• ঢাকা সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

নিটওয়্যার রপ্তানিতে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সাফল্য

মো. তানভীর হোসেন

  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:৪১
মো. তানভীর হোসেন
লেখক : মো. তানভীর হোসেন

লুক্সেমবার্গে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর পরিসংখ্যান অফিস ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী ইইউ এর ২৭ সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ২০২৩ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিটওয়্যার পণ্য আমদানি করেছে এবং মোট আমদানির মধ্যে বাংলাদেশ ৮.৩১ বিলিয়ন ডলারের নিট আইটেম সরবরাহ করেছে, যেখানে পোশাক পণ্যের বৃহত্তম রপ্তানিকারক চীন ৮.২৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

মূল্য ও আয়তন উভয় ক্ষেত্রেই প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে নেতৃস্থানীয় নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বৈশ্বিক জায়ান্ট চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক হাসান এর মতে গত দুই-তিন বছর ধরে বিশেষ দুটি কারণে ক্রেতাদেরকে পণ্যের দাম বেশি দিতে হচ্ছে।

প্রথমত, ক্রেতারা কাঁচামালের অস্বাভাবিক দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে বেশি দাম দিচ্ছেন এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ বেসিক টেক্সটাইল পণ্য এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ভ্যালু এডেড টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি করছে, উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশ এখন ৩০ থেকে ৩৫ ডলার পর্যন্ত মূল্যের গার্মেন্টস আইটেম রপ্তানি করে থাকে।

ভ্যালু এডেড টেক্সটাইল পণ্যগুলিতে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল কারণ এই ধরনের পণ্য গুলিতে গুণমানের উন্নতি বা অনন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাদের প্রতিযোগিতা থেকে আলাদা করে।

নিটওয়্যার রপ্তানিতে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে এ দেশের বস্ত্র শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো।

প্রাথমিক টেক্সটাইল খাত বা প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টরে (পিটিএস) প্রায় ১৮০০টি মিল রয়েছে এবং প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে যা পোশাক শিল্পের স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করছে, একটি শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির কারণে বাংলাদেশী বস্ত্র উৎপাদনকারীরা নিটওয়্যার সেক্টরের জন্য প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে।

বাংলাদেশের নিটওয়্যার রপ্তানিতে এই অগ্রগতির জন্য পোশাক খাতে নিরাপত্তা এবং কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এই সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের কারণে বিশ্বজুড়ে আমাদের ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে।

তাছাড়া পরিবেশ বান্ধব টেক্সটাইল মিলসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। যদিও অতীতে বিশেষ করে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তদন্তের সম্মুখীন হয়েছে এবং তারপর থেকে, দেশটি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশে এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির মতো উদ্যোগগুলি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম এবং নিরাপত্তা মান মেনে চলা বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

এই শিল্পের সাথে জড়িত উৎপাদনকারী, সরকারী সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সহ সকল স্টেকহোল্ডাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই সেক্টরের সার্বিক নিরাপত্তা উন্নতি করে যার ফলে অনেক ক্রেতাই এখন বাংলাদেশে অর্ডার দিতে আগ্রহী।

এছাড়াও রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থার কারণে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বছরের পর বছর ধরে এই খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে যা বাংলাদেশটির প্রচুর পরিমাণে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।

সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, ইথিওপিয়া এবং কম্বোডিয়ার মতো অন্যান্য দেশ থেকে কাজের আদেশগুলি স্থানান্তরিত হয়েছে কারণ তারা প্রতিযোগিতামূলক দামে বড় পরিমাণের অর্ডার দিতে অক্ষম।

অধিকন্তু, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক সংঘাত চলছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য বাধা স্থাপন শুরু করেছিলেন। এ বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ক্রেতারা দিন দিন চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ক্রেতারা বাংলাদেশকে ২য় পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তারা বাংলাদেশকে চীনের সেরা বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে।

২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২৪ নভেম্বর, ২০২৬-এ স্বল্পোন্নত দেশগুলির (এলডিসি) গ্রুপ থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ সমূহের কাতারে যোগদান করতে প্রস্তুত তখনই নতুন মজুরি কাঠামো, বৈশ্বিক সংকট, উচ্চতর ইউটিলিটি সার্ভিস খরচ, স্থানীয় রপ্তানিকারকদের জ্বালানি অনিশ্চয়তার মতো গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন এই দেশ।

এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিটওয়্যার রপ্তানিতে মূল্য ও আয়তন উভয় ক্ষেত্রেই চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অবশ্যই ভালো খবর। যদিও এটাই এই ধরনের প্রথম ঘটনা নয়, ২০১৪ সাল থেকে ইইউর জন্য ডেনিম সোর্সিংয়ে তুরস্ক ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।

এইসব সম্ভব হয়েছে রপ্তানিকারকদের জ্বালানি এবং বন্দর, সড়ক ও মহাসড়কের মতো দুর্বল অবকাঠামোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার কর্তৃক গৃহীত কর্ম পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন এর মাধ্যমে।

সাম্প্রতিক মন্দা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি হতাশাজনক পূর্বাভাস, বিশেষ করে পোশাক বাণিজ্যের জন্য একটি কঠিন সময় অপেক্ষা করছে যদিও বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে বাংলাদেশ এখনও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ভালো করছে এবং বাংলাদেশের আরও অনেক অপার সম্ভাবনা রয়েছে যার জন্য স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কোনো বিকল্প নাই।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

daraz
  • মুক্তমত এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
দিল্লি বিমানবন্দরে বাংলাদেশি গার্মেন্টসের রপ্তানি বাড়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আপত্তি
ভারত থেকে আসবে পেঁয়াজ, এলসি খুলছেন ব্যবসায়ীরা
পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলো ভারত
স্বর্ণ রপ্তানিতে সম্ভাবনা উজ্জ্বল বাংলাদেশের
X
Fresh