• ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
logo
ভারতীয় গণমাধ্যমের ‘আকাশ-কুসুম’ অপপ্রচার
বাংলাদেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে: মাহফুজ আনাম
ভারত আর বাংলাদেশ দুই অকৃত্রিম বন্ধুদেশ এ কথা আমরা শুনে আসছি, পড়ে আসছি। কিন্তু সেটা ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত বর্ণনা, ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলা ও দেশটির দায়িত্বশীল নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এ বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের একটি লেখা পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মাহফুজ আনামের লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো- সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদগুলো দেখলে একটি ধারণাই পরিস্ফুটিত হয়, তা হলো—বাংলাদেশ একটি হিন্দুবিদ্বেষী দেশ। যেভাবে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেভাবে আমাদের অবমাননাকর ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় জনগণের মনে আমাদের প্রতি ঘৃণা তৈরির জন্যই এসব প্রচেষ্টা। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এবং একইসঙ্গে, বাংলাদেশেও যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তা দূর করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এটা উভয় দেশেরই ক্ষতি করছে। এখানে আমাদের ক্ষতি—বাংলাদেশের একটি বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে। আর ভারতের ক্ষতি—এ ঘটনায় আবারও প্রমাণ হচ্ছে যে তারা তাদের সব প্রতিবেশীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং কাউকেই নিজেদের নীতি গ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এসব নীতি ভারতের বিপক্ষে নয়, বরং আমাদের নিজের তৈরি পথে এগিয়ে চলার স্বতন্ত্র প্রকাশ। আমার নেপালি সাংবাদিক বন্ধুরা ভারতের মনোভাব ও ব্যবহার নিয়ে যেসব গল্প শোনান, সেগুলো ভারতের জন্য সম্মানজনক নয়। ভুটানের জনগণের মনেও ভারতের ভাবমূর্তি ভালো নয়। ভারতের সর্বশেষ সামরিক উপস্থিতিটুকুও দূর করার জন্য মালদ্বীপ যেভাবে সচেষ্ট, তা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়। শ্রীলঙ্কার নতুন নেতৃত্ব কী আমাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশী দেশটিকে বিশেষ বার্তা দেয়নি? সব মিলিয়ে, ভারত সম্পর্কে প্রতিবেশীদের অভিন্ন মনোভাব কী প্রকাশ পায়নি? তারপরও সমালোচনামূলক মতামতকে গুরুত্বহীন, ভিত্তিহীন বা ঈর্ষা দ্বারা প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, কৃতজ্ঞতাহীন বলে বিবেচনা করা কতটুকু বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তার পরিবর্তে প্রতিবেশীদের আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনুভব করা উচিত। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যম ও নেতাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ছিল অতি উত্তম প্রতিবেশী। তাদের মতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাহলে কী এমন ঘটল যে বাংলাদেশ অতি উত্তম প্রতিবেশীর মর্যাদা থেকে অন্যতম নিন্দিত দেশে পরিণত হলো? তাদের চোখে আমাদের পতনের কারণ হচ্ছেন ৫ আগস্ট আমাদের সরকার পরিবর্তন। অথচ, এটি কোনো ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। কিন্তু ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যম সেটাই ভাবছে। তারা বিষয়টি মানতেই পারছে না যে এই সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মতে প্রতিফলন। তারা বিশ্বাস করে যে, এটি পাকিস্তান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কাজ—বাংলাদেশের জনগণের নয়। যে সত্যটি তারা মেনে নিতে পারছে না সেটা হলো, আমাদের আন্দোলন ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র একটি শক্তিশালী প্রকাশ, যা বহু বছর আগে ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন ঘটানো ‘পিপলস পাওয়ার’ আন্দোলন কিংবা মিশরের হোসনি মুবারককে উৎখাত করা ‘আরব বসন্ত’র চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের প্রতিবেশীর মন ও মননে দাগ কাটতে পারেনি। এ দেশের মানুষ কয়েক সপ্তাহে যা করে দেখিয়েছে তা করতে অন্যদের বছর না হলেও কয়েক মাস লেগেছে। এটাই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তি। ভারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শক্তিমত্তা অনুধাবন করতে পারেনি, কারণ আমাদের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো তারা অবগত নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরুদ্ধে আমাদের শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা জেনারেল আইয়ুবের 'ইস্পাত-কঠিন শাসনামল'র অবসান ঘটিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (১৯৬৬) ও ছাত্রদের ১১ দফাকে (১৯৬৯) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে পরিণত করেছিল। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের পেছনেও ছাত্ররাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল এবং বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে তুলতেও ছাত্র ও কৃষকভিত্তিক যুব সমাজ ছিল অগ্রভাগে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আমাদের ছাত্রদের গৌরবময় ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে। তারা মানবাধিকার ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং স্বৈরাচার, সামরিক শাসন ও সব ধরনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৩৬ জুলাই'য়ে যা কিছু হয়েছে, তা সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা, এমনকি তারচেয়েও বেশি কিছু। এই আন্দোলন অনেক বেশি উদ্দীপনাপূর্ণ, শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে, যা এই আন্দোলনকে করে তুলেছে অনন্য। গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অধিকার যে আমাদের আছে, সেটা ভারত মানতে পারছে না। আমাদের দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়তো প্রচলিত ধারার নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি। বরং এটা ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র বলিষ্ঠ প্রকাশ, যা সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন। যার ফলে আন্দোলনই ছিল একমাত্র পথ। মজার বিষয় হলো, তিনি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে পরাজিত হতেন, তাহলে অন্তত দেশে থেকে যেতে পারতেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার লজ্জার মুখে তাকে পড়তে হতো না। কাজেই সার্বিকভাবে আমাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ভারত প্রথম থেকেই এটা মেনে নেয়নি। উল্টো তারা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' তৈরি করেছে এবং আজ অবধি তারা সেই তত্ত্বই আঁকড়ে ধরে আছে। আমরা সবাই জানি, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান এবং তার সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের তিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে তৈরি হয় শূন্যতা। এ সময় আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হন। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, আক্রান্তদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন এবং তাদের অনেকে পতিত সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন (তার অর্থ এই নয় যে তাদের ওপর হামলা করা ঠিক হয়েছে)। কাজেই এই হামলার ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা বলা সম্পূর্ণভাবে উচিত না, যদিও সেটাই করা হচ্ছে। যদি পুলিশ বাহিনী তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বে থাকত, তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। যাইহোক, প্রথম কয়েক দিনের সেই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় সরকার ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নতুন নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও সঠিক মূল্যায়ন করার পরিবর্তে ভারতীয় গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল প্রতিবেদন প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। ভারতের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমি অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন বাংলাদেশকে 'হাসিনার চোখে না দেখে গণতন্ত্রের চোখে দেখে'। দুঃখজনকভাবে তারা সে কথায় কর্ণপাত না করে একই ধারা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো একে অপরকে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং শেখ হাসিনার পতনকে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরের কাজ বলে আষাঢ়ে গল্প তৈরি করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আন্দোলন হয়তো শিক্ষার্থীরাই শুরু করেছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটাকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। এটা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, যার টোপে আটকে গেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। যখন ভারতীয় গণমাধ্যমে 'হিন্দু হত্যা'র ন্যারেটিভ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সংগঠিত সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট সময়কালের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দুই হাজার ১০টি ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এসব ঘটনায় নয় জন নিহত, চারজন নারীকে ধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ৯১৫টি বাড়ি ও ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ৩৮টি শারীরিক হামলা ও ২১টি সম্পত্তি দখলের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাংলা পত্রিকা প্রথম আলো ৬৪ জেলায় ও ৬৯ উপজেলায় তাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৬৮টি বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনায় হামলার প্রমাণ পায়। এ ছাড়া, ২২টি উপাসনালয়ে হামলার তথ্যও পায়। তাদের প্রতিবেদকরা এসব স্থানের মধ্যে ৫৪৬টিতে (৫১ শতাংশ) সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং বাকিগুলোর পরিস্থিতিও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে যাচাই করে। এসব ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন—একজন বাগেরহাটের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণাল কান্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অপরজন খুলনার পাইকগাছার স্বপন কুমার বিশ্বাস। সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা কি ভারতেরও বাস্তবতা নয়? গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলিম ও ২৫৪ জন হিন্দু নিহত হয়েছিলেন, হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন। এই তথ্য খোদ ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে ৩১টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০টি ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। ভারতীয় গণমাধ্যম এখন যা করছে, তখন কি বাংলাদেশি গণমাধ্যম তেমন কিছু করেছিল? সাম্প্রতিক যেসব ঘটনার কারণে ভারতে বিক্ষোভকারীদের হাতে বাংলাদেশি পতাকা এবং আমাদের দেশে কয়েকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাতে ভারতের পতাকার অবমাননা হয়েছে; চট্টগ্রামে এক মুসলিম আইনজীবী ও ঢাকায় একজন হিন্দু চিকিৎসক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে সাবেক ইসকন নেতা গ্রেপ্তারের ঘটনা। আগরতলায় আমাদের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি নিন্দনীয় এবং এটি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল, প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। অপরদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য তাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক এবং এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এবং সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হয়ে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা এই পরিস্থিতিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যুদ্ধংদেহী ভারতীয় গণমাধ্যম সেগুলোকে যেভাবে প্রচার করেছে, তা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। কিন্তু আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে হতবাক করেছে তা হলো, তারা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের আগে তথ্যগুলো যাচাই করেনি। অথচ, এগুলো সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব। অনেক সাক্ষাৎকার ও টকশোতে অন্য কোনো অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ফুটেজ দেখিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি আরটি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে শিব মূর্তি ভাঙার একটি ফুটেজ দেখানো হয়। সেখানে দাবি করা হয়, ভিডিওটি বাংলাদেশ থেকে ধারণ করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি ভারতের বর্ধমানের সুলতানপুরের একটি মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফুটেজ। আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরলেও আরটি ইন্ডিয়া দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরে থাক, ভুল প্রতিবেদনটি সংশোধনও করেনি। এ ধরনের ঘটনা কমতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমের উত্তপ্ত ভাষাও হয়তো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে আসবে এবং নৈতিক মূল্যবোধের জায়গায় ফিরবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের সৃষ্টি করা এই বিকৃত বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদে বেদনাদায়ক অনুভূতি রেখে যাবে। অহংকারী ও যেকোনো মূল্যে বাড়তি ক্লিক পাওয়ার মানসিকতার কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম হয়তো এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করবে না, কিন্তু পেশাদার কূটনীতিকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
এ সমাজে পুরুষ কোথায়?
এক মহাজীবনের সান্নিধ্যে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত
রক্ষক যখন ভক্ষক 
ত্রিমুখী সমস্যায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, শান্তির অন্বেষায় প্রয়োজন কঠোর সিদ্ধান্ত
পুঁজিবাজারের চলমান অস্থিরতা এবং কিছু প্রস্তাবনা
দেশের পুঁজিবাজারে তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। নব্বই দশকের পর থেকে কিছু ব্যক্তি ও স্বার্থান্বেষী মহল পুঁজিবাজারকে জুয়ার বাজার বানিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা এই  অর্থলোভী ব্যক্তিস্বার্থের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছি। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্বিগ্ন।  পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর মেয়াদে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মত পুঁজিবাজারেও অবাধ লুটতরাজ হয়েছে। এ সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে যোগসাজশ করে অসংখ্য দুর্বল ও প্রায় দেউলিয়া কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ক্রমেই এসব কোম্পানির আসল চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যদিকে এই বাজারে লাগামহীন কারসাজির মাধ্যমে দুর্বল, জাঙ্ক কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক উচ্চমূল্যের শেয়ারে আটকে আছে অসংখ্য বিনিয়োগকারীর মূলধন।  ২০১০ সালে বড় ধসের পর থেকেই পুঁজিবাজার ধুঁকছিল। সদ্যবিদায়ী শিবলী কমিশনের মেয়াদে এসে তা আরও নাজুক অবস্থায় পড়ে। শিবলী কমিশন ফ্লোরপ্রাইস আরোপসহ নানান কৃত্রিম ব্যবস্থায় বাজারের এ অবস্থা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন ওই কৃত্রিম চেষ্টা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি, কারসাজির অনিবার্য পরিণতি এখন আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।  পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি মার্কেট ভালো করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তৎপর রয়েছে চক্রান্তকারীরা। সালমান এফ রহমান ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সিন্ডিকেট এখনো বাজারে সক্রিয়। এরা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং নিজেদের হীন গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্য হিসেবেই পুঁজিবাজারকে নানাভাবে অস্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে কলকাঠি নাড়ছেন সিআরও খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। এই খায়রুল বাশার হলেন শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মূলহোতা সালমান এফ রহমানের অন্যতম সহযোগী। খায়রুল বাশারের অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন ডিএসইর আবু তাহের, বজলুর রহমান, জাকির হোসেন, ইকরাম হোসেন, আফজালুর রহমানসহ কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।  