• ঢাকা শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১
logo
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি যৎসামান্য
ইলিয়াসের পডকাস্টে মেজর ডালিম: প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য ও বিতর্ক
সম্প্রতি প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের পডকাস্টে একটি আলোচিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে 'মেজর ডালিম' নামক এক ব্যক্তির উপস্থিতি সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তবে, তার উপস্থিতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে। মেজর ডালিমের নাম যেমন পরিচিত, তেমনই তার চেহারা বা তার পরিচয় নিয়ে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, তিনি আসলে মেজর ডালিম নন, এবং তার বক্তব্যের মধ্যে অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে, যা সামাজিক গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। অনেকই বলছেন, লাইভে যিনি কথা বলেছেন তিনি মেজর ডালিম নন। এটা সাজানো নাটক বা গল্প! মেজর ডালিম নামের সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তি মূলত মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় তার নাম শোনা যায়। কিন্তু পডকাস্টে যে ব্যক্তি নিজেকে মেজর ডালিম হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তার চেহারার সাথে সেই পুরনো পরিচয়ের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তিনি সত্যিকার মেজর ডালিম নন, বরং তার নাম এবং পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই বিতর্ক পডকাস্টটির শ্রোতাদের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। পডকাস্টে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আরো বিতর্কিত হয়েছে। বিশেষত, তিনি দাবি করেছেন মুক্তিযুদ্ধে দুজন নারীর সম্ভ্রমহানীর বিষয়ে তিনি অবগত, যা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরের বিষয়। এমন দাবি পুরো সমাজকে বিভ্রান্তি ও বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু হত্যায় মেজর জিয়ার সম্পৃক্ততা এবং ক্ষমতায় টিকতে ৪ হাজার সেনা সদস্যকে হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান, এমন তথ্য দেন তিনি। কিন্তু এসব তথ্য কোনো সূত্র বা বাস্তব প্রমাণ ছাড়া উপস্থাপন করায় আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেছেন, মুজিব মারা যায়নি, একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। বাকশাল বিদায়ের পরে কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে শুকরিয়া আদায় করেছে। শেখ মুজিব তার জুলুমের মাত্রা এতোটাই তীব্র করেছিল যে, তখন মানুষ রবের কাছে মুক্তি চাচ্ছিল যে তার জুলুমের অবসানের জন্য। এ ধরনের ভুল তথ্য এবং বিতর্কিত মন্তব্য, বিশেষ করে একটি পডকাস্টের মাধ্যমে, অনেকের কাছে খারাপ উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। যখন একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্মে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তখন তথ্যের সঠিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা বা অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমন পরিস্থিতিতে, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, তথ্য যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করা এবং যেকোনো আলোচনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা। পডকাস্টের মাধ্যমে আলোচিত বিষয়গুলি যদি সঠিক এবং গবেষণাপ্রসূত না হয়, তবে তা কেবল সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াবে, যা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইলিয়াসের পডকাস্টে মেজর ডালিমের উপস্থিতি একদিকে যেমন কৌতূহল সৃষ্টি করেছে, তেমনি তার বক্তব্যে নানা ভুল তথ্য উপস্থাপন সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এ ধরনের বিতর্কিত মন্তব্যের ফলে জনগণের মধ্যে তথ্যের সঠিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। সত্য-ভিত্তিক আলোচনা এবং তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। লেখক: গণমাধ্যম কর্মী আরটিভি/ডিসিএনই
 কেমন চাই গণমাধ্যমের সংস্কার
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ‘চরমপন্থা রোধ’
মানুষকে মশা-মাছি ভেবে মাড়িয়ে যেতে চায় ভারত?
একাত্তরের ডিসেম্বর ও বড়দিনের স্মৃতি 
হকার মাইকিংয়ে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী, মুক্তি মিলবে কি
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর রাজধানী ঢাকা। যে শহরে বসবাস করে প্রায় ২ কোটি মানুষ। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের এ শহরে কেউ করেন চাকরি, কেউ পড়ালেখা, কেউ আবার ব্যবসা। প্রকৃত অর্থে থেমে নেই কেউ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলমান এ শহরকে ‘অদ্ভুত শহর’ নামেও আখ্যা দেন অনেকে। মূলত, এ শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে তিন শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে—উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। যদিও প্রত্যেকেই ব্যস্ত থাকেন আপন কর্মে। জীবিকার তাগিদে সকাল থেকে রাত অব্দি ছুঁটে চলেন এ মানুষগুলো। প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রকমের কর্ম। আজ কথা বলতে চাই ‘ইদুর মারেন’, ‘তেলাপোকা মারেন’, ‘মাজায় ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা’ প্রভৃতি পেশা নিয়ে।   সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, কোনো-না কোনো সময় মনের অজান্তে হলেও এ শব্দগুলো আপনার কানে আসবেই। সেটি আপনি অফিসে বসেই হোক আর বাসায় শুয়ে থেকে হোক, শুনবেনই। শোনতে আপনি বাধ্য। কোনো রেহাই নেই আমাদের। তীব্র যানজটের এ শহরে বাসে বসে থাকেন বা পার্কে হাঁটেন কথা একটাই—‘ইদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন’, ‘মাজায় ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা’ ইত্যাদি। এ যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই না! আচ্ছা একটু মনে করে দেখুন তো, আপনি কারও সাথে একান্ত নীরবে মোবাইলে কথা বলছেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করছেন বা কোনো কন্টেন্ট তৈরি করছেন। এমন সময় আপনার প্রয়োজন হবে একটা নিরিবিলি পরিবেশ। কিন্তু আপনার কাজ শুরু করার পরই হঠাৎ বাতাসে একটি শব্দ ভেসে আসলো- ‘ইঁদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন’ বা ‘কাগো...জ, পেয়া...জ, ছা...ই’ ইত্যাদি। ঠিক সে সময় আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে? রাজধানী ঢাকা, যেখানে- পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণসহ এমন কোনো দূষণ নেই যা আপনি পাবেন না! মূলত, প্রয়োজনের তাগিদে শত দূষণ সহ্য করেও ঠিকে থাকতে হচ্ছে আমাদের। ফেরার পথ বন্ধ অনেকের। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্যেও ইটপাথরের এ শহরে নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। আজ যাদের নিয়ে কথা বলছি- তারা মূলত, নিম্নভিত্ত বা নিম্ন আয়ের মানুষ। সহজ ভাষায় যাদের ‘হকার’ বলা হয়। যদিও হকারদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন শেণিবিন্যাস। রাজধানীর ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন তাদেরকেও হকার বলা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের হকার রয়েছে। কিছুদিন পূর্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, রাজধানীতে সকল প্রকার যানবাহনের হর্ন বাজানো বন্ধ করবেন। মূলত, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। যদিও তার সে উদ্যোগ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ পরবর্তীতে আর চোখে পড়েনি। রাজধানীতে শব্দ দূষণের যে কয়েকটি বিশেষ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে ‘হকার মাইকিং’ অন্যতম। শহরের বিভিন্ন স্থানে, অলিতে-গলিতে হ্যান্ডমাইক বা ভ্যানে স্থাপিত মাইকে পণ্যের প্রচারাণা চালিয়ে ব্যপক শব্দ দূষণ করা হচ্ছে। যদিও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে দেখা যায় না পরিবেশবিদদের। তবে, অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে ‘হকার মাইকিং’ খুবই বিরক্তিকর। দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরকারের যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের উচিত হবে রাজধানীর কোটি কোটি মানুষের বিরক্তি ও সুস্থতার কথা বিবেচনায় ‘হকার মাইকিং’ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ কর। তবে, অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে- কোনো অবস্থাতেই যেন হকারদের ব্যবসা বন্ধ বা তাদের আয়-রুজিতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। লেখক: সাংবাদিক আরটিভি/ ডিসিএনই
ভারতীয় গণমাধ্যমের ‘আকাশ-কুসুম’ অপপ্রচার
