• ঢাকা মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৬ ভাদ্র ১৪৩১
logo
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে যা বললেন মাহফুজ আনাম
হাসিনার ওপর থেকে পশ্চিমাদের সমর্থন গুঁড়িয়ে দেওয়া কে এই সাংবাদিক
গদি হারানো শেখ হাসিনা যখন দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর গলা টিপে ধরেছিল এবং তার অপশাসনের কোন প্রকার তথ্য পরিবেশন করতে দিচ্ছিল না তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে তৎকালীন ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী। জাতিসংঘ, হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দপ্তরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ, গণহত্যা ও অপশাসনের কথা তুলে ধরার মাধ্যমে সবসময়ই ফ্যাসিস্ট সরকারকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে রেখেছিলেন বাংলাদেশি এই সাংবাদিক। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নীতি নির্ধারণীতে যে কজন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের একজন মুশফিকুল ফজল আনসারী। বাংলাদেশে ডেপুটি অ্যম্বাসেডর হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ মুশফিকুল ফজল আনসারী সম্পর্কে এক টুইটে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সামনে বাংলাদেশের হুমকিসমূহ তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুশফিকুল ফজলের অনন্য ভূমিকা ইতিহাস মনে রাখবে। শেখ হাসিনা সরকারের যন্ত্রণার কারণ এই সাংবাদিক, বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভিতে কূটনৈতিকদের নিয়ে বিশেষ প্রোগ্রাম সঞ্চালনা করেছেন তিনি। এ ছাড়াও সংবাদ সংস্থা ইউ এন বি -তে বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ওয়ার্ক এক্সিপিরিয়েন্স রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছেন বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য টাইমস ও সানডে টাইমসে। এ ছাড়া বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন, এনডিটিভিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গণমানুষের হয়ে দিয়েছেন একাধিক সাক্ষাৎকার।  শুধু সাংবাদিকতাই নয়, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের তখনকার অবস্থা তুলে ধরে বক্তব্য রেখেছেন ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, জর্জ ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটন ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক, জাস্ট নিউজ বিডির সম্পাদক ও ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ফরেন পলিসি বিষয়ক ম্যাগাজিন সাউথ এশিয়া পার্পেক্টিভসের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ওয়াশিংটন থেকে কাজ করছেন।  গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য লড়ে যাওয়া এই সাংবাদিক এখন বহুল চর্চিত নাম। সাম্প্রতিক ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিটি ঘটনা জাতিসংঘের সদর দপ্তর, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউসে তুলে ধরার মাধ্যমে আন্দোলনের আসল চিত্র বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেন এই সাংবাদিক।  বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিকদের সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রেসক্লাবের দুটি কমিটির নির্বাহী সদস্য তিনি। হোয়াইট হাউস করেসপন্ডেটস এসোসিয়েশন এবং ইউএনসি’র সদস্য মুশফিক। বাংলাদেশের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যও ছিলেন তিনি। তবে পদলেহী সাংবাদিকদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান।  ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নানাভাবে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী ও তার পরিবারের সদস্যদের হেনস্থা করেছে। দীর্ঘ ৮ বছর  দেশে থাকা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি আলোচিত এই সাংবাদিক। সরকারের সৃষ্ট পার্সপোর্ট জটিলতার কারণে মুশফিকুল ফজল আনসারীর বাবা মাকেও ৮ বছর যাবত দুই দেশে থাকতে হয়েছে। বাবা লন্ডনে আর মাকে সিলেটে। এমন পরিস্থিতিতেও অসহনীয় নির্দয় আচরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, সুশাসন ও ন্যায় বিচারের কথা বলে গেছেন তিনি।  নানা অর্জনে ভূষিত এই সাংবাদিক, বাংলাদেশে না থেকেও দেশের গণতন্ত্র ন্যায় বিচার ও সুশাসনের জন্য যেভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, তা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকবে। লেখক: সুফিয়ান ফারাবী, গণমাধ্যমকর্মী।
এই গল্পটা শুনে যান প্লিজ
উপদেষ্টারা সাহস দেখান, দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করুন
প্রধান উপদেষ্টার হাতকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে যা লিখলেন মাহফুজ আনাম
ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল পেশাদারদের জন্য বিপ্লবোত্তর কর্মজীবন পরিকল্পনা
দেশ গঠনে যেভাবে তারুণ্যকে কাজে লাগানো যেতে পারে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চলমান এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত সব পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলো পরীক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ কীভাবে করা হবে, তা নিয়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করবে শিক্ষা বোর্ডগুলো। তবে এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।  দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ২৮ হাজার ২৮১ জন। এরমধ্যে ছাত্র সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬৮০ জন এবং ছাত্রী সংখ্যা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬০১ জন। যাদের বেশিরভাগ ১৮ ছুঁই ছুঁই। অনেক ইউরোপীয় দেশে, ১৮ বছর বয়সে পৌঁছালে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান করা বা জাতীয় পরিসেবা কাজে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের স্বল্প মেয়াদী জাতীয় পরিসেবা কাজে সুযোগ দিয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারে, যা পরবর্তীতে তরুণদের দেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাবে।  রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে দূর্নীতিমুক্ত করে প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং পরবর্তী সরকারের কাজ। আর এই জন্য দরকার সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ জনবল। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই যোগ্যতা আছে। তাদের হাতে থাকলে সব ঠিকঠাক হবে এবং চলবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রায় সকল সরকারী সেক্টর এখন সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। আর এই সঠিক তত্ত্বাবধান করার জন্য দরকার প্রচুর জনবল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এইচএসসি এবং অন্যান্য সাধারণ পরীক্ষার্থীদের স্বল্প মেয়াদী ও অনন্যা মেয়াদী পরিসরে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সুযোগের মাধ্যমে একজন সুনাগরিকের বিকাশে যা যা দরকার তা অর্জন হবে।  ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, আওয়ামী সরকার পতনের শুরু করে পরবর্তী দিনগুলোতে সাধারণ পরীক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, মন্দির পাহারা এবং রাতের ডাকাত পাহারায় নিজেদের কিভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে । বর্তমানের বন্যা দুর্যোগ , ত্রাণ এবং আগামীতে অনন্যা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এইসব এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং অনন্যা সাধারণ পরীক্ষার্থীদের জড়িত হওয়ার সুযোগ দিলে দারুণ একটা ফল পাব আমরা। আর এই অভিজ্ঞতাগুলো শুধু  একজন মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে না, বরং সমাজ এবং দেশের কল্যাণেও অবদান রাখবে। আমি মনে করি, এই জেন জি জেনারেশন তথা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদেরকে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বল্প ও বিভিন্ন মেয়াদী বাধ্যতামূলক পরিসেবা কাজে সুযোগের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ৩-৪ মাস ব্যাপী কর্মমূখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান হোক, যা বেশির ভাগ তরুণকে উদ্যোক্তা বা কর্মমূখী হতে সাহায্য করবে। এতে একদিকে যেমন বেকারত্ম কমবে,অন্য দিকে সমাজে নানা অনিয়ম চিরতরে দূর হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে আমাদের বেশি দিন সময় লাগবে না ।   লেখক : ফিনল্যান্ড প্রবাসী সাংবাদিক
ইলিশ কেলেঙ্কারি