এরই মধ্যে তাদের উৎখাতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, এইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ডিএসইতে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। তারা যতদিন ডিএসইতে থাকবেন, ততদিন বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুঁজিবাজারে বর্তমান যেসব কোম্পানি আছে তার মধ্যে কতগুলো পুঁজিবাজার বান্ধব? যদি বিশ্লেষণ করি এর ভিতর শতকার ৯৭ শতাংশ কোম্পানি তাদের  অধিক পরিমাণ ব্যাংক লোন শোধ করার জন্য পুঁজিবাজারের দারস্থ হয়ে অতিরঞ্জিত ব্যবসার মুনাফা কাগজে কলমে দেখিয়ে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, অধীনস্ত কমকর্তা, ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বোর্ড, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থ বিনিময় কমিশনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে এসেছে। এইসব কোম্পানি বাজার থেকে শুধু শেয়ার বিক্রিমূল্যে নয় বরং এরা শেয়ারকে কারসাজি করে গেম্বলিং করে অধিক মুনাফা নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে শেয়ার গছিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।  বিগত সরকারের খাইরুল-শিবলী কমিশনের  আমলে ১৩০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে। এগুলোর সক্ষমতা যাচাই করলে দেখা যাবে পুঁজিবাজারে আসার যোগ্যতাই নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক  ক্ষমতা, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের অসাধু চেয়ারম্যান, কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, কমকর্তা এবং ইস্যু ম্যানেজারের অনৈতিক প্রভাবেই এই কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে পেরেছে। এদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।  পুঁজিবাজারে অস্থিরতা রোধে কিছু প্রস্তাবনা সবার প্রথমে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে কেন বিনিয়োগ করবে, যেখানে ব্যাংকগুলো বছরে ১২ শতাংশ সুদ দেয়। সেখানে পুঁজি হারাবার জন্য বাজারে মাফিয়াদের প্রলোভনে গুজবে অতি লাভের আশায় কেনো বিনিয়োগ করবে? ১. কোম্পানিগুলোকে বছরে নগদ লভ্যাংশ ২০ শতাংশ দিতে হবে। ২. বিগত সরকারের আমলে খাইরুল-শিবলি রুবাইয়েতের আমলে ১৩০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আইন বহির্ভূত আসছে তাদের সব খতিয়ে দেখতে হবে। এই কোম্পানিগুলো আনার জন্য যে সকল সংস্থা এবং ইস্যু ম্যানেজার কাজ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই বাজে কোম্পানির শেয়ারগুলো কোম্পানির মালিক এবং ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানিগুলোকে বর্তমান দামে কিনে নিতে হবে।  ৩. সকল ব্রোকারেজ লোন বন্ধ করতে হবে, শুধু মার্চেন্ট ব্যাংক লোন দিতে পারবে নিজ দায়িত্বে। কোনো ব্যক্তিকে নয়, শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক লোন দেওয়া হবে নিজ দায়িত্বে। সাধারণ বিনিয়গকারীদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে শেয়ার কেনা বন্ধ করতে হবে। ৪. কোম্পানি তালিকা নীতিমালা এবং মানদণ্ড কঠোরভাবে মনিটর করা উচিত। প্রয়োজন হলে, পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন নিয়ম ও বিধিমালা বাস্তবায়ন করা উচিত। ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা একটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ পেতে পারে। কাগজে-কলমে লাভ দেখিয়ে বাজে কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা যাবে না।  ৫. শেয়ার গ্রুপের শ্রেণিবিভাগ পুনঃসংশোধন করা উচিত। A, B, G, N এবং Z গ্রুপের পরিবর্তে একটি ঐক্যবদ্ধ ফরম্যাট থাকা উচিত। যখন একটি কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তখন শেয়ারটিকে Z গ্রুপে রাখা আসলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে; বরং আমাদের উচিত কোম্পানিটি কেন লভ্যাংশ বিতরণে ব্যর্থ হলো, তা নিয়ে তদন্ত করতে হবে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে যেকোনো ধরনের আর্থিক অপব্যবহারের জন্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। পুঁজিবাজারের টাকা দিয়ে কোম্পানির বোর্ডের পরিচালকরা কোনো অপচয় করতে পারবে না। যেমন, কোম্পানির পক্ষ থেকে গাড়ি কেনা, পরিচালকের জন্য ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমনের টাকা। ৬. যখন একটি কোম্পানি পাবলিক হতে চায়, তখন কমপক্ষে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কাছে ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে এবং বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার প্রাথমিক পাবলিক অফারের (IPO) জন্য অনুমোদিত হওয়া উচিত। এইভাবে কোম্পানির প্রতি জবাবদিহি এবং দায়িত্ব আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যদি পাবলিক শেয়ার দিয়ে কোম্পানির বোর্ডের ডিরেক্টরের থেকে বেশি শেয়ার হয়ে থাকে তাহলে পাবলিক শেয়ার দিয়ে ওই বিনিয়োগকারী বোর্ড পরিচালনা করার জন্য যোগ্য হবে, এতে করে কোম্পানির মালিকদের শেয়ার বিক্রির ঝুকি কম থাকবে। ২ শতাংশ থেকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার হলে বোডে থাকতে হবে এই আইন প্রয়োগ করতে হবে, যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা কোম্পানি পরিচালনা করা প্রয়োজন, কোম্পানি গুলোকে পারিবারিক সম্পদ থেকে বিরত রাখাই উত্তম। বিনিয়োগকারীদের মধ্য থেকে যে কেউ অধিক শেয়ার কিনে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারবে এই আইন করতে হবে। মোদ্দাকথা কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য যোগ্য প্রতিনিধির প্রতিযোগিতা থাকা উচিত।  ৭. একটি উদীয়মান বাজার এবং আমাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তাই মূলধন লাভ কর প্রয়োগ করা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বোঝা হতে পারে। বাজার একটি নির্দিষ্ট উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোর পর আমরা সেই মূলধন লাভ কর প্রয়োগ করতে পারি। কর কোম্পানির মাধ্যমেই প্রদান করা হবে, সাধারণ বিনিয়োগকারী কেনো কোম্পানির লভ্যাংশের কর প্রদান করবে। কর কোম্পানি লভ্যাংশের উপর এককভাবে প্রদান করার যদি সেই কর সাধারন বিনিয়োগ কারিদের উপর ও অব্যাহত থাকে তাহলে কর ২-৩ বার আদায় করা হয়, এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ৮. প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদের হার কম খরচের তহবিল ব্যবস্থা করা উচিত (ডিলার কোড)। এটি পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াবে। ৯. সাধারণ জনগণকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে সচেতন করতে বিপণন উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের পুঁজিবাজারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে প্রচলিত বিনিয়োগ কৌশলের তুলনায় বেশি লাভ করতে পারে। আমাদের মোট জনসংখ্যার সাথে তুলনা করলে বিও অ্যাকাউন্টের (BO) সংখ্যা খুবই কম, তাই শেয়ারবাজারের সঠিক ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। ১০. সম্প্রতি আমাদের পুঁজিবাজারে পতন দেখা গেছে। তাই পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার জন্য, নেগেটিভ ইকুইটি অ্যাডজাস্টমেন্ট আরও বাড়ানো যেতে পারে। ব্রোকারেজ হাউজ কোনো লোন দিতে পারবে না পাবলিক বিও একাউন্ট হোল্ডারদের। লোন শুধু মাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পাবে মাচেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে এবং মাচেন্ট ব্যাংক এই লোনে সকল দায়িত্ব নিবে নিজ দায়িত্বে কোনো ওজর আপত্তি করতে পারবে না রেগুলেটরি কমিশনের কাছে, মোদ্দাকথা মাচেন্ট ব্যাংক নিজ দায়িত্বে লোন দিবে প্রতিষ্ঠানকে যদি ক্ষতি হয় উভয় মিলে সমস্যার সমাধান করবে, মারকেটে শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি করে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। প্রতিষ্ঠান এবং মাচেন্ট ব্যাংক উভয় মিলে লোনের সমস্যা সমাধান করবে এর জন্য সাধারণ বিনিয়োগ কারির উপর গুজব ছড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে পালিয়ে যেতে পারবে না। ১১. বাই ব্যাক আইন পরিবর্তন হতে হবে। কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম যদি পড়ে যায় ,বাংলাদেশের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুসারে কোম্পানি এমপ্লোই প্রভিডেন্ড ফান্ড দিয়ে শেয়ার  ক্রয় করে এমপ্লোইদের মাধ্যমে বিতরণ করতে পারে। যা খুবই দুর্বল আইন ,আইন হওয়া উচিত কোম্পানিকে সকল পাবলিক শেয়ার মালিক পক্ষের কিনে নিতে হবে বাজার মুল্যে। লেখক: পুজিবাজার বিশ্লেষক এবং বিনিয়োগকারী আরটিভি/ ডিসিএনই    
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জালে আসক্ত হয়ে পড়ছেন না তো?