ঘোড়া উড়ে গেছে আকাশে, কুকুর ও ছাগল মানুষের মতই কথা বলছে কিংবা দৈত্য গিলে নিয়েছে আস্ত মানুষ - উক্তিগুলি যে রূপকথার গল্পের অংশ  তা শনাক্ত করতে হয়ত খুব বেশি সময় লাগবে না আপনাদের। তবে সেই একই রকম কথা যদি ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বলে তবে কি অবাক হবেন খুব বেশি?  না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারতের সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপি আগে থেকেই যথেষ্ট সমালোচিত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা কারণে হাস্যরসের খোরাক। কখনো দেখা গেছে সাংবাদিক কথা বলছেন রাজনৈতিক দলে কর্মী হয়ে, কখনো বা সংবাদ উপস্থাপনকে বানিয়ে ফেলেছেন টিভিসি বা সিরিয়াল নাটকের অংশ, কখনো আবার উপস্থাপক নিজেই  হয়ে যাচ্ছেন আলোচক, আবার আবেগে ঢলে পড়ছেন এদিক ওদিক। এ ধরণের কোন ধরণের আচরণই আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতায় গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু ভারত এদিক থেকে অনড়। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ধার ধারে না দেশটির গণমাধ্যমগুলো, যত যাই হউক তারা রূপকথার গল্পের ভিত্তিতেই করে যাবেন নিউজ রিপোর্ট। ইদানিং ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে তা সত্যিই অনবদ্য। প্রফেশনাল ফেরি টেলস রাইটার ছাড়া   এ ধরনের গল্প লেখা সত্যিই অসম্ভব প্রায়। হয়ত মানের দিক থেকে তারা গুছিঁয়ে আনতে পারছেন না পুরো গল্প বা রিপোর্টটি, তবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আপ্রাণ।  কিন্তু লক্ষ্যে অনেকটাই সফল দেশটির পোর্টালগুলো। ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদের নামে রূপকথার গল্প প্রচার করে পাচ্ছেন হাজার হাজার ‘হা হা রিয়্যাক্ট’। অর্থাৎ মূলধারার গণমাধ্যম হলেও তারা যে মানুষ হাসাতে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই তা বেশ পরিষ্কার। এসব সংবাদ পরিবেশনের ভিত্তিতে অনেক গবেষক বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে- ভারত, বিদ্বেষ বা ঘৃণা থেকে নয় বরং ভয় থেকেই করছে এ ধরনের প্রতিবেদন। কারণ দেশটির সাথে নানা কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। তার উপর আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে বাংলাদেশও খুব বেশি পরোয়া করছে না তাদের। যেটি ভারতের জন্য একটি ভীতির কারণ। তবে ভীতি থাকলেও নানা কারণে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করবে না। ফলে গণমাধ্যমগুলো এ ধরনের প্রচারণার মধ্য দিয়েই বহি:প্রকাশ করছে তাদের ভয়ের। যদিও ভারতীয় সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় সাংবাদিকতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাড়ছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যা প্রমাণ ও উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। তবে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (RSF) ২০২৩ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে। এই অবনমন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সাংবাদিকদের হুমকি, গ্রেপ্তার এবং আইনগত চাপের ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা পক্ষপাতভিত্তিক সাংবাদিকতার বাইরে চাইলেও যেতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ভারতীয় সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিবিসি এবং আলজাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর রিপোর্টে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যক্রম এবং বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন নিয়ে ভারতে সাংবাদিকতার ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম এবং ইন্টারনেটের যুগে ভুয়া খবরের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ভারতীয় মিডিয়া হাউসগুলোকে মাঝে মাঝে এই ভুয়া খবরের উৎস বা প্রচারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের সাংবাদিকতার প্রতি আস্থার অভাব তৈরি করেছে। ভারতের কিছু মিডিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোতে পক্ষপাতমূলক কভারেজ করে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। এটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে মিডিয়ার ভূমিকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। এমনকি ২০২৪ এর শেষভাগে এসে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই আচরণ প্রদর্শন করেছে তারা। লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট আরটিভি/ডিসিএনই  
বাংলাদেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে: মাহফুজ আনাম
ভারত আর বাংলাদেশ দুই অকৃত্রিম বন্ধুদেশ এ কথা আমরা শুনে আসছি, পড়ে আসছি। কিন্তু সেটা ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিকৃত বর্ণনা, ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলা ও দেশটির দায়িত্বশীল নেতাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এ বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের একটি লেখা পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মাহফুজ আনামের লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো- সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদগুলো দেখলে একটি ধারণাই পরিস্ফুটিত হয়, তা হলো—বাংলাদেশ একটি হিন্দুবিদ্বেষী দেশ। যেভাবে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেভাবে আমাদের অবমাননাকর ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় জনগণের মনে আমাদের প্রতি ঘৃণা তৈরির জন্যই এসব প্রচেষ্টা। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এবং একইসঙ্গে, বাংলাদেশেও যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তা দূর করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। এভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপন করে ভারত কী অর্জন করতে চাইছে? এটা উভয় দেশেরই ক্ষতি করছে। এখানে আমাদের ক্ষতি—বাংলাদেশের একটি বিরূপ ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে। আর ভারতের ক্ষতি—এ ঘটনায় আবারও প্রমাণ হচ্ছে যে তারা তাদের সব প্রতিবেশীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং কাউকেই নিজেদের নীতি গ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এসব নীতি ভারতের বিপক্ষে নয়, বরং আমাদের নিজের তৈরি পথে এগিয়ে চলার স্বতন্ত্র প্রকাশ। আমার নেপালি সাংবাদিক বন্ধুরা ভারতের মনোভাব ও ব্যবহার নিয়ে যেসব গল্প শোনান, সেগুলো ভারতের জন্য সম্মানজনক নয়। ভুটানের জনগণের মনেও ভারতের ভাবমূর্তি ভালো নয়। ভারতের সর্বশেষ সামরিক উপস্থিতিটুকুও দূর করার জন্য মালদ্বীপ যেভাবে সচেষ্ট, তা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়। শ্রীলঙ্কার নতুন নেতৃত্ব কী আমাদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশী দেশটিকে বিশেষ বার্তা দেয়নি? সব মিলিয়ে, ভারত সম্পর্কে প্রতিবেশীদের অভিন্ন মনোভাব কী প্রকাশ পায়নি? তারপরও সমালোচনামূলক মতামতকে গুরুত্বহীন, ভিত্তিহীন বা ঈর্ষা দ্বারা প্রভাবিত বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, কৃতজ্ঞতাহীন বলে বিবেচনা করা কতটুকু বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তার পরিবর্তে প্রতিবেশীদের আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অনুভব করা উচিত। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যম ও নেতাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ছিল অতি উত্তম প্রতিবেশী। তাদের মতে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাহলে কী এমন ঘটল যে বাংলাদেশ অতি উত্তম প্রতিবেশীর মর্যাদা থেকে অন্যতম নিন্দিত দেশে পরিণত হলো? তাদের চোখে আমাদের পতনের কারণ হচ্ছেন ৫ আগস্ট আমাদের সরকার পরিবর্তন। অথচ, এটি কোনো ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না। কিন্তু ভারত সরকার ও তাদের গণমাধ্যম সেটাই ভাবছে। তারা বিষয়টি মানতেই পারছে না যে এই সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মতে প্রতিফলন। তারা বিশ্বাস করে যে, এটি পাকিস্তান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কাজ—বাংলাদেশের জনগণের নয়। যে সত্যটি তারা মেনে নিতে পারছে না সেটা হলো, আমাদের আন্দোলন ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র একটি শক্তিশালী প্রকাশ, যা বহু বছর আগে ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন ঘটানো ‘পিপলস পাওয়ার’ আন্দোলন কিংবা মিশরের হোসনি মুবারককে উৎখাত করা ‘আরব বসন্ত’র চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের প্রতিবেশীর মন ও মননে দাগ কাটতে পারেনি। এ দেশের মানুষ কয়েক সপ্তাহে যা করে দেখিয়েছে তা করতে অন্যদের বছর না হলেও কয়েক মাস লেগেছে। এটাই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তি। ভারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শক্তিমত্তা অনুধাবন করতে পারেনি, কারণ আমাদের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো তারা অবগত নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরুদ্ধে আমাদের শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়িয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা জেনারেল আইয়ুবের 'ইস্পাত-কঠিন শাসনামল'র অবসান ঘটিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (১৯৬৬) ও ছাত্রদের ১১ দফাকে (১৯৬৯) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে পরিণত করেছিল। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের পেছনেও ছাত্ররাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল এবং বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে তুলতেও ছাত্র ও কৃষকভিত্তিক যুব সমাজ ছিল অগ্রভাগে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আমাদের ছাত্রদের গৌরবময় ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে। তারা মানবাধিকার ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং স্বৈরাচার, সামরিক শাসন ও সব ধরনের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। '৩৬ জুলাই'য়ে যা কিছু হয়েছে, তা সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা, এমনকি তারচেয়েও বেশি কিছু। এই আন্দোলন অনেক বেশি উদ্দীপনাপূর্ণ, শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে, যা এই আন্দোলনকে করে তুলেছে অনন্য। গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অধিকার যে আমাদের আছে, সেটা ভারত মানতে পারছে না। আমাদের দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়তো প্রচলিত ধারার নির্বাচনের মাধ্যমে হয়নি। বরং এটা ছিল 'জনতার ইচ্ছা'র বলিষ্ঠ প্রকাশ, যা সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন। যার ফলে আন্দোলনই ছিল একমাত্র পথ। মজার বিষয় হলো, তিনি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে পরাজিত হতেন, তাহলে অন্তত দেশে থেকে যেতে পারতেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার লজ্জার মুখে তাকে পড়তে হতো না। কাজেই সার্বিকভাবে আমাদের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ছিল গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ভারত প্রথম থেকেই এটা মেনে নেয়নি। উল্টো তারা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' তৈরি করেছে এবং আজ অবধি তারা সেই তত্ত্বই আঁকড়ে ধরে আছে। আমরা সবাই জানি, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান এবং তার সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের তিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে তৈরি হয় শূন্যতা। এ সময় আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হন। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, আক্রান্তদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন এবং তাদের অনেকে পতিত সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন (তার অর্থ এই নয় যে তাদের ওপর হামলা করা ঠিক হয়েছে)। কাজেই এই হামলার ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা বলা সম্পূর্ণভাবে উচিত না, যদিও সেটাই করা হচ্ছে। যদি পুলিশ বাহিনী তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বে থাকত, তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। যাইহোক, প্রথম কয়েক দিনের সেই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় সরকার ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নতুন নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও সঠিক মূল্যায়ন করার পরিবর্তে ভারতীয় গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল প্রতিবেদন প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। ভারতের প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমি অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন বাংলাদেশকে 'হাসিনার চোখে না দেখে গণতন্ত্রের চোখে দেখে'। দুঃখজনকভাবে তারা সে কথায় কর্ণপাত না করে একই ধারা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো একে অপরকে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং শেখ হাসিনার পতনকে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবিরের কাজ বলে আষাঢ়ে গল্প তৈরি করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আন্দোলন হয়তো শিক্ষার্থীরাই শুরু করেছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটাকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। এটা ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, যার টোপে আটকে গেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। যখন ভারতীয় গণমাধ্যমে 'হিন্দু হত্যা'র ন্যারেটিভ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সংগঠিত সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট সময়কালের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দুই হাজার ১০টি ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এসব ঘটনায় নয় জন নিহত, চারজন নারীকে ধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ৯১৫টি বাড়ি ও ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ৩৮টি শারীরিক হামলা ও ২১টি সম্পত্তি দখলের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাংলা পত্রিকা প্রথম আলো ৬৪ জেলায় ও ৬৯ উপজেলায় তাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের মাধ্যমে সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৬৮টি বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনায় হামলার প্রমাণ পায়। এ ছাড়া, ২২টি উপাসনালয়ে হামলার তথ্যও পায়। তাদের প্রতিবেদকরা এসব স্থানের মধ্যে ৫৪৬টিতে (৫১ শতাংশ) সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং বাকিগুলোর পরিস্থিতিও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে যাচাই করে। এসব ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন—একজন বাগেরহাটের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণাল কান্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অপরজন খুলনার পাইকগাছার স্বপন কুমার বিশ্বাস। সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা কি ভারতেরও বাস্তবতা নয়? গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলিম ও ২৫৪ জন হিন্দু নিহত হয়েছিলেন, হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন। এই তথ্য খোদ ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে ৩১টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২০টি ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। ভারতীয় গণমাধ্যম এখন যা করছে, তখন কি বাংলাদেশি গণমাধ্যম তেমন কিছু করেছিল? সাম্প্রতিক যেসব ঘটনার কারণে ভারতে বিক্ষোভকারীদের হাতে বাংলাদেশি পতাকা এবং আমাদের দেশে কয়েকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাতে ভারতের পতাকার অবমাননা হয়েছে; চট্টগ্রামে এক মুসলিম আইনজীবী ও ঢাকায় একজন হিন্দু চিকিৎসক হত্যার ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে সাবেক ইসকন নেতা গ্রেপ্তারের ঘটনা। আগরতলায় আমাদের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি নিন্দনীয় এবং এটি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল, প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। অপরদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য তাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক এবং এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এবং সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হয়ে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা এই পরিস্থিতিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যুদ্ধংদেহী ভারতীয় গণমাধ্যম সেগুলোকে যেভাবে প্রচার করেছে, তা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। কিন্তু আমাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে হতবাক করেছে তা হলো, তারা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের আগে তথ্যগুলো যাচাই করেনি। অথচ, এগুলো সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব। অনেক সাক্ষাৎকার ও টকশোতে অন্য কোনো অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ফুটেজ দেখিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি আরটি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে শিব মূর্তি ভাঙার একটি ফুটেজ দেখানো হয়। সেখানে দাবি করা হয়, ভিডিওটি বাংলাদেশ থেকে ধারণ করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি ভারতের বর্ধমানের সুলতানপুরের একটি মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফুটেজ। আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরলেও আরটি ইন্ডিয়া দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরে থাক, ভুল প্রতিবেদনটি সংশোধনও করেনি। এ ধরনের ঘটনা কমতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমের উত্তপ্ত ভাষাও হয়তো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে আসবে এবং নৈতিক মূল্যবোধের জায়গায় ফিরবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের সৃষ্টি করা এই বিকৃত বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদে বেদনাদায়ক অনুভূতি রেখে যাবে। অহংকারী ও যেকোনো মূল্যে বাড়তি ক্লিক পাওয়ার মানসিকতার কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম হয়তো এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করবে না, কিন্তু পেশাদার কূটনীতিকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