‘স্যার, এইডা পদ্মার ইলিশ। খাইবেন আর আমার নাম নিবেন।’ এটা হলো খুচরা মাছ বিক্রেতার খুচরা ইতরামি। এই ধরণের ইতরামির সঙ্গে প্রায় সব ইলিশ-ক্রেতাই পরিচিত। অভ্যস্ত। বাঙালি বলতেই পদ্মার ইলিশের জন্য পাগল। ইলিশ সামুদ্রিক মাছ হলেও বঙ্গোপসাগরে পতিত প্রায় সব নদীতেই ইলিশ পাওয়া যায়। মূলত ডিম ছাড়ার জন্যই ইলিশ উজানের মিঠা পানিতে পাড়ি দেয়।  সেই মিঠা পানির ইলিশই স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু পদ্মার ইলিশ অতো সহজ কথা নয়। দেশের প্রাপ্ত মোট ইলিশের এক হাজার ভাগের এক ভাগও হয়তো পদ্মার ইলিশ হবে না। যাহোক, কথা হচ্ছিল ইলিশ নিয়ে ইতরামি প্রসঙ্গে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানের পর হঠাৎই চাউর হয়ে গেল, এবার বাজারে সস্তায় ইলিশ পাওয়া যাবে। সস্তায় ইলিশ প্রাপ্যতার যুক্তি দুইটা। এক. ইলিশ আর রপ্তানি হবে না। সব আমরাই খাবো। তাহলে বজারে যোগান বাড়বে। যোগান বাড়লে দাম কমবে। দুই. ঘাটে-পথে আর চাঁদাবাজি হবে না। ঘাটে থেকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে নানান ‘লীগ’ এবং পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো। ইলিশের দাম বাড়ার সেটাও একটা কারণ ছিল। এখন চাঁদা দিতে হচ্ছে না। সুতরাং দামও কম। আসলে কি তা-ই হলো? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে ইলিশ নিয়ে নতুন এক ইতরামির খবর জানাই। ইলিশের দাম কমেছে শুনে বাজার থেকে সরষে কিনে আনলাম। ‘সরষে-ইলিশ’ এখন শুধু পুস্তকে পাওয়া যায়। পুস্তকের রেসিপিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার এক কড়া অঙ্গীকার করলাম। বাজারে সস্তায় ইলিশ কিনতে যাবো- এমন প্রস্তুতির মুহূর্তে ফেসবুকে দেখি- ৬০% ছাড়ে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। চাঁদপুরের পদ্মার ইলিশ। একেবারে আড়ৎ থেকে ভিডিও করে ইলিশের সাইজ দেখানো হচ্ছে। একেকটা ইলিশের ওজন দুই কেজির ওপরে। দাম? সস্তার চেয়েও সস্তা! মাথা ঘুরে গেল। এই তো চেয়েছিলাম। আন্দোলনের ফল হাতেনাতে পাচ্ছি! ধমাধম অর্ডার করে ফেললাম। বিক্রেতা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালো- “স্যার, ইলিশ হাতে পেয়েই দাম পরিশোধ করবেন। শুধু বরফ এবং প্যাকিং বাবদ ৫৭০ টাকা এখন পাঠিয়ে দিন।” ভাবলাম, বলে কী ব্যাটা! এতো সস্তায় ইলিশ খাওয়াচ্ছিস, চাইলে তোর নামে বাড়ি-ঘর পর্যন্ত লিখে দিতে পারি! ৫৭০ টাকা পাঠিয়ে তাকিয়ে থাকলাম মোবাইলের দিকে। কখন ডেলিভারি ম্যান ফোন দিয়ে বলে- স্যার আপনার ইলিশগুলো রিসিভ করেন! দুইদিন গেল খবর নাই। বাধ্য হয়ে বিক্রেতাকে ফোন লাগালাম।  বিক্রেতা আগের চেয়েও বিনীত ভঙ্গিতে বলল- স্যার, কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলিভারি ম্যান আপনাকে ফোন দিবে! আমাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি ডেলিভারি ম্যান ফোন দিলো। ইলিশ নিয়ে ৩০ মিনিটের মাথায় আমার বাসায় আসছে বলে আমার মোবাইলে প্রেরিত ওটিপি জানতে চাইলো। আমার মোবাইলে তো কোনো ওটিপি নেই। আবার ফোন দিলাম বিক্রেতাকে। আমার তর সইছে না। এখনই ওটিপি চাই। বিক্রেতা আগের দুবারের চেয়েও বিনয় দেখালো। বলল- স্যার, এখনই আপনার মোবাইলে ওটিপি চলে যাবে। আপনি কিন্তু স্যার মাছগুলো ভালো করে চেক করবেন। যদি কোনো মাছ পছন্দ না হয়, অবশ্যই ফেরত পাঠাবেন। ভাবলাম, এই বিক্রেতাকে কাছে পেলে নিশ্চয় একটু চুমু দিয়ে দিতাম। পরক্ষণেই বিক্রেতা বলল- স্যার ওটিপি পাওয়ার জন্য আপনাকে মাত্র এক হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে। বাকি টাকা ডেলিভারি ম্যানের হাতে দিলেই হবে! এক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার হুঁশ ফিরলো। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল- গোলমাল হ্যায় ভাই গোলমাল হ্যায়! ফোনটা কেটে খোঁজ নেয়া শুরু করলাম। যে পেজ থেকে ইলিশের অর্ডার নেয়া হচ্ছিল, সেই পেজে গিয়ে দেখলাম- আমার মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা অসংখ্য। সবাই প্রতারিত। এভাবেই এক শ্রেণির ক্রিমিনাল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অজস্র টাকা। বাস্তবে কোনো ইলিশ পাঠাচ্ছে না।  এটাই এদের ইলিশ-ইতরামি। এবার আগের প্রসঙ্গে ফিরি। ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করলে স্থানীয় বাজারে তার কী প্রভাব পড়তে পারে? বছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিকটন। আর ভারতে সর্বশেষ ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল এক সিজনে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন। দূর্গাপূজা মাথায় রেখেই সাধারণত বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি করতো। এটাকে বাংলাশের ইলিশ-কূটনীতিও বলা যায়। চীন যেমন ‘পান্ডা-কূটনীতি’ চালায়। তাহলে পাঁচ-ছয় লাখ মেট্রিক টন থেকে চার হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি, খুব বেশি মনে হয় না।  তবে মনস্তাত্বিক একটা প্রভাব আছে। সে প্রভাবেই ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়।  অন্যদিকে পুলিশ এবং নানান জাতের লীগ যে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল, সেই ইতরামি যদি সত্যি সত্যি বন্ধ হয়, তাহলে ইলিশের দাম কিছুটা কমার কথা। শেষে আরেক ধরণের ইতরামির নমুনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে ওই সরকারের সুবিধাভোগী সুশীল সাইনবোর্ডের কিছু মানুষ খুব দাঁত কেলাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বলছেন- কই, ইলিশের দাম নাকি কমেছে? তোমাদের নতুন বিপ্লবী সরকার নাকি সস্তায় ইলিশ খাওয়াবে? কই? পারছে না তো! এই ইতরামির কারণ স্পষ্ট। তাদের গা জ্বলছে। বোঝাতে চাইছে- নতুন সরকার ইলিশের দাম যখন কমাতে পারলো না, তাহলে আগের সরকারই ভালো ছিল। ইতরামি কাহাকে বলে! সোহেল অটল: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক [email protected]  
দাবি-দাওয়ার যেন শেষ নেই
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি-দাওয়ার যেন শেষ নেই। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জানানো হচ্ছে নানা ধরনের দাবি। দাবি দাওয়া নিয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতর ও বাইরে ঘেরাও, অবস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচি চলছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কেও। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা প্রতিবাদ মুখোর হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, এতদিন তাদের এতো ক্ষোভ কোথায় ছিল? দীর্ঘ ১৬ বছর অসংখ্য অন্যায়, অনিয়ম, বঞ্চনা নিয়ে টু শব্দটি করেনি কেউ। কিন্তু দশ সহস্রাধিক হতাহতের রক্তের বিনিময়ে যখন দেশে পরিবর্তন এলো, তখন সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নানারকম দাবি-দাওয়া নিয়ে। সরকারকে স্থিতিশীল হওয়ার সময় পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না।  মেট্রো রেল চলার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হলে চাকরিতে যোগ দেবে না। একই অবস্থা রেল যোগাযোগেও। কর্মচারীদের দাবি দাওয়া পূরণ না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গভাবে রেল চলাচল চালু করা যাচ্ছে না। সচিবালয়ে ৯ দফা দাবি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবিগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে সোচ্চার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। এদিকে বিসিএস ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন। ওই স্মারক লিপিতে তারা ২০০২ সালের প্রণীত সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালার বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেন।  বেতন বৈষম্য রোধসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কয়েক দিন ধরেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ গ্রাম-পুলিশের সদস্যরা। পেনশন চালুকরণ, পদ সৃজন, পদোন্নতি, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি ও আউটসোর্সিং-ডেইলি বেসিসের চাকরি সরকারিকরণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অপরদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের রাজস্ব খাতের স্থায়ী কর্মকর্তারা পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এমন দাবি জানান। দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও বিসিএস খাদ্য (কারিগরি) ক্যাডার কর্মকর্তাগণ আভ্যন্তরীণ নানা ধরণের বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব বৈষম্য দূর করতে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন খাদ্য কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ‘ইউনিয়ন প্রকল্প’র জনবল রাজস্ব বাজেটের আওতায় আনার দাবি নিয়ে এসেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হলে আমাদের সমস্যা কেটে যাবে। সেজন্য আমরা অবস্থান নিয়েছি। মিরপুরে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদত্যাগ ও অনিয়মের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।  জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য অবসানের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিকস। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতারের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ বেতারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিজস্ব শিল্পী এবং কলাকুশলীরা। চাকরিতে পদোন্নতিবঞ্চনাসহ বিভিন্ন বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চুক্তিভিত্তিক কেবিন ক্রুরা। বাংলাদেশ বিমান কেবিন ক্রু ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অন্দোলনরতরা অনশন করেন। দাবি পূরণ না হলে কর্মবিরতির হুমকি দেন ক্রুরা। ফলে বিঘ্নিত হতে পারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ডমেস্টেক এবং ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের সময়সূচি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ বাস্তবায়ন, ফিল্ড পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদ আপগ্রেডেশনসহ নানা বিষয়ে সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজধানীর মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সামনে দাবি আদায়ে মানববন্ধন করেন তারা। দাবি দাওয়ার ভিড়ে প্রেসক্লাবের সামনে জায়গা না পেয়ে তৎকালীন বিডিআর থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যদের একটি দল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেন, বিদ্রোহের কোনো ঘটনার সঙ্গেই তাঁরা জড়িত ছিলেন না। বিনা কারণে তাঁদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি অন্য বাহিনীতে যোগ দিতে গেলেও তাঁদের বাদ দেওয়া হয়। এখন চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে তাঁরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেবেন। অটোরিকশা চালকরা সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, দৈনিক এক হাজার ২৫০ টাকা জমা দিতে হয় চালকদের। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দৈনিক জমা ৯০০ টাকা। মালিকরা ৩৫০ টাকা বেশি নেন। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত টাকা জমা নেবেন মালিকরা। মহাখালী রেলগেট সংলগ্ন বৃটিশ টোবাকো কর্মচারীরা বিক্ষোভ করছেন। তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে এই আন্দোলন চলছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের এই পদগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করে। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতি জাতীয়করণের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। অবস্থান নেয় বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি কর্মকর্তারা। তারা তাদের ব্যানারে তাদের চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত করে তোলে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ।  এক সারিতে বসা সাদা অ্যাপ্রোন পরা নার্সরা। তাদের দাবি বেতন বৈষম্য দূর করা। আবার এক পাশে দাঁড়িয়ে নীল রঙের নার্সরা দাবি তুলছেন, ভুয়া নার্স বাতিল করতে হবে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদার সমন্বয় কমিটি কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ ও দুনীতি বন্ধ করাসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই দাবি বাস্তবায়ন না হলে সড়ক ভবন ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেন। ইডকলের ১০৬ জন কর্মচারীর চাকরি পুনর্বহাল দাবিতে গতকাল কারওয়ান বাজারে মানববন্ধন করে। তারা অভিযোগ করেছে, গত মে মাসে কোনো ধরনের নোটিস ছাড়াই অন্যায়ভাবে নির্বাহী আদেশে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। নির্বাহী আদেশে তাদের চাকরি পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছে। শিক্ষা ভবনের অদূরে বিভিন্ন সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধনে দাঁড়ায় ডিপ্লোমা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বাংলামোটরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের সামনেও একটি দলকে দাবি আদায়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারওয়ান বাজারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সামনে সকালে একদল মানুষ অবস্থান নিয়ে নানা দাবিতে স্লোগান দেন। ঢাকার সাভারের আশুলিয়া ডিইপিজেডের পোশাক কারখানায় তাৎক্ষণিক চাকরির দাবিতে কয়েকদিন যাবত বিক্ষোভ করছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। জাতীয় গৃহায়ণে মাস্টার রুলে নিয়োগপ্রাপ্ত ওয়ার্কচার্জড কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য শিকার হওয়া কর্মচারিরা। গৃহায়ণ অধিদফতরের নিচে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়। এ সময় তারা চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন এবং জাতীয় গৃহায়ণের চেয়ারম্যান মো. হামিদুর রহমান রুম ঘেরাও করেন। এসব ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাদ প্রতিবাদের অভাব নেই। বলা হচ্ছে, সব সেক্টর একযোগে পরিকল্পিতভাবে বৈষম্য-বঞ্চনা নিয়ে বার্গেনিং শুরু করেছে। এটা মূলত অসহযোগিতা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র। সরকারি চাকরি কোন ট্রেড ইউনিয়ন নয়। তাদের দাবি দাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু সেই দাবির সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেয়া-না দেয়ার শর্ত থাকতে পারে না। অতীতে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো গঠিত হয়েছিল, সেই সব সরকারের প্রধান কাজ ছিল কেবলই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাষ্ট্র সংস্কার করার মহান দায়িত্ব এ সরকারের কাধে চাপানো হয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সাভাবিক রাখার পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্কার সহজ কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে সকল মহলের সার্বিক সহায়তাসহ সহানুভূতি থাকতে হবে। দাবি দাওয়া পূরণের আল্টিমেটাম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই। এর পরিবর্তে অরাজকতা সৃষ্টির যে কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবেই পরিগণিত হওয়া উচিত।   লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
তারেক মাসুদকে মনে পড়ে যায়
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ।  প্রথম তার গল্প শুনি বন্ধু নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মুখে, সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। ‘মুক্তির গান’ ছবিটি সম্পাদনার সময় সরয়ার কিছুদিন তারেক মাসুদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তখনও আমার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়নি। ওই সময় মগজে ছিল গ্রুপ থিয়েটার করে সমাজ বদলের ভাবনা। সরয়ারের মুখ থেকেই শুনি, ১৯৭১ সালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন মুক্তিযুদ্ধের ওপর ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। একদল শিল্পীর সঙ্গে তিনি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে প্রায় ২০ ঘন্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন।  পরে আর্থিক অনটনের কারণে সেটি তৈরি করতে পারেননি। দীর্ঘ ১৯ বছর ওই ফুটেজ তার নিউইয়র্কের বাসার বেসমেন্টে পড়ে ছিল। তারেক মাসুদ যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেলে সহপাঠী ক্যাথরিনের মাধ্যমে পরিচয় হয় লিয়ার লেভিনের সঙ্গে। ওই ফুটেজের কথা শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রাশ ফিল্ম হিসেবে ফেলে রাখা ফুটেজগুলো তারেক মাসুদকে দিয়ে দেন লেয়ার লেভিন। প্রেম করে বিয়ে করা ক্যাথরিনকে নিয়ে ওই ফুটেজগুলো ব্যবহার করে ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। ওইসব ফুটেজ সম্পাদনার কাজে কিছুদিন তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন আজকের আলোচিত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তার কাছ থেকেই শুনি, তারেক মাসুদ শৈশবে পড়াশোনা করেছেন মাদ্রাসাতে। আশ্চর্যের ঘটনা, লোকটার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠি। বছর দশেক পরে তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়। মুক্তির গানের পরে এরই মধ্যে তিনি নির্মাণ করে ফেলেছেন ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’ ও ‘অন্তর্যাত্রা’। বিকল্পধারার নির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন খেতাব। সাংবাদিকতায় আসার আট বছর পর ২০০৭ সালে এই মানুষটার মুখোমুখি হই। আমি তখন আনন্দ আলো পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ করি। কতো সেলিব্রিটির কতো ইন্টারভিউ-ই তো করেছি। এগুলো যে ‘থ্যাঙ্কস লেস জব’ ততোদিনে জেনে গেছি। তারেক মাসুদ ব্যতিক্রম। তিনি পত্রিকা অফিস থেকে আমার মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলেন এবং ফোন করে থ্যাঙ্কস জানালেন। ইন্টারভিউ এবং থ্যাঙ্কসের এই ঘটনার আরও পাঁচবছর পর গড়ে ওঠলো তারেক মাসুদের সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা। সেটাও একটা মজার ঘটনা। আমি ততোদিন মাধ্যম পরিবর্তন করে নিউ জার্নালিজম অনলাইনে চলে এসেছি। এই মাধ্যমটির সঙ্গে এদেশের মানুষের তখন সদ্য পরিচয়। তারেক মাসুদের শেষ চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’র প্রিমিয়ার শো হলো পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। ছবির প্রদর্শনীর পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান করা হলো। কয়েকজন বলার পর আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে বেশ হাততালি পড়েছিল, এটা মনে আছে। হাততালি রেশ কাটতেই স্টেজে দাঁড়ানো তারেক মাসুদ বললেন, অ্যাই তুমি দেখা করে যেও। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করলাম। তিনি বললেন, যোগাযোগ নাই কেন? নামটাও তো তোমার ভুলে গেছি। কই আছো এখন? দেখি কার্ড দাও। অনলাইনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি তখন তীব্র গতিশীল। কাজ করি বাংলানিউজে। শো শেষ করে অফিসে গেলাম। ‘রানওয়ে’ নিয়ে লেখাটা পোস্ট করে ইমেইলে তারেক ভাইকে লিংকটা পাঠিয়ে দিলাম। বাসায় ফিরলাম রাত ১ টায়। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারেক মাসুদের ফোনে ঘুম ভাঙলো। বললেন, এতো দ্রুত নিউজ করলে কীভাবে। হাই তুলে বললাম, সময়ের সংবাদ সময়ে। সেই থেকে তারেক ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। কখন কী করতেন, নিজেই ফোন করে জানাতেন। বলতেন নানা পরিকল্পনার কথা। একদিন ফোনে বললেন, দেশের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হল ভেঙে মার্কেট হচ্ছে। যদি চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হয়, সিনেমা হলকে বাঁচাতে হবে। এই নিয়ে একটা মুভমেন্ট শুরুর কথা ভাবছি। আমি বললাম, ওইসব সিনেমা হলে তো কমার্শিয়াল ফিল্ম চলে। আপনাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিকল্পধারার ছবি তো ওইসব হলে চালানো হয় না। তারেক ভাই বললেন, কমার্শিয়াল আর নন-কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কিছু নেই। এফডিসিতে অনেক ভালো ছবি হয়, অনেক ভালো ভালো নির্মাতাও আছে। আমাদের চেয়ে অনেক সুক্ষ কাজ তারা জানেন এবং করেন। তোমাদের চোখে সেগুলো পড়ছে না। ওদের মন্দটাই খালি লিখতে পারো। সিনেমা হলে টিকিট কেটে শেষ কবে ছবি দেখেছো, বলো তো আমাকে। থতমত খেয়ে গেলাম। এসব কী শুনি তারেক মাসুদের মুখে! আরও যারা জীবনঘণিষ্ঠ ছবির নির্মাতা হিসেবে নিজেদের দাবি করেন তারা তো এফডিসির নির্মাতাদের কাজকে 'অশ্ব ডিম্ব' বলে মনে করেন। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে বললে তারা নাক কুঁচকে মূলধারার পরিচালকদের গালিগালাজ করতে থাকেন। অথচ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি তারেক মাসুদের এতো উচ্চধারণা এতো সম্মান! তারেক মাসুদের ‘প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাও’ মুভমেন্ট সম্পর্কে আরও জানতে তার সঙ্গে টিএসসিতে দেখা করলাম। টিএসসির বাউন্ডারির পাশে দাঁড়িয়ে তারেক ভাই তার পরিকল্পনা বললেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি যাবেন, সিনেমা হলের মালিকদের সঙ্গে কথা বলবেন, দর্শকদের সঙ্গে কথা বলবেন। সারাদেশে সিনেমা হল রক্ষায় গণমত গড়ে তুলবেন। এলাকাভিত্তিক দর্শক ফোরাম গঠন করবেন। কথাবার্তা শেষে ফিরতে চাইলাম। তারেক ভাই ছাড়বেন না। কিছু খেয়ে যেতে হবে। চলো ডাসে চলো। আমার আরেকটা অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার তাড়া, কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। কিছু খেতেই হবে। শেষমেষ ১০০ গ্রাম বাদাম কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, খেতে খেতে চলে যাও। অ্যাসাইনমেন্টে দেরি করে যাওয়া ঠিক হবে না। তারেক মাসুদ ‘প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাও’ আন্দোলনে নেমে পড়লেন। ফোন দিয়ে বললেন, যশোহরের মনিহার সিনেমা হলে যাচ্ছি। যাবে নাকি? আমি বলি, এতো কাজের চাপ কী করে যাই! তবে সঙ্গে সঙ্গে করে ফেললাম নিউজ! অন্যরা পত্রিকায় নিউজ করার আগেই অনলাইনে নিউজ করি, ফেসবুকে ওইসব নিউজ লিংকে তারেক ভাইয়ের মুভমেন্টকে সমর্থন জানিয়ে লাইকের পর লাইক, শেয়ারের পর শেয়ার চলে। ওই নিউজই আবার কপিপেস্ট হয় পরদিন ছাপা হয় ছোটবড় নানা দৈনিকে। ঘন ঘন তারেক মাসুদের ফোন পাই, ময়মনসিংহ যাচ্ছি। চলো আমার সঙ্গে। ভালো লাগবে। ... হ্যালো বিপুল, খুলনা যাবো। সম্পাদককে বলে ছুটি নিয়ে নাও দুইদিন। খুলনার সিনেমা হলগুলো নিয়ে এক্সক্লুসিভ রিপোর্টও করতে পারবে। আরে চলো চলো। তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার কোথাও যাওয়া হয়নি। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, শেষযাত্রাতেও তিনি আমাকে সঙ্গী হতে বলেছিলেন। ওইসময়ের বাংলানিউজের অনেক কলিগই ঘটনাটা জানেন। হয়তো সেটা সবসময়ের মতো বলা তারেক ভাইয়ের কথার কথাই ছিল। তারেক মাসুদ তার নতুন প্রজেক্ট ‘কাগজের ফুল’ তৈরির পরিকল্পনার বিষয়ে আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন। এটাও জানান যে, শিগগিরই ছবিটি তৈরির কাজে হাত দিবেন। ২০১১ সালের ১২ আগস্ট অর্থাৎ সেই সর্বনাশা দূর্ঘটনার আগের রাতে তিনি ফোন দিয়ে বলেন, লোকেশন দেখতে যাবো কালকে সকালে। মানিকগঞ্জের বালিয়াজুড়ি। যাবে নাকি? একটা পুরনো জমিদার বাড়ি আছে। সেখানেও যাবো। চলো তোমার ভালো লাগবে। খুব ভোরে রওনা দেব, বিকেলের আগেই ফিরবো। তারেক মাসুদ আর ফিরেননি। তার শেষ যাত্রাতেও আমি সঙ্গী হতে পারিনি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ফোন দিয়েছিলেন, আমি তখন বাসায়। ‌‘কাগজের ফুল ছবির লোকেশন খুঁজতে মানিকগঞ্জে তারেক মাসুদ’, এরকম একটা হেডিংয়ে নিউজটা করে অফিসে মেইল করবো বলে পিসিতে গিয়ে বসলাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। পিসিতে বসে দেখি নেট নাই। বৃষ্টি-বাদলার সময় এই সমস্যটা হয়। নিউজটা করা হলো না। সকালে অফিসে গিয়ে করবো ঠিক করে বিছানায় গেলাম। আজি ঝর ঝর মুখরও বাঁদর দিনে.. শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলাম। একটু দেরিতে বিছানা থেকে ওঠা এবং দেরি করে অফিসে যাওয়া আমার দীর্ঘদিনের বাজে অভ্যাস। সেদিনের সকালটাও শুরু হলো ধীরগতিতে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে অফিসে ঢুকলাম। পিসি ওপেন করে কাজ শুরু করতে করতে পেরিয়ে গেল আরো ১৫ মিনিট। প্রথম নিউজটা লিখতে শুরু করলাম, নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর লোকেশন খুজঁতে হন্যে হয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটছেন তারেক মাসুদ। বিকল্পধারার জীবন ঘণিষ্ঠ চলচ্চিত্রে এই নির্মাতা অবশেষে মানিকগঞ্জের ঘাটাইলে...। এই পর্যন্তই। এক সহকর্মী ছুটে এসে বললেন, তারেক মাসুদ মানিকগঞ্জে এক্সিডেন্ট করেছেন! এটিএন নিউজে স্ক্রল দিচ্ছে। এটিএনের সিইও মিশুক মুনীরও তার সঙ্গে ছিলেন। দুজনই নাকি মারা গেছেন। ড্রাইভারসহ আরো বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। খোঁজ নেন খোঁজ নেন। প্রথমে ভাবলাম, রসিকতা... নাহ, মৃত্যু নিয়ে তো কেউ রসিকতা করে না। বোকার মতো প্রথমেই তারেক মাসুদের নম্বরে কল দিলাম। ফোন বন্ধ। কল দিলাম ক্যাথরিন মাসুদের নম্বরে। কয়েকবার রিং হলেও তিনি রিসিভ করলেন না। তারেক ভাইয়ের এসিস্টেন্ট মনীশ রফিকের নম্বরটাও ছিল আমার কাছে। একবার রিং হতেই তিনি ফোন ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বিপুল ভাই... সবশেষ সবশেষ। চোখের পানি মুছতে মুছতে আগের নিউজটা ডিলেট করে নতুন করে লিখলাম, ‘জীবনঘণিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোখা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক দুর্ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান....।’ তের বছর আগের ঘটনা। অনেক লম্বা সময়। তবুও তারেক মাসুদের প্রয়াণ দিনে প্রতিবারের মতো এবারও সেইসব ঘটনা ছায়াছবির মতো চোখে ভাসছে। লেখক : ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর/ অনলাইন ইনচার্জ, আরটিভি
সাংবাদিকদের ঐক্যের প্রয়োজনে এ মুহূর্তেই যা জরুরি
দেশের মিডিয়া সেক্টরে দালালি, প্রতিরোধ, পাল্টা দালালি আর পা চাটা গোলামদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে। সেই ফাঁকে শিক্ষার্থীরা এবার সাংবাদিকতাকেও সংস্কার করতে চায়! তারা চোখ রাঙানি, হুমকি ধমকি দিয়ে সাংবাদিকদের চাপে রাখতে চান- নিয়ন্ত্রণ করতে চান গণমাধ্যমকে। যারাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে বা ভাবে তাদেরই গণমাধ্যমকে আজ্ঞাবহ রাখতে বিকৃত শখ জাগে। এটা আগেও ছিল।  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কেউ কেউ রীতিমত অফিসিয়াল কায়দায় চিঠি পাঠিয়ে প্রেসক্লাব পুনর্গঠন, নেতৃত্বের রদবদল, আলোচনার জন্য সাংবাদিকদের ডেকে পাঠাচ্ছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও চিঠি পাঠিয়ে দালাল সাংবাদিকদের একটা তালিকা পাঠিয়েছে এবং তাদেরকে গণমাধ্যম জগতে নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছে।  এইতো সেদিন, ২৪ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের বিরামহীন আন্দোলনকালে আমরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছি প্রকাশ্যে। একের পর এক লেখা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের 'আমাদের সন্তান' আখ্যা দিয়ে তাদের নির্বিচার হত্যার করুণ বিবরণ তুলে ধরেছি। আরটিভি অনলাইনসহ অর্ধ শতাধিক পত্রিকা ও অনলাইনে সেসব লেখা প্রকাশ হয়েছে অবলীলায়। নিজের লেখা নিজে পাঠ করতে গিয়েও অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি, আবেগাপ্লুত হয়েছেন পাঠকরাও। বিজয় কেড়ে আনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি এখনও সেই ভালোবাসা অক্ষুন্ন রয়েছে, আছে অভিন্ন আবেগের টানও। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করবে, সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিবে এটা কেন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। কেন যেন তা কল্পনাতীত লাগছে। মেধাবী দাবিদার ছাত্রদের পাল্টা কিছু বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। শুধু বলবো- যাদের কাজ তাদেরই করতে দিন, গণমাধ্যম ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। নিরীহ সাংবাদিকদের অভিশাপ বেশ কঠিন, বড়ই নির্মম।  পেশাজীবি কয়েকজন অন্ধ দালালের কারণে গোটা গণমাধ্যম সেক্টরটি আজ প্রশ্নবিদ্ধ, আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তারপরও মনে রাখতে হবে দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত সৎ সাংবাদিকদের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক অত্যাচার, নিপীড়ন, হয়রানির শিকার, অবজ্ঞা অবহেলা তাদের নিত্যসঙ্গী। তাদের আপোসহীন মনোভাব, সততা, নিরপেক্ষতা সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই শ্রেণীর বাড়ি, গাড়ি, অর্থবিত্ত বলতে হয়তো উল্লেখ করার মতো কিছুই নেই, তবে ব্যক্তিত্ব আর পেশাদারিত্বের ইগো আছে চূড়ান্ত পর্যায়ের। পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে দলবাজ মুক্ত প্রকৃত সাংবাদিকরা কখনও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিকতায় কারো হস্তক্ষেপ চায় না।  দালালরা বরাবরই সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অতিউৎসাহী ছিল, তারা তা কার্যকরও করেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একটানা ১৬টি বছর যন্ত্রনাদগ্ধতার পর সম্ভাবনার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, ও অসান ঘটেছে একচ্ছত্র দাপটের। এখন দালালমুক্ত শ্রদ্ধাভাজনরা সাংবাদিকতার হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে প্রাণপণ লড়াই করবেন, পেশাদারিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মজবুত ভিত্তিও গড়ে তুলবেন। এক্ষেত্রে আমরা যদি আবার কোনো সরকার বা সরকার সমর্থিত কোনো গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ হয়ে উঠি, তাদেরই নিয়ন্ত্রণে সাংবাদিকতার নানা কাঠামো সংস্কার করতে চাই তাহলে কি দাঁড়ায়? এক গোষ্ঠীর দালাল হটিয়ে আমরা নিজেরাই আরেক গোষ্ঠীর দালাল হয়ে উঠছি না তো? আমাদের পেশায় কি সার্বজনীন শ্রদ্ধার কোনো ব্যক্তিত্ব নাই? এমন কোনো অভিভাবক কি নাই যার আহ্বানে মতভিন্নতা তুচ্ছ করে সবাই এক কাতারে দাঁড়াবে? তাহলে অন্যের সাহায্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থেকে আমাদের ফিরে আসাই ভালো। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের প্রেসক্লাবও দখল বেদখলের প্রতিযোগিতা শুরু হতে দেখলাম। এসব প্রেসক্লাবের সাবেক ব্যবস্থাপনার সবাইকে গড় হিসেবে দালাল আখ্যা দিয়ে বিতাড়িত করা হয় কিংবা তারা স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান। নতুন দখলে আসা সাংবাদিক বন্ধুরা আগের সবাইকে হটিয়ে শুধু নিজেদের সমমনাদের নিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি বানিয়েছেন। ফলে বেশ সংখ্যক সাংবাদিক কিন্তু প্রেসক্লাবের বাইরেই থেকে গেলেন। তাহলে তারা কি আরেকটি পালাবদলের অপেক্ষায় থাকবেন?  তার মানে দ্বন্দ্ব বিরোধ থেকেই গেল। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যদি দালাল হিসেবেই কিছু সাংবাদিক চিহ্নিত হয়ে থাকে তাদেরকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকেও হটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, দালালদের সাংবাদিকতায় থাকতে দেয়াটাই তো উচিত নয়। দালালি সাংবাদিকতার যুগেও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃত্ব, কর্মকান্ড ও সার্বিক পথচলা অনুকরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে কোনো গ্রুপিংয়ের ঠাঁই নেই। মূলত নির্বাচনকালে প্যানেলভুক্ত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব, সংঘাতময় সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। সর্বাগ্রে প্যানেলবাজীর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ করা উচিত। দলবাজির তো প্রশ্নই উঠে না। সাংবাদিকদের যা কিছু দরকার ১) সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি বিলুপ্ত করে প্রকৃত সাংবাদিকদের (যারা নিয়মিত গণমাধ্যমে কাজ করেন) তাদের সদস্য বানানো। বিএফইউজে, ডিইউজের উভয় অংশ ভেঙে দিয়ে একীভূত করে পূণরায় নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে তোলা।  ১. ক)    সাংবাদিক ইউনিয়নকে শুধু তাদের সদস্যদের জন্য নয়, দেশের সকল সাংবাদিকদের জন্য দায়িত্ববান হওয়া। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর দেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি সকল বিভাগে সুপারিশসহ প্রেরণ করা।  ১. খ ) একইভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবকে কেবলমাত্র পেশাদার সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে ঢেলে সাজানোসহ দেশের সকল প্রেসক্লাবের প্রতিনিধির সম্পৃক্ততা গড়ে তোলা। জাতীয় প্রেসক্লাব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত মিটিয়ে অভিন্ন প্রেসক্লাব গঠনের ব্যবস্থা করা। ২) সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে সকল সংবাদকর্মী হতাহত হয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।  ৩) বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, পিআইবি ও তথ্য কমিশন পুনর্গঠন করে সেখানে সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধি বাড়ানো। প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।   ৪) সাংবাদিক হত্যা মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা।  ৫) সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে ঢেলে সাজানোসহ হামলায় আহত, মামলা ধকলে পড়া ও হুমকির শিকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো।  ৬) সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ স্বাধীন সাংবাদিকতা পরিপন্থী সকল কালাকানুন জরুরিভাবে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া।  ৭) ডিএফপি, সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সরেজমিন পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সংবাদপত্রের প্রকৃত প্রচার সংখ্যা নিরুপণ, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, পেশাদারিত্ব বজায় রাখার বাধ্যতামূলক উদ্যোগ নেওয়া। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন
বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজটি সম্পন্ন করে ইতিহাসের পাতায় যিনি অমর হয়ে আছেন তিনি হলেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তাঁর জন্ম ১৮৩৪ মতান্তরে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক হলেন রাজা রামমোহন রায়। একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ‘নববিধান’ নামে এক সার্বজনীন ধর্মমত গঠন করেন। ‘নববিধান’ তত্ত্বের মূলকথা ছিল সমন্বয়ধর্ম বা ‘রিলিজিয়ন অফ হারমোনি’। গিরিশচন্দ্র সেন  ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ ব্রাহ্মসমাজের প্রচারকব্রত গ্রহণ করেন। কেশবচন্দ্র সেনই সেসময় গিরিশচন্দ্র সেনকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত গ্রন্থাবলী বাংলা ভাষায় অনুবাদের নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এ বিষয়ে গিরিশচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে বিস্তারিত তথ্যের অবতারণা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ‘আত্ম-জীবন’ (১৯০৭) বইটা পড়ে দেখতে পারেন।  অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’-এ লিখেছেন—‘কেশব সেন প্রমুখ চেয়েছিলেন সব ধর্মের একটা সমন্বয় করতে। এই সমন্বয়ের ধারণা থেকেই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে ভালো করে জানার জন্য তাদের মধ্যে একটা আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়। অবশেষে এই জানার আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য কেশব সেন উপর্যুক্ত চারটি ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বাংলায় ভাষান্তরের জন্য ব্রাহ্মভাইদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করেন। শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন— ১. ইসলাম ধর্ম : গিরিশচন্দ্র সেন ২. হিন্দু ধর্ম : গৌরগোবিন্দ রায়  ৩. বৌদ্ধ ধর্ম : অঘোরনাথ গুপ্ত  ৪. খ্রিস্টান ধর্ম : প্রতাপচন্দ্র মজুমদার।’ (পৃ. ১৫৪) এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমরা জানি, উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে ফারসি ভাষার নিগূঢ়তম সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শ’ বছর পর্যন্ত ফারসি ভাষাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। গিরিশচন্দ্র সেন পারিবারিক সূত্রে এই ফারসি ভাষা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার লাভ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব আলীবর্দি খানের আমল থেকেই গিরিশচন্দ্র সেনের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মুসলমান শাসন প্রণালী, ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামী ভাষা-সংস্কৃতির ছিল হৃদ্য ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁর পিতা এবং দাদা উভয়ই ছিলেন ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত। পাঁচ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্র সেনের হাতেখড়ি বাংলায় শুরু হলেও তাঁর প্রকৃত শিশুশিক্ষা শুরু হয় একজন মৌলবীর নিকট ফারসি ভাষা শেখার মধ্য দিয়ে। এরপর সাত বছর বয়সে উপনীত হলে গিরিশচন্দ্র সেনের পিতা মাধবরাম রায় যখন দেখলেন তাঁর পুত্র ফারসি বর্ণমালা বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করতে পেরেছে তখন তিনি শেখ সাদির ‘পন্দনামা’ বইখানা নিজ হাতে লিখে ছেলেকে তা পড়তে দেন।  উল্লেখ্য যে, গিরিশচন্দ্র সেনের পিতামহ, পিতা ও পিতৃব্য সকলেই ছিলেন সুলেখক (খোশনবিশ)। তৎকালীন সময়ে ফারসি ভাষায় তাঁদের স্বহস্তে লেখা অনেকগুলো বই ছিল। অতঃপর পিতার তত্ত্বাবধানে গিরিশচন্দ্র সেন ‘পন্দনামা’ ও ‘গুলিস্তাঁ’ পুস্তক পাঠ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নিজ গ্রাম পাঁচদোনার পার্শ্ববর্তী শানখলা গ্রামের পারস্য ভাষাভিজ্ঞ মুনশি কৃষ্ণচন্দ্র রায় যিনি বাঁকা কৃষ্ণরায় নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, তাঁর কাছে তিনি ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর কাছ থেকেই গিরিশচন্দ্র সেন— তওয়ারিখ জাহাঁগির, মাদনোজ্জওয়াহের, মহব্বতনামা, বহরদানেশ, সেকন্দরনামা, রোক্কাতে ইয়ার মোহম্মদ ইত্যাদি বড় বড় ফারসি বইয়ের পাঠ সমাপ্ত করেন। (‘আত্ম-জীবন’ পৃ.