শৈশব প্রতিটি শিশুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আনন্দময় শৈশব অত্যন্ত জরুরী। আর আনন্দময় শৈশবের জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ, সামাজিক কাঠামো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পারিবারিক সহাবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে শৈশব সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটা দেশে শিশুর শৈশব আজ নানা কারণে বিপন্ন। সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন শিশু তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছে। বিপন্ন শৈশবের কারণে শিশুরা অল্প বয়সে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের আচরণে বিচ্যুতির প্রভাব লক্ষণীয়। বিপন্ন শৈশবের জন্য প্রধানত দায়ী প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার। প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে শিশুর শৈশব এবং সৃজনশীলতা, তাকে করেছে চার দেয়ালে বন্দি। ১৯২০ সালে টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, মোশন পিকচার আসার কারণে টেক্সট বই উঠে যাবে, সবাই মোশন পিকচারের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত পেয়ে যাবে। আজ ১০০ বছর পর এসে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে টমাস আলভা এডিসনের কথার প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ২০১৯ সালের করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী সকল শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। টেলিভিশন, রেডিও-র পরিবর্তে এখন মানুষের নজর বেশি থাকে ফেসবুক, টিকটক, গুগল, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, স্যাম্পচ্যাট, ভাইবার, উইচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ-এর উপর। বর্তমান বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়া যোগাযোগ ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হলেও দেশের যুব সমাজের কাছে এর আবেদন সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২০ জন ছাত্রছাত্রীদের উপর পরিচালিত একটা জরিপে দেখা যায়, কোভিড-১৯ কারণে যুব সমাজের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যার মধ্যে ৪০% শিক্ষার্থী ফেসবুক বা টিকটকের উপর আসক্ত। বিশ্বজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একটা বড় অংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর বাংলাদেশে এই হার আরও বেশি। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ১ জন করে ফেসবুক ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছে যা দেশের জন্মহারের চেয়ে বেশি। এই একটা তথ্য বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় দেশের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ার উপর কতটা আসক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি আশ্চর্যেও বিষয় হলো সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশে^ দশম। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্রছাত্রী এবং বয়স ১১ থেকে ৩০ বছর। অন্য একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী দিনে প্রায় ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সময় মোবাইল স্ক্রিনে সময় ব্যয় করে এবং প্রয়োজন ব্যতিরেকে ১৮৫ বার তার মুঠোফোন লগইন করে। হয়তোবা এইজন্যই প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ”ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়”। সংক্রামক ব্যাধির মতোই আজ অপসংস্কৃতি আর অসামাজিক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়াল জুড়ে। প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়ার ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক টোবিয়াস ডিয়েনলিন বলেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু দিন শেষে আপনার জীবনে তার প্রভাব কতটা সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ না এটি আপনার জীবনে সমস্যা তৈরি না করবে, ততক্ষণ আপনি বুঝতে পারবেন না যে, আপনি আসক্ত হয়ে পড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জালে।  কিন্তু শিশুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির জন্য শুধু কি তারা নিজেরাই দায়ী, না কি অভিভাবক, পারিবারিক কাঠামো, প্রযুক্তির সহজলভ্যতাও সমভাবে দায়ী। এর পাশাপাশি আর যে বিষয়টা দায়ী তা হলো পুশ ফ্যাক্টর এবং পুল ফ্যাক্টর। যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আকর্ষণীয় ফিচার আমাদের আকৃষ্ট করে তখন তা পুল ফ্যাক্টর। আর পারিপার্শ্বিক ঘটনা প্রবাহ যখন আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে উৎসাহিত করে তখন সেটা পুশ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া অত্যধিক জনপ্রিয় হবার কারণ হলো পুশ ফ্যাক্টর। কোভিড-১৯ কারণে বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। ঐ সময় ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য অনলাইন ভিত্তিক পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করে। ফলশ্রুতিতে অভিভাবকরা সন্তানদের স্মার্ট ফোন দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা বাধ্য হয়ে গেল। ছাত্রছাত্রীদের স্মার্ট ফোন কী শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? ছাত্রছাত্রীরা একাডেমিক ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রধান বাহন হিসেবে মোবাইল ফোনের উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। এক সময় সেই নির্ভরশীলতা আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মোল্লা ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে উঠে এসেছে, কোভিড-১৯ কালীন সময় দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হয়েছেন কিংবা এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আমাদের সমাজে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউ-এর সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিকুল আলম বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার ব্যক্তি জীবনের উদ্বেগ, পারিবারিক জীবনে অশান্তি, বিষণ্ণতার জন্য দায়ী। তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে কিশোর-কিশোরীর শারীরিকের চেয়ে মানসিক ক্ষতি বেশি হয়। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, যে সকল কিশোর-কিশোরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে, তাদের ঘুমের মান অনেক খারাপ, একাগ্রতা হ্রাস এবং পরবর্তীতে একাডেমিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া ও তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। অন্য আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি শিশু মোবাইল ফোনে ২ মিনিট কথা বললে তার মস্তিষ্কে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে ৯০ মিনিট সময় লাগে।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, এখানে কোনো ব্যবহারকারী স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেই মতামত অন্যের ক্ষতি হতে পারে তা আমাদের শিশুদের বোধগম্য নয়। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ইউনিসেফ-এর গবেষণায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০-১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদে রয়েছে।” বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা” শিরোনামে ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত অপর একটি সমীক্ষায় দেশের স্কুল, কলেজ মাদ্রাসার ১২৮১ জন শিক্ষার্থীদের উপর জরিপ পরিচালনা করে যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে শারীরিক অথবা মানসিক হেনস্তার কথা শিকার করেছে। যাদের মধ্যে ১০ শতাংশ শিশু কিশোর ধর্মীয় উস্কানির কথাও বলেছেন। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছরের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে। এছাড়া শিশুদের একটা অংশ যা প্রায় ৬৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের জায়গা হিসেবে নিজেদের কক্ষকে ব্যবহার কওে, যা ”বেডরুম কালচার” এর ব্যাপকতা নির্দেশ করে।  সম্প্রতি চীনের গবেষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেছেন। চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর ১৬৭ জন শিক্ষার্থীদের উপর ঐ জরিপ পরিচালিত হয়। তারা দাবি করেছেন যারা একটানা ৩ দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ রাখেন তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। গবেষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন- পরিবারকে সময় দেয়া, কাজের সময় মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা, বই পড়ার অভ্যাস করা, ডায়েরি লেখা। প্রযুক্তি জায়ান্ট ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস-এর মতো আমরাও আমাদের সন্তানদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট হবো। লেখক: ব্যাংকার ও সমাজকর্মী। আরটিভি/এসএপি