এ সমাজে পুরুষ কোথায়?
আমাদের জীবনটাই হয়ে গেছে দিবসময়। আজ এই দিবস তো কাল সেই দিবস। এরই মাঝে আজ চলে এসেছে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এত দিবস পালনের পক্ষে নই। কিন্তু আজ লিখতে হচ্ছে। গতকাল রাত থেকেই ইনবক্সে অনেকেই লিখেছেন, নারী দিবসে তো আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই কিন্তু পুরুষ দিবসে কেন আমাদের শুভেচ্চা জানাবেন না? এত এত মেসেজ দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেও অবাক হইনি।  একজন অভিনেত্রী হিসাবে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তারা আমার কাছ থেকে শুভেচ্ছা চেয়েছেন। আমি অবশ্যই নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে পৃথিবীর সব পুরুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। পাশাপাশি এ সমাজে পুরুষ কোথায়? এ প্রশ্নটাও তুলে রাখলাম।  কেননা আমার কাছে পুরুষ মানে পিতা, পুরুষ মানে স্বামী, পুরুষ মানে ভাই-বন্ধু-স্বজন। কিন্তু আজকের একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ সমাজে পুরুষ (মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন) কোথায়? তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।  এত বসন্ত পার করেও জীবনে চলার পথে পুরুষ দেখেছি, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল পুরুষ তেমনভাবে দেখিনি। আজকে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে আমার প্রত্যাশা থাকবে, পৃথিবীর সব নারীর প্রতি পুরুষের সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকুক। তাহলেই এই সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে যে দূরত্ব তা সরে যাবে। একটি সমতাভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশায় যেখানে নারী-পুরুষ সমধিকার নিয়ে চলতে পারবে।  উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর তারিখে পালিত হয়। সারা বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে লিঙ্গ ভিত্তিক সমতা, বালক ও পুরুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং পুরুষের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে। পুরুষ দিবস পালনের প্রস্তাব প্রথম করা হয় ১৯৯৪ সালে। তবে ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালন করা হতো রেড আর্মি অ্যান্ড নেভি ডে। এই দিনটি পালন করা হতো মূলত পুরুষদের বীরত্ব আর ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে। ২০০২ সালে দিবসটির নামকরণ করা হয় ‘ডিফেন্ডার অফ দ্য ফাদারল্যান্ড ডে’। রাশিয়া, ইউক্রেনসহ তখনকার সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এই দিবসটি পালন করা হতো। বলা যায়, নারী দিবসের অনুরূপভাবেই দিবসটি পালিত হয়। ষাটের দশক থেকেই পুরুষ দিবস পালনের জন্য লেখালেখি চলছে। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস নিজের লেখায় এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। নব্বই দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মাল্টায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ দিবস পালনের জন্য বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যদিও অনুষ্ঠানগুলো খুব একটা প্রচার পায়নি। অংশগ্রহণও ছিল কম। পরবর্তী সময়ে ১৯ নভেম্বর পুরো বিশ্বে পুরুষ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিশেষে বলতে চাই, আমার সোনার বাংলাদেশে সোনার পুরুষ হোক। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন পুরুষ থাকুক। নারীর প্রতি বিদ্বেষ, হিংসা না ছড়িয়ে নিজের পরিবারে যে নারী আছে, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন। তাহলেই এ সমাজে কোনো নারী পুরুষের লালসার শিকার হবে না। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। পুরুষের শক্তি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধেই নিহিত। জয় হোক সকলের। শুভ কামনা মানবিকবোধ সম্পন্ন পুরুষদের জন্য। লেখক: অভিনয়শিল্পী   আরটিভি/ডিসিএনই  
এক মহাজীবনের সান্নিধ্যে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত
দুই যুগ পেরিয়ে গেছে সাংবাদিকতার বয়স। এই লম্বা সময়ে মনে রাখার মতো প্রাপ্তি হলো কিছু মহাজীবনের সান্নিধ্য, যাদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। কখনো দখিন হাওয়া কখনো নুহাশপল্লী, হুমায়ুন স্যারের সঙ্গে বহুবার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছি একাধিকবার। পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও হুমায়ূন আহমেদের সম্মোহনী কথার আসরে হাজির থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, পছন্দও করতেন। মাত্র ৬৪ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা ক্ষণজন্মা এই মনীষির জন্মদিন আজ। হুমায়ূন আহমেদের ৭৬ তম জন্মদিনে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার  সঙ্গে কাটানো কিছু দুর্লভ মুহূর্ত স্মরণ করছি। ঠিক কবে কখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোন বইটি পড়েছিলাম মনে নেই। মনে আছে, বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখার কিছু টুকরো স্মৃতি। ১৫ দিন পর পর ধারাবাহিকটির একেকটি পর্ব প্রচার হতো। যেদিন বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখানো হবে, সেদিন আমাদের পরিবারে আগে থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি। খুব সম্ভবত রাত ৯টায় দেখানো হতো ধারাবাহিকটি। আগে ভাগেই সেদিন রাতের খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করে আমাদের ৬ সদস্যের পরিবারের সবাই বসতাম টিভি সেটের সামনে। মনে পড়ে নাটকটির টুনি চরিত্রের মৃত্যুর ঘটনাটি। মা-বাবা দুজনের চোখেই দেখেছিলাম জল। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছি। হঠাৎ কানে ভেসে উঠল ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। বইখাতা আর বাবার চোখ রাঙানি ভুলে দে ছুট। বিশাল মিছিল। মিছিলে লোকজন কেবল বাড়ছে। সবার সঙ্গে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিলাম ‘বাকের ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। তারপর কত নাটক আর কত উপন্যাস! কলেজ জীবনে পরিচয় হলো হিমুর সঙ্গে। ইচ্ছে হলো, আমিও হিমু হই। ওমা শুধু কী আমি, সহপাঠী অনেকের মধ্যেও দেখলাম হিমুর প্রচণ্ড প্রভাব। সাংবাদিকতা শুরু করি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায়, আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল ছিল অন্যদিন। এ পত্রিকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশ, যেখান থেকে হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে হুমায়ূনের তৃতীয় ছবি ‘দুই দুয়ারী’ নিয়ে একটি কভার স্টোরি তৈরির। সেটা ছিল ১৯৯৯ সাল। প্রথম সুযোগ হয় হুমায়ূন আহমেদের মুখোমুখি হওয়ার। প্রথমবার হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারে কেবল ‘দুই দুয়ারী’ আর নাটক-চলচ্চিত্র প্রসঙ্গেই কথাবার্তা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমি মুগ্ধ। যথাসময়ে কভার স্টোরি বের হলো। সময় এলো ‘দুই দুয়ারী’ মুক্তির।  ছবি মুক্তির ঠিক আগের দিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের রুমে আমার ডাক পড়ল। ভিতরে ঢুকে দেখি বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনিই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন, তোমার লেখা কাভার স্টোরি আমার পছন্দ হয়েছে। কাল তো ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তুমি এত সুন্দর একটা লেখা তৈরি করলে, ছবি মুক্তি পাবে আর তুমি দেখবে না, তা হয় না। পকেট থেকে দুইটা টিকিট বের করে দিলেন। মধুমতি সিনেমা হলের টিকিট। বললেন, বিয়ে করেছো? - জ্বি না, করিনি। - প্রেম করো? - আসলে সেইভাবে … - এই বয়সে প্রেম না করলে আর কবে করবে? একটা টিকিট তোমার জন্য আরেকটি টিকিট তোমার প্রিয় কারও জন্য। এই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর অনেক দিন পর হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সাক্ষাৎকার নিতে তার দখিন হাওয়ার বাসায় যাই। অ্যাপয়েনমেন্ট করা ছিল শাওনের সঙ্গে। ড্রয়িং রুমে বসে আছি। হুমায়ূন আহমেদ এলেন। আমি জানতে চাইলাম, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তুমি কী আমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নিতে আসছো? - জ্বি না স্যার… এমনিই… - তোমার নাম বিপুল হাসান। বিপুল মানে বিশাল। পৃথিবীতে এসেছো, নামকরণে স্বার্থকতা প্রমাণ করে যাবে, ঠিক আছে? কী আশ্চর্য, মাত্র একবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর থেকেই আমার মতো অভাজনকে তিনি মনে রেখেছিলেন। এরপর কতবার চাকরি বদল... অন্যদিন, ভোরের কাগজ, আনন্দ আলো, বাংলানিউজ। হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে কিংবা তার সৃষ্টি নিয়ে স্টোরি করার জন্য সময় চাইলে তিনি কখনও বিমুখ করেননি। এমনকি জানতেও চাননি কোন পত্রিকার জন্য কাজটি করছি। এমনও হয়েছে ধানমন্ডির দখিন হওয়া কিংবা গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেছি। কিন্তু হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আড্ডায় বসে তার সম্মোহনী কথোপকথনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভুলে গেছি কী কাজে সেখানে যাওয়া! একবার গেলাম নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ূন আহমেদ তখন সবেমাত্র ওষুধি গাছপালা চাষাবাদ শুরু করেছেন। দেখলাম গাছপালা নিয়ে তার ভীষণ উৎসাহ। আমাদের নিয়ে গেলেন তার সেই বাগানে। - এটা হলো উলট কম্বল। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এ গাছের ডালপালা বেটে রস দিয়ে শরবত খেলে মুহূর্তেই মামলা খালাস। - জ্বি, স্যার। - এখন পর্যন্ত ১৩৪টি গাছ লতাপাতা সংগ্রহ করেছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো বাগানে একসঙ্গে এত ওষধি গাছপালা নেই। হঠাৎ স্যার বলে ওঠলেন, ‘মানুষের চেয়ে গাছ অনেক বেশি ভাগ্যবান!’  মনে মনে বলি, এ কেমন কথা? গাছরা বেশি ভাগ্যবান হয় কী করে?  ব্যাখ্যা দিলেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। বললেন, ‘এটা টের পাবে প্রতি বসন্তে। দেখো, বছর বছর বসন্ত আসে। কৃষ্ণচূড়া লালফুলে ছেয়ে যায়, আমগাছে মুকুল আসে, গাছে গাছে নতুন করে কচিপাতা গজায়। এর মানে বসন্ত এলে বৃক্ষরা ফিরে পায় নতুন যৌবন। প্রতি বসন্তেই গাছপালা যৌবন ফিরে পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষের জীবন থেকে একবার যৌবন চলে গেলে আর ফিরে আসে না।’ সেদিন স্যারের এ কথা শোনার পর অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মনে আক্ষেপ, বৃথাই এ মানবজীবন। কেনো বৃক্ষ হয়ে পৃথিবীতে এলাম না।  নুহাশপল্লীতেই আরেকবার হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এমন এক যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি যে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতে হতো। বিশাল তার জ্ঞানের পরিধি। এটা সেটা নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর উঠলো ধর্মবিষয়ক কথাবার্তা। একপর্যায়ে স্যারের কাছে আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা স্যার, ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে তো পুরুষরা ৭০ জন হুর পাবে। নারীদের ক্ষেত্রে কী হবে? হুমায়ূন স্যার প্রথমেই কোরআন শরীফের একটা আয়াত পড়লেন। অবাক হলাম, কোরআনের আয়াত তার মুখস্ত দেখে। তারপর তিনি ব্যাখ্যায় এলেন। স্যার বললেন, পুনরুত্থানের পর তোমার স্বত্বা কী হবে, তা কী তুমি বলতে পারো? বেহেশতে যাওয়ার পর নারী বা পুরুষ স্বত্বা তুমি নাও পেতে পারো। ফেরেশতারা না নারী, না পুরুষ? তারা যেমন কোনো লিঙ্গের নয়। তোমার পরিণতিও তো তাই হতে পারে। আর হুররাও যে নারী বা পুরুষ হবে, তা নিশ্চিত হও কী করে। শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার মধ্যে তখন তীব্র সংঘাত। দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরির জন্য নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে সময় হুমায়ূন স্যারের এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনাকে যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলা হয় তাহলে কী করবেন? হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমি দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলব, আপনারা এক ঘণ্টার জন্য আমাকে সময় দেন। আমার নুহাশ পল্লীতে আপনারা একবার এসে এককাপ চা খান। তারপর জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখেন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। আমি নিশ্চিত এই অল্পসময়েই দুই নেত্রীর মধ্যে ভাব হয়ে যাবে। কারণ, তারা দুজনেই খুব ভালো মানুষ। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের দুই পরিবারেরই অবদান আছে। দুজনই দেশকে ভালোবাসেন। কিছু সময়ের জন্য তারা একসঙ্গে হলেই তাদের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যাবে। দুজন মিলে তখন দেশ গড়ার উদ্যোগ নেবে। তখন আর আমাদের দেশকে ঠেকায় কে। দেখবে ধেই ধেই করে বাংলাদেশ কোথায় চলে যাবে। অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ হুমায়ূন আহমেদ শুয়ে আছেন নুহাশ পল্লীতে লিচু গাছের নিচে মাটির বিছানায়। কিন্তু তার সংস্পর্শ পাওয়ার মুহূর্তগুলো এখনও ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভাসে। লেখক : উপপ্রধান বার্তা সম্পাদক, আরটিভি  
রক্ষক যখন ভক্ষক 
বাংলাদেশের পুজিবাজারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ হওয়া উচিত ছিলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার স্থান, সেখানে খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন অবৈধ বাণিজ্যের সাথে জড়িত খায়রুল বাশার এবং তার সহযোগী গংদের দিয়ে চলেছে সুরক্ষা।  গত ১১ নভেম্বর সোমবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে একটি দল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের উর্ধ্বতন কমকর্তাদের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এজিএম সাত্তিক আহমেদ বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলেন, যার ভিডিও আমাদের কাছে আছে। বিনিয়োগকারীরা স্পষ্টভাবে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানিয়ে আসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নিয়ন্ত্রক কমকর্তা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ, বজলুর রহমান (এজিএম), মোহাম্মদ ইকরাম (মনিটরিং ম্যানেজার), মো. জাকির (সিনিয়র এক্সকিউটিভ) এবং মো. আফজালুর রহমান (ইনভেস্টিগেশন এন্ড এনফোর্সমেন্ট, এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার) এই পুরো টিমটি পুঁজিবাজারের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।  তারা বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজ করছে, বর্তমান সিকুউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার মাকসুদের কমিশনের  বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা বিগত সরকারের সালমান এফ রহমান - শিবলী রুবাইয়াত (সাবেক চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সিকুউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন) এর পক্ষ হয়ে কাজ করছে। এই চক্রটি ২৫০ টি ব্রোকার হাউজের কাছে আতংকের নাম, এরা সাপ্তাহিক চাঁদা উত্তোলন করে প্রতিটি ব্রোকার হাউজ থেকে। যদি কোন ব্রোকার হাউজ চাঁদা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা তার বিরুদ্ধে আইনের তকমা দিয়ে হেনস্থা করে। বিগত সরকারের শেষ সময়ের চাঞ্চল্যকর তদন্তের নামে হয়রানির শিকার আভিভা ইকুউটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। সালমান এফ রহমান ৪০ কোটি টাকার মারজিন লোন নেয় তার কোম্পানির স্পনসর শেয়ার দিয়ে। এই টাকা এখন পর্যন্ত অনাদায়ী পাওনা হিসেবে পড়ে আছে। সালমান এফ রহমানের কাছে পাওনা টাকা ফেরতের জন্য তাগাদা দিলে উনি উনার খায়রুল বাশার গং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পেটুয়াবাহিনী লেলিয়ে হয়রানির নামে তদন্ত চালিয়ে যায়। সেই টাকা সালমান এফ রহমানের কাছে থেকে কোনভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং উনি সেই ক্রয়কৃত শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রেও বাধা দেয়। এ অবস্থায় আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বারংবার চাপ দেওয়া হলে সালমান-শিবলী ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তাদের পেটোয়া বাহিনী খায়রুল বাশার আবু তাহের এবং তার পালিত প্রভুভক্ত টিমকে লেলিয়ে দেয়। তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে চিরুনি অভিযানের নামে তদন্ত চালায়। শেষমেষ কোন অভিযোগ না পেয়ে জহিরুল হক জুয়েল (সাবেক কমকর্তা আভিভা ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লি:) এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে এখনো কড়া ভাষায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চিঠি পাঠাচ্ছে। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আইন বহির্ভুত। এই জহিরুল হক জুয়েল হলেন খায়রুল বাশার এবং বজলুর রহমানের খুবই বিশ্বস্ত সহচর এবং পুরানো বন্ধু। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই এই ব্রোকার হাউজের সম্মানহানির মাধ্যমে খায়রুল বাশার গং প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে।  অভিযোগ আছে, এই খায়রুল বাশার গং বাজারের মাফিয়া এবং গেম্বালারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। বাজারের যেসব বস্তাপচা বন্ধ কোম্পানি আছে সেগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উচ্চ মূল্যে পাবলিককে শেয়ার গছিয়ে দিচ্ছে এবং বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, এমারল্ড অয়েল কোম্পানি  বা লাভেলো কোম্পানির শেয়ার যখন উচ্চমুল্যে ছাড়া হয়, তখন এই খায়রুল বাশার গং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কোন আইনগত পদক্ষেপ নেয় নাই। তখন তারা নিরবতা পালন করে। কারণ এই গেম্বালারদের কাছ থেকে তারা মোটা অংকের টাকা পায়। আর যখন তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছাড়া কোন ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে নিজস্ব গতিতে বেচাকেনা হয় তখন তারা ইনকুয়েরি দিয়ে চিঠি পাঠায় কোম্পানিকে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের, ব্রোকার হাউজগুলোতে। এর মাধ্যমে তারা তাদের ভাগের টাকা আদায়ের চেষ্টা করে, নয়ত আইনের গ্যাড়াকলে ফেলে শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ করে দেয়। আফসোস, বিগত সরকারের এই জঞ্জাল এখনো কিভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভিতর চাকরি করে!  সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এই চিহ্নিত দুষ্ট চক্রের সকল অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের পরিমাণ জানতে চেয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করার। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর এই খায়রুল বাশার আমেরিকা পালানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সফল হয়নি। অভিযোগ আছে, বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার একজন ডিডি বা অফিসারের প্রভাব খাটিয়ে তার চাকরি বাঁচিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেও খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তার এবং তার সহযোগীদের পক্ষে সাফাই গাইছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠতেই পারে, আমরা কি আসলেই বিজয় আনতে পেরেছি? চোখের সামনে দেখছি, কিছু চাটার দল কোনো না কোনোভাবে দেশটাকে চেটে খাচ্ছে। লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং বিনিয়োগকারী আরটিভি/  ডিসিএনই
ত্রিমুখী সমস্যায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, শান্তির অন্বেষায় প্রয়োজন কঠোর সিদ্ধান্ত
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মটর সাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামুন (৩০) নামে এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।  এর প্রতিবাদে দীঘিনালা কলেজের ছেলেরা মিছিল করতে গেলে পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায় এবং বাজারের দোকান পাটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে স্থানীয় প্রসাশন এবং  সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা সংঘর্ষ নিরসনে চেষ্টা করেও নিবৃত করতে না পারায় এক পর্যায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইউপিডিএফ (মূল) এর কয়েকজন সদস্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের ভিতর থেকে গোলাগুলি শুরু করে। এতে সংঘর্ষের মাত্রা আরও বেড়ে যায়, যা ব্যাপক আকারে ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হয়ে খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটি জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।  এসব সংঘর্ষের ঘটনায় খাগড়াছড়িতে তিনজন এবং রাঙ্গামাটিতে  একজনের প্রাণহানি ঘটে। দেশের এই ক্রান্তিকালে এই ধরনের সংঘর্ষ কোনভাবেই কাম্য ছিল না। কারণ দেশে প্রচলিত আইন আছে, নিরাপত্তা বাহিনী আছে, অপরাধীদের বিচারের জন্য আদালত আছে, কিন্তু তারপরেও এক অদৃশ্য ইশারায় মাঝে মাঝেই পাহাড়ি বাঙালি জনগোষ্ঠির মধ্যে এ ধরনের সংঘর্ষ বাধিয়ে শান্তিপুর্ণ সহ-অবস্থানকে নস্যাৎ করতে কোন এক বিশেষ গোষ্ঠী সর্বদাই তৎপর।   সুপ্রিয় পাঠক, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটি দুই জেলাতেই আমার চাকুরী করার সুযোগ হয়েছে। ২০০৮ সালে খাগড়াছরির দীঘিনালা উপজেলার কাসালং ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে কোন একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ইন্ধনে দীঘিনালার বাগাইহাট এলাকায় পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে একই ধরনের সংঘর্ষ বাধে। পরবর্তিতে তা প্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে নিবৃত করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে কাপ্তাই এলাকায় জোন উপ অধিনায়ক এবং জোন কমান্ডার হিসেবে আমি প্রায় তিন বছর চাকরি করেছি। যদিও এই সময়ে তেমন কোন সমস্যা সংঘটিত হয় নাই। তবে পার্বত্য জেলার মৌলিক সমস্যা নিয়ে  আমার ভাবনা ওই সময়ে বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আসলে পাহাড়ের এই সংঘাত সংঘর্ষের সাথে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব জড়িত।  স্বাধীনতার পর থেকেই কিছু বিছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাইরের মদদে আমাদের তিন পার্বত্য জেলাকে অশান্ত করার চেষ্টা করে আসছিল, যার প্রেক্ষিতে আমাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ভৌগলিক অক্ষণ্ডতা রক্ষার্থে তিন পার্বত্য জেলার গভীরে ক্যাম্প করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে। এক সময়ে তিন পার্বত্য জেলার যোগাযোগ ব্যাবস্থা খুবই দুর্গম ছিল। তিন পার্বত্য জেলায় সমতলের জনগণের কোন সম্পৃক্ততাও তেমন ছিল না, ফলে ঐ অভয়ারন্যে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। দুর্গম পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প ছাড়া সমতলের কোন লোক বসবাস করতো না। এমনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, তৎকালীন সরকারের দুরদর্শী সিদ্ধান্তে পার্বত্য জেলার নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকার কিছু ভুমিহীন পরিবারকে পূনর্বাসন করা হয় এবং প্রত্যেক পরিবারকে চাষাবাদের জন্য ৫  একর করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।  বাঙালিদের এই পুনর্বাসন এবং ভূমি বরাদ্দের কারণে পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বাঙালিদেরকে উচ্ছেদের জন্য ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে থাকে যা একসময়ে ইন্সার্জেন্সিতে রুপ নেয়। পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর ব্যানারে এই সন্ত্রাসী গ্রুপের তখনকার নেতৃত্বে ছিল মি. জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সংক্ষেপে সন্তু লারমা। অতঃপর, ১৯৯৭ সালে, ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সাথে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়, এতে পার্বত্য জেলার শতভাগ বাঙালি এবং পাহাড়ি যে খুশি হয়েছিল তা বলা যাবে না। তবে তখনকার বাস্তবতার প্রেক্ষিতে চুক্তি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। কিন্তু চুক্তি পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও আন্দোলন হয়েছে। পাহাড়িদের মধ্যেও চুক্তি নিয়ে অনেক অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বরে শান্তিচুক্তির বিপক্ষ দল হিসাবে ইউনাইটেড পিপুল’স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রাথমিকভাবে ওই সংগঠনের কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত থাকলেও ২০০৭ সালের পরে তারা ব্যাপক চাঁদাবাজিসহ সশস্ত্র দল গঠন এবং এর শক্তি বৃদ্ধির কাজে লিপ্ত হয়।  সুত্রে জানা যায়, সমগ্র পার্বত্য জেলার ২০টি উপজেলায় তাদের সক্রিয় কার্যক্রম বিস্তৃত। উল্লেখ্য যে, ঐ শান্তি চুক্তিতে বেশ কিছু ক্লজ রয়েছে যা আমাদের সংবিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। যেমন ভূমি আইন। পাহাড়ে সমতলের বাঙালিরা কোন জমি কিনতে পারে না। এতে বলা হয়েছে পার্বত্য এলাকার ভূমির মালিক পাহাড়িরা। পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা বা ভূমি আইন সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। যার ফলে পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভূমির মালিকানা, কেনাবেচা ও দখল নিয়ে ব্যাপক জটিলতা রয়েছে। অনেক সময় বাঙালিদের সঙ্গে উপজাতিদের বা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভূমি নিয়ে হানাহানি ও সংঘাতের ঘটনা অহরহই ঘটছে । এসব জটিলতা নিরসনে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর ‘পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন’ করার কথা থাকলেও এখনও তা সম্পন্ন হয়নি বলে জানা গেছে। এই চুক্তির আলোকে পাহাড়িরা সকল খাস জমি অন্যান্য পাহাড়িদেরকে চাষাবাদের জন্য বরাদ্দ দিলেও বাঙালিদের বঞ্চিত করেছে। এমনকি যে জমি তারা পুর্বে বরাদ্দ পেয়েছিল, তাও চাষাবাদে বাধা প্রদান করছে। এতে পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হচ্ছে। পাহাড়িদের বক্তব্য, তিন পার্বত্য জেলা তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। কারণ আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষনের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর একটি রেজুলেশন পাশ করে, যার নম্বর ৬১/২৯৫। রেজুলেশনে মোট ৪৬টি অনুচ্ছেদ আছে যা দ্বারা আদিবাসিদের অধিকার সংরক্ষন করা হয়েছে। এর মধ্যে স্পর্শকাতর  কয়েকটি অনুচ্ছেদের বিবরন নিচে উল্লেখ করা হলো:  অনুচ্ছেদ-১। আদিবাসি জন-গোষ্ঠীর একক বা  সমষ্টিগতভাবে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে।  