১-২; ৮-১০)  গিরিশচন্দ্র সেনের ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে এই নিবিড়-গভীর সম্পৃক্ততাই পরবর্তীতে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনকে অনুপ্রাণিত করেছিল পবিত্র কুরআন বাংলায় অনুবাদ করার কাজটি তাঁকে দিয়ে সম্পন্ন করাতে। সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত গিরিশচন্দ্র সেন এ পর্যায়ে পবিত্র কুরআন অনুবাদের লক্ষ্যে আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য প্রায় ৪২ বছর বয়সে লখনৌতে চলে যান। সেখানে গিয়ে বিখ্যাত মৌলবী এহসান আলীর কাছে আরবী ভাষা শেখা শুরু করেন। তিনি তাঁর কাছে প্রায় এক বছর আরবী ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজ অধ্যয়ন করেন। এরপর কলকাতার একজন মৌলবী ও ঢাকার নলগোলার মৌলবী আলিমুদ্দিনের কাছে তিনি আরবী সাহিত্য ও আরব ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেন। অতঃপর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র কুরআন অনুবাদের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৮৫ মতান্তরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তা শেষ করেন। প্রায় পাঁচ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ, মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন গিরিশচন্দ্র সেন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’-তে লিখেছেন— ‘ভাই গিরীশচন্দ্রের এই বাংলা তরজমার কয়েক খণ্ড প্রকাশ পাওয়ার পরই তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জনৈক মুসলিম তাঁকে কতল করার হুমকি দিয়েছিলেন। অপরাধ শুধু এই যে, বিধর্মী হয়ে তিনি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের তরজমা করেছিলেন। পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুসলমানই গিরীশ বাবুকে তাঁর এই বাংলা তরজমার জন্য অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কলকাতার আহমদুল্লাহ সাহেব এবং কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবী উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রবৃত্তিধারী জনাব আবদুল আলা ও আবদুল আযীয সাহেবান ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চে গিরীশ বাবুকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অভিনন্দন জানিয়ে ইংরেজিতে পত্র লিখেছিলেন। এই প্রশংসাপত্র সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং গিরীশচন্দ্রের অনূদিত কুরআন মজীদের প্রথম খণ্ডের শুরুতেও সংযোজিত হয়।’ (পৃ. ৫৭-৫৮) এখানে একটি কথা না বললেই নয়— একথা সত্য যে, গিরিশচন্দ্র সেনের আগে আরো কয়েকজন পবিত্র কুরআনের অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁরা কেউই পুরো কুরআনের অনুবাদ করেননি। এ কারণে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই পবিত্র কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরতরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা কয়েকজন মুসলিম মনীষীর রচনায় এবং তাঁদের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন সম্পর্কে আলোকপাত করতে চেষ্টা করবো। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী (রহ.) (১৯০০-১৯৭২) তাঁর ‘বাংলা ভাষায় কুরআন পাকের অনুবাদ ও তফসীর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—   ‘তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ নিবাসী দেওয়ান মাধব রায় সেনের পুত্র এবং নববিধান ব্রাহ্ম-সমাজের প্রবর্তক আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের শিষ্য ছিলেন। তিনিই প্রথম পাদটীকাসহ তিন খণ্ডে কুরআন পাকের পূর্ণাঙ্গ ও গদ্যানুবাদ প্রকাশ করেন। ঢাকায় তিনি শাহ আবদুল কাদের দেহলভীর ‘মুবিহুল কুরআন’ ও তাফসীর হোসাইনীর অনুসরণ করেন। ইহার প্রথম সংস্করণ ১৮৮১-১৮৮৫ সালের মধ্যে এবং ৪র্থ সংস্করণ মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর ভূমিকাসহ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়।  অনুবাদের নমুনা ‘দাতা দয়ালু ঈশ্বরের নামে— প্রবৃত্ত হইতেছি। বিশ্বপালক পরমেশ্বরেরই সম্যক প্রশংসা। তিনি দাতা ও দয়ালু। বিচার-দিনের অধিপতি।  আমরা তোমাকেই মাত্র অর্চনা করিতেছি এবং তোমার নিকট মাত্র সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি।  তুমি আমাদিগকে সরল পথ প্রদর্শন কর— যাহাদিগের প্রতি তোমার আক্রোশ হইয়াছে এবং যাহারা পথভ্রান্ত, তাহাদের পথ নয়; যাহাদের প্রতি তুমি কৃপা করিয়াছ তাহাদের পথ (প্রদর্শন কর)।’ (ই.ফা.বা. প্রকাশিত মওলানা নূর মুহাম্মদ আজমীর রচনাবলী, পৃ. ২৪৮-২৪৯)  শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) ‘ভাই গিরীশচন্দ্র সেন’ (১৯৬৪) নামে সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনার মাধ্যমে তাঁর প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন— ‘এমন একজন সাধু পুরুষ ছিলেন ভাই গিরীশচন্দ্র সেন। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থাদি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পাঠ করে কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা তর্জমা করেন; হযরত ইব্রাহীম, মূসা, দাউদ এবং মুহম্মদ (সঃ)-এর বিস্তৃত জীবন বৃত্তান্ত লিখে প্রচার করেন; হাদীশ মেশকাতুল মসাবীহ-এর বঙ্গানুবাদ ৪ খণ্ডে সম্পন্ন করেন; সুবিখ্যাত ‘তাপস-মালা’ গ্রন্থ রচনা করেন এবং মুসলিম ঐতিহ্যবাহী আরও কয়েকখানা পুস্তক প্রণয়ন করেন। সুখের বিষয়, তিনি একখানা অতি অকপট আত্ম-জীবনী লিখে গেছেন, যার থেকে তৎকালীন সমাজের একটা জাজ্বল্যমান চিত্র পাওয়া যায় এবং তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার ও নির্যাতন-বরণের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। মোটকথা, তিনি এমন একজন বিনয়ী স্পষ্টবাদী, সমর্পিত-চিত্ত ভক্ত ছিলেন, যাঁর জীবন-চরিত আলোচনা করলেও লাভবান হওয়া যায়— দুর্বল চিত্তে বল-সঞ্চয় হয়। তাই আজ যখন হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে জাতীয় পুনর্গঠনের আয়োজন চলছে, তখন চরিত্র, সাধনা ও শুভবুদ্ধি দ্বারা যিনি নিজে ব্রাহ্ম হ’য়েও মুসলিম ধর্মের আলোচনায় বিশেষ কীর্তি রেখে গেছেন, সেই বিরাট কর্মী মৌলবী গিরীশচন্দ্র সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা বিশেষ সময়োপযোগী হবে। এতে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিমের বর্তমান প্রশংসনীয় সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে পারে।’ (ই.ফা.বা. প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল, ১৯৮০)  ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮) তাঁর ‘বাতায়ন’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘রাজসিংহ, পলাশীর যুদ্ধ প্রভৃতি বই পড়ার পর গিরীশ সেনের তাপস-মালা পড়ে মুগ্ধ চিত্তে ভাবলাম, তাহলে আমাদের ভাল জিনিসের কদর করার লোকও অন্য সমাজে আছে। এই উদার ধার্মিক বিদ্বানের প্রভাব নিঃসন্দেহ রকমে আমার উপর পড়ে ছিল। পরে তাঁর কুরআনের বঙ্গানুবাদ পড়ি। বাংলা ভাষায় তিনিই সকলের আগে ঐ অনুবাদ করেন। ধর্ম জিজ্ঞাসা ছিল তাঁর অন্তরের অন্তরতম আকাঙ্ক্ষা। সেই পরম জিজ্ঞাসার মহান তাকীদে তিনি একান্ত যত্নে, একান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ইছলাম সম্বন্ধে অধ্যয়ন ও আলোচনা করেন। কুরআন শরীফ ছাড়া তিনি মেশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ (৪র্থ খণ্ড) হযরত মুহম্মদ (দঃ), হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুছা, হযরত দাউদ— এঁদের জীবন-চরিত, দেওয়ান হাফিজের বঙ্গানুবাদ, চারজন ধর্মনেতা প্রভৃতি পঁচিশখানা বই রচনা করেন। আজ পর্যন্ত বাংলার কোন মুছলিম লেখকও অতগুলি বিষয়ে অতগুলি বই লিখেছেন বলে আমার জানা নাই। ঢাকা জিলায় পাঁচদোনা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তিনি বাংলা, সংস্কৃত, আরবী ও ফারসীতে মস্ত পণ্ডিত ছিলেন।’ (পৃ. ২৮০, বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, জুলাই, ১৯৬৭) উনবিংশ শতকের শেষ দিকে মুসলিম পুনর্জাগরণে যে ক’জন মনীষী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন (১৮৭০-১৯৩৭) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেকালের খ্রিস্টান মিশনারীদের সংস্পর্শে এসে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে, অবিভক্ত বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতের একজন অবিসংবাদিত সিংহপুরুষ, ইসলাম প্রচারক ও তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক মুনশী মেহেরুল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭) সঙ্গে ধর্ম সংক্রান্ত বাদানুবাদে লিপ্ত হয়ে আবার তিনি ইসলাম ধর্মের আশ্রয়ে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্ম প্রচার ও রক্ষা কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন।   ১৩০৮ বঙ্গাব্দ, ‘ইসলাম প্রচারক’ পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়, শেখ জমিরুদ্দীন ‘শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী’ নামে পরিচিতিমূলক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনী আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন— ‘ইসলাম প্রচারকের’ পাঠকবর্গ মনে করিতে পারেন যে, ইসলামী কাগজে ব্রাহ্মের জীবনী কেন? বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের ইতিহাসের সহিত গিরিশবাবুর জীবনীর বিশেষ সম্বন্ধ আছে বলিয়াই, আজ ইসলাম প্রচারকে তাঁহার জীবনীর প্রচার হইল। বঙ্গদেশে খ্রিষ্টান মিশনারীরা অনেকদিন হইতে তাঁহাদিগের ধর্ম্মপ্রচার করিয়া আসিতেছিলেন ও কত শত মুসলমান যুবককে খৃষ্টানীর দিকে টানিতেছিলেন; কিন্তু যেদিন বঙ্গীয় মুসলমান যুবক “গিরিশবাবুর বঙ্গানুবাদিত কোরাণ শরিফ” ও “হজরতের জীবনী” হস্তে পাইয়াছেন, সেইদিন হইতেই তাঁহার স্বধর্ম্মের দিকে টান পড়িয়াছে। আর খৃষ্টান, হিন্দু ও ব্রাহ্ম ইসলামের মাহাত্ম্য বুঝিতে পারিয়াছেন।’ (পৃ. ১৮৭)  ধ্বনিবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) এবং খ্যাতনামা সাহিত্যিক, কবি ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান (১৯২০-২০০২) “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে লিখেছেন— ‘ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে নববিধানের প্রবর্তনকারী ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন তাঁর কয়েকজন অনুবর্তীকে বিভিন্ন আলোচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে গিরিশচন্দ্র সেন এবং গৌরগোবিন্দ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। গিরিশচন্দ্র ইসলামের সাধনা ও সংস্কৃতির আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ঢাকা জেলার পাঁচদোনা গ্রামে ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন এবং পরিণত বয়সে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান। গিরিশচন্দ্রই সর্বপ্রথম কোরআন শরীফের সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ (১৮৮১-৮৬) এবং মিশকাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন।’ (পৃ. ১১০) লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭) তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’-তে গিরিশচন্দ্র সেন সম্পর্কে লিখেছেন— ‘১৮৮১-৮৬ সালে কোরান-শরীফের সম্পূর্ণ অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করেন। ইহাই প্রথম কোরান-শরীফের পূর্ণ বঙ্গানুবাদ। এই অনুবাদে বিখ্যাত তফসীর গ্রন্থসমূহ হইতে প্রভূত সাহায্য গ্রহণ করেন এবং টীকা-টিপ্পনী রচনা করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত বহু গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন মূল আরবী ও ফার্সি ভাষা হইতে। তাঁহার ‘হাদিস’ গ্রন্থখানাও বিখ্যাত। ইহা ‘মেশকাতুল মসাবিহ’ নামক বিখ্যাত আরবী হাদিস গ্রন্থের সংকলন। তিনি সর্বপ্রথম মেশকাতের পূর্ণ বাংলা অনুবাদ রচনা ও প্রকাশ করেন।’ (পৃ. ৪৩৩, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল, ২০০৪) প্রাবন্ধিক, ছন্দবিশারদ ও কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) ‘কুরআন মজীদের বাংলা অনুবাদ’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘গিরীশ বাবু তাঁর এই অনুবাদ কার্য শুরু করেন ১৮৮১ সালে এবং সমাপ্ত করেন ১৮৮৬ সালে। প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ কুরআনের তরজমাকরণ, মুদ্রণ, প্রকাশনা— সবকিছুই সমাপ্ত হয়ে যায়।’ (ইসলামী একাডেমী পত্রিকা, এপ্রিল-জুন সংখ্যা, ১৯৬১) গিরিশচন্দ্র সেন মাসিক ‘মহিলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রায় ১২ বছর সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদনায় এটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩০২ বঙ্গাব্দে। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) প্রথম দিককার অনেক লেখা এই ‘মহিলা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বেগম রোকেয়ার ভাই হাফেজ খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের-এর পৌত্রী অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার একজন উত্তরসূরি বিশিষ্ট লেখিকা ও শিক্ষাবিদ ‘মাজেদা সাবের’ তাঁর “ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়ী” গ্রন্থে লিখেছেন— ‘রোকেয়ার দ্বিতীয় রচনা— “অলঙ্কার না Badge of Slaver” ১৩১০ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে তিন কিস্তিতে ‘মহিলা’য় প্রকাশিত হয়। “অলঙ্কার না Badge of Slaver” ছাপা হবার পরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে গিরিশচন্দ্র তাকে সমাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।’ তিনি আরো লিখেছেন— ‘মহিলা পত্রিকা সম্বন্ধে রোকেয়া মন্তব্য করেছেন, আমারও মনে হয় ‘মহিলা’ যেন আমাদেরই কাগজ।’ (পৃ. ১১১) বেগম রোকেয়ার সাথে গিরিশচন্দ্র সেনের পত্র যোগাযোগ ছিল। বেগম রোকেয়ার প্রতি গিরিশচন্দ্র সেনের মমত্ববোধ কত গভীর ছিল তা তাঁর “আত্ম-জীবন”-এর এই লেখা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়— ‘মোসলমানদের প্রতিভাশালিনী বিদূষী কন্যা মতিচূর পুস্তকের রচয়িত্রী শ্রীমতী আর. এস. হোসেন মৎকর্ত্তৃক অনুবাদিত ধর্ম্মসাধন নীতিপুস্তকের সমালোচনায় আমাকে “মোসলমান ব্রাহ্ম” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি আকৃতি প্রকৃতি ভোজ্য পরিচ্ছেদ আচার ব্যবহারাদি দেখিয়া আমাকে মোসলমান ব্রাহ্ম বলেন নাই, আমি মোসলমান জাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিয়া থাকি তজ্জন্য সেরূপ বলিয়াছেন, ইহা নিশ্চিত। তাঁহার সঙ্গে আমার মাতৃ-পুত্র সম্বন্ধ স্থাপিত। সেই মনস্বিনী মহিলা উক্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচয় নিজেই প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি আমাকে পত্রাদি লিখিতে পত্রে নিজের নাম না লিখিয়া নামের পরিবর্ত্তে “মা” বা “আপনার স্নেহের মা” বলিয়া স্বাক্ষর করিয়া থাকেন। কিন্তু মাতা অপেক্ষা পুত্রের বয়ঃক্রম দ্বিগুণেরও অধিক। মাতার ২৬/২৭ বৎসর বয়ঃক্রম, পুত্রের ৭১/৭২ বৎসর বয়স।’ (পৃ. ৫০-৫১) শেষ করবো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম চিন্তক, সাংবাদিকতার পথিকৃত, রাজনীতিবিদ, ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞ ও সমাজ সংস্কারক ঢাকার প্রথম দৈনিক পত্রিকা— দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ‘মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র বক্তব্য দিয়ে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মৃত্যুর অনেক পরে ২৪ নভেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে যখন ‘নববিধান পাবলিকেশন কমিটী’র উদ্যোগে গিরিশচন্দ্রের অনূদিত কোরআনের ৪র্থ সংস্করণ বের হয় তখন সেটির ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি। মওলানা আকরম খাঁ লিখেছেন— ‘তিন কোটি মোসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা, তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশের কোন মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবী-পার্শী ভাষায় সুপণ্ডিত মোসলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল, তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরু কর্তব্যভার বহন করার জন্য সুদৃঢ় সঙ্কল্প নিয়া সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন— বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে। গিরীশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’ লেখক : গবেষক 
জঙ্গীদের নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের ভূমিকা
কয়েক বছর ধরে বিশেষায়িত বাহিনীগুলো দেশে জঙ্গী নেই, জঙ্গী নেই বলে ধোয়া তুলে সরকারকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার পর কী দেখতে পেলো দেশবাসী? দেখতে পেলো ৭২ ঘন্টাব্যাপী নজিরবিহীন তাণ্ডব। এ তাণ্ডব কোনভাবেই ছাত্রদের নয়। পুরোটাই ভয়ঙ্কর জঙ্গীদের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ। সরকারকে দিশেহারা বানাতে, রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিতে যা যা দরকার সেগুলোই তারা করেছে, পরিকল্পিতভাবে।  এবারের ভযাবহ নাশকতায় জামায়াত শিবিরের সম্পৃক্ততা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দল দুটি সরকার বিরোধী যুৎসই আন্দোলন করার সক্ষমতা আরো আগেই হারিয়েছে। ২০১৩-১৪ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পর গত একদশকেও তারা মেরুদণ্ড দাঁড় করে আর কোনো আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারেনি। বরং আন্দোলনের নামে আচমকা কিছু অরাজকতা ঘটিয়ে পরক্ষণেই লাপাত্তা হতে দেখা গেছে। বর্তমানে দল দুটির অবস্থা আরো করুণ। একটা ককটেল ফুটলেও আশপাশের কয়েক মহল্লার বিএনপি জামায়াত ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা ৭২ ঘণ্টা ধরে একের পর এক নাশকতা চালাবে- এমন সক্ষমতা অর্জন অবিশ্বাস্যই বটে। নাশকতার ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে হামলাগুলোতে বিএনপি জামায়াত শিবিরের পরিচিত মুখের বর্ণনা শোনা যায়নি এখনও। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বরাবরই প্রধান রাস্তার নির্দ্দিষ্ট গন্ডিতে জমায়েত হয়ে দিনভর স্লোগানসহ নানাবিধ বার্তা প্রচার করতে দেখা গেছে। বিক্ষুব্ধ মিছিল নিয়ে তারা এদিক সেদিক প্রদক্ষিণ করেনি বললেই চলে।  তাহলে এরইমধ্যে কারা সংঘবদ্ধ মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালালো? মেট্রো রেলে কারা আগুন জ্বালালো? সেখানকার ভিডিও ফুটেজসমূহে প্রথম সারির হামলাকারীদের চেহারা অবশ্যই রয়েছে। গুলিতে হতাহত শিক্ষার্থীদের কারো চেহারার সঙ্গে কোনো মিল কি খুঁজে পাওয়া গেল?  এসব কারণেই সংঘটিত নাশকতাসমূহে জঙ্গীদের অংশ গ্রহণের বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায়, দলগুলো জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর চালায় নিজ নিজ সংগঠনের শক্তিমত্তা দেখাতে। কিন্তু জঙ্গীরা যাবতীয় নাশকতা ঘটায় যুদ্ধ স্টাইলে, চমকে যাওয়ার মতো অভাবনীয়তায়। যেমন হঠাৎ করেই নরসিংদী কারাগার দখলের মাধ্যমে বন্দী থাকা জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা। এতটাই চমকে দিলো তারা যা ঘটনার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কারো কল্পনাতেও ছিল না। একইভাবে ছাত্র আন্দোলনের 'সাইড স্টোরি'র মতো সিরিজ ঘটনাগুলোও ঘটেছে চমকানোর মতো নাশকতায়। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মেট্রো রেলে হামলা, ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া, একের পর এক অধিদপ্তর ভবনে আগুন লাগানো, ভবনগুলোর সুরক্ষিত পার্কিং লটে ঢুকে শত শত সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে কয়লায় পরিণত করা। কঠিন নিরাপত্তা বলয়কে তুচ্ছ করে বিটিআরসি ভবনের ১১ তলায় উঠে কেন্দ্রীয় সার্ভার স্টেশন ধ্বংসের প্ল্যানিং যোগ্যতাও নেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী কিংবা ন্যুব্জ থাকা দলগুলোর। এসব নাশকতা দেশকে পঙ্গু করাসহ সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলার জঘন্য যুদ্ধ কৌশলই বটে। নাশকতার সিরিজ ঘটনার মধ্যেই রয়েছে পুলিশের স্থাপনাগুলো গুড়িয়ে দেয়াসহ নরসিংদী কারাগার দখল করার ঘটনা। সেখানে বন্দী থাকা শীর্ষ ৯ জঙ্গী ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং বাকী ৮২৬ কারাবন্দীকে ছেড়েও দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রশিক্ষিত জানবাজ জঙ্গী ছাড়া এসব তান্ডব চালানোর দুঃসাহস কোনো দল বা গোষ্ঠীর আছে বলে মনে করি না। বিভিন্ন মহলের মত অভিমত অনুযায়ী রাজধানী জুড়ে ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা চালানোর ঘটনাসমূহে কয়েকশ জঙ্গীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। অথচ জঙ্গী না থাকার ধোয়া তুলে কয়েক বছর ধরেই বিশেষায়িত বাহিনীগুলো ছিল নির্জিব ভূমিকায়।  