কীভাবে আ.লীগ আমলের পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধার করতে পারে বাংলাদেশ?
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সম্পদ জব্দ করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অন্যসব দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়, তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তা চাইতে বাধ্য হয়। একই সময় যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস বাংলাদেশি ঘড়ি সংগ্রহকারী আহমেদ রহমানকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আহমেদ রহমান হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ভাগনে। বর্তমানে সালমান এফ রহমান কারাগারে রয়েছেন। দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দামি ঘড়ি ছাড়াও আহমেদের পরিবার যুক্তরাজ্যে কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তির মালিক। এর আগে আরেকটি নিউজ সাইট নেত্র নিউজে প্রকাশিত হয়েছিল, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে রহমান পরিবারের মালিকানাধীন একটি বাড়িতে থাকেন। কীভাবে আহমেদ এবং তার পরিবার এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাজ্যে স্থানান্তরিত করেছে তা একটি ধাঁধার মধ্যে রয়ে গেছে। কারণ, বাংলাদেশের আইনে সীমিত পরিমাণ অর্থই বিদেশে পাঠানো যায়। বাংলাদেশে হাসিনার শাসনামলে ক্ষমতাসীন এলিটরা বিদেশে অসৎ উপায়ে অর্থ পাচার করেছিল। আল জাজিরার অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী, হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, যার বৈশ্বিক সম্পদের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। যার বেশির ভাগ অংশ তিনি বাংলাদেশ থেকে পাচার করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই সরকারকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে। ইউনূস সরকার ইতোমধ্যেই অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। যেগুলো হলো— বিতর্কিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রদবদল করে আর্থিক খাতের সংস্কার এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা চাওয়া। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর চাপ রয়েছে। সুতরাং ঋণ চাওয়ার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যা কেবল অর্থনীতিকেই চাঙা করবে না, ঋণের বোঝা কমাতেও সহায়তা করবে।  বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে চারটি উপায় রয়েছে— প্রথমত, বাংলাদেশ স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ (এসটিএআর)-এর সদস্য। বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত অফিসের (ইউএনওডিসি) মধ্যেও অংশীদারিত্ব রয়েছে। কিন্তু হাসিনা সরকারের অপব্যবহারের কারণে এখনও এগুলোর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। সম্পদ পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে বিরোধী নেতাদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত পেতে সহায়তা করেছে। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকার সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং তাদের সম্পদ জব্দ করতে অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া তাদের বাংলাদেশে ফেরত আসতে এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি দুর্নীতি অনুশীলন আইন (এফসিপিএ) একটি গেমচেঞ্জার হতে পারে যদি পাচারকৃত অর্থ মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনিয়োগ বা লেনদেন করা হয়। এমনকি বাংলাদেশ ফিফার দুর্নীতি কেলেঙ্কারি থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং এটিকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের টার্গেট করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো- সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সহযোগী মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ২০২০ সালের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। আরেকজন হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা গেছে। সবশেষ, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অবশ্যই হাসিনার সহযোগীদের অর্থ পাচারের গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সম্পর্কে আর্থিক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে আইনি সহায়তা এবং অর্থ পাচারকারীদের জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার থেকে সরকার অংশীদারিত্ব শুরু করতে হবে। যদিও বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে বাংলাদেশকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে পশ্চিম, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারেরও পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও সদিচ্ছা দেখানো উচিত। লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী  (দ্য ডিপ্লোমেট থেকে বাংলা করা)
পর্যটন শিল্পের রূপান্তর: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতির পথ
দেশে পর্যটন ব্যবসার উন্নতি ও অগ্রগতি করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যা দেশের সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এবং ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। নিচে কিছু কৌশল আলোচনা করা হলো যা পর্যটন ব্যবসার উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। ১. নিশ পর্যটন (Niche Tourism) বিকাশ  •    ইকো-ট্যুরিজম: সুন্দরবন, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্স ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকাগুলোর পরিবেশ-বান্ধব ভ্রমণকে উন্নীত করুন। •    সাংস্কৃতিক পর্যটন: স্থানীয় উৎসব, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম, এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি (যেমন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার) প্রচার করুন।  •    অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ট্রেকিং, রিভার ক্রুজিং এবং অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের ব্যবস্থা করতে পারেন। •    ধর্মীয় পর্যটন: মহাস্থানগড়, পুঠিয়া মন্দির, এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থানগুলোকে প্রচার করুন। ২. অবকাঠামো উন্নয়ন •    পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি: মূল পর্যটন স্থাপনাগুলির সাথে ভালো সড়ক ও যেখানে সম্ভব বিমান সংযোগ গড়ে তুলুন। •    আবাসন সুবিধা: পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বাজেটের আবাসনের সুযোগ তৈরি করুন, বিশেষ করে নতুন পর্যটন হাবগুলোতে। •    ডিজিটাল সংযোগ: পর্যটন এলাকায় ইন্টারনেট এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক উন্নত করুন। ৩. স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রচার •    সাংস্কৃতিক উৎসব: স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতে পারেন, যেমন পহেলা বৈশাখ, লোকসংগীত উৎসব। •    খাদ্য পর্যটন: স্থানীয় খাবার ও রান্নার উৎসবের আয়োজন করতে পারেন, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। •    হস্তশিল্প: স্থানীয় কারিগরদের হস্তশিল্প প্রচার ও বিক্রির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিন। ৪. ডিজিটাল মার্কেটিং ও অনলাইন উপস্থিতি •    সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের মাধ্যমে দেশের পর্যটন স্পটগুলোকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরুন। •    ওয়েবসাইট ও অনলাইন বুকিং: পর্যটকদের জন্য সহজ ও ব্যবহারবান্ধব বুকিং ব্যবস্থা তৈরি করুন। ৫. পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুবিধা বৃদ্ধি •    পর্যটন তথ্যকেন্দ্র: প্রধান পর্যটন এলাকায় ও বিমানবন্দরে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করুন। •    নিরাপত্তা ব্যবস্থা: পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন এবং পর্যটন এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করুন। ৬. স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব •    ভ্রমণ সংস্থা ও ট্যুর অপারেটরদের সাথে অংশীদারিত্ব: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভ্রমণ সংস্থার সাথে অংশীদারিত্ব করে পর্যটকদের আকর্ষণ করুন। •    হোটেল ও বিমান সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা: হোটেল ও বিমান সংস্থাগুলোর সাথে মিলে প্যাকেজ অফার করুন। •    সরকার ও এনজিও সহযোগিতা: বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে কাজ করে টেকসই পর্যটন উদ্যোগ তৈরি করুন। ৭. হসপিটালিটি স্টাফ ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ •    গ্রাহক সেবা: হোটেল, রেস্তোরাঁ, এবং ট্যুর গাইডদের পেশাগত প্রশিক্ষণ দিন যাতে তারা পর্যটকদের উন্নত সেবা দিতে পারে। •    ট্যুর গাইড: দক্ষ ও বহু ভাষায় পারদর্শী ট্যুর গাইড নিয়োগ করুন, যাতে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সঠিকভাবে সেবা প্রদান করা যায়। ৮. পর্যটন শিল্পে টেকসইতা নিশ্চিত করা •    পরিবেশ সুরক্ষা: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিন এবং ইকো-ফ্রেন্ডলি ট্যুরিজম প্রচার করুন। •    বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: পর্যটন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিন, যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রক্ষা করতে সহায়ক হবে। ৯. বিশেষ বাজার লক্ষ্য করা •    দেশীয় পর্যটন: দেশীয় পর্যটকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের প্যাকেজ তৈরি করে স্থানীয় পর্যটন বৃদ্ধি করুন। •    আন্তর্জাতিক পর্যটন: নিকটবর্তী দেশগুলোতে (যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান) প্রচারণা চালান এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণ করুন। এই কৌশলগুলোকে একত্রিত করে পর্যটন ব্যবসা উন্নত করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সহায়ক হবে। লেখক: রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (মেকানিক্যাল), কনকর্ড গ্রুপ আরটিভি/ডিসিএনই
পাহাড়ে হচ্ছেটা কী? সুযোগ নিচ্ছে কারা?
অশান্ত উত্তাল পাহাড়ি জনপদ দীঘিনালা। সেখানে রক্তপাত ঘটেছে, উদগীরণ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। শান্ত প্রকৃতির ছায়া শীতল সৌহার্দ্যতার মাঝে বাজছে সংঘাতের দামামা, আবার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পাহাড়ি-বাঙালি। ভালো নেই খাগড়াছড়ি, ভালো নেই সেখানকার মানুষজন।  খাগড়াছড়ির মধুপুর, মহাজনপাড়া, দিঘীনালা, বাবুছড়ার নানা জায়গায় হামলা-ভাঙচুর হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট, সবকিছু। বাঙালি যুবক হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করেই সীমাহীন অরাজকতার সূত্রপাত ঘটে, ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। টানা দুদিন ধরে স্পর্শকাতর ওই জনপদে সংঘাতের বিস্তার ঘটলো কিভাবে? বাধাহীন নৈরাজ্যের পেছনে কারা দায়ী? সবকিছু খুঁজে বের করার পাশাপাশি সকল ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারে জরুরি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক, এখনই। বৃহস্পতিবার রাতভর পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের ৩০ জনেরও বেশি। এসময় অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিহতরা হলেন- ধন রঞ্জন চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০)। এর মধ্যে রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০) জেলা সদরের নারানখাইয়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন। আর ধন রঞ্জন চাকমা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।  জাতিগত সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে দূরবর্তী রাঙামাটিতেও। সেখানেও সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উত্তেজনাময় পরিবেশের জের ধরে বান্দরবানেও বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। সেখানে জেএসএস আর দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা বুঝতে সাধারণ বাসিন্দাদের গলদঘর্ম অবস্থা। আগে সংঘাতময় পরিস্থিতি কঠোর ভাবে বন্ধ করুন, জ্বালাও পোড়াও চলবে না। ব্যর্থতার দায়ভার গণমাধ্যমের কয়েকটি যুগ ধরে বৃহত্তর পার্বত্য জনপদ জুড়ে অস্বাভাবিক, বিপর্যয়কর পরিবেশ চলে আসছে। এদেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশের বিরাট সংখ্যক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বনাম সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে সীমাহীন বৈরীতাসহ সঘাত সংঘর্ষ চলে আসছে। লাশের পর লাশ পড়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে সবুজ পাহাড়। উভয়পক্ষই পরস্পরবিরোধী মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলে, একপর্যায়ে সবকিছুর জন্য দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর উপর। অথচ এদেশের এতো এতো মিডিয়া, অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরও অভাব নেই। কিন্তু সুদীর্ঘ সময়েও কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক টিমকে পাহাড়ে অশান্তির নেপথ্য তথ্যচিত্র তুলে ধরাসহ সহসা সমাধানের কোনো পথ বাৎলে দিতে দেখা যায়নি।  যারাই হাতি ঘোড়া নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে তারাই ফিরে এসে নয়তো সেটেলার বাঙালিদের পক্ষ নিয়েছে, নয়তো পাহাড়িদের ঘরের মানুষ সেজে মানবতাবাদী বনে গেছেন। কিন্তু পাহাড়ের সমস্যা অভিন্ন অবস্থাতেই জিইয়ে রয়েছে, ভিক্ষুকের দগদগে ঘা এর মতো। বন্ধু প্রসীত ইতিহাস হও! দীঘিনালার বিচ্ছিন্ন ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ নাকি অতিমাত্রায় শক্তি প্রদর্শনের নগ্ন খেলায় মেতে উঠেছে। পাহাড়ি উগ্রবাদী এ সশস্ত্র গ্রুপটির প্রধান প্রসিত খীসা আমার ২৩ বছরের পুরোনো বন্ধু। লীগ পতনের পর বিএনপির প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে বন্ধুর ইউপিডিএফ কি অলৌকিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলো?  আপাতত রক্তের হলিখেলায় বিরতি দাও বন্ধু, নতুন দেশ গঠনে এগিয়ে আসো, সক্রিয় ভূমিকা রাখো। তাহলেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের স্মৃতির মণিকোঠায় শত শত বছর তোমাকে ঠাঁই দিবে।  পান থেকে চুন খসলেই সুযোগ নেয় ভারত আমরা মণিপুরের স্বাধীনতাকামীদের সহমর্মিতা জানালে, ভারত আমাদের পার্বত্য উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোকে লেলিয়ে দেয়। আমরা মিজোরামের অত্যাচারী, বঞ্চিত, দিশেহারা মিজোদের পক্ষে বললে ভারত তখন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সাজিয়ে কুকিচিনকে বান্দরবানে পাঠায় ম্যাসাকার ঘটাতে। আমরা শুধু শান্তি, শৃংখলা আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র দানবের মঙ্গল চাই বলে উলফা, এনডিএফবি, আচিক ফ্রন্ট, বড়ো বিদ্রোহী, এনএলএফ, পিএলএ, কেএনএলএফ সহ দুই ডজনেরও বেশি উগ্রপন্থী সশস্ত্র গ্রুপকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দেই না, সাহায্য করি না।  স্বাধীনতাকামী এসব সশস্ত্র দল - উপদলকে শুধু সীমান্তবর্তী নোম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানের সুবিধাও যদি দেওয়া হয় তাহলে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ডে কিন্তু ভারতের জাকান্দানি শুরু হয়ে যাবে। বাস্তবতায় এখন আসলেই ভারতকে অস্থিরতায় ঠেলে দেওয়া ছাড়া আমাদের পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক আরটিভি/ ডিসিএনই
কার তামাকের কলকেতে কে সুখ টান দেয়
উহুদের যুদ্ধের শিক্ষা যেন ভুলে না যাই। মুসলমানদের প্রাথমিক বিজয় কীভাবে হাতছাড়া হয়ে পরাজয় সে বিজয়কে গ্রাস করে। প্রতিরক্ষা ব্যূহ ছেড়ে বিজয় উদযাপনে মনোযোগী হয়ে পড়ায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। প্রাথমিক জয়ে প্রতিরক্ষা অরক্ষিত রেখে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন, গনিমতের মাল বণ্টনে মশগুল হওয়ায় চরম মূল্য দিতে হয়েছিল মুজাহিদদের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অভ্যুত্থানের পর প্রতি অভ্যুত্থান মোকাবিলায় সজাগ ও সরব থাকতেই হবে, নচেৎ বিপদের আশঙ্কা। দল ও গোষ্ঠীর কৃতিত্ব নিতে সম্মিলিত মহৎ আন্দোলনকে পাশ কাটানো কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ভারহীন কথা সমাজমাধ্যমে বলে নিজের প্রচারে নিজের দক্ষতা জাহির করতে গিয়ে জাতীয় ঐক্য নিয়ে দলীয় গন্ধ ছড়ানো অনুচিত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো অর্বাচীনের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। টাউট শ্রেণির লোক মতলববাজ দলীয় উচ্ছিষ্টভোগীরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন কাউকে খুশি করতে তাকে রূপকার, সুরকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, মাস্টার মাইন্ড ইত্যাদি বিশেষণ বলে তোয়াজ করছে, তেল মারছে শ্রুতি কটুভাবে নিজের ফায়দা লুটতে। বীরত্বের খেতাব কাড়াকাড়ির সময় এখন না। পিচ্ছিল সরু বিপৎসংকুল পথ দিয়ে চলছে দেশ। আন্দোলনে আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সব নাগরিক এখনো স্বস্তি খুঁজে পায়নি। হয়তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিশ্চয়ই কোনো পাকা মস্তিষ্কের দীর্ঘদিনের প্রতিকূল পরিবেশে বৈরী পরিস্থিতিতে আন্দোলনের অভিজ্ঞ নেতার মেধা কাজ করতে পারে যা তিনি আঁচ করতে দেননি। সেই মেধা জাতীয় সম্মিলিত আন্দোলনের ধারায় একাকার হয়ে এক স্রোতে স্বৈরাচার ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা এখন বলারও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা জনগণের ধাওয়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন মাত্র। সমালোচকরা বলেন, তার অপমানের যন্ত্রণা সহ্য করার মতো পরিপক্বতা, ধৈর্য