অনুচ্ছেদ-২। আদিবাসি জন-গোষ্ঠী একক বা  সমষ্টিগতভাবে মুক্ত এবং সম-অধিকারের নাগরিক। আদিবাসি পরিচয়ে তাদের অধিকারের বিষয়ে কোনো ধরনের বৈষম্য বিবেচিত হবে না। অনুচ্ছেদ-৩। আদিবাসি জন-গোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারনের  পূর্ণ অধিকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ-৪। আদিবাসি জন-গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীন/স্থানীয় বিষয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন বা নিজ-সরকার(Self-Government) পরিচালনার অধিকার আছে। অনুচ্ছেদ-৫। আদিবাসি জন-গোষ্ঠী তাদের আইনি ব্যবস্থাসহ সতন্ত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজস্ব অবকাঠামো তৈরী এবং উন্নয়নের অধিকার সংরক্ষন করে। তবে তারা চাইলে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারবে।   অনুচ্ছেদ-৬। প্রত্যেক আদিবাসী সংশ্লিষ্ট দেশের একজন নাগরিক।  অনুচ্ছেদ-৭। আদিবাসি প্রত্যেক জন-গোষ্ঠীর একক বা সমষ্টিগতভাবে শারীরিক ও মানষিক নিরাপত্তা বিধানসহ স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার আছে। তারা  স্বাধীন, শান্তিপ্রিয় এবং নিরাপদ। বিশেষ গ্রুপের জনগোষ্ঠী হওয়ায় কোনোভাবেই যেন তারা কোনো প্রকার গনহত্যা বা উচ্ছেদের মতো ঘটনার স্বীকার না হয় এবং কোনো প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে তাদের সন্তানদেরকে তাদের থেকে আলাদা করা না হয়।     অনুচ্ছেদ-৮। কোনো আদিবাসি জন-গোষ্ঠীকে জোরপূর্বক মূল ধারায় আত্বীকরণ করা বা তাদের আচার/সংস্কৃতি ধ্বংস হয় এমন কাজ করা যাবে না। সরকার কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে আদিবাসিদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিশ্চিত করবেঃ      ক) এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করা যাতে তাদের নিজস্ব উপজাতীয় পরিচয় ধ্বংস হতে পারে।   খ)  এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করা যাতে তাদের নিজস্ব ভূমি, এলাকা এবং সম্পদ বিনষ্ট হয়।   গ) কোনো গোষ্ঠীকে জোরপূর্বক স্থানান্তর না করা যাতে তাদের অধিকার ক্ষুন্ন হয় বলে মনে হতে পারে।   ঘ)  এমন মতবাদ প্রচার না করা যাতে তারা জাতিগত বৈষম্যের স্বীকার হয়।        অনুচ্ছেদ-৯। কোনো আদিবাসি দল বা ব্যক্তির যে কোনো আদিবাসি সমাজ বা জাতির অন্তর্ভক্ত হওয়ার অধিকার আছে যদি সে উক্ত সমাজ বা জাতির রীতি-নীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানকে অনুসরন করে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নাই।    অনুচ্ছেদ-১০। আদিবাসি জন-গোষ্ঠীকে জোরপূর্বক তাদের ভুমি বা এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। তাদের সম্মতিক্রমে এবং যথোপোযূক্ত ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষেই কেবল তাদেরকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা যাবে, তবে তারা চাইলে পূর্বের স্থানে পুনরায় ফিরে আসতে পারবে। অনুচ্ছেদ-১১। আদিবাসি জন-গোষ্ঠীর নিজস্ব প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান এবং সংস্কৃতিকে পালন এবং পুনর্জীবনের অধিকার আছে। তাছারা তারা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল প্রত্নতাত্তিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা, শিল্পকলা, আচার-অনুষ্ঠান, প্রযুক্তি, সাহিত্য-কলা ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নের পুর্ণ অধিকার সংরক্ষন করে। সরকার কার্যকর এমন পদ্বতি অনুসরন করবে যাতে অননু্মোদিত ভাবে উপজাতীয় সাংস্কৃতি, বুদ্ধিজীবি, ধর্মীয় ও আধ্যাতিক সম্পদের ক্ষতিসাধনের সকল চেষ্টা ব্যহত হয়। আরও অনেক ক্লজ রয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা হল না।     আদিবাসিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এধরনের নির্দেশনা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং এতে কারও কোন দ্বিমত নাই। তবে বাংলাদেশে যেহেতু কোন আদিবাসি নাই সেক্ষেত্রে উল্লেখিত রেজুলেশনের কোন অনুচ্ছেদই বাংলাদেশ তথা পার্বত্য জেলার জন্য প্রযোজ্য নয়।  বাংলাদেশের সার্বভৌম ভূখণ্ডের একাংশে বসবাসকারী ঐ পাহাড়ি জন-গোষ্ঠীরা কেবল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মাত্র, এ বিষয়ে ২০১২ সালের দিকে সংসদে একটি আইনও পাশ হয়েছে যেখানে তাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই পার্বত্য জেলা গুলোতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে কোনভাবেই আদিবাসি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন সুযোগ নাই।  তাছাড়া, পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসরত পাহাড়ীদের আদি নিবাস কখনোই বাংলাদেশে ছিল না। বরং তারা মঙ্গোলয়েড বংশোদ্ভুত এবং বার্মার আরাকান, ভারতের বিহার-মিজোরাম, থাইলান্ড এবং চায়না হতে আমাদের দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে। অন্য দিকে বাঙালিদের ইতিহাস হাজার বছরের। বাংলাদেশের আদি-নিবাসী বাঙালিরাই। ‘আদিবাসী’ মানে হোলো ‘ভুমি সন্তান’ (SON OF THE SOIL বা NATIVE)। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ABORIGINE’ OR ‘ABORIGINAL PEOPLE’। ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কতৃক সম্পাদিত  এবং বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত ইংলিশ-বাংলা অভিধানে ‘ ABORIGINAL, বলতে ঐ মানুষ এবং প্রানী গুলোকে বুঝিয়েছেন যারা আদিকাল থেকে একই স্থানে বসবাস করছেন এবং পরিচিতি পেয়েছেন।  ‘Webster’ New World Dictionary তেও একই বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে “The first people known to have lived in a certain place or region which was not under anybody’s control/possession are to be termed as aborigines or adivashis. আমরা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি, সামোয়ার দিকে তাকালে আসল আদিবাসী সম্পর্কে ধারনা আরো স্পষ্ট হবে। সেখানে বসবাসকারী সতন্ত্র জন-গোষ্ঠি যারা ভুমি সন্তান(Native) নামে পরিচিত, তারা কোনো অঞ্চল থেকে যেয়ে উক্ত এলাকায় বসতি স্থাপন করে নাই। তাদের সংস্কৃতি এবং আচারের উৎসও তাদের নিজস্ব।    অপরদিকে পার্বত্য এলাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতীয় গোষ্ঠীরা কেবল জীবিকার প্রয়োজনেই বিভিন্ন সময়ে এ এলাকায় আগমন করেছে। এসব উপজাতীদের সংস্কৃতি/আচারের উৎস এ অঞ্চলের নয়। প্রত্যেক গোষ্ঠির নিজস্ব সংস্কৃতি/আচারের উৎস তারা যে সব অঞ্চল থেকে এসেছে, সেখান থেকে আসা। তাই বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা গুলোতে বসবাসরত উপজাতীয় জন-গোষ্ঠীকে কেবল পাহাড়ী উপজাতি বলা যেতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তাদেরকে আদিবাসী বলা বা আদিবাসী হিসাবে গণ্য করা যাবে না। আমাদের  দেশে যে সকল উপজাতি আছে তাদের পার্বত্য জেলাগুলোতে আগমন হয় মূলত ১৬০০ হতে ১৯০০ খ্রিস্টব্দে। বর্তমানে পার্বত্য জেলাগুলোতে যে ১৩টি উপজাতির বসবাস করছে, তাদের প্রত্যেকের আদি-নিবাস এবং পার্বত্য জেলায় আগমনের তথ্য নিম্নরূপ: ক) মগ বা মার্মা জন-গোষ্ঠী ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আরাকান হতে বিতাড়িত হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের কক্সবাজার, পটুয়াখালী এবং পার্বত্য তিন জেলাতে আগমন করে।  খ) মুরং জন-গোষ্ঠী ১৮০০ সালের শেষের দিকে বার্মার আরাকান রাজ্যের খুমিস নামক একটি উপজাতি কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বান্দরবান জেলায় আগমন করে। গ) বার্মার আরাকানে বসবাসরত খুমিস জন-গোষ্ঠী আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টব্দে মুরং ও বোমাংদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল বান্দরবানের রুমা এবং থান্‌চি এলাকায় আগমন করে। ঘ) বোমাং বা বম  জন-গোষ্ঠী ১৮৩৮ হতে ১৮৩৯ খ্রিস্টব্দে বার্মা হতে এসে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলার দক্ষিনে বান্দরবান জেলায় বসতি স্থাপন করে।   ঙ। খিয়াং জন-গোষ্ঠী ১৮০০ খ্রিস্টব্দের প্রথম দিকে আরাকানের উমাতাং হিল হতে বার্মিস  কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলায় প্রবেশ করে।  চ) রাখাইন জন-গোষ্ঠী ২০০ বৎসর আগে বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে পটুয়াখালী, বরগুনা এবং কক্স-বাজার এলাকায় আগমন করে।   ছ) ত্রিপুরা জন-গোষ্ঠীর আদি নিবাস হলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। তারা মুলতঃ জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রথমে কুমিল্লা, সিলেট এবং চট্রগ্রামে বসতি স্থাপন করে।  জ) লুসাই জন-গোষ্ঠীর আদি নিবাস হলো ভারতের মিজোরাম প্রদেশে। তারা মুলতঃ মিজোরামের লুসাই পাহাড় হতে আনুমানিক ১৫০ বছর পুর্বে বাংলাদেশে আগমন করে।   ঝ) পাঙ্খু জন-গোষ্ঠীর আদি নিবাস ভারতের মিজোরামে। তারা লুসাই পাহাড়ের ‘পাঙ্খয়া’ নামক একটি গ্রাম বসবাস করত। পরবর্তিতে জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে তারা বাংলাদেশের পার্বত্য জেলায় আগমন করে।   ঞ) কুকি জন-গোষ্ঠীর আদি নিবাস ভারতের মনিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম এবং মিজোরামে।   ট। চাক জন-গোষ্ঠীর আদি নিবাস সুদূর চীনের উনান প্রদেশে। তারা প্রথমে আরাকানে  প্রবেশ  এবং পরে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলায় আগমন করে। যদিও এখনও আরাকানে তাদের বসতি আছে। ঠ) তংচংঞ্যা চাকমা জন-গোষ্ঠীর একটা অংশ। তারা বাংলাদেশের রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার এলাকা ছাড়াও ভারতের মিজোরাম এবং মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে বসবাস করে।  ড) চাকমা হলো তিব্বতীয়-বার্মিস বংশোদ্ভুত জন-গোষ্ঠি। এই উপজাতিও গোষ্ঠীর অতীত নিয়ে নানাধরনের কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। পৌরানিক গল্পে উল্লেখ আছে চাকমাদের আদি নিবাস ছিলো ‘চম্পোকনগর’বা ‘চম্পাপুরি’ নামে এক প্রাচীন সম্রাজ্যে। ভারতের ভিতরে এবং বাইরে এরকম পাচটি এলাকা আছে, যার নাম ‘চম্পোকনগর’। যার একটি উত্তর বার্মার ‘সান’এ, তিনটি ভারতের বিহার রাজ্যের ‘মাগাধা’, আসামের কালাবাগা’, এবং কোচীন’এ, অন্য একটি হোলো মালয়েশিয়ার মালাক্কা’তে। এক পৌরানিক কাহিনী মতে, চাকমা জন-গোষ্ঠিরা ‘বিজয়গিরি’ নামক এক কাল্পনিক যুবরাজ এর নেতৃত্বে ভারতের বিহার  রাজ্যের মাগাধা সম্রাজ্য হতে প্রথমে বার্মার আরাকান রাজ্যে আগমন করে। পরবর্তিতে বার্মার রাজকীয় শক্তি আরাকানে বসবাসরত চাকমা জন-গোষ্ঠীকে আক্রমন করলে তদানিন্তন বাংলার সুবেদার মানবিক বিবেচনায় তাদেরকে কর্নফুলী নদীর পূর্ব পাশে প্রথমবারের মত বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় এবং ভারতের মিজোরামে চাকমাদের বিস্তার ঘটে।  পাহাড়ের গভীরে বসবাসকারী সাধারন উপজাতিদের চাওয়া-পাওয়া কি, তা আমাদের সকলের জানা দরকার। আমি পার্বত্য এলাকায় অনেক  দিন থেকেছি। আর পার্বত্য এলাকার পাহাড়-পর্বতের সাথে, ওখানকার জন-গোষ্ঠীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে পাহাড়ি জন-গোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে আমি যেটুকু জানতে পেরেছি শুধু সেটুকুই আমি আজ আপনাদের জন্য উল্লেখ করছি।  এ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর পরে আছে মার্মারা। এই উপজাতিদের মধ্যে ৮০ শতাংশই বাস করে গভীর জঙ্গলে, যাদের জীবন/জীবিকার পুরটাই কৃষি নির্ভর। এদের কাছে জেএসএস, ইউপিডিএফ বা শান্তিচুক্তির কোন মূল্য নাই। তারা নেহায়েতই খেটে খাওয়া মানুষ। বাকী ২০ শতাংশ যারা শহরে বসবাস করে,‌ তারাই সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতি-শিক্ষিত কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ের গভীরে বসবাসকারী ঐ অনগ্রসর গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে সর্বদা ব্যস্ত। তারা অনগ্রসর গোষ্ঠীর দৈন্যতার কথা বলে দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভসহ বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে, যার সাথে খেটে খাওয়া ঐ সাধারণ পাহাড়িদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।  এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশের ভিতরের এবং বাহিরের ঐ বিশেষ চক্র বিভিন্ন ভাবে অপ-প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত  দুঃখজনক এবং দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি, দেশের ঐ বিশেষ চক্রের অপচেষ্টা দ্রুত বন্ধ করা। একই সাথে সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ‘আদিবাসি’ শব্দের সঠিক মানে বুঝে তার ব্যবহার করা উচিত। এজন্য আমাদের সকলকে বিশেষ করে সরকার এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকেই বেশি সচেতন এবং সতর্ক হতে হবে।  একই সাথে পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাধীন এবং  স্বতন্ত্র জাতি-সত্ত্বা যেন কোনভাবেই বিনষ্ট না হয় সেদিকে আমাদের সকলকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, তারা সমতলের অন্য সাধারন মানুষের মতই স্বাধীন এবং সার্বভৌম এই দেশের নাগরিক। তাই দেশের অন্যান্য স্থানের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে মিল রেখে ঐ অনগ্রসর জাতি গোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নেও আমাদেরকে সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। তবে গত ২০ বছরে পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যাবস্থার যে অভুতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তাতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। প্রচুর সংখ্যক সাধারণ পাহাড়িরা উন্নত লেখাপড়া শিখে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এখন কাজ করছে এবং আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। কিন্তু তারপরেও কিছু ভিন্ন মতের পাহাড়িরা দেশের এবং বাহিরের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মদদে পার্বত্য জেলা গুলিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। তাই এই বিষয়ে শান্তি প্রিয় পাহাড়ি জনগণেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।  পাঠক, উপরোল্লেখিত আলোচনায় এটা মনে হতে পারে, ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার কারণেই পাহাড়ি এবং বাঙালিদের মধ্যে বৈরীতা তৈরি হচ্ছে। তবে তৎকালীন সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের ফলে পাহাড়ে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলেও পাহাড়ি- বাঙালি জনগোষ্ঠীর বর্তমান আনুপাতিক উপস্থিতি পার্বত্য এলাকাকে যে স্থায়ী শান্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নির্বিধায় বলা যায়। এছাড়াও সরকার পাহাড়ীদেরকে বিশেষ কোটা ব্যাবস্তার মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করায় তাদের মেইন-স্ট্রিমে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগোম হচ্ছে।  তবে, ইদানিং কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের মদদে বান্দরবানের কুকিচীনসহ পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফ সদস্যদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এলাকা কিছুটা অশান্ত হয়ে উঠছে। ফলে সমতলে লুকিয়ে থাকা সুযোগ সন্ধানী গ্রুপ সরকারকে বিপদে ফেলতে সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সরকারের নীতি নির্ধারক মহলকে সতর্ক হতে হবে। এমনও হতে পারে, সব ভুলে সকল সন্ত্রাসী গ্রুপ আবার একত্রিত হয়ে ‘শান্তি বাহিনী’র মত স্বাধীন ‘ঝুমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুনরায় পার্বত্য জেলাগুলোকে অশান্ত করে তুলতে পারে। তাই এই সংকটময় পরিস্থিতি হতে উত্তরনের জন্য সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কুকিচীনসহ জেএসএস এবং ইউপিডিএফ এর শীর্ষ নেতৃত্বকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে হবে ঐ সকল স্থানীয় রাজনৈতিক দলকে যারা সশস্র সন্ত্রাসীদেরকে লালন করছে।     ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে, যেখানে ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে ম্যাস কিলিংয়ের কারণে নিষ্ক্রিয়প্রায় পুলিশ বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করাসহ সারা দেশের আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করার এই ঘৃণ্য প্রয়াস নিশ্চয়ই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পিছনে অবশ্যই পতিত ফ্যাসিষ্ট সরকারে দোসরদের মদদ দিচ্ছে। কারণ দেশের ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতন, প্রতিবেশী দেশে পলায়ন এবং প্রতিবেশী দেশের একটি রাজ্যে অস্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা মোটামুটি  নিশ্চিত যে, আমাদের তিন পার্বত্য জেলাগুলোকেও যদি অশান্ত করা যায়, তাতে বাংলাদেশের উপরে একটা চাপ সৃষ্টি করা যাবে। এতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে পূর্বের সকল অসম চুক্তি বাস্তবায়নে কিছুটা নমনীয় হবে, যা তাদের জন্য খুবই দরকারী। এমন চিন্তাকে উড়িয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং সেটাই হয়তো করার চেষ্টা চলছে। তাই এই মুহূর্তে বর্তমান সরকারকে খুবই কৌশলী এবং সতর্ক হতে হবে। অভ্যন্তরীন সমস্যার সমাধানে পার্বত্য জেলার সকল স্টেক-হোল্ডারেদেরকে নিয়ে বিশেষ গুরত্ব সহকারে এবং আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করে ফেলতে হবে। যদি এতেও সমাধান না হয়, তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করে ঐ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে সমূলে ধ্বংস করতে হবে । প্রয়োজন হলে চুক্তির স্পর্শকাতর বিষয়গুলোও পূণর্বিবেচনা করতে হবে। আর এভাবেই নিশ্চিত করতে হবে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, যা আপনার-আমার, আমাদের সকলের দায়িত্ব। অন্যথায় দেশকে শান্তি চুক্তির পূর্ববর্তী যে কোনো ভয়ানক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতে পারে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। তাই  আসুন আমরা সবাই একযোগে কাজ করি, নিশ্চিত করি সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা, আর রক্ষা করি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অখণ্ডতা।