যখন জানা গেল, কুকিচিন আর মিয়ানমারের গোপন আস্তানাগুলোতে ১০/১২টি ব্যাচে কয়েকশ’ জঙ্গী উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছে, দক্ষতা অর্জন করেছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র চালানোতেও। তারাই তো ছড়িয়ে আছে দেশে। সেই প্রশিক্ষিত জঙ্গীদের অবস্থান, গতিবিধি, পরিকল্পনার কোনো কিছুই সরকার জানতে পারলো না। জঙ্গীদের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ডাটা ব্যাংক খুব বেশি সবল নয়। এসব ব্যর্থতায় কোনো সংস্থার মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠাও নেই। কারা বেশি লাভবান? অপরাধ বিজ্ঞানের বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা হচ্ছে, যে অপরাধ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে বা যারা লাভবান হয় তারাই কোনো না কোনোভাবে সে অপরাধে সম্পৃক্ত থাকে- এটাই প্রাথমিক সূত্র হিসেবে পরিচিত। তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যা কিছু ঘটে গেল সেগুলো থেকে সবচেয়ে লাভবান হলো কে বা কারা? একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, কোটা কেন্দ্রীক আন্দোলনের পূর্ব সময় পর্যন্ত দেশে দুর্নীতি-লুটপাট বিরোধী বিরতিহীন কলমযুদ্ধ চলছিল। সে যুদ্ধে ১৬ পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সেক্টরের অর্ধ শতাধিক কর্তার ভেদ কাহিনীও ফাঁস হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শত কোটিপতি বনে যাওয়া হয়তো হাজার খানেক কর্তার মুখোশ উন্মোচন হতে পারতো।  কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে লুটপাটের তথ্য উদঘাটন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি ঘটেছে। এতে আলাদীন চেরাগের মালিক বনে যাওয়া শত শত কোটি টাকা আর বেশুমার সম্পদধারী লুটেরাগণ সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন। এক্ষেত্রে জঙ্গীরা কতটুকু লাভবান হলেন সেটি অবশ্য অভিজ্ঞ মহলের বিশ্লেষণের ব্যাপার। লুটেরা গোষ্ঠী আর উগ্রবাদী জঙ্গীদের মধ্যে একটি জায়গায় খুব মিল রয়েছে, তারা কেউ দেশের মঙ্গল চায় না বরং উভয় গোষ্ঠীই দেশ ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত। দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা, মায়া, ভালোবাসা নাই- তারাই ভয়ংকর নাশকতা চালানোর নেপথ্য কারিগর। জঙ্গীদের ভয়ঙ্কর সিরিজ নাশকতার পেছনে লুটেরাদের অর্থায়ন থাকার অভিযোগ উঠলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মেট্রো রেল, বন ভবন, ত্রাণ ভবন, স্বাস্থ্য ভবন, বিটিআরসি ভবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যে অরাজকতা ঘটানো হয়েছে তা নজিরবিহীন। শত শত সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়েছে। এমন পৈশাচিকতা মেনে নেয়া যায় না। রাষ্ট্রকে পঙ্গু বানানোর এ কেমন ধ্বংসযজ্ঞ? এসব স্থাপনায় সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারীরা চিহ্নিত, তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক।  অভিযোগ উঠেছে, স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের সব দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে এই কারণে, যাতে তাদের উপর নিপীড়ন ও হত্যার মতো অতিমাত্রার ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। হেলিকপ্টার থেকে শিক্ষার্থী জমায়েতের স্থানসমূহে টিয়ার শেল ও মুহূর্মুহু গলিবর্ষণের ঘটনা অতিমাত্রায় ক্ষমতা ব্যবহারের কথাটি মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি), অতিরিক্ত আইজিপি মো. হারুন অর রশিদ বলেছেন, সহিংসতা ঠেকাতে র‌্যাব হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি করেনি। এগুলো প্রপাগান্ডা। অনুসন্ধানে অন্য কিছু আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জঙ্গী বিষয়ক রিপোর্টিংয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা অগ্রজ সাংবাদিকদের মুখে শুনেছিলাম নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। নানা পরিকল্পনা ও যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ জঙ্গীরা ঘটনার কয়েক ধাপ পর্যন্ত নিজেরাই সম্পৃক্ত থাকে।  সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা উদাহরণ দিয়ে জানান, কোথায়ও জঙ্গীদের শক্তিশালী বোমা হামলায় হয়তো ১০ জন ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন, আহত হলেন অপর ৩০ জন। দ্বিতীয় ধাপে আহতদের নিয়ে হাসপাতালে দিকে রওনা দেয়া এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে পথে আটকে আগুনে পুড়িয়ে দিবে আরেক গ্রুপ। বিভিন্ন পথে কিছু আহতকে নিয়ে হাসপাতালে হয়তো পৌঁছানো হলো। কিন্তু তাদের চিকিৎসা শুরু হতে না হতে তৃতীয় গ্রুপটি হাসপাতালেই বোমা হামলা চালিয়ে বাকিদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত বেশ কয়েকটি নাশকতার কথা সবাই জানি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পর পুলিশের সোয়াত টিমের সদস্যরা যা ঘটিয়েছে তাতো জঙ্গীদের কয়েক ধাপের ভয়াবহতার বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেখানে মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে ছয় জন পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। বারিধারা বসুন্ধরা গেটে ২০ জুলাই কারফিউ ভঙ্গ করে সন্ধ্যা অবধি শিক্ষার্থী জমায়েত চলে। আন্দোলনের পরবর্তী কোনো কর্মসূচি না জানিয়েই শিক্ষার্থীরা রাত ৯ টার মধ্যে স্থানটি ছেড়ে চলে যায়। পরদিন ২১ জুলাই দুপুর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে দুপুর একটার পর ভাটারার দিক থেকে পুলিশ ভ্যানে থাকা সোয়াত টিমের সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালাতে চালাতে বসুন্ধরা গেট এলাকায় আসে। সেখানে গাড়ি থেকে নেমেও তারা দুই পাশের ফুটপাতে পথচারীদের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে শতাধিক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ওভারব্রিজের অদূরেই ফুটপাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এরপর পুলিশ দলটি বসুন্ধরা গেট থেকে কুটুর গলি পর্যন্ত ২০০ গজ দীর্ঘ রাস্তায় বাজার, দোকানপাট, ফুটপাত লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে অপ্রশস্ত কুটুর গলিতে ঢুকেও দুই পাশের ঘনঘিঞ্জি বাসা, বাড়ি, বস্তি সাদৃশ্য ঘরগুলোর দিকে আরো প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে পুলিশ দলটি আজিজ রোডের দিকে চলে যায়। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত আজিজ রোড, হারেজ রোড, মসজিদ রোড, জে ব্লকের অলিগলি এবং প্রগতি সরণির দুই কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে পুলিশের বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ ছিল নজিরবিহীন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জে ব্লকের গির্জা গেট থেকে যমুনার গেট পর্যন্ত প্রগতি সরণির দুই কিলোমিটার রাস্তা ও আশপাশের গলিতে অন্তত ৫০০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়েছে। টার্গেট ছিল রাস্তা ও ফুটপাতের পথচারী, সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যার সময়ই আচমকা সোয়াত সদস্যরা আবারও গুলি চালাতে চালাতেই ঢুকে পড়ে ঘনবসতিপূর্ণ আজিজ রোডে। গলির মোড়েই গুলিতে মারা যায় মাছ ব্যবসায়ি আমজাদ (৪৫) নামে একজন। তার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই ছোট ভাই ইনতাজুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বেলাল নামে এক শ্রমিক। এসময় গলির দুই’শ গজ ভিতরে মসজিদের সামনে পাশাপাশি চার জন পথচারী গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। ভয়ানক আতঙ্কে গোটা এলাকার রাস্তা, গলি জনশূন্য হয়ে পড়ে।  চার লাশ ফেলা গাড়িটি ফেরার সময় এক সবজি বিক্রেতা জোড় হাত তুলে জানতে চান, স্যার লাশগুলো কি করবো? ভ্যানের সামনের আসনে থাকা এক কর্মকর্তা তাকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে লাশ ফেলে দিও। অবশ্য ঘন্টা দেড়েক পর আজিজ রোডস্থ সোসাইটির কর্মকর্তারা ভ্যানে তুলে লাশ চারটি নিয়ে যায় বলে খবর পাওয়া গেছে। কোনো লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। অভিন্ন স্টাইলেই লাশ পড়েছে গুলশানের শাহজাদপুরসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকাতেও। নির্বিচারে সাধারণ পথচারী, দোকানপাট লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ, একই এলাকায় দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ছয় জন খেটে খাওয়া মানুষ হত্যা, লাশ না নিয়ে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনীটির এ আচরণ কি কারফিউ ভঙ্গের শাস্তি, নাকি সর্ব সাধারণের মাঝে সরকার বিরোধী অসন্তোষ সৃষ্টি? নাকি জঙ্গীদের সিরিজ নাশকতা ঠেকাতে পাল্টা পুলিশি তান্ডব? যদি বলা হয়, কারফিউ ভঙ্গের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ভূমিকা নিয়েছে, তাহলে কারফিউ জারির প্রথম দিন (২০ জুলাই) পুলিশ কোথায় ছিল? সেদিন সকাল থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে কারফিউ ভঙ্গ করে প্রকাশ্য ছাত্র জমায়েত হয়েছে, কিন্তু পুলিশের কোনো সদস্য ভুলেও সেখানে যাননি কেন? কারফিউর মর্যাদা রক্ষায় কেন তারা ভূমিকা নেননি? পরদিন শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণকারীরা তো পুলিশই ছিল, নাকি অন্য কেউ? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক