংঘের কাছে খুব মর্যাদাবান ব্যক্তি ইউনূস। তিনি জাতিসংঘের অনেক কাজ করে দেন। তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে তারা চরমভাবে উদ্বিগ্ন।  এখন আমরা দেখে নিতে পারি, ঠিক কোন বিষয়ের ওপর কেন জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন। এর জন্যে আমাদের ভিভিন্ন সময়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত দেখতে হবে। যে অভিযোগ ইউনূস সাহেব করছেন এর গোড়ায় কী ছিল? ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক গঠন করা হয়েছিল। এসময় গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের পরিশোধিত মূলধন শূন্য ছিল । অর্থাৎ এর মূলধন ছিল পুরোটাই সরকারের। সেসময় আইনে গ্রামীণ ব্যাংককে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান করার কোনো এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। তাই আজ যে প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো তৈরির সময়ই আইন ভাঙা হয়েছিল।   প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ শক্তি, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন; গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংক অনুসন্ধান কমিটির ২০১২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মোট ৪০ টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থায়নে মোট ৫৪ টি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বলছে দেশের গণমাধ্যমগুলো। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকই পরিচালনা করছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকরাই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক ছিলেন। তবে সম্প্রতি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকায় এবং ব্যাংকে ইউনূসপন্থী পরিচালকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন ম্যানেজমেন্ট তার আওতাভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজমেন্টেও পরিবর্তন এনেছে।  ১৯৮৩ সালের আইন মেনে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে যে পরিবর্তন এনেছে এটিকেই দখল বলছেন ইউনূস সাহেব। তার দাবি এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ বিদেশি কোম্পানি টেলিনরের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের শেয়ার বিতর্কের সময় তিনি নিজেই বলেছিলেন, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণমাধ্যমে বহুবার এসব বক্তব্য ছাপা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের বেতন ভাতা নিয়ে চলমান মামলায় আদালতে উত্থাপিত নথি থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইটেও একই তথ্য দেখা যায়। ২০০৬ সালে অ্যাশডেন পুরস্কার বিজয়ের সময় গ্রামীণ শক্তি অ্যাশডেনকে নিজেদের যে পরিচিতি দেয়, তাতে বলা হয়েছে, এ্ই প্রতিষ্ঠানটি সহজে গ্রামের মানুষের কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পৌঁছে দেয়ার জন্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আর এখনকার সুর ভিন্ন। ইউনূসের আরও নানা কৌশল এরই মধ্যে গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে। একেক কৌশল একেক কারণে করেছেন তিনি। এর কোনটি ব্যবহার করেছেন কর ফাঁকি দিতে। কোনটা করেছেন কর্মচারিদের ন্যায্য পাওনা না দেয়ার জন্যে, আবার কোন টা বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক বাাড়াতে। এমনকী তাঁর মিথ্যাচার আদালতের বাইরে মিটমাট করার তথ্য প্রামাণিত হয়েছে। এরইমধ্যে পুরো বিষয়গুলোই প্রকাশ্য ।  এত সব জানা তথ্য সাবার সামনে। অথচ জাতিসংঘেষের সংবাদ সম্মেলনে ডুজারিককে কেউ জিজ্ঞাসা করলো না, ইউনূস সম্পর্কে আনসারি যেটা বললো, এর বাইরে কোন সত্য আছে কী না? জাতিসংঘের জন্যে কেউ কোন কাজ করলে, তার জন্যে যেকোন অপরধ করা বৈধ কী না? কোন ঘটনার আদ্যপান্ত না জেনে একটি স্বাধীন দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করা কূটনৈতিক সভ্যতার মধ্যে পড়ে কী না? এমন কী জাতীসংঘ কী এনিয়ে কোন তদন্ত করেছে কী না? ইউনূসের ঢাকার সংবাদ সম্মেলন আর জাতিসংঘের সংবাদ সম্মেলন এক সূত্রে গাঁথা কী না?  এরইমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক এবং সরকার আলাদাভাবে এই দুই সংবাদ সম্মেলনের জবাব দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, ইউনূসের নামে যে মামলা হয়েছে, এতে তাদের কোন হাত নেই। বিষয়ের পুরোটা এনবিআর, দুদক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের এখতিয়ার। গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও সাংবাদিকদের তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতিসংঘ কথা বলেছে বিচারধীন একটি বিষয় নিয়ে। যেখানে পরিস্কার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। আমার প্রশ্ন, জাতিসংঘের মত একটি আন্তর্জাতিক সার্বজনিন সংগঠনের এরকম পক্ষপাতদুষ্ট উদ্বেগ কতটা নৈতিক?       