কোনোটা নেই। মাতা-পুত্র নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য নবীনদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপচারিতা করে বুকের ব্যথা বুকেই লুকিয়ে ক্ষমতা হারানোর বেদনা লাঘব করার চেষ্টা করছেন। বলছেন যেভাবে পদত্যাগ করতে হয় সেভাবে তিনি করেননি। টুস করে দেশে আসবেন। কথাটা সমালোচকদের বিনোদন জোগাচ্ছে। সাধারণ মানুষ, যারা কোনো দল-মতের না, তারাই সংখ্যায় বেশি। তারাই রাজপথ দখল করেছিল, ছাত্রদের সঙ্গে রক্ত দিয়েছে বেশি তারাই। ছাত্র-জনতা আমাদের দিয়েছে নতুন ভাবনার জগৎ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে বেপরোয়া মতলববাজরা নির্লজ্জ চামচামির রেকর্ড বাজাচ্ছে। পতিত সরকারের মিডিয়া ফ্যাক্টরি ভোল পাল্টিয়ে নতুন সুরে আওয়াজ তুলছে। মতলববাজরা উঁচু গলায় নতুন সাজে জাতীয়তাবাদী হচ্ছে। এবারের আন্দোলনের লক্ষণীয় ছিল রাজনৈতিক পরিচয় কেউ দেয়নি, রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম ছিল না। এ অরাজনৈতিক আন্দোলনে কোথাও কোথাও রাজনৈতিক লোকজন কুলচিহ্নবাহী পতাকা ছাড়া, ঘোষণা ছাড়া, স্লোগান ছাড়া নীরবে ঢুকে পড়ছেন নির্দলীয় হয়ে আন্দোলনকে বেগবান করতে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করে। সবাই এক হয়ে লড়াই করেছে সরকার পতনের আখেরি রূপ দিতে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দারুণ এক বিস্ময়। বাংলাদেশের ৫ আগস্ট আন্দোলন নতুন অভিনব মডেল। একদিকে যেমন কেউ নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়দানে উৎসাহ দেখাননি, অন্যদিকে যোগদানকারীদের বেশির ভাগই সচেতনভাবে রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছেন জাতিকে অরাজনৈতিক এক মঞ্চে ধরে রাখতে। রাজনৈতিক দলগুলো এ গণ আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকা গোপন রেখেছে বলে মনে হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে সব রাজনৈতিক দল মিছিল নিয়ে মাঠে নামে। মনে থাকার কথা পতিত সরকার ক্ষমতায় বসেই জামায়াত নিধন অভিযান চালায়। ফাঁসি জেল মামলার শিকলে বাঁধা সব নেতা। বিএনপি ১৮ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে রক্ত ঝরিয়ে, জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, হিজরত করে, জেল জুলুম খুন গুমের অভিশাপে পর্যুদস্ত ক্লান্ত। কর্মীদের বিলুপ্ত করতে গায়েবি মামলা-হামলা খুন গুম চলেছে। দানবীয় সরকার আর জাহেলি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শক্তি যখন ক্ষয়িষ্ণু প্রায়, তখনই সাধারণ ছাত্ররা রাজপথ কাঁপাতে শুরু করল। বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ সফল করে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে। চূড়ান্ত সমাবেশ ঢাকায়ও সফল হয়েছে। পুলিশ গোলাগুলির নাটক মঞ্চস্থ করে সব নেতা-নেত্রীকে জেলে ঢোকানোর অজুহাত বের করল। এ আন্দোলন রাজনৈতিক পরিচয়হীন শুধু নির্দলীয় ছাত্র দিয়ে শুরু। ছাত্র আন্দোলনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করলে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হবে। দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে পুঁজি করে কেউ দলীয় আন্দোলন আখ্যা দিয়ে আবার দুর্নীতি চর্চা করলে তাদের ছাত্র-নাগরিক প্রতিহত করবে। জাতির নীতি হবে এখন ৫ আগস্ট ও এর আগে যে গণহত্যা, জুলুম অত্যাচারের শিকার দেশের মানুষ হয়েছে, এর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নৈরাজ্য, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজির রাজনীতির ইতি টানতে হবে। সারা দেশে লুটপাট, সহিংসতা যারা করেছেন তাদের এখনই ইনসাফ, ন্যায়ের পথে ফেরাতে হবে। অনেকের সঙ্গে চরম অন্যায় করা হয়েছে। অন্যায়কারীদের দেশের আইনে অবশ্যই বিচার করতে হবে। হাসিনার পলায়নকাণ্ডের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ঘটেচলা নানা উলটপালট দেখে পুরনো প্রবচনটি মনে পড়ে। গত চার দশকে রাজনৈতিক কর্মীদের দাপুটে হাবভাবের সমাজচিত্রের প্রেক্ষিতে মানুষের ধারণা হয়েছিল—এখানে সব আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি বা বাম-ডান দলের কর্মী সমর্থক থাকলেও বুঝি ‘মানুষ’ নেই। তারা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিলেন—এসবের বাইরে স্রেফ ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে চাইলে, মানুষের মতো উচিত কথা বললে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়, হেনস্তা হতে হয়। কন্যাকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হয়। আবার প্রমাণ হলো পচা রাজনীতির খোলসের আড়ালেও আদতে প্রচুর আদর্শিক অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক ‘মানুষ’ ছিলেন। এতদিন যারা ভয়ে ও অনিশ্চয়তায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস পাচ্ছিলেন না। সব ভীতি প্রলোভনের ঊর্ধ্বে ওঠে ভয়কে জয় করে তারাই রাত জেগে শাহবাগ, রাজপথ দখল করেছেন, মিছিল করেছেন, দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল গড়েছেন, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটতে হাঁটতে আওয়াজ তুলেছেন পেছনে ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকসহ ছাত্রদের ন্যায্য দাবির ডাকে বাংলাদেশ তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকা ইউরোপ পাকিস্তান ও ভারতের নানা রাজ্যে, পৃথিবীর নানা দেশে বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে যে অগণিত মানুষ রাত ও রাজপথের দখল নিতে নেমে পড়েছিলেন, তার তুল্য স্বতঃস্ফূর্ততা কবে বিশ্ব দেখেছে বলা শক্ত। তার চেয়েও বড় কথা, এ গণ আন্দোলন যে উৎসাহ ও প্রেরণার জন্ম দিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতি মরিয়া হয়ে আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য চালিকাশক্তি দেখে সেনাবাহিনীও দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। কোনো নীলনকশা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। দল গোষ্ঠীর বাহাদুরি সংকীর্ণ বিবেচনা না করে স্বাধীনতাকামী জনতার বাহাদুরির ইতিহাস এ আন্দোলন। আমজনতা তাদের নিজ বিবেকের তাড়নায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাদের একটাই স্বর, এক দাবি ছিল হাসিনা কবে যাবি! এক দফা শেখ হাসিনার পতন। সোজা আঙুলে ঘি না ওঠায় ছাত্র-জনতা ঢাকার চতুর্দিক থেকে গণভবনের দিকে অগ্রসর হয় হাসিনাকে হটাতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বোনকে নিয়ে পালান শেখ হাসিনা। এখানে কোনো রাজনীতির ব্যানারে আন্দোলনের আলামত ছিল না। অবাক করা ঘটনা, দিনের পর দিন যে গণ আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, সেগুলো এতই স্বতঃস্ফূর্ত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেউ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর অপেক্ষা করেনি, নির্দেশনা আশা করেনি। প্রাথমিকভাবে ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে পথে নামে। তাদের ওপর জুলুম অত্যাচার নির্যাতনের বুলডোজার চালিয়েও দমাতে পারেনি। নির্দলীয় প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিসর আমজনতার প্রতিবাদী মিছিল শামিল হওয়ার ও প্রতিবাদী-সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়। সাধারণ নাগরিকরা তো ছিলেনই, একই সঙ্গে পেশাজীবী শিক্ষক, অভিনেতা, কবি, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যৌনকর্মী, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, রিকশাচালক, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দেখা গেছে প্রতিবাদে শামিল হতে! দিন যত এগোচ্ছিল, আন্দোলনের আগুনের তেজ ততই বাড়ছিল। ঢাকা শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল দেশের প্রান্তিক শহরে। ছাত্র-জনতা হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহীদ হয়েছে। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আর কোনো ছাত্র পেছাল না, শুধু জীবন দিতে উদগ্রীব হলো, দেশের মানুষকে জীবন দিয়ে মুক্ত করে গেল।  এখানে রাজনৈতিক দলের কোনো গন্ধ নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল, তার বেশির ভাগই আহ্বান করছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন ছাত্র ও মানুষেরা, যাদের কথা অতীতে সেভাবে শোনা যায়নি। এমনকি তাদের অধিকাংশেরই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে উজ্জ্বল অংশগ্রহণের পূর্ব ইতিহাস নেই। ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের স্রোতের তোড়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সরকার।  যে কোনো মূল্যে জাতীয় সংহতি বজায় রাখতে হবে। দেশ বাঁচাতে আন্দোলনের সফলতা ক্ষুদ্র কর্তা হওয়ার যে আনন্দ, তার চেয়ে বেশি মহিমা দেশের সব মানুষের আন্দোলনের ফসল আজকের মুক্ত দেশ এটা প্রচার করা। আসুন দেশ গড়ি, দেশের ভালোমন্দের আপনি আমি সবাই অংশীদার, সবাইকে সম্পৃক্ত করি দেশের কাজে। লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরটিভি/এআর  
বাংলাদেশে কি সরাসরি রাজনীতি না করে টিকে থাকা যায়? 
বাংলাদেশে কি সবাই রাজনীতি করে? আচ্ছা বাংলাদেশে এতো লোক  রাজনীতি করে কেন? যার নামই শুনছি সেই সরকারি দলের বিশেষ কোনো হোমরা চোমরা ছিলেন। এমনকি সংগীত বা অভিনয়শিল্পী,  লেখক, খেলোয়াড়, নাটক- সিনেমার শিল্পী, সাংবাদিক, পুলিশ বা আর্মি, ডাক্তার, আইনজীবী; কে নেই যে সরকারি দল করতো না? অথচ আমরা যে কানাডায় থাকি, সেখানে এরকমভাবে রাজনীতি তো করে খুব কম লোক। ভোট দেয় কেউ অনলাইনে বা বাই  পোস্টে কিংবা অ্যাডভান্স ভোটিং ডেতে।  ভোটে কোনো কারচুপি হতেও তো দেখি না।  তাহলে কি কানাডিয়ানরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন না? আসলে কানাডায় রাজনীতি করা মানে -এখানকার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি বা এমপিরা তাদের নিজস্ব পেশা ছেড়ে একটা সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাত্র।  এ দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ক্রেডিট কার্ডে এক পেনিও ব্যক্তিগত খরচ করলে তাঁর জবাবদিহিতা করতে হয়।  কিন্তু বাংলাদেশে কেন এতো মানুষের রাজনীতি করতে হয়? বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কেন এরকম জবাবদিহিতা নেই, কেন ভোটে এতো কারচুপি হয়? বাংলাদেশে কি সরাসরি রাজনীতি না করে টিকে থাকা যায়? বাংলাদেশে আমি শিক্ষকতা করতাম। আমি কখনোই কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি  সম্পৃক্ত ছিলাম না।  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে  বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলাম। ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে লেকচারার হিসাবে চাকরি শুরু করি এবং পরে বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি কলেজে যোগদান করি।  বিএল কলেজে থাকা অবস্থায় কুড়িতম বিসিএসের মাধ্যমে আমার তথ্য ক্যাডারে, শাহবাগে পোস্টিং হয়। কিন্তু আমি  অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে টেসরেল মাস্টার্স করি ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে।  এরপর জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে  চাকরির ইন্টারভিউ দেই।  আমি দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি পাই এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি।  আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বাগেরহাটের শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতি করতেন আর সেই সুবাদেই  খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে  আমাকেও বিএনপির তকমা লাগিয়ে দেয়া হলো।  আশ্চৰ্যজনকভাবে  খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের হেড এবং  তখনকার ভিসি যাদের উভয়েরই নিয়োগ হয়েছিল বিএনপির আমলে তাঁরা আমার প্রমোশন আটকালেন, সিন্ডিকেটে সৌদি আরবের কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে  লিয়েন নিয়ে যাওয়ার আদেশ বাতিল করলেন।  কারণ তখন খুলনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন।    খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলামের ট্রেজারার হিসাবে নিয়োগ পত্রটি  এই কারণেই শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। তাঁর নিয়োগ বাতিল হলো কারণ সে বিএনপি করতো- বুঝলাম এক ঘাটে দুই বাঘ পানি খেতে পারে না। কিন্তু আমার দোষটা কোথায়? আমিতো বিএনপি, আওয়ামী লীগ কিছুই করিনি কখনো, আমি নিতান্তই একজন শিক্ষক।  কখনো কোথাও কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করিনি, রাজনৈতিক পেশী শক্তিও দেখাইনি।   শুধুমাত্র আমার স্বামীর ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আমি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলের কাছ থেকেই  অন্যায় -অবিচারের শিকার হয়েছি। আমার প্রমোশন আটকে দেয়া হয়, সিন্ডিকেটে শেষ মুহূর্তে আমার ছুটি বাতিল করা হয়। কে ছিলেন তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি  ডিপার্টমেন্টের হেড? আমারই কলিগ যাঁর প্রোমোশনের ফাইল আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম (হেড ছুটিতে থাকায় একদিনের অস্থায়ী হেডের দায়িত্বে ছিলাম)।  ফাইল সাইন  করার পর পরই বিভাগীয় প্রধান এবং স্বয়ং ভিসি স্যার টেলিফোনে ভীষণ বকাঝকা করলেন।  ‘তুমি ওঁর প্রোমোশনের ফাইল ছেড়ে দিলে যেটা ঝুলে আছে অনেক দিন থেকে - তুমি জানোনা ও কোন ব্লকের লোক? তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না  তুমি শিক্ষক রাজনীতির কিছুই বোঝো না।’  এই প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে  আমার একটি লেখা বেরিয়েছিল প্রথম আলোতে।  আমার মতো এরকম নাদান বাংলাদেশে বহু আছে যারা বাধ্য  হয়েছে সরকারি দল করতে শুধু মাত্র তাদের চাকরি বাঁচাতে।  শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের  চাকরির ক্ষেত্রেই  নয়, বাংলাদেশে যেকোনো চাকরি বা ব্যাবসা যেটাই করতে গেছেন আপনাকে আওয়ামী লীগ করতেই হয়েছে অন্যত্থায়  আপনি কোনো কিছুই করতে পারতেন না। আপনি এমন কি  গুম হতে পারতেন, আপনাকে আয়না ঘরে পাঠানো হতে পারতো, আপনার প্রমোশন আটকে থাকতে পারতো।  উপরন্তু আওয়ামী লীগের  হাসিনা আপা, তাঁর আত্মীয় স্বজন, চামচাদের হম্বি তম্বি দেখে মনে হবে দেশটা তাদেরই, আমরা সবাই বানের  জলে ভেসে এসেছি।      আমি লাল-সবুজ- নীল কোনো দলেরই ছিলাম না কোনো দিন। যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্বস্তিকর পরিবেশ এড়ানোর জন্যে আমি আর্ন লিভ নিয়ে  স্বামী এবং সন্তানদের নিয়ে সৌদি আরব চলে যাই। ইচ্ছে ছিল নতুন দেশে নতুন পরিবেশে কিছুদিন চাকরি করে, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়  করে,  হজ-ওমরাহ করে দেশে ফিরে যাবো।   এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আমি ছুটিতে থাকা অবস্থায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিটা চলে গেলো।  আমি রিট করেছিলাম এই  অন্যায়ের বিরুদ্ধে- কিছুই হয়নি সেই আবেদনের।  আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আটকে আছে- আমি কি সেগুলো  ফেরত  পেতে পারি না? আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হয়েছে, সেটি কি ইউনিভার্সিটি স্বীকার করবে?  সবাই বলে- আমরা অকৃতজ্ঞ, দেশ থেকে সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি,  ব্রেন ড্রেন হয় - আসলে কি তাই? নাকি আমাদেরকে দেশে থাকতে দেয়া হয় না? আমরা আসলে দেশে থাকার যোগ্যতা রাখি না।  দেশে থাকতে গেলে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করতে হবে, শাসক শ্রেণীর সব অন্যায় অপরাধ মেনে নিয়ে জি হুজুর, জি হুজুর করতে হবে, আপা আপা করতে করতে নাভিশ্বাস ওঠাতে হবে তবেই আপনি বাংলাদেশে থাকতে পারবেন। আমার ছোট ভাই অ্যাডমিন ক্যাডার এ - তাঁর দীর্ঘ দিনের আটকে থাকা প্রমোশন হয়েছে গতকাল।   সৈয়দ আমিনুল ইসলামের নামে মিথ্যা হয়রানিমুলুক মামলা দেওয়ার কারণে সে আজ ১৬ বছর দেশে যেতে পারেনি। সে অনেকবারই চেয়েছে দেশে যেয়ে এই মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করতে।  এখন মনে করি এটি মহান আল্লাহতালার বিশেষ নেয়ামত - সে দেশে গেলে গুম হতে পারতো, জেলে যেতে হতে পারতো, আয়না ঘরে আটকা পড়তে পারতো এমনকি খুনও হতে পারত।  মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ই তাঁকে বাঁচিয়েছেন।  আমি সারাজীবনই একজন আশাবাদী মানুষ।  যে সব ছাত্রদের জীবন এবং ত্যাগ তিতিক্ষায় আজকের এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে, তাঁদের প্রতি রইলো আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। নতুন সরকার বাংলাদেশে নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবে এটিই আমার ঐকান্তিক কামনা।  ভালো থাকুক আমার বাংলাদেশ, ভালো থাকুক আমার দেশের মানুষগুলো।  লেখক: প্রিন্সিপাল কনসালটেন্ট, ক্যানবাংলা ইমিগ্র্যাশন সার্ভিসেস, আরসিআইসি, টরেন্টো, কানাডা/ প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়/ কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।   আরটিভি/ ডিসিএনই