• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

গল্প

সিন্দুক

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

  ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৬:০২
সিন্দুক
ফাইল ছবি

আমিনুলদের বাড়িতে একটি কাঠের সিন্দুক আছে। অতি পুরাতন ও জীর্ণ। চতুষ্কোণ ও বিশাল। আকৃতি বড় চৌকির সমান। দেখতে পালঙ্কের মতো। প্রায় ৪ ফুট উঁচু। সিন্দুকটির ভেতরে সংসারের যাবতীয় পুরনো ও অতিরিক্ত জিনিসপত্র; যেমন শীতকালের জামা, লেপ, পুরনো বই-পুস্তক ইত্যাদি রাখা হয়। ঘরে শোবার চৌকির স্বল্পতার কারণে এর উপরের পিঠে তোষক বিছিয়ে দিয়ে বিছানা তৈরি করা হয়েছে। একজন শিশু, কিশোর, এমনকি পূর্ণ বয়স্ক মানুষ সহজেই রাত্রিযাপন করতে পারে। শৈশবে আমিনুল এই সিন্দুকের উপরের বিছানায় ঘুমাত। পাশের চৌকির বিছানাতে ঘুমাত আমিনুলের বাবা-মা এবং তাদের ছোটবোন। সিন্দুকের চাবি থাকত আমিনুলের মায়ের কাছে। কখনোই তিনি এই চাবি কারো কাছে হস্তান্তর করতেন না। ফলে আমিনুল কখনোই জানতে পারত না লেপ-তোষক ছাড়া সেখানে আর কী কী ছিল বা আছে। একটা প্রবল অনুসন্ধিৎসা কাজ করত তার ভেতরে।

আমিনুল তার বাবার কাছ থেকে শুনেছে যে, ফকির মজনু শাহ পঞ্চাশ হাজারের বেশি ফকির সন্ন্যাসীকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করে বাংলায় বহু অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এসব অভিযানে তারা কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব অফিস, স্থাপনা দখল, জমিদারদের কাছারি লুট এবং কোম্পানির সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। প্রায় ছাব্বিশ বছরকালব্যাপী এই বিদ্রোহে অনেক ইংরেজ সৈন্য ও কর্মচারী নিহত হয়। ১৭৭৬ সালে ফকির মজনু শাহ পাঁচশ সৈন্যসহ বগুড়া হতে পূর্বদিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে কালেশ্বর নামক স্থানে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি হন। এই যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর ফকির বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুদ্ধের অন্যতম।

আমিনুল পারিবারিক সূত্রে জানতে পেরেছে যে, সিন্দুকটি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। আমিনুলদের পূর্বপুরুষ ফকির মজনু শাহের ছোট্ট একটি দলের নেতৃত্ব দিতেন। দলের ফকিররা এই সিন্দুকের ভেতরে তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ে বের করতেন। সাধারণত গভীর জঙ্গলের ভেতরে সিন্দুকটি লুকিয়ে রাখা হতো। যুদ্ধের প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করা হতো। বলা যেতে পারে একটি চলমান অস্ত্রাগার ছিল এটা। যুদ্ধে হারার পর ফকিররা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে বসতি স্থাপন করে। আমজাদ ও আমিনুলের পূর্বপুরুষও এই সময়ে নিজের দলবলসহ আমিনুলদের বাড়ির নিকটবর্তী সেই বনরূপী জংগলের ভেতরে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সিন্দুকসহ। এখান থেকেই তারা তাত্তাপাড়ায় অবস্থিত ইংরেজদের নীলকুঠির উপরে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। সেটিকে দখল ও লুট করতেও সমর্থ হয়েছিলেন। বেশকিছু ইংরেজ সিপাই এতে হতাহত হয়েছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হবার কারণে এরপর ইংরেজরা এখান থেকে কুঠি গুটিয়ে নেয়। ময়মনসিংহের দিকে চলে যায় বলে জনশ্রুতি আছে। উল্লেখ্য, এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের সময়ে আমজাদের সেই পূর্বপুরুষ সিন্দুকটিকে নিজ বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন। যদিও সেখানে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

আমিনুলের ছোটবোন কিছুটা বড় হবার পর তার শোবার জন্যে পৃথক একটা চৌকি স্থাপনের প্রয়োজন হলে সিন্দুকটিকে আমিনুলের ঘরে স্থানান্তর করা হয়। এই ঘরেই আমজাদের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া চাচা বাস করতেন। আমজাদ বাস করেছে। এখন আমিনুল বাস করে। সিন্দুকটি আমিনুলের ঘরে আসার পর এটি নিয়ে তার ঔৎসুক্য প্রবলভাবে বেড়ে গেছে। এই প্রথমবার তার মা সিন্দুকটির চাবি তার কাছে হস্তান্তর করেছেন। প্রথমদিন সিন্দুকটি খোলার পর সে সেখানে লেপতোশকের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পুরনো বই খুঁজে পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রথম বইটি সন্ন্যাসী চাচার কাছ থেকে আমজাদ কর্তৃক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। নাম ‘চাহার দরবেশ’। বইটি আমিনুল গোগ্রাসে পড়ে শেষ করেছে। কিন্তু বইটির সামনের ও পেছনের কয়েকটি পাতা ছেঁড়া থাকার কারণে কোনোভাবেই আত্মসন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছে না। দ্বিতীয় বইটির নাম ‘আমি সুভাষ বলছি’। লেখক শৈলেশ দে। বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা থেকে অগ্রাহায়ণ, ১৩৭৫ সালে প্রকাশিত। সচিত্র বই। বইটি সম্ভবত তার পিতা আমজাদের নিজের সংগ্রহ। এতে সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান, কাবুল হতে ইউরোপের পথে, ঢাকায় লোম্যান হত্যা, মেদিনীপুরে পেডি-হত্যা, কলকাতা কংগ্রেসে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র, সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগ, ফরোওয়ার্ড ব্লক গঠন, কংগ্রেস হতে বহিষ্কার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু, মুক্তি ও অন্তর্ধান ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। অবাক করা ব্যাপার হলো আমজাদ কখনোই তাকে বইগুলো সম্পর্কে তাকে বলেনি। আমিনুলের ধারণা বই দুটো বা এগুলোতে বর্ণিত ঘটনাবলীর সাথে আমজাদের সন্ন্যাসী চাচার অন্তর্ধানের বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে সেদিন রাতে আমিনুলের ঘরের বাইরে রাতের আঁধারে আমজাদের সংগে শ্মশ্রুমণ্ডিত জ্যোতির্ময় পুরুষের আলাপচারিতা তার সন্দেহকে আরো ঘনীভূত হয়েছে।

সুতরাং বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে কোনো নির্জন স্থানে একাকী চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল সে। সিন্দুকটি তার ঘরে আসার পর হঠাৎ তার মনে হলো সে সঠিক জায়গা খুঁজে পেয়েছে। ইতিপূর্বে সে বাড়ির কাছের বন বা জঙ্গলের কেন্দ্রে বসে এই চিন্তা করার কথা ভেবেছিল। কিন্তু সঙ্গী ছাড়া একাকী সে বনের গভীরে প্রবেশ করার সাহস পায়নি। সন্ধ্যার পর খরকাবিল থেকে মৃদু বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। রাতের খাওয়ার পর আমিনুল তার ঘরের দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিলো। পরেরদিন সকালের আগে কেউ তার খোঁজ করবে না।

সিন্দুকের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতর থেকে ডালা বন্ধ করে দিলো। মুহূর্তের মধ্যেই বাইরের পৃথিবী হতে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। চারদিক থেকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরল। অন্ধকারের তোষক বিছিয়ে শুয়ে পড়ল সে। খেয়াল করল যে, শুধু আলো নয়, বাইরের কোনো শব্দই ভেতরে প্রবেশ করছে না। এমনকি খরকাবিল থেকে আসা বাতাসের শব্দও নয়। আমিনুল ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। সিন্দুকের ভেতরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ও নির্জনতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে। নিজের হৃদস্পন্দন ছাড়া আর কোনোকিছুর শব্দই সে শুনতে পেল না। সম্ভবত অক্সিজেনের সল্পতার কারণে খুব দ্রুতই তার ভেতরে তন্দ্রা ভাব চলে এলো। সে অনুভব করতে লাগল যে, শরীর থেকে তার মন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ।

এক সময়ে আমিনুলের মনে হলো তার শরীর হালকা হয়ে এক সময়ে বায়বীয় রূপ ধারণ করেছে। অদৃশ্য কোনো ছিদ্র দিয়ে সে কখন কীভাবে সে সিন্দুকের বাইরের চলে এসেছে, তা সে জানে না। দাঁড়িয়ে আছে অন্দর বাড়ির উঠোনে। এখন সে চাইলেই উড়তে পারে পাখির মতো। একটু চেষ্টা করতেই সে উড়তে শুরু করল। দুই হাতের ডানাকে মনে হচ্ছিল পাখির ডানা। পা দুটোকে মনে হচ্ছিল পাখির লেজ। সেটি দিয়ে চলার দিক নির্ধারণ করতে পারছিল সে।

খরকা বিলের উপর দিয়ে উড়তে শুরু করল সে। একটু পরে নীচে তাকাতেই ভীষণ অবাক হলো। নীচে খরকা বিল নেই। বিলের পাড়ে আশেক মাহমুদ স্কুল, কালি মন্দির – কোনোকিছুই নেই। এমনকি অনতিদূরে যমুনা নদী থাকার ছিল, সেটাও নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জনপদের ওপর দিয়ে উড়ছে সে। অনেকগুলো তালগাছের সারি দেখে বুঝতে পারল জায়গাটি খরকাবিলের ওপারের তাত্তা পাড়া। তালগাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে খরকাবিলের জায়গায় দেখতে পেল অনেকগুলো ইমারতের ধ্বংসাবশেষ। তার মনে হলো এগুলো এক সময়ে ইংরেজদের নীল কুঠি ছিল। অকস্মাৎ তার মনে হলো সে অতীত কোনো পৃথিবীতে এসে পড়েছে। এই পৃথিবীতে তার পূর্বপুরুষেরা সবাই আছে। আছে আমজাদ। ফাতেমা ফুপু। এমনকি তার হারিয়ে যাওয়া সন্ন্যাসী দাদাও।

আমিনুলের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম বা স্বপ্নের ভেতরে উড়তে পারাটা তাকে আনন্দ দিয়েছে। তবে সবচেয়ে আনন্দ দিয়েছে তাকে সিন্দুকের ভেতরের জগতটা। অতীতকে আবিষ্কার করার জন্যে তাকে বারবার ফিরে আসতে হবে এই জগতে। বাইরে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সকাল। খরকাবিলের জল সকালের আলোতে ঝিকমিক করছে। দূরে তাত্তাপাড়ার তালগাছগুলোর মাথা দেখা যাচ্ছে। দিগন্তরেখার ওপরে। অনেকগুলো বিন্দুর মতো।

আরআর

মন্তব্য করুন

daraz
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বগুড়ায় জন্ম নিল অদ্ভুত আকৃতির ছাগল
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প এবার স্টার সিনেপ্লেক্সে!
সমুদ্রের রোমাঞ্চকর গল্প বলেন তারা, শোনান গান
‘শেষমেশ’, যে গল্প কাঁদিয়েছে দর্শকদের
X
Fresh