ইউনূস সাহেবের বর্তমান তৎপরতা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। তিনি দীর্ঘদিন নিজেই একটি পক্ষ। তার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনেও তার সঙ্গে ছিলেন সরকারবিরোধী সুশীল আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। যিনি সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে জেলে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যাকে কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্ত থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিনা অনুমতিতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করার। আরও যারা ছিলেন সবাই আগে থেকে সরকার বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত। তারা সরকারের বিরোধিতা করবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকী আনসারি সাহেবের উস্কানীও আমার অস্বাভাবিক মনে হয় না। আমার অস্বাভাবিক লাগে জাতিসংঘের এরকম একপাক্ষিক আচরণ। অসহায় লাগে যখন দেখি লবিস্ট ফার্মগুলো জাতিসংঘের মহাসচিবকেও টলিয়ে দিচ্ছে। লেখক: গণমাধ্যম কর্মী  
সাবধান চোর ভাই, বাজারে আসছে ‘গণধোলাই’
বাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরক্ত। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। না করে উপায় কী? প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় বাজারের যেসব অদ্ভুত চিত্র আসছে, তাতে কারোরই প্রতিক্রিয়াহীন থাকার সুযোগ নেই। আর তিনি তো প্রধানমন্ত্রী। দেশের অভিভাবক। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, দেশের প্রতিটি মানুষ বাজার চিত্র বোঝে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। কারণ, সরকার দাম ঘোষণা করে দিচ্ছে কোন পণ্যের। কিন্তু বাজারে গিয়ে সেই দামের সঙ্গে পণ্যেরে দামের কোন মিল পায় না মানুষ। বিক্রেতার কাছে ক্রেতা হয়তো বলেছে সরকারি দামের কথা। কিন্তু আমি নিজে বিক্রেতাকে বলতে শুনেছি সরকারের কাছে গিয়ে কেনেন প্রতিদিন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার বচসা কখনও কখনও হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এই তথ্য নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়।  আমি দু-একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেন বেশি দামে কিনতে হয়। বেশি দামে বিক্রি না করে উপায় কী? সব পণ্যের দামেরই একই অবস্থা। ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে মাংস পর্যন্ত। অথচ সরকার বলছে, প্রতিটি পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে টাস্ক ফোর্স আছে। যদিও অতীতেও সবসময় এসব ছিল। কিন্ত বাজারের স্বেচ্ছাচার যায়নি। তাই কোন সন্দেহ নেই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির নাম বাজার। খোদ প্রধানমন্ত্রীই এই অস্বস্তির উদাহরণ দেন। বলেন, ‘একবার পেঁয়াজের খুব অভাব দেখা দিল। পরে দেখা গেলো, বস্তার পর বস্তা পচা পেঁয়াজ পানিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এদের কী করা উচিত, আপনারাই বলুন। তাদের গণধোলাই দেওয়া উচিত। পণ্য লুকিয়ে রেখে পঁচিয়ে ফেলে দেবে, আরেক দিক দিয়ে দাম বাড়াবে।’ তিনি নিশ্চয়ই এও জানেন জানেন যে, বাজারে কোন পণ্যের দাম সরকার যদি কমায়, বাজারে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগে অন্তত তিন মাস। আর দাম বাড়ার সময় সরকারের ঘোষণা আসার আগেই দাম বেড়ে যায়। এর জন্যে খুচরা বিক্রেতা দোষ দেন পাইকারি বিক্রেতাকে, আর পাইকারি বিক্রেতা দোষ দেন খুচরা বিক্রেতাকে। আর ক্রেতা দোষ দেন সরকারের। বাজার থেকে বাসায় ফেরেন শাপ-শাপন্ত করতে করতে। আসলে দোষ কার? কৃষক কী অস্বাভাবিক বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে পারেন? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আসলে কৃষকের পণ্য মজুদ করে করে রাখার সুযোগ নেই। কারণ তার ওপর বীজ, সার, পানি বিক্রেতার চাপ থাকে। তিনি ফসল ঘরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কোন কোন কৃষকের ফসল ক্ষেতে থাকতেই কিনে নেয় ফড়িয়া। আসলে মজুদটা হয় ফড়িয়ার ঘরে। বাজার কারসাজি করলে ফড়িয়া করে। মোদ্দা কথা বাজার থেকে পণ্যের উৎপাদকও স্বস্তি পান না, ক্রেতাও স্বস্তি পান না।  উৎপাদক এবং ভোক্তার অস্বস্তির বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে পরিস্কার। তিনি বললেন, “দরকার দাম বাড়ালে ভোক্তার ক্ষতি আর দাম কমালে কৃষকের ক্ষতি” আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সরকারের হাতে থাকলে কারোরই ক্ষতি নয়। কারণ আমজনতার সবাই ক্রেতা অথবা বিক্রেতা। মাছ ব্যবসায়ী মাছ বিক্রি করে সবজির ওয়ালার কাছে যান। সবজি ব্যবসায়ী যান একটু আগে তার দোকান থেকে ঘুরে যাওয়া চাল ব্যবসায়ীর কাছে। সমস্যাটা করে তারা যাদের আম জনতার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। অর্থাৎ যে শ্রেণি উৎপাদকও নয় আবার প্রকৃত ভোক্তাও নয়। কেউ কেউ তাদের বলে মধ্যস্বত্বভোগী।  আমার হিসাবে এদের শুধু মধ্যস্বত্বভোগী বললে দোষী সবাইকে চিহ্নিত করা হবে না। কারণ আমাদের বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগী হওয়াটা দোষের নয়। সৎ ভাবেও মধ্যসত্ব ভোগ করা যেতে পারে। আসলে এই দায়টা যাদের তারা আসলে এক শ্রেণির অসৎ মধ্যসত্বভোগী। যে কারণে এদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু এদের টাকা আছে পেশিশক্তিও আছে। এরাই আসলে কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না কেন? এই সহজ কিন্তু দামী কেনর উত্তর কিছু দিন আগ পর্যন্ত মন্ত্রীরা দিতেন। এখন খোদ প্রধানমন্ত্রী দিচ্ছেন। গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন লেখে। এই লেখায় আমি আর সেই বিস্তারে গেলাম না। মোদ্দা কথা যারাই বাজার অস্থির করুক না কেন , তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। সে সরকারের সঙ্গে থাক বা বিরোধী দলে থাক সেটা তার কৌশল। তার মুল লক্ষ্য বাজার থেকে মুহূর্তেই টাকা তুলে নেয়া।       মুহূর্তেই যারা বাজার থেকে টাকা তুলে নিতে চায়, তারা বাজার অস্থির করার সুযোগ খোঁজে। রোজার মাস তেমনই সময়। প্রতিবছর এই সময় বাজোরের অস্থিরতার চূড়ান্ত হয়। একেবারে প্রকাশ্যে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম নিয়ে কারসাজি হয়। কারও কিছু বলার থাকে না। কারসাজিটা শুরু হয় সরবরাহ দিয়ে। বছরের অন্যান্য সময় টের পাওয়া না গেলেও এই সময়ই বোঝা যায় বাজার অস্থিরতার মূল সূত্র পণ্যের সরবরাহ লাইনে। এই লাইনেই সারা বছর ঘাপটি মেরে বসে থাকে ওই দুর্বৃত্ত মধ্যসত্বভোগী। এখানে আবারও একটি কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে সরবরাহ লাইনের সবাই দুর্বৃত্ত নয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা শক্তিশালী। যে কারণে চাইলেও অনেকে সৎ থাকতে পারেন না। কিছু দিন আগে একজন মাংস বিক্রেতা সরকারি দামে মাংস বিক্রি করতে চেয়ে জীবন দেয়াটা এর উদাহরণ।  গত সংসদের একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলে ফেলেছিলেন সে কথা। এবারও বলা শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রমজান সামনে রেখে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই, বাজারে কারসাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অবৈধভাবে নিত্যপণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে, এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। অবৈধভাবে যারা নিত্যপণ্য মজুত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নিরাপত্তা বাহিনী সেই অনুযায়ী কাজ করছে। আর সব শেষ বললেন প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, রমজানে কোনো জিনিসের অভাব হবে না। সব রকমের ব্যবস্থা করা হয়েছে” বলতে দ্বীধা নেই বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অতীতের যেকোন সময়ের সরকার এখন তৎপর মনে হচ্ছে। সেই নির্বাচনী ইশতেহার থেকে সবখানেই এই তৎপরতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। এখন দরকার ঠিকঠাক মনিটরিং। সেটা যে নেই তাও বলা যাবে না। কিন্তু সেটা ঠিকঠাক হওয়া দরকার। ঠিকঠাক শব্দটি ব্যবহার করলাম কারণ, প্রতিবার বাজার মনিটরিং এর উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রত্যেক বাজারে একটি পণ্যের দাম ঝোলানো বোর্ড রাখা হয়। সপ্তাহ খানেক সজিবও থাকে এই ব্যবস্থা। কিন্তু এর পরপরই সব কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। মনিটরিং এর কাজটি ঠিকঠাক হয় না।  কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এবার বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে। কারণ খোদ প্রধানমন্ত্রী এবার বাজার কারসাজিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গণধোলাই এর কথা বলে তিনি সাধারণ ক্রেতাদেরও সতর্ক হতে বলেছেন। এখন দরকার মানুষের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা। আজকের অনলাইনের যুগে যেকোন মানুষ তার পরিচয় নিশ্চিত করে একটি বাজারের যেকোন অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করতেই পারেন। চাইলে তিনি ছবিও যুক্ত করতে পারেন এই অভিযোগের সঙ্গে। এর পর ঘোষণা অনুযায়ী প্রকাশ্যে শাস্তি শুরু হলে, জানা যাবে কে কেন বাজার অস্থির করতে চায়। সবচয়ে বড় কথা এতে বাজারে স্বস্তি ফিরবে।  লেখক : গণমাধ্যম কর্মী
উপজেলা নির্বাচন / বিএনপি অংশ নেবে, নাকি ষড়যন্ত্রের নতুন জাল বুনবে?
নির্বাচন, হউক সেটা জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ বাঙ্গালী জাতি হিসাবে সবসময়ই অন্যরকম এক আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে।   তন্মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনগুলোতে এই আগ্রহের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়। কেননা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীরা স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে থাকে এবং স্থানীয় জনগণ এদেরকে বেছে নেন।  এই প্রেক্ষাপটে এদেশে উপজেলা নির্বাচনসহ অন্যান্য সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করবে এটা অবশ্যই আশা করি আর বিএনপি তাদের রাজনৈতিক দায় থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি। কারণ প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলই দেশের জনগণের দোহায় দিয়ে রাজনীতি করেন, তাই এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য তো বটেই।  তবে এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভাষ্যমতে বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কতটা সুফল বয়ে আনতে পেরেছেন তা স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপির নেতাকর্মীসহ দেশের অন্যান্য জনগণের নিকটতা খুবই পরিষ্কার।  এমনকি গত ৭ই জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আরও একবার হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছে দলটি। নিশ্চয় এক্ষেত্রে বলবেন বিএনপির ডাকে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যায়নি, বিএনপি নেতৃবৃন্দের তথ্যমতে মোট ভোট পড়েছে শতকরা ৫ ভাগ -তাহলে দেশের ৯৫ ভাগ জনগণ আপনাদের কথা শুনেছে- তাহলে এটাতো বলা যায় যে, বিএনপির উচিত ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর রায় আপনাদের পক্ষে প্রকাশ করার সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিএনপি সেই কাজটুকু করেননি- যা নিছক অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।  আরেকটা অন্যভাবে যদি বলি, দেশের অনেক মানুষ আছে যারা গণতন্ত্রের মতো কঠিন কোন শব্দ ব্যবহারে পারদর্শী না কিন্তু একটা জিনিস বুঝে সেটি হলো সেরা জিনিসটা বেছে নেয়া। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে জনগণের সম্মুখে তাদের নিজ নিজ দলের সেরা ব্যক্তিটিকে মনোনয়ন দিয়ে সেই ব্যক্তিটির নিজের তথা দলের গ্রহণযোগ্যতার যাচাই করা।  একটি কথা দৃঢ়তার সহিত বলতে পারি আজকের এই বাংলাদেশ সর্বদিক থেকেই এক গর্ভের বাংলাদেশ- যার সকল সুবিধা আমরা সবাই ভোগ করছি। তাই আমি মনে করি বিএনপি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কিছু বাক্যাবলীর হিসাব নিকাশের মধ্যে নিমজ্জিত না থেকে স্থানীয় জনগণ এবং কর্মীদের মনোভাবের যথাযথ মূল্যায়ন সাপেক্ষে সামনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।  আমি হলফ করে বলতে পারি স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীরা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারবে না কেননা এই সমস্ত তৃনমূল নেতাকর্মীরা তাদের নিজস্ব এলাকার জনগণের নিকট অনেক বেশী দায়বদ্ধ এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহী।  যার সুস্পষ্ট উদাহরণ গত ৭ই জানুয়ারি নির্বাচন যেখানে বিএনপির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের বাহবা কুড়িয়েছে। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো সংগঠন গোছানো।  বিএনপি মনে করছে যেহেতু এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে না এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে বিএনপির আগ্রহী প্রার্থীদের দল উপেক্ষাও করবে না। এর ফলে তৃণমূলে সংগঠন গোছানোর একটি বড় সুযোগ পাবে। কারণ এমনিতেই গ্রেপ্তার মামলায় বিএনপি এখন বিপর্যস্ত। দলের সাংগঠনিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে।  এমন অবস্থায় নেতাকর্মীরা নির্বাচন করার সুযোগ পেলে তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থা শক্তিশালী হবে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে দলের নেতাকর্মীরা আবার সক্রিয় এবং উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এবার উপজেলা নির্বাচনে না গেলে যে ভুল হবে তা কাটিয়ে ওঠা বিএনপির জন্য কঠিন হবে।  পাশাপাশি, যদি নির্বাচনের পথ পরিহার করে ষড়যন্ত্রের কোন কৌশল করার চেষ্টা করে তাহলে আজকের এই উন্নত বাংলাদেশের রুচিশীল তরুণ সমাজ কোনভাবেই তা গ্রহণ করবে না।  এদেশের জনগণকে কোন রাজনৈতিক দলই বোকা বানাতে পারবে না। কারণ, মানুষ এখন অনেক সচেতন, সময়ের মূল্য দিতে শিখেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখেছে। তাই পূর্বের ন্যায় কোন আগুন-সন্ত্রাস, কিংবা যানবাহন পুড়িয়ে জানমালের ধ্বংস করে সেই জনগণের জন্যই রাজনীতি করার কৌশল আর হালে পানি পাবে না বলেই আমি মনে করি।  পরিশেষে বিএনপি সকল ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দেশে রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়ার লক্ষ্যে দেশে অনুষ্ঠিতব্য সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজ দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং বাংলাদেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি বিকাশে ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।  লেখক : উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।  
নির্বাচন বর্জন সংস্কৃতি বিএনপির জন্য বুমেরাং হবে
গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান হাতিয়ার। কারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তারা জনগণের একেবারে কাছাকাছি যায়, নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করে এবং নেতৃত্ব বিচার করে। শুধু যেসব রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতৃত্ব বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা বদলের চিন্তা করে, তারাই নির্বাচন অপছন্দ করে কিংবা নির্বাচনের ধার ধারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপাতত সেরকম পরিস্থিতি নেই। সহজ করে বললে সেরকম, বিপ্লবী রাজনৈতিক দল নেই, যারা বিপ্লব করে সরকার পরিবর্তন করতে পারবে বা ক্ষমতায় যেতে পারবে।  বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করে ক্ষমতার পালা বদলের চিন্তায় বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সে রকমই একটি রাজনৈতিক দল। যদিও তাদের জন্ম ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। যারা তিন দফায় বেশ কয়েক বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো। তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দলটি প্রথমে ক্ষমতায় বসে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতা দখলের অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছিল। এতে জিয়াউর রহমানের মদদ ছিলো বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে। ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাগ্রহণের পর একাধিক ক্যু হয়। এরমধ্যে ৭ নভেম্বরের ক্যু পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।  জিয়া নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে হ্যাঁ-না ভোট চালু করেন। অর্থাৎ তিনি এটা ভালো ভাবেই বুঝেছিলেন যে, এদেশের মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হলে এবং তাদের মন জয় করতে হলে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনের বিকল্প কিছু নেই। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করলেন, তিনিও একই কায়দায় নির্বাচন ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখলেন। তার বিরুদ্ধে বার বার আন্দোলনের পরও তিনিও নির্বাচনের উপর আস্থা রেখেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় গণঅভ্যুত্থানের মুখে।  ১৯৯০-এর পট পরিবর্তনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। দেশে সূচনা হয় সংসদীয় গণতন্ত্রের। তারপর থেকে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। যদিও বিএনপি ১৯৯৫ সালে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে জনআন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করতে বাধ্য হয়।  ১৯৯৬ সালের ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করে। সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের মেয়াদের শেষ দিকে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার পাঁয়তারা করলে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করলে দেশে এক-এগারো পরিস্থিতির তৈরি হয়। প্রায় আড়াই বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনার পর ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে।   এরপর আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেলে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু হয়। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই। তিনটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। পরে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। একই সঙ্গে তারা নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করতে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। কিন্তু তাদের আন্দোলন আমলে না নিয়েই সরকার সংবিধান অনুযায়ী ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে।   ২০১৮ সালেও একইভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রথমে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন যায়। এই নির্বাচন নিয়েও নানান বিতর্ক আছে। নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি ও তাদের জোট শরিকরা সরকার পতনের আন্দোলন করে। শেষদিকে এসে ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিএনপি দেশজুড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ায়। দলটি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সভা-সমাবেশ করে। এতে করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণ ফিরে আসে। দল চাঙ্গা হতে থাকে। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন দল নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু শেষ দিকে এসে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শক্ত অবস্থান নেয় এবং নির্বাচন বর্জন করে।     নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে এসেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সাহস, শক্তি সবই হারিয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বের একাংশ এখনও বলছে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা। আরেক অংশ এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন সংগঠন টিকিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।  রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে এই অবস্থান ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদলাতে হবে। কারণ দলীয় নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো বিকল্প বিএনপির সামনে থাকবে না। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন হচ্ছে মোক্ষম হাতিয়ার। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব সংকট এবং সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে নাজিল হওয়া নির্বাচন বিরোধী নির্দেশের কারণে বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছে। আর নির্বাচন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে দলের নেতাকর্মীদের হতাশা ক্রমশ বাড়ছে।   বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সর্বশেষ মামলায় জামিন পেয়েছেন বুধবার। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও জামিন পেয়েছেন একই মামলায়। তাদের দুই জনের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ১১ ও ১০টি মামলা ছিলো। এখন সবগুলো মামলায় তারা জামিন পেলেন। তাদের কারামুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকলো না। এতদিন ধরে বিএনপি যে নেতৃত্ব শূন্যতায় ছিলো সেই সংকট দূর হবে বলে ধারণা করা যায়। আগামী উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যদি ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত না নিতে পারে তাহলে তাদেরকে সেই ভুলের খেসারত দিতে হবে।  শেষ করতে চাই পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফলের প্রসঙ্গ দিয়ে। পিটিআই সভাপতি ইমরান খানকে জেলে পুরে, একাধিক মামলায় সাজা দিয়ে সরকার কোণঠাসা করে রেখেছিল। এমনকি পিটিআই এর নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ১০১টি আসনে জয় পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব যদি এখান থেকে কিছু রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে পারে তাহলে তাদের দলের জন্য এবং তাদের অনুসারীদের জন্য ভবিষ্যতে হয়তো ইতিবাচক ফল আসবে। লেখক : সাংবাদিক 
হনুফাদের ভালোবাসার গল্পটা অন্যরকম! 
  ৩৫ বছরের এক মা। নাম হনুফা। গাজীপুরের টঙ্গীতে অন্যের বাসায় কাজ করা হনুফার স্বামী শারীরিক প্রতিবন্ধী। দিবস ছাড়াই মানুষের সহজাত যে ভালোবাসা, তাতেই হনুফার কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে সন্তান। অভাবের সংসারেও ভালোবাসা নামে। আবার সেই অভাবের কাছেই কখনও কখনও হার মেনে যায় ভালোবাসা। পৃথিবীর কোনো ভালোবাসাকেই স্বার্থহীন ভালোবাসা বলা না গেলেও, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা ভিন্ন ব্যাকরণে তৈরি। সেই ভালোবাসাও অভাবের অপঘাতে পরাজিত হওয়ার বয়ান তৈরি করে, যখন হনুফা আর সংসার চালাতে না পেরে ৪৭ দিন বয়সী সন্তানটিকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়!   এমন অনেক হনুফার বিসর্জিত ভালোবাসার পৃথিবীতে বারবার ফিরে আসে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।’ দিবস আসে, দিবস যায়। সব হয়, তবু উদযাপনের আড়ম্বরে আর আয়োজনের ঝলকানিতে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না ওই ভালোবাসাটাই! ভালোবাসা আসলে কী? ‘সখি, ভালোবাসা কারে কয়’ বলে রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই ভালোবাসাকে বিমূর্ত (Abstract) বলে রায় দিয়ে গেছেন! সেটি না দিলেও চলতো। কারণ, ভালোবাসা বিমূর্তই; প্রকৃতির সবচেয়ে সহজাত, সবচেয়ে প্রাণের বিষয়টি হলো ভালোবাসা। এ বোধ হয় একমাত্র ভালোবাসাই যা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, কাউকে বলে দিতে হয় না এই হলো ভালোবাসা! এ হলো ফুলের সৌন্দর্যের মতো; নিজের থেকেই ছড়িয়ে পড়ে তার সৌরভ। ঝর্ণার পানির মতো; আপন পথেই বয়ে যায় অবিরাম! সূত্র নেই, নিয়ম নেই, ব্যাকরণ নেই। এসব নেই বলেই ভালোবাসার নেই কোনো সংজ্ঞাও। ভালো সবকিছুই ভালোবাসা।  কিন্তু আমরা এমন নিবীর মানবিক ভালোবাসাকে বাক্সবন্দী করে ফেলেছি ভোগ আর উদযাপনের আড়ম্বরে। সত্যিকারের ভালোবাসার মাটির উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি কংক্রিটের কৃত্রিম অট্টালিকা। ভালোবাসার বিশাল পরিধিকে সংকীর্ণ করে গড়ে তুলেছি ভোগের চাকচিক্যময় সাম্রাজ্য। ভোগের লালসায় নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে অনুভূতির শেষ বিন্দুও। লাগামহীন পুঁজির বিনিয়োগে ‘পণ্য’ করে ফেলেছি ভালোবাসাকে।  এই মানুষের, এই সময়ের সত্যিকারের পরিচয় কী? উপাসক! আমরা ক্রমান্বয়ে উপাসক হয়ে উঠছি। আমাদের রক্তে, মাংসে, মজ্জায় শুধু উপাসনা। পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রভূ। এই বাংলাদেশের এক একজন মানুষ এক একজন পণ্য-উপাসক। পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রচারমাধ্যম সব একাট্টা হয়ে আমাদের শিরায় শিরায়, আমাদের মননে আর মগজে অবিরাম বয়ান করে চলেছে, আরো চাও, আরো চাও। আমাদের জীবন শেষ হয়, চাওয়া শেষ হয় না। আমরা তো চেয়েছিলাম মুক্তি। শুধু একটি মানচিত্র আর পতাকা চাইনি। আমরা তো চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। শুধু লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করতে চাইনি। আমরা তো চেয়েছিলাম ভালোবাসা। নরম, কোমল, দখিনা হাওয়ার মতো স্নিগ্ধ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। পণ্যের মোড়কে ভোগসর্বস্ব ভালোবাসা নয়। আমরা প্রেমিক হতে চেয়েছিলাম। আমাদেরকে বানানো হয়েছে ভোক্তা।  বিশ্বাস করুন, ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নেই। ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়’, ভালোবাসা দিবসের প্রেম সেই প্রেম নয়। এই প্রেম বোঝে পুঁজি আর ভোগ। নাহলে ভালোবাসার মতো এমন কোমল মানবীয় বিষয়ের উদযাপনে দিবসের প্রয়োজন হবে কেন? এটি পুঁজিবাদের সৃষ্টি এবং দিন শেষে পুঁজির কাছেই এর আত্মসমর্পণ। যত দিবস, তত উদযাপন। উদযাপনের নানা রঙিন আয়োজনে পুঁজির বিনিয়োগ। পণ্য উৎপাদন। অতঃপর সেই পণ্যই হয় আমাদের উদ্দিষ্ট। আস্তে আস্তে আমরা হয়ে পড়ি পণ্যের উপাসক। অবিরাম ভোক্তা। ভোগের এই দুষ্টচক্রে ভালোবাসা তো হারায়ই; সবচেয়ে বেশি হারায় মানবিক বোধ। তার রেশ রয়ে যায় জীবনের সর্বত্র। গড়ে ওঠে বৈষম্যের অমানবীয় এক সমাজ।  মাস্টারকার্ডের ‘কনজ্যুমার পারচেজিং প্রায়োরিটিজ’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, কয়েকবছর আগের ভালোবাসা দিবসে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে উপহার দিতে প্রত্যেকে গড়ে ৬৮০ টাকা (৭১ ডলার) করে ব্যয় করছে।  জরিপে ১৮টি দেশের নয় হাজার ১২৩ জন ব্যক্তি অংশ নেয়, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৪ বছর। এই ৬৮০ টাকার (কোথাও কোথাও টাকার পরিমাণ আরো অনেক বেশি) বিনিয়োগই হলো পুঁজিবাদের মূলমন্ত্র! ভালোবাসা দিবস না থাকলে এই খরচটি হতো না। তাই এটি একটি অহেতুক খরচ। অপ্রয়োজনের খরচ। পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার এই হলো তরিকা। প্রয়োজনের চাহিদা পূরণের ক্ষমতা অর্জনের পর পণ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দরকার অপ্রয়োজনের ‘চাহিদা’ সৃষ্টি। ৬৮০ টাকার উপহার তাই আর ভালোবাসার প্রকাশ নয়; প্রকারন্তরে পুঁজিরই প্রসার। এই পুঁজির হাতেই বর্তমান বিশ্ব নিজেকে সঁপে দিয়েছে। ভোগের বাইরে পৃথিবীর আর কোনো বাস্তবতা নেই।  অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, প্রতিরাতে বিশ্বের ৮০ কোটিও বেশি লোক ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। আমাদের বাংলাদেশেও কত মানুষ এখনো দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারে না। অভাবের তাড়না সইতে না পেরে আত্মহত্যার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটছে এই বঙ্গদেশে।  ফরিদপুরের নগরকান্দায় অর্থকষ্ট সইতে না পেরে পঙ্গু কৃষক শেখ সহিদ আত্মহত্যা করেছে গলায় ফাঁস দিয়ে (দৈনিক যায়যায়দিন, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)। ঋণের কিস্তির টাকা দিতে না পারায় লালমনিরহাটের আদিতমারিতে আত্মহত্যা করেছে খোরশেদ আলম নামের এক কৃষক (যুগান্তর, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭)। এমন আরো অনেক উদাহরণের মাঝেও থেমে নেই আমাদের ভোগ বিলাস। বৈষম্যের পাহাড় রচনা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। ঢাকার কোনো কোনো পাঁচতারকা হোটেলে এক কাচ চায়ের দাম দুইশো টাকার বেশি। অথচ যাদের শ্রমে আর ঘামে চা উৎপাদিত হয়, সেই চা বাগানের একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ৫০ টাকা বাড়াতে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ধর্মঘট করতে হয়! এই ঢাকার শহরে কতো পরিবার আছে যাদের প্রতিদিনের সকালের নাস্তা যায় পাঁচতারকা হোটেল থেকে! অথচ ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার বিলকিস বেগমের কাছে জীবন কত নিষ্ঠুর! অভাবের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাত্র পাঁচ শত টাকার বিনিময়ে দেড় বছরের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এই গর্ভধারিণী মা (যুগান্তর, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭)।  কুড়িগ্রামের রেবি খাতুন তার ২২ দিনের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন। সন্তান বিক্রির টাকা দিয়ে কোনোমতে তুলেছেন একটি ঘর। সাভারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে টাকা দিতে না পারায় দুই রোগীকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে হাসপতালে আটকে রাখা হয়। এদের একজন মানিকগঞ্জের রাজবানু আবার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর ২০১৫)!   মুক্তিযোদ্ধাদেরই বা কী অবস্থা! ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা আজিজুলের হকের দিন কাটে রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে (সকালের খবর, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬)। এমন আরো অনেক উদাহরণে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। যাদের ত্যাগে ও রক্তে এই বাংলাদেশ, সেখানে আজ আদ্যপান্ত ভোগের চাষাবাদ। আমাদের আর কতো হলে আমরা বলব, আর দরকার নেই! পুঁজিবাদের চাতালে নিজেদেরকে ‘পণ্য’ করবার এমন উৎসব কবে বন্ধ হবে? একদিনের ভালোবাসার উদযাপন-খরচ দিয়ে কতো মানুষের চোখের পানি মুছে দেওয়া যায়! চোখের পানি মুছে দেওয়ার ভালোবাসাই তো সত্যিকারের ভালোবাসা। চোখের পানিকে ‘পণ্য’ করতে নেই, ‘পণ্য’ করতে নেই ভালোবাসাকেও।  তথাকথিত এই ভালোবাসা উৎসবকে উপলক্ষ্য করে চারদিকে হুলস্থুল আয়োজন। সংবাদপত্রগুলো ছাপছে বিশেষ ফিচার-খবর, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করছে পাঁচ-সাত দিনব্যাপী ‘বর্ণিল’ অনুষ্ঠানমালা।  বহুজাতিক কোম্পানিগুলো খুলে বসেছে নানা ইভেন্ট। কেউ কেউ মঞ্চস্থ করছে ‘কাছে আসার সাহসী গল্প!’ কাছে আসায় কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যে ‘কাছে আসা’কে এখানে উপজীব্য করা হয়েছে, প্রশ্ন তা নিয়েই। সত্যিকার অর্থে এই ‘কাছে আসা’ হলো প্রবৃত্তি, সহজাত, এর জন্য ‘সাহসের’ প্রয়োজন নেই। সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ করে যে ‘কাছে আসা’ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে সাহসের কিছু নেই; একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত প্রক্রিয়া। বরং ‘কাছে আসার’ সেই গল্পগুলোই হতে পারে সাহসী যেখানে বিরুদ্ধ পরিবেশে কারো কাছে গিয়ে নি:স্বার্থ বলা যায় ‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’ একটি পথশিশুর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাওয়া ‘তুমি দুপুরে খেয়েছ কিনা‘-ই হলো সত্যিকারের ‘কাছে আসা।’ রাস্তা পার হতে না পারা বৃদ্ধকে হাত ধরে পার করিয়ে দেওয়া হলো সত্যিকারের ‘কাছে আসা।’  ঋণের কিস্তির টাকা দিতে না পেরে আত্মহত্যা করা খোরশেদ আলমকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হতে পারত ‘কাছে আসার সাহসী গল্প।’ অভাবের যন্ত্রণা বিলকিস বেগমের কাছ থেকে দেড় বছরের শিশুকে দূরে নিয়ে গেছে। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের যাবতীয় খরচ দিয়ে এরকম অসংখ্য বিলসিক বেগমের অভাব দূর করা যেত। শিশু ফিরে আসত মায়ের কাছে। রচিত হত সত্যিকারের ‘কাছে আসার সাহসী গল্প।’ আধুনিক স্বার্থপর জীবনযাপনের ‘প্রাইভেসি’ রক্ষার নামে বৃদ্ধ বাবা মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে নিজের কাছে রাখার মাধ্যমে ‘কাছে আসার যে গল্প’ নির্মিত হতে পারত, তা-ই হত ভালোবাসার স্বার্থক অনুবাদ। এমন গল্পই আজ বেশি প্রয়োজন। এই ভালোবাসাই মানবিক ভালোবাসা। কাছে আসার সাহসী গল্পগুলো এমনই হোক!   লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক