• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo
আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো গো মরার কোকিলে
আগে ঘরের ছেলেরা নিরাপদে ঘরে ফিরুক
আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পথে রয়েছে এমভি আবদুল্লাহ। ৩২ দিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ২৩ নাবিক এখন পাড়ি দিচ্ছে এডেন উপসাগর। বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে জাহাজটি ঘেরা হয়েছে কাঁটাতার দিয়ে। আরও নিরাপত্তার জন্যে জাহাজের ডেকে যুক্ত করা হয়েছে ফায়ার হোস পাইপ। যাতে আবার কোনো বিপদ হলে নিরাপত্তাকর্মীরা শত্রুর দিকে গরম পানি ছিটাতে পারে। নাবিকরা যেন লুকিয়ে থাকতে পারেন সেজন্যে প্রস্তুত রয়েছে নিরাপদ গোপন ঘর সিটাডেল। আর সব শেষ নিরাপত্তার জন্যে এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ।  জাহাজটির মালিক কেএসআরএম গ্রুপের কর্মকর্তারা এসব তথ্য দিয়েছেন গণমাধ্যমে। তারা বলছেন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও এমভি আবদুল্লাহ এখনও উচ্চঝুঁকিপ্রবণ এলাকা অতিক্রম করেনি। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই নিয়মের কারণেই তারা সাংবাদিকদের বলেননি, কী পরিমাণ মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি মুক্ত হলো। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একজন জলদস্যুর বরাত দিয়ে, মুক্তিপণের পরিমাণ উল্লেখ করা করা হলেও তা স্বীকার করেনি কেএসআরএম।  এদিকে জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, জলদস্যুদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে সমঝোতা করা হয়েছে। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন ধরনের চাপ দিয়ে মুক্ত করা হয়েছে আব্দুলাল্লাহকে। অনেকে ছবি দেখাচ্ছেন, এ ছবিগুলোরও কোনো সত্যতা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিপিং ডিপার্টমেন্ট, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম উইং, ইউরোপিয়ান নেভাল ফোর্স, ভারতীয় নৌবাহিনী এবং সোমালিয়ার পুলিশ এই উদ্ধার কাজে এখনও সহায়তা করছে।  আমরা যদি একটু পেছনে যাই দেখব, ছিনতাই হওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজ ছাড়িয়ে আনার নজির প্রায় নেই। ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হয় ১২ মার্চ। জাহাজটি মুক্ত হয় শনিবার রাত ১২টা ৮ মিনিটে। এ হিসাবে ৩২ দিন পর জাহাজটি মুক্তি পেলো। এর আগে ২০১০ সালে এই একই গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। সেটি উদ্ধার করতে তিন মাস নয় দিন সময় লেগেছিল। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুদের চূড়ান্ত অত্যাচার ছিল ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০১১ সালে ৩১টি জাহাজ জিম্মি করেছিল সোমালীয় দস্যুরা। এর প্রত্যকেটিকেই মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছিল। প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে সময় লাগে গড়ে ১৭৮ দিন। সোমালিয়ায় নাবিকদের দীর্ঘ সময় জিম্মি থাকার ঘটনা মালয়েশিয়ার জাজাজ এমভি আলবেদো জাহাজের। তাদের ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর জিম্মি করেছিল দস্যুরা। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে নাবিকেরা মুক্তি পেয়েছিলেন। মুক্তির সব শেষ ধাপটি ছিল ২০১৪ সালের ৭ জুন।  জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসি এর তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল ছিনতাই হওয়া মিয়ানমারের একটি মাছ ধরার জাহাজটি মুক্ত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। জাহাজটির ২৪ জন নাবিকের মধ্যে ৬ জন অসুস্থ হয়ে মারা যান। মিয়ানমারের ১৪ জন নাবিক মুক্তি পান ২০১১ সালে। বাকি ৪ জন মুক্তি পান ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। শেষ ৪ জন মুক্তি পান ৪ বছর ৩১৩ দিন পর। সোমালিয়ান দস্যুদের মুক্তিদেয়ার এত ফিরিস্তি এখনে দিলাম, কারণ প্রথমত বলতে চাইলাম এরা ভয়ঙ্কর হতে পরে। দ্বিতিয়ত সম্প্রতি যেভাবেই আমাদের নাবিকরা মুক্তি পান না কেন, খুব কম সময়ে তারা ঘরে ফেরার পথে আছেন, কিন্ত তারা এখনও শতভাগ বিপদমুক্ত নন।  অনেকে আমার এমন কথায় আঁতকে উঠতে পারেন। ভয় পাওয়ার হয়তো কিছু নেই। কিন্তু কিছু অদ্ভুত বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এবার এই বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি হওয়ার পর আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখলাম সোমালিয়া উপকূলে এই অপহরণের বিষয়টি যেন কোনো অপরাধ নয়। একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ডাকাতরা রীতিমতো দক্ষ। তারা প্রযুক্তি জানে।  আধুনিক অস্ত্র আছে। এমনকি তাদের পক্ষে কথা বলার মত বৈধ প্রতিষ্ঠান আছে। ডাকাতির মতো একটি ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সঙ্গে মধ্যস্ততার জন্যে প্রকাশ্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে লন্ডন আমেরিকার মত দেশে। রাষ্ট্র শক্তির মতো কোনো অমোঘ শক্তি পেছনে না থাকলে কী এই দৌরাত্ম সম্ভব? তাই কারা দস্যুদের পক্ষে কারা বিপক্ষে তা বোঝার ঝুঁকি তো রয়েই যায় শেষ মুহূর্তে। পাঠক আসুন আবারও প্রেক্ষাপটে ফিরি। জিম্মি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক মুঠোফোনে তার স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিও। অর্থাৎ প্রথম থেকেই ২৩ নাবিকের বেঁচে থাকার আকুতি বাংলাদেশের কাছে ছিল। যে কারণে নাবিকদের যেন ন্যূতম ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি প্রথম থেকে খুব মুখ্য ছিল। তাই এ কথা আর বলতে বাঁধা নেই যে, জিম্মি হওয়ার পর ২৩ নাবিকই শুধু  চূড়ান্ত ঝুঁকির মুখে পড়েননি। ঝুঁকির মুখে ছিলেন যারা তাদের উদ্ধার করতে চাইছিলেন তারাও। তাদের সামনে একদিকে ভয়ঙ্কর জটিল কূটনীতি অন্যদিকে ২৩ জনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়। সবকিছু মিলিয়ে সবাকে কৌশলী হতে হয়েছে। শুধু কৌশলী বললে ভুল হবে, বলতে হবে সুক্ষ্ম কৌশলী। যে কারণে বার বার অভিযানের প্রস্তাব আসলেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। জাহাজ জিম্মি হওয়ার খবর প্রথম জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনী। তাদেরকেও বাংলাদেশ শুধু অনুসরণ করার অনুরোধ করেছিল। সেখানো ভারতীয় নৌবাহিনীরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারাও বিশেষ নজর রেখেছিলেন, নাবিকদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।  এখনও পর্যন্ত উদ্ধার কাজের পুরো প্রক্রিয়া প্রকাশ্য হয়নি। কিন্তু সার্বিক বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, ২৩ জন  নাবিক যে নিরাপদে ফিরতে যাচ্ছেন, এটা একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নয়। এটা রীতিমতো কূটনীতিক সাফল্যই বলতে হবে। যারা কাজ করেছেন, তাদের কাউকে ছাড়া কারো পক্ষে এতদূর এগোনো সম্ভব ছিল না। আর সম্ভব হলেও সেই মাসের পর মাসের ধাক্কা ছিল হয়তো। থাক আর হয়তো বলে মন খারাপ করতে চাই না। কারণ এই ‘হয়তো’ আমাদের সামনে অনেক বিপজ্জনক প্রশ্ন আনতে পার। তাই আর প্রশ্ন না বাড়িয়ে শুধু বলি, গোটা প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে ধান ভানতে এই  শিবের গীত গাইতে হলো। ছবির যে প্রসঙ্গ খোদ প্রতিমন্ত্রী তুলেছেন, সেই ছবিটি আমিও দেখেছি। আজকের এই ফেক ভিডিও ছড়ানোর যুগে আমার মনেও যে প্রশ্ন ওঠেনি তা নয়। একদল ডাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে, প্লেনে বহন করে পর পর ৩টি ডলারের প্যাকেট ফেলা খানিকটা সিনেম্যাটিক। কিন্তু সত্য যে হতে পারে না, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে টাকা যদি দিয়েই থাকে, তাহলে ফেরত আসার পথে এত নিরাপত্তা লাগছে কেন? আর যেখানে আমরা জলদস্যু দলপতির চিঠির কথা জেনেছি। যে চিঠিতে তিনি বলেছেন এই চিঠি দেখালে কেউ তাদের আটকাবে না। তারপরেও এত সতর্কতার কারণ কী শুধুই আন্তর্জাতিক নিয়ম? যে কারণে বলতেই হচ্ছে জাহাজ এবং নাবিক উদ্ধার কূটনীতি এখনও সক্রিয়। যাই হোক, বিমান থেকে টাকা ফেলার ছবি, কেএসআরএম এর বিবৃতি এবং প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে এক ধরণের অমিল খুঁজে পাচ্ছেন কেউ কেউ। এটা কোন কোন গণমাধ্যম থেকে সংক্রামিত হয়ে  মানুষের মনেও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। সেই ধোঁয়াশা ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একটা সফল অপারেশনের শেষ সময়ে এটা আসলেই প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ এই তিন বক্তব্যে আপাত দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ মিল হয়তো নেই, কিন্তু আমাদের ভাবা দরকার গোটা বিষয়টা একটা কূটনীতি। এখানা নানা কৌশল থাকবেই। তাই ধোঁয়াশাও থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা ২৩ জন নাবিকসহ জাহাজটি এখনও সমুদ্রে। নিশ্চয়ই ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরার পর অনেককিছু প্রকাশ্য হবে। আর যদি নাও হয়। তারাতো ফিরলো। না হয় এই সুযোগে একবার নজরুল চর্চা করে নেবো " মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান'। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী  
পরিবহন শ্রমিক : আমাদের ক্ষোভ বনাম বাস্তবতা
এতিমদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ, এগিয়ে আসুক দূর্বার তারুণ্য
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের মৃত্যু যেন এক নক্ষত্রের পতন
নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না
দুনিয়ার ক্রেতা এক হও 
এবছরও রোজার আগের আলোচিত পণ্য তরমুজ। একইভাবে গণমাধ্যমে দেখছি ঢাকার ৮০০ টাকার তরমুজে আসলে কৃষক কত পাচ্ছেন। গতবারের মত এবারও আমরা অবাক হচ্ছি ক্রেতা আর উৎপাদকের বঞ্চনার চিত্র দেখে। আমার অবশ্য অবাক হওয়ার সুযোগ কম ৷ কারণ পেশার সুবাদে আমাকে মানুষের নানা বঞ্চনার সঙ্গে সব সময় থাকতে হয়। তবু হচ্ছি। কারণ গোটা বিষয়টি আর তরমুজে আটেকে নেই। বলতে পারি আমাদের বাজার পরিস্থিতি এখানে এসে আটকে গেছে। এখন এটাই নিয়ম। তাই বিষয়টি যেন কেউ নিয়ম না বলে, অন্তত অনিয়ম বলে। যে কারণে আসলে অবাক হতে হয়।   সম্প্রতি গণমাধ্যমে তরমুজ নিয়ে নানা খবরা খবরা আসছে। তরমুজের আড়তে ভোক্তার অভিযান । কর্মকর্তারা দাড়িয়ে থেকে ন্যায্যমূল্যে তরমুজ বিক্রি করাচ্ছেন। কোথাও ন্যায্যমূল্য তরমুজ বিক্রির নির্দেশ দেয়ার পর বিক্রেতা বিক্রি বন্ধ করে দিচ্ছেন। কোথা্ও ভোক্তার লোকজন চলে যা্ওয়ার পরপরই আবার আগের দামে বিক্রি করছেন। সব মিলিয়ে তরমুজ নিয়ে টানা হেচড়া চলছেই।  তরমুজ ঘিরে একটি তাদের ব্যবসায়ী গ্রুপ তাদের অসততা সবার সামনে নিয়ে আসছে। হাজার চেষ্টা করেও তাদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। আসলে আমাদের এই মুহূর্তের বাজারে তরমুজ কোন একক পণ্য নয়। আমরা বলতে পারি আমাদের যেকোন পণ্যের প্রতীক। এভাবেই অসৎ ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্য হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন অবাক হয়েই যাচ্ছে।  আবারও ফিরি তরমুজের কাছে, আমি নিজেও তরমুজের খবর নিয়েছি। একজন কৃষক একশ’ তরমুজ বিক্রি করেন, সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারেন। আবার সর্বনিন্ম ৫ হাজার টাকা শ'তেও বিক্রি করেন। সেই তরমুজ ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়ে ডাকাতের হামলা এড়িয়ে আসে ঢাকায়। আড়তে সব সাইজের তরমুজ বেচার পর গড়ে প্রতিটি ফলের বিক্রি দাম দাঁড়ায় এক থেকে দেড়শ টাকায়।  আড়তদারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীও গড়ে ১ থেকে ১৫০ টাকায় বড় তরমুজ কেনেন। শ’ হিসাবে কিনে তিনি এবার বিক্রি করছেন ৮০ থেকে থেকে ৯০ টাকা কেজিতে। এতে দেখা চোখেই প্রতিটি তরমুজে, খুচরা ব্যবসায়ী এক থেকে চার'শ টাকা লাভ করেন। অর্থনীতিবিদ কিম্বা বাজার বিশ্লেষকরা এটাকে হয়তো সুন্দর করে বলবেন মুনাফা। কিন্তু আম জনতার কাতার থেকে বলা হবে প্রকাশ্যে চুরি। দিন শেষে এই চুরিটাই সত্যি অনেক ভাবলাম আসলেই তো তাই। যেখানে যাই সেখানে প্রশ্ন ওঠে। এই পণ্যের কী এই দর হওয়া উচিত ছিল? যে সার্ভিস নিতে যাই, প্রশ্ন ওঠে এত দাম কেন? এমন কি রিকশা ভাড়াও বদলে যায় প্রতি মাসে। শুধু আয় বাড়তে চায় না নিয়মিত চাকরিজীবীর। সুতরাং প্রত্যেককে বাড়তি আয়ের চিন্তা করতে হয়। তাই এদের কেউ অতিরিক্ত সময় কাজ করতে চান। আবার কেউ তরমুজ ওয়ালার মত কৌশলী হন। কেউ কেউ নামতে নামতে চুরিতে নেমে পড়েন। যদি ঘুরিয়ে বলি, তাহলে বলতে হবে, প্রত্যেকে নিজে ঠকছেন, পাশাপাশি অন্যকেও ঠকাচ্ছেন। আমি মনে করি এর মূল কারণ বাজার ব্যবস্থা। ব্যবস্থা না বলে অব্যবস্থা বলাই ভাল। পাঠক আপনি চাইলে আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে পারেন, আমার দেশে আজ অস্থিরতা নামে যে লতার বাড় বাড়ন্ত, তার বীজ বপন করা হয়েছে বাজারে। যত বিরোধ, ক্ষমতা দখল, আধিপত্য বিস্তার যাই বলেন, এর উৎস কিন্ত বাজার। মূলত এটা ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর অস্থির প্রতিযোগিতা। বাজার বলতে আমি আক্ষরিক অর্থেই বাজার বুঝিয়েছি। এখানে পেঁয়াজও যেমন পণ্য, রড সিমেন্টের সেতুও পণ্য। আমি টিকেট জালিয়াতি বলতে যা বুঝি, তরমুজ ওয়ালার কেজিতে তরমুজ বিক্রিকেও তাই বুঝি। বাস বা লঞ্চের টিকেটে ঈদের বাড়তি দাম নেয়া, কারণ ছাড়াই পেঁয়াজ বা তেলের দাম বাড়াও আমার কাছে এক সূতোয় গাঁথা। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে যে যুদ্ধ এবং দুর্নীতি তাও আমার মনে হয় এই অস্থির বাজারের অংশ।    ধীরে ধীরে আমাদের বেশি চাওয়া চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর এদের চাওয়ার ধরণ হচ্ছে "কত কম পরিশ্রম করে কত বেশি পাওয়া যায়"। কৌশলে ধার না ধেরে গায়ের জোরেই সব কিছু নিজের দখলে নিতে চায়। যেকারণে আমরা বলতেই পারি যে এখন পুঁজিবাদী গায়ের জোরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি। তার চেয়ে বড় কথা সবার বাজার একই। চোর চুরির টাকা নিয়ে যে বাজারে ঢুকছে সাধারণ মানুষও সেই বাজারে যাচ্ছেন। তাই কেনার প্রতিযোগিতায় পড়ে অনেকেই চৌর্যবৃত্তিতে উৎসাহিত হচ্ছেন।   আবারো মাথায় ভিড় করে হাজারো প্রশ্ন, কী হবে আমাদের? কী হবে এই অস্থিরতার সমাধান? আমাদের বাজার থেকে যেভাবে মানুষ শোষণ শুরু হয়েছে তাতে কীভাবে মানুষ বাঁচানো যাবে? যারা এই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না বা প্রতিযোগিতা করবে না তারা কী দেশ ছাড়বে? নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের ইতিবাচক সমাধান চাই আমরা। তাহলে এই অবস্থায় বাজারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোন পথ দেখি না। নিয়ন্ত্রণ বলতে আমি বুঝি চৌর্যবৃত্তি একেবারে বন্ধ। বন্ধ শব্দটির সঙ্গে জোর করার সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ জোর খাটিয়ে মানুষের পকেট কাটা বন্ধ করতে হবে। তাহলে যারা কাজটি করবে তাদের হাতে থাকতে হবে, পকেটকাটা দের চেয়ে বেশি জোর। এত জোর আসলে রাষ্ট্র ছাড়া কেউ দিতে পারে না। অর্থাৎ যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে, তাদের হাতে শক্তি থাকতে হবে। শুধু শক্তি নয়, থাকতে হবে তথ্য এবং গবেষণা। যে কারণে তাদের থাকতে হবে বাজারের সঙ্গেই। কারণ তাদের ভেতর থেকে জানতে হবে প্রকৃত উৎপাদন খরচ, পরিবহন খরচ এবং বাজারজাত খরচ। সুতরাং বোঝাই যায়, কাজটি সহজ নয়। চাইলেই একটা একটা নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা আকাশ থেকে পড়বে না। কিন্তু এবছর বাজাররের কিছু শুভ উদ্যোগ দেখে আমি কিছু আশার আলো দেখতে পাই। যেমন আমরা দেখলাম কিছু ব্যবসায়ী কম লাভে পণ্য বিক্রি করে প্রচুর বেচাকেনা করছেন। বলা যায় এই উদ্যোগগুলো বার বার ঠকে যাওয়া মানুষের পক্ষে নেয়া হয়েছে এবং পরিস্কার সাফল্যও পাওয়া গেছে। আসলে এই ঠকে যাওয়া মানুষদের একত্রিত হওয়া দরকার।  ধরা যাক কোন একটি বিশেষ সময় উপলক্ষে কোন একটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলো। সবাই মিলে বেশি বেশি ওই পণ্য কিনতে চেয়ে এর চাহিদাও বাড়িয়ে দেয়া হলো। আমাদের মুখস্ত অনুশীলন অনুযায়ী, বেশি চাহিদার কারণে তাৎক্ষনিকভাবে ওই পণ্যে দাম হয়ে যায় আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু আমরা যারা বার ঠকি এবং অবাক হই তারা যদি ওই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পণ্যটি আপতত না কেনার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে কী হয়? প্রচলিত অর্থনীতি কী বলে? দুঃখজনক হচ্ছে বঞ্চিত মানুষেরা কখনো একত্রিত হয় না। অথচ বাজার শোষনের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের একত্রিত হওয়ার চেয়ে তাৎক্ষণিক কার্যকর আর কোন সিদ্ধান্ত আছে বলে আমার মনে হয় না।    লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
রমজানে দরিদ্রের প্রতি আওয়ামী লীগের সহানুভূতি ও বিএনপির ইফতারের রাজনীতি
রমজান উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টির মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি চাঙ্গা করার পাশাপাশি মানুষের দৃস্টি আকর্ষণের কৌশল নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা নামিদামি হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দিয়ে বিশাল ইফতার পার্টির আয়োজন করে। তবে এবার কিছুটা ভিন্ন। কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।সেই নির্বাচন বর্জন করে সরকার পতনের আন্দোলন ডাক দিয়েছিল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, আবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন ’বয়কটের’  ডাক দিয়ে ব্যর্থ বিএনপি এখন ইফতার মাহফিলের নামে দলটির নেতা কর্মীদের চাঙ্গা করতে চাইছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে কম আয়ের মানুষের জন্য কোনো কর্মসূচি নেই। অথচ  রোজায় ‘মানবসেবা’মূলক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি এবার পুরো রোজায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দরিদ্রদের মধ্যে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করছে। রোজার শেষ সপ্তাহে ঈদসামগ্রীও বিতরণ করা হবে। রমজানে বিএনপির ইফতার রাজনীতি মঙ্গলবার রোজা শুরুর দিনে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নানা স্তরে পাঁচশ’র বেশি ইফতার আয়োজন করেছে বিএনপি। এইদিনেই রাজধানীর ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এবং দলের সিনিয়র নেতারা এতিম, আলেম ও ওলামা মাশায়েখদের সঙ্গে নিয়ে ইফতার করেন। সেখানে মেন্যু হিসেবে ছিল- খেজুর, ফল, পেয়াজু, বেগুনি, ছোলা, জিলাপি, জুস, ডিমসহ মোরগ পোলাও রোজার মাসে রাজপথে তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ইফতার ‘পার্টি’র নামে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপিতে নানামুখী সংকটের কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ ও হতাশা কাটিয়ে ইফতার মাহফিলের মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে চান তারা।  গেল ১২ মার্চে ঢাকার ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতার পার্টি। কাচ্চি বিরিয়ানির পাশাপাশি ৬-৭ পদের আইটেম দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই ইফতার পার্টিতে দেখা গেল পাকিস্তানি ব্র্যান্ড ‘সেজান’ জ্যুস। অথচ গত ১১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য সস্তা খাবার বরাদ্দ রেখে নিজেরা ‘দামি ফল, খেজুর, আঙুর’ খাবে।’ আর বাস্তবতা হলো, ঢাকার ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতার পার্টিতেই দেখা মিললো দামী খেজুরের। রমজানে আওয়ামী লীগের কৃচ্ছ্রতা সাধন অসহায়-ছিন্নমূল ও গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবনে কোনো ইফতারের আয়োজন না করার কথা রোজা শুরুর আগেই জানিয়েছেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ইফতার মাহফিল না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ এবার তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কোথাও ইফতার মাহফিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ইফতার আয়োজনের সকল অর্থ অসহায়-গরিব মানুষের মাঝে সহায়তা হিসেবে প্রদান করবে। রমজানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা রমজান ইফতার পার্টি করতাম। এবার রমজানে আমরা ইফতার পার্টির না করে সব টাকা ও খাদ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। মানুষের কল্যাণে কাজ করি।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন দলের নেতারা। তারা মনে করছেন, এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি বাড়াবে।  আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলো কোন ইফতার মাহফিলের আয়োজন করবেন না। সেই টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করবেন।’তিনি আরও বলেন, ‘রমজান সংযমের মাস। রমজান মাসে  কর্মসূচি চলমান রাখার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারা দেশের জনগণকে কোনোভাবেই স্বস্তিতে থাকতে দিতে চায় না। আমরা আগেই বলেছি, রমজানে ঘোষিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপি আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’ পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সারাদেশের নেতাকর্মীদের আটটি নির্দেশনা দিয়ে মাঠ থাকার নির্দেশ দিয়েছে সংগঠনটি। এরমধ্যে- শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার ও সেহরি বিতরণ; বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ; রমজান মাসে স্বেচ্ছা রক্তদান ইত্যাদি। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সারাদেশে অসচ্ছল মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করেছে সংগঠনটি।  রমজান সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ একটি মাস রমজান মুসলিম জাতির কাছে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়া, ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত সময়ও রমজান মাস। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ রোজা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন- 'আর তোমরা জমিনে বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না তার সংশোধনের পর এবং তাঁকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের কাছাকাছি।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬) রোজাদারদের পারস্পরিক সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রমজান মাসের রোজার ভূমিকা অপরিসীম উল্লেখ করে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন বলেন, ‘একজন রোজাদার ব্যক্তি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে গরিব-দুঃখীদের অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখার মধ্য দিয়ে সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন ও তাদের জন্য সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।’ নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বাস এই প্রিয় বাংলাদেশে। মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সম্প্রীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনো রকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। তাই সমাজ-জীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী  
প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি / ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি
ঢাকার আগারগাঁওয়ে সরকারি এক একর জমির উপর অবস্থিত বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)। বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করে দেওয়া স্থাপনায় এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, বাইগাম এ বিগত কয়েকটি কার্যনির্বাহী কমিটির দূর্নীতি ও অনিয়মতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিষ্ঠানটি আজ ধ্বংসের পথে।  লাগামহীন দূর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম সেই মুহূর্তে আশার আলো হয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর এগিয়ে আসে এবং একজন প্রশাসক নিয়োগ দেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে কাজ এখনো কাজ চলছে।  প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ (লটারি ফান্ড ৪ কোটি ১০ লক্ষ এবং মেম্বার সাবক্রিপশন ফান্ড ৮৮ লক্ষ টাকা) বিগত কমিটিগুলো পূর্বেই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তসরুপ করে খরচ করে ফেলেছে। এখন শুধুমাত্র কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো জমা রয়েছে। কার্যনির্বাহী কমিটিগুলোর লাগামহীন দুর্নীতি (৭২ লক্ষ টাকা সাব-স্টেশন স্থাপন বাবদ, ৪৩ লক্ষ টাকায় পিকনিক বাবদ, ২৫ লক্ষ টাকা কার্যনির্বাহী কমিটির সিটিং ও মিটিং ভাতাবাবদ, ২২ লক্ষ টাকা এজিএম বাবদ, ৬৮ লক্ষ টাকা ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন বাবদ, ২২ লক্ষ টাকা প্যাথলজি বিভাগে মেশিন ক্রয় বাবদ এবং কোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য ও ২০২৫ সালের লটারি দূর্নীতি ৪৭ লক্ষ টাকা) এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে গত দুই অর্থ বছর ধরে বাইগাম এর জন্য বরাদ্দকৃত সরকারী অর্থ এখন পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। ফলশ্রুতিতে আমরা বাইগামের কর্মকর্তা কর্মচারিরা গত ১ (এক) বছর যাবৎ বেতন ভাতা পাচ্ছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কি অবস্থা হবে সে বিষয়েও আমরা চিন্তিত।  বাইগাম আগারগাঁয়ে সরকারি ১(এক) একর জমির উপর সমাজসেবা অধিদফতর এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ভবনে এবং সরকারি বরাদ্দকৃত টাকায় পরিচালিত হচ্ছে। বাইগামের প্রবীণ নিবাসকে (বৃদ্ধাশ্রম)  সাধারণ মানুষসহ সরকারি নানা মহলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবীণ নিবাস হিসেবেই চিনে থাকেন। বর্তমানে আমরা মাত্র ৪০ জন প্রবীণকে প্রবীণ নিবাসে জায়গা দিতে পারছি। কিন্তু প্রতিদিনই প্রবীণ আসছে এখানে আশ্রয়ের আশায়, আশাহত হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তারা অজানার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না।  বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে, বর্তমানে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রবীণ। গবেষণা বলছে ২০৪০-৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যায় ২২ শতাংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী থাকবে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো ইউনিসেফের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিতে ২য় স্থানে রয়েছে। সে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৯ সালে বাংলাদশ প্রবীণপ্রবন সমাজে পা দিতে যাচ্ছে এবং ২০২৯ সালে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিনত হবে। রাস্ট্রীয়ভাবে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাইগামকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রথম সারির প্রবীণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বন্ধপ্রায় প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন রুপে সাঁজিয়ে এখানে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।   এমতাবস্থায়, বাইগামে কর্মরত আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারিরা গত ১ বছর ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতরভাবে দিনপার করছি। আমরা বিশ্বাস করি, কার্যনির্বাহী প্রথা সিস্টেমটি বিলুপ্তি করে প্রতিষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হলে এটি একসময় বাংলাদেশে প্রবীণকল্যাণে রাস্ট্রীয়ভাবে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রবীণদের কল্যাণে তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠানটিতে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরির মাধ্যমে প্রবীণ কল্যাণে কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান রুপান্তিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করার সময়ে এসেছে।  ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে আগারগাঁওয়ের বিভিন্ন সরকারি অফিসে এবং ঢাকায় ৫ হাজার খোলা চিঠি বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার দিকে পথ চেয়ে বসে আছি। আমরা চাই উন্নত বিশ্বের আদলে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সেবায় ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ আপনি আমাদের উপহার হিসেবে তৈরি করে দিবেন এবং আমাদের চাকুরীসহ বেতন ভাতার নিশ্চায়তা প্রদান করবেন।    ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ নির্মানের মাধ্যমে প্রবীণসেবায় রোল মডেল হিসেবে যে সমস্ত কাজ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করতে পারে এবং আমাদের চাওয়াসমূহ – ১. বাইগাম পরিচালিত প্রবীণ নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম) বর্তমানে মাত্র ৫০ জন প্রবীণ বসবাস করার সুযোগ পাচ্ছে, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিদিনই অসহায় প্রবীণ এখানে আসছে, আবাসনের অভাবে তাদের আমরা রাখতে পারছি না। অসহায় প্রবীণরা ব্যাগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে ফিরে যাচ্ছে। তাই এখানে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস তৈরি করার আবেদন/অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রবীণ নিবাসে বসবাস করার বর্তমান নিয়ম হচ্ছে, যাদের বয়স ৬০ এবং যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ প্রবীণ কেবলমাত্র তারাই থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু যারা শারিরীক ও মানসিক ভাবে সুস্থ নয়, তাদেরও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ২. ‘লং টার্ম কেয়ার সেন্টার’ তৈরি করা - উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও বাড়ছে ৮০ বছরের উর্ধ্বে বয়স্ক প্রবীণের সংখ্যা। এই বয়সে গেলে বেশিরভাগ মানুষই বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং তার পৃথিবী তৈরি হয় শুধুমাত্র একটি বিছানাকে কেন্দ্র করে। তাকে বিছানাতেই ফিজিওথেরাপি, খাওয়ানো, গোসল করানো ও টয়লেটিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব যেটাকে বলা হয় কেয়ার গিভিংয়ের দায়িত্ব নেবার পাইলট প্রকল্প চালু করে উন্নত বিশ্বের মতো একটি মডেল চালু করার সময় এসেছে এবং এই মুহূর্তে এটি বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন। ৩. প্রবীণ হাসপাতালের মাধ্যমে প্রবীণদের জন্য আউটডোর চিকিৎসাসেবা এবং আগারগাঁয়ে নির্মিত সরকারি টারশিয়ার লেভেলের হাসপাতালগুলোর (পঙ্গু হাসপাতাল, নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল দেশের উন্নয়নের অবকাঠামোতে যথারীতি রয়েছে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রবীণ নিবাসে বসবাসরত প্রবীণদের জন্য দ্রুত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এখানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট প্রবীণ হাসপাতাল পরিচালনা করা।  ৪. প্রবীণদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, ইন্ড লাইফ (মৃত্যপথ যাত্রী) কেয়ার সেন্টার ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। ৫. প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা কেন্দ্র স্থাপন করা এবং প্রতিষ্ঠানটি থেকে সরকারি হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থানে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বিপদে পড়লে পিতা-মাতার ভরণপোষন আইন-২০১৩ এর প্রয়োগ করা এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। ৬. ঢাকায় বসবাসরত অসুস্থ প্রবীণদের বাসায় গিয়ে কেয়ার গিভিং হোম সার্ভিসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৭. প্রবীণদের জন্য স্বল্পমূল্যে বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। ৮. দক্ষ প্রবীণবান্ধব সেবাকর্মী (জেরিয়েট্রিক কেয়ার গিভার) তৈরির উদ্দ্যেগ গ্রহন করা এবং বাংলাদেশে প্রবীণ সেবাকর্মীর চাহিদা মিটিয়ে উন্নত বিশ্বে দক্ষ জনবল হিসেবে তরুণদের কাজ করতে প্রেরণ করা। বাংলাদেশ থেকে উন্নতবিশ্বে এই জনবল পাঠানোর চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু সঠিক ট্রেনিংয়ের উদ্দ্যেগ গ্রহণের অভাবে আমরা প্রবীণ সেবাকর্মী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারছি না, এই উদ্যোগ গ্রহণ করাও এখন সময়ের দাবি।   মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে (বাইগাম) এ  বর্তমানে ১২০ জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রবীণ সেবায় দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি এক একর জমির উপর সরকারি অনুদানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত দূর্দশার ভিতর দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্ত গবেষণা ও তথ্য বলছে আগামীর বাংলাদেশ প্রবীণ নির্ভর বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্সে’ রুপান্তরিত করে প্রবীণ কল্যাণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন করে পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠানটিই হবে বাংলাদেশের প্রবীণকল্যাণে জন্য একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও, প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন-২০১৮ পাশ হয়েছে, ভবিষ্যতে ভিন্ন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে বাইগামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’ তৈরি করে প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনটিও এখানে পরিচালনা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।    পরিশেষে বলা যায়, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আমাদের সদিচ্ছা এবং বাস্তবমূখী নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবীণদের বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্যার ব্যাপকতা কমিয়ে আনা অনেকাংশেই সম্ভব। তাই এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে এবং গতিশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সস্তিময় বার্ধক্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তরুনদের প্রবীণ কল্যাণে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে আজকের তরুনই আগামীকালকের প্রবীণ। সকলেরই বার্ধক্য সস্তিময় ও শান্তিময় হোক। আধুনিক বাংলাদেশ নির্মানের রুপকার গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমরা বিশ্বাস করি আপনার হাত দিয়েই বাংলাদেশের সেকেন্ড ক্যাপিটাল খ্যাত আগারগাঁয়ে সরকারী এই ১(এক) একর জমির উপর তৈরি হবে বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে ‘বঙ্গবন্ধু প্রবীণ কমপ্লেক্স’।   লেখক :  বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক/ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী  ওজরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)  
বাজারের শুভ উদ্যোগগুলো আরও দীর্ঘ হোক
এবার রোজার আগে খিলগাঁও খলিলের মাংসের কথা খুব শোনা গেলো। টেলিভিশনে লাইভ হলো। লোকজন লাইন দিয়ে মাংস কিনলো। এর পর তার দেখা দেখি আরও অনেককে একই রকম উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। তারা কেউ কেউ খলিলের চেয়েও কম দামে মাংস বিক্রি করেছেন। দিন দিনে আরও উদ্যোগ আসছে। কিন্তু ঢাকায় খলিলের মত প্রচার এখনও কেউ পাননি। প্রথম উদ্যোগ বলে কথা।  আসলে কেউ কোন উদ্যোগের শুরুতে থাকলে তিনি সব সময় কিছু সুবিধা এমনি এমনি পাবেনই। অন্যরাও স্বেচ্ছায় সেই সুবিধা দেবেন। মোদ্দাকথা প্রথম উদ্যাক্তকে সবাই সম্মান করেন। কারণ আর কিছু নয়, তার সঙ্গগুণেই অনেকেই একটি ভাল উদ্যোগে যুক্ত হন। আসলে দোষও যেমন এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে মধ্যে সংক্রমিত হয় গুণও তেমনি।  কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আমাদের চোখে মানুষের গুণ খুব একটা প্রচার হয় না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিস্ফোরণের সময়। কিন্তু এবার রোজার আগে কেন জানি মানুষের ভাল কিছু উদ্যোগ সামনে আসছে। যেমন দেখা গেলো চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ মুদি ব্যবসায়ী শাহ আলম মাত্র ১টাকা লাভে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। দাম কমের কারণে শাহ আলমের দোকানে বেড়েছে বেচাকেনাও। অনেক দূর থেকে ক্রেতা আসছেন তাঁর দোকানে। শাহ আলমের উদ্যোগের ঢেউ এসে লেগেছে, ঢাকার ধামরাইয়ে। সেখানেও আছেন আরেক শাহ আলম। তার সঙ্গে রুবলে আহমেদ নামে আরও একজন আছেন। তারা দুই বন্ধু প্রতি পণ্যে ২টাকা লাভ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা মূলত ইফতারে ব্যবহৃত হয় এমন পণ্য বিক্রি করছেন। সেখানেও প্রচুর ক্রেতার ভিড়। ক্রেতারাই সাংবাদিকদের বলছেন, দুই বন্ধুর দোকানে মানুষ সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনেন। আর ওই দুই বন্ধু জানান, তাদের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। বিক্রি বাড়লেই ভাল ব্যবসা হয় এর জন্যে ক্রেতা ঠকাতে হয় না। দেশের বহু এলাকা থেকে এরকম নানা শুভ উদ্যোগের খবর আসছে ইদানিং। ঢাকা ও আশে পাশের এলাকায় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ মিলে রেটে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। যে কারণে এবার রোজার আগে বাজারের দাম নিয়ে যতটা উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল ততটা ছাপ পড়েনি জনজীবনে। সব শ্রেণির মানুষ কষ্ট করে হলেও রোজার খাবার যোগাড় করতে পারছেন।    আমি বলছি না বাজারে পুরোপুরি স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু একথা বলা যেতে পারে যে, আজ অল্প বিস্তর বিকল্প এসেছে একেবারে কম আয়ের মানুষের সামনে। কিন্তু মধ্যবিত্ত এখনও নানা কারণে সেই সুবিধার সামনে যেতে পারেনি। কিন্তু তারও যাওয়া দরকার। মধ্যবিত্তের সমস্যাতো আরও ভয়াবহ। একেবারে কম আয়ের মানুষ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পরিচিত মানুষের কাছে ঋণ চাইতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সব সময় সেটাও পারে না। তাই তার জন্যেও আজকের এই বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটে সুলভ বাজার দরকার। এত কথা বললাম, এত উদাহরণ দিলাম কারণ একটাই। দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্যে সুলভ বাজার দরকার। কিন্তু প্রচলিত যে বাজার পদ্ধতি, সেটা সবার নাগালের মধ্যে আসছে না। তাই একটি ধর্মীয় অনুভূতি সামনে রেখে, কখনও ব্যক্তিগত, আবার কখনও সরকারি উদ্যোগ নিতে হয়েছে। কর্পোরেট উদ্যোগ নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা তো কোন স্থায়ী সমাধান নয়। রোজা চলে গেলেই সব বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের ক্ষুধা তো রয়েই যাবে। সব শ্রেণির মানুষ এই সুবিধা চাইবে। তাই আমার প্রস্তাব, বাজারের এই মানুষ বান্ধব উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত করা হোক। উদ্যাক্তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বর্তমান শুভ উদ্যোগগুলোকে স্থায়ীরূপ দেয়া হোক।   একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে, আজ যেসব উদ্যোগে মানুষের কাছে একটু কমদামে যারা পণ্য দিচ্ছেন, তিনি বা তারা সারা বছরই এভাবে পণ্য দিতে পারেন। তাহলে একসময় এই বিশেষ উদ্যোগের কাছে সব ক্রেতা আসতে থাকবেন। তখন বেশি দামের পণ্য নিয়ে কতদিন বসে থাকবেন বেশি দামের ব্যবসায়ী?   অনেকের কাছে বিষয়টি উচ্চ মূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের শিশু সুলভ সমাধান মনে হতে পারে। কিন্তু আরেকবার ভেবে দেখুন, এটাইতো হওয়ার কথা ছিল। একজন ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামে পণ্য কিনবেন এবং সহনীয় লাভে সেই পণ্য বিক্রি করবেন। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মানেন না বলেই আমাদের সমাজে এক অর্থনৈতিক অসাম্য। বলা বাহুল্য এই অসাম্যই সামাজিক যত অশান্তির কারণ। খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে, আমি এই রোজার বাজারের কিছু শুভ উদ্যোগ স্থায়ী করার কথা বললাম বটে। কিন্তু একটু পেছন ফিরলে দেখা যাবে, কাজটি মোটেও সহজ নয়। এই তো রোজার ক’দিন আগেই কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করা নিয়ে বিরোধের জেরে রাজশাহীর বাঘায় মামুন হোসেন নামে এক মাংস ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। মামুনের পরিবার থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছিল, হত্যাকারীরা মামুনের প্রতিযোগী মাংস ব্যবসায়ী।  আজকে বাজারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে গেলেই অবধারিতভাবে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ চলে আসে। সংসদের মত যায়গায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের জোরের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সুতারাং কোন শুভ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করারও চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এই রোজায় সেই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কিছু উদ্যাক্তার কিছু সফল উদ্যোগ নিশ্চয়ই আমাদের সাহসী করে। বাজার অর্থনীতির এই চরম দুঃসময়ে এর চেয়ে ভাল আশার বাণী আর কী হতে পারে?  লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
পর্যটনের নতুন যুগে বাংলাদেশ
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়-পর্বত, গহীণ অরণ্য, জীব-বৈচিত্র্য, সমুদ্র-সৈকত, নদ-নদী, বৈচিত্রময় আদিবাসী সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ ও গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ, অতিথিপরায়ণ মানুষ অর্থাৎ বিশ্বের যে কোন প্রান্তের যে কোন পর্যটককে আকৃষ্ট করার মত সকল উপকরণই বাংলাদেশে বিদ্যমান। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে স্থানীয় জনসাধারণকে পর্যটন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে টেকসই পর্যটন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বাসস  পর্যটনের উন্নয়নে বর্তমান সরকার নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এ খাতে দ্রুত প্রসার ঘটছে। নতুন নতুন সুযোগ সুবিধা যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একুশ শতকের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন খাত। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রভাব রাখছে পর্যটনের বিকাশে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাহিদা অনুযায়ী পর্যটনের প্রসার ঘটছে। নতুন নতুন স্থানে পর্যটনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।  পর্যটন ও বাংলাদেশ   পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনের গুরুত্ব সর্বজনীন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি। যুগান্তর  পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) এবং সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি, ২০২৩ সালে তা আড়াই কোটিরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৭ সালে বিদেশি নাগরিক আগমন করেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন। এছাড়া ২০১৮ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। ২০১৯ সালে বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে এসেছেন ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সাল নাগাদ বিদেশি এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন। আর ২০২১ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন শুধু ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন। দেশে মোট ১ হাজার ৫১টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আকর্ষণীয় পর্যটন খাতে যেসব উপাদান থাকা দরকার যেমন-সমুদ্র, নদী, বন, পাহাড়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঋতুবৈচিত্র্য সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা রয়েছে ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুধু কক্সবাজারেই সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়া এই তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। পার্ক তিনটির কাজ সমাপ্তির পর প্রতি বছরে এতে বাড়তি ২শ’ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। কক্সবাজারের খুরুশকুলে শেখ হাসিনা টাওয়ার ও এথনিক ভিলেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের সহজ ও আরামদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিতে দেশের সব বিমান বন্দর উন্নয়নসহ কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে রেললাইন। দেশের পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নে পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে।  পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরে আছে কক্সবাজার। পরের অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পছন্দের তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট। হজরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত ছাড়াও সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত জায়গাগুলোতে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। বেড়ানোর তালিকায় আরও আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়পুর প্রভৃতি। ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকার খুব কাছে গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্টও এখন বেশ জনপ্রিয়। ইনকিলাব  সমুদ্রে পর্যটন  পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, সিলেটের সবুজ অরণ্যসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিমি. দীর্ঘ সৈকতটিতে কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্র সৈকতের চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হল সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। যুগান্তর সমুদ্র ও পাহাড় একসঙ্গে দেখার সুযোগ থাকায় কক্সবাজার দেশীয় পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আগে শীতের মৌসুমে বেশি ভিড় থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনায় মূখর থাকে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধার জন্য কক্সবাজারজুড়ে এখন ৫০০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে পাঁচতারকা মানের হোটেল যেমন রয়েছে, তেমনই আছে কম খরচে থাকার ব্যবস্থা।  সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ এবং সেখান থেকে নৌপথে সেন্টমার্টিন যেতে হত। সব মিলিয়ে ২৮২ কিলোমিটারের যাত্রা পথে ছিল নানা ঝক্কি। সাগর পথে ২৩৬ কিলোমিটার দূরে সেন্টমার্টিন যেতে সেই ঝক্কি ঝামেলা বিগত ৩ বছর যাবৎ আর নেই। বরং বাড়তি পাওনা নদী সাগরের বিচিত্র রূপ আর মুগ্ধতা। রাতে সাগর পাড়ি দিয়ে ভোরে প্রবালদ্বীপে সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে সেন্টমার্টিন জেটির অদূরে নোঙ্গর করে ফেলবে এমভি বে-ওয়ান। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ওয়াটার বাসটার্মিনাল থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ছেড়ে শুক্রবার ভোরে সেন্টমার্টিন এবং পরদিন শনিবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে সন্ধ্যায় ফেরা।   ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৭তলা বিলাসবহুল এই প্রমোদ তরিটি সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন ও লিফট সুবিধা সম্বলিত। ১৮০০ আসনের জাহাজটিতে সাধারণ চেয়ার থেকে বিলাসবহুল কেবিন, সিভিউ ও রুফটপ বুফেট রেস্তোঁরাসহ একাধিক ট্রেডিশনাল রেস্তোঁরা, আইসক্রিম ও কফিবার, ব্রান্ড শপ সবই আছে। জাহাজ পরিচালনা ও পর্যটকদের সেবা দেয়ার জন্য এতে নাবিক আছেন ১৬৭ জন।  এই কোম্পানীর সেন্টমার্টিন ক্রুজে করে সাগরবক্ষ থেকে গোটা প্রবালদ্বীপ, ছেড়াদ্বীপ, ঘোড়াদ্বীপ এবং নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে হয় বলে আন্তর্জাতিক মানের নৌনিরাপত্তা সম্বলিত এই জাহাজে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য রয়েছে লাইফ জ্যাকেট ও জীবনতরীসহ যাবতীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। বিশেষ করে সাগরে ঢেউ হলে জাহাজের তলদেশে থাকা দুইপাশে দুটিপাখা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে ঢেউয়ের মুখেও জাহাজ দুলতে পারে না। কক্সবাজারের মত বন্দরনগরী চট্টগ্রামকেও সরাসরি প্রবাল বেষ্টিত সেন্টমার্টিনের সঙ্গে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে আরো সম্প্রসারিত হল দেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা। ২০২০ পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের মধ্যে চালু হয় এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস এবং চট্টগাম-সেন্টমার্টিন পাঁচতারকা মানের বিলাসবহুল জাহাজ এমভি বে ওয়ান। নদীর নাব্যতাসহ বিভিন্ন সংকট মোকাবেলা করে দেশের অন্যতম বৃহৎ কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিঃ ২০২০ সালে ‘কর্ণফুলী ক্রুজলাইনের অধীনে শুরু করে অতি কাঙ্খিত ও স্বপ্নের এসব নৌরুটে জাহাজ চলাচল। বাসস  সেন্টমার্টিন ভ্রমণে ‘সি-প্লেন’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকরা সারা বছর যেতে পারবেন প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে। তবে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সীমিত পর্যটক সেখানে ভ্রমণ করতে পারবেন। এ জন্য সব পর্যটকদের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ইত্তেফাক  পাহাড়ে পর্যটন  পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অধিক পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হল পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়।  কমিউনিটি ট্যুরিজম- পথ দেখাচ্ছে দার্জিলিং পাড়া। বান্দরবানের রুমা উপজেলার বম জনগোষ্ঠীর এলাকা দার্জিলিং পাড়া ক্রমশ পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক কম মূল্যে থাকা-খাওয়া যায় সেখানে। পর্যটকদের থাকার জন্য বাঁশ ও কাঠের তৈরি কটেজ ও ছোট ছোট টংঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এসব পাড়ায় থাকলে একদিকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারেন, অন্যদিকে পাহাড়ে গ্রামীণ পরিবেশে প্রাণ-প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ হয় তাদের। সেখানে সব মিলে প্রায় ৩০০ জন পর্যটকের থাকার সুবিধা রয়েছে। ইংরেজি নববর্ষ ও ঈদের সময় আবাসনের সংকট পড়ে যায়। তখন খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে পর্যটকরা রাত কাটায়। কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে দার্জিলিং পাড়া। অধিকাংশ পর্যটক কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এই দার্জিলিং পাড়ার বিভিন্ন কটেজেই রাতযাপন করে থাকে। tbsnews  হাওরে ‘জলনিবাস’ বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নল, খাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী আর হাওর পারের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। কয়েক বছর আগেও এই হাওরে ভ্রমণ, থাকা সবকিছুই ছিল বেশ কষ্টকর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে হাওর ভ্রমণের জন্য এখন মিলছে নানা সুযোগ-সুবিধা। আর এটি ভ্রমণকে করেছে সহজ ও আরামদায়ক। পর্যটকদের জন্য এখন সেখানে মেলে বিভিন্ন মানের হাউসবোট। সেই বোটগুলোতে থাকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ঢাকা শহরের মানুষদের সহজে বিশ্রাম আর আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে দিতে শহরের কাছে কিন্তু কোলাহল থেকে দূরে বহু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। গাজীপুর, পূর্বাচলে মূলত এই রিসোর্ট গুলোর অবস্থান। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন বহু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনে বাড়ছে পর্যটন স্পট। পুরোনো পর্যটন স্পটগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন এবং নতুন আরো চারটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জুলাই মাস থেকে নতুন এই চারটি পর্যটন স্পটের নির্মাণকাজ শুরু হবে। চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। অর্থ বছরে (২০১৮-১৯) সুন্দরবনের এই সাতটি পর্যটন স্পটে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন বিদেশি পর্যটক ছিলেন। ঐ অর্থ বছরে সরকার সুন্দরবনের পর্যটন খাত থেকে প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা আয় করেছে। আগে দেশে পাঁচ তারকা হোটেল ছিলো মাত্র ২ টি। বর্তমানে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সরকারি হিসেবে ১৭ তে। আরও হোটেল চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ঢাকাসহ সারাদেশের অনেক হোটেল মালিকরা নিজেদের হোটেলকে ফাইভ স্টার বা পাঁচ তারকা হোটেল বলে দাবি করে থাকেন। অনেকে আবার ‘ফাইভ স্টার সমমানের সেবা’ শব্দটিও ব্যবহার করেন। এ নিয়ে অনেক সময় গ্রাহকরা বিভ্রান্তিতে পড়েন। আগামী তিন বছরে ঢাকায় পাঁচ তারকা মানের নতুন ৪টি হোটেল হতে যাচ্ছে। নগরীর গুলশানে দ্বারোদঘাটন করতে চলেছে সুইসোটেল, তাজ, ভিভান্ত ও হিলটন ব্র্যান্ডের এসব হোটেল। এতে করে বেড়াতে ও কাজের প্রয়োজনে ঢাকায় আসা বিদেশি ও স্থানীয় ভ্রমণকারীদের সুবিধা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।  লেখক: গণমাধ্যমকর্মী  
বাংলাদেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা: করণীয় ও প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের নারীরা যুগ যুগ ধরে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে তাকে সর্বদা রাখা হয়েছে অবদমিত। তার মেধা শ্রমশক্তিকে শুধু সাংসারিক কাজেই ব্যয় করা হয়েছে। সমাজ ও দেশ গঠন কাজে তাকে কখনও সম্পৃক্ত করা হয়নি। নারী আন্দোলনের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন– ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, তাহারা নিজেরাই নিজেদের অন্নের সংস্থান করুক।’ তাঁর এ আহ্বানে নারীর অধিকার অর্জনের পন্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও লিঙ্গভিত্তিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবু নারীদের নিরাপত্তা, বিশেষ করে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিশ্চিত করা একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং ক্ষমতায়নের মূল চালিকা হিসেবে বিবেচিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির নানামুখী পরিবর্তন হয়। শিক্ষা শুধু যে আত্মিক বিকাশের জন্যই অপরিহার্য তা নয়; বরং শিক্ষা বর্তমানে কর্মের দৃঢ় সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও তাদের ভবিষ্যৎ সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭২ সালে নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় রচিত এ সংবিধানে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে যে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮(১) ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’। ২৮(২) ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন’। ২৮(৩)-এ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষভেদ বা বিশ্রামের কারণে জনসাধারণের কোনও বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনও নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’। ২৮(৪)-এ উল্লেখ আছে যে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের কোনও অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’। ২৯(১) এ রয়েছে–  ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে’। ২৯(২)-এ আছে–  ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’। এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্র, অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি  বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ডিসেম্বর, ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) গৃহীত হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সালে কার্যকর হয়। নারীর জন্য আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস বলে চিহ্নিত এই দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদণ্ড বলে বিবেচিত। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ তিনটি ধারায় [২, ১৩(ক), ১৬(ক), ও (চ)] সংরক্ষণসহ এ সনদ অনুস্বাক্ষর করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ প্রণয়ন করে, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত ও অবহেলিত এ দেশের বৃহত্তর নারী সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন করা। এতদসত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপর যৌন হয়রানি ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তার রেখাপাত দাঁড় করিয়েছে। একটি গবেষণা সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী দেখা যায় যে পড়াশোনার মান নিয়ে সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা একই ধরনের মত দিলেও নিরাপত্তার বিষয়ে বিশাল মত পার্থক্য দেখা গেছে। পুরুষ শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও নারী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত। ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোতে দুই দলের এই বিশাল মতপার্থক্য এটি স্পষ্ট করে দেয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও নিরাপদ বোধ করার মতো পরিবেশ নারী শিক্ষার্থী প্রদান করা যায়নি। বাংলাদেশের সামাজিক রীতি-নীতিতে বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে আসছে। বাংলাদেশে আর্থিক উপার্জনমূলক খাতে নারীর পদচারণা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় কর্মক্ষেত্রেই বেড়েছে। নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বাড়ায়, নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রের পরিধি ও অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের আওতায় শিল্প, কলকারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে। নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগ্যতা ও দক্ষতাতেও পরিবর্তন এসেছে। সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর ২৭ শতাংশ নারী। উদ্যোক্তা হিসেবেও নারীদের উপস্থিতি নজর কেড়েছে, বিশেষত অনলাইন ব্যবসায়। গত তিন দশকে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পেছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে কর্মজীবী নারীর নিরাপত্তা। যৌন হয়রানির ফলে একজন নারীর কর্মজীবনে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি, মর্যাদাহানি এবং নারীর জীবনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে, নারীর পরিবারে দুঃখ-দুর্দশা, যন্ত্রণা ও অসম্মান ভোগ করে। তাই যৌন হয়রানি বন্ধে সরকারকে আইন, বিচার ও প্রশাসন রাষ্ট্রের এই তিন অঙ্গের সবকটি দ্বারা নারীর জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। সেখানে বলা আছে, কোনও প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত এবং প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের এবং শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই হাইকোর্টের এই নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক গত ২০১৯ সালের ১০ জুন জেনেভাতে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ১০৮তম সেশনে ‘Elimination of Violence and Harassment in the world of work’ শীর্ষক কনভেনশন ১৯০-এ বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে এই কনভেনশনের প্রস্তাবনা একদিকে একটি শক্তিশালী ফ্রেমওয়ার্ক ও সুরক্ষা কবজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে শিক্ষার সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রাথমিক স্তরে ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষার হার সমান হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা মাত্র ৩ শতাংশ পিছিয়ে। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ৬ শতাংশ এগিয়ে মাধ্যমিক স্তরে। পেশাগত এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে। পেশাগত শিক্ষায় নারী ৩৮ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় ৩৩ শতাংশ। অনেক প্রতিবন্ধকতা জয় করেই এগিয়ে চলেছেন দেশের নারীরা। আকাশে বিমান ওড়াচ্ছে নারী। হিমালয়ের চূড়ায় উঠছে নারী; বন্দুক কাঁধে যুদ্ধেও যাচ্ছে। নারীর নিয়োগ বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে। রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরতদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। শিক্ষায় নারীর নিরাপত্তার উন্নয়নে অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং হয়রানির ব্যাপকতা। নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মৌখিক অপব্যবহার, যৌন হয়রানি এবং এমনকি শারীরিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়, যা তাদের অ্যাকাডেমিক কর্মক্ষমতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তদুপরি হয়রানির অভিযোগের সমাধান এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থার অভাব সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অভিযোগ প্রতিকারের ব্যবস্থার অভাব রয়েছে এবং হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রায়ই রিপোর্ট করা হয় না, যা দায়মুক্তি এবং নীরবতার সংস্কৃতিকে স্থায়ী রূপ দান করছে। কিন্তু এরপরও সিংহভাগ নারীকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। একক নারী, নারীর একক পরিবার এবং একক মা—নারীর এই পরিচয়কে সমাজ করুণার চোখে দেখে। উন্নয়ন ও আধুনিকতার এই ডামাডোলের মধ্যেও নারীকে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে, বাইরে, পরিবহনে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীর যতই অর্জন থাকুক কিন্তু নিরাপত্তা ও অধিকার নারীরা ঠিক সেই অর্থে পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। দেশের জিডিপিতে মোট জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। এই কাজগুলো কোনও অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেসকোর ‘শান্তি বৃক্ষ’ এবং গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিছু হতাশা থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের অর্জন অনেক। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতাভিত্তিক এক উন্নত-সমৃদ্ধ বিশ্বে প্রবেশের মাধ্যমে উন্নত দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। প্রান্তিক নারী প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীগুলোর কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে পর্যাপ্ত নীতি তৈরি করা দরকার। যেসব আইন ও নীতি আছে, তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অবসানে স্কুলের পাঠ্যক্রমে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এছাড়া নারীর নিরাপত্তার উন্নয়ন, সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি সেবা পাওয়ার সহজপ্রাপ্যতা, সহিংসতা রোধে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সে বিষয়গুলো সরকার ও উন্নয়ন অংশীদারদের কার্যক্রম ও কৌশলে স্থান পাওয়া উচিত। এছাড়াও দেশের শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। করণীয়– ১. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। ২. নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ৩. আদালতের নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সে জন্য সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি থাকা উচিত। ৪. গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা। ৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলীর মাঝে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইন, প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এবং আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ৬. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধী একটি কমিটি থাকতে হবে। ৭. নারীবান্ধব অবকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নারী সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়। ৮. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোনও সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি নিজস্ব নৈতিক নীতিমালা বা কোড অব কন্ডাক্ট থাকা প্রয়োজন। ৯. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নির্যাতন সেল গঠন ও তার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত করা। ১০. নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশনগুলো অনুমোদন এবং সে অনুযায়ী আইন সংস্কার জরুরি। সর্বোপরি, নারীবান্ধব শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই পরিবেশ উন্নত হলে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে, যা আগামীর জন্য সুখী, সমৃদ্ধশালী ও টেকসই বাংলাদেশ বিনির্মাণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবে। লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী প্রচারের নেপথ্যে কি?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী এক ধরনের প্রচারণা চলছে। সেখানে ভারতীয় পণ্যসহ দেশটিকে 'বয়কট' নিয়ে করা বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে। যারা এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে কয়েকটি ছোটখাটো  রাজনৈতিক দলও যুক্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ পোস্টদাতা বলছেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভারত অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এই কারণে তারা ভারতীয় পণ্য বয়কটেরও ডাক দিচ্ছেন।’ এখন প্রশ্ন হলো- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোন দেশ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থান কেমন ছিল? আর কেনই বা শুধু ভারত-বিরোধী প্রচারণা চলছে? চীন ও রাশিয়া বর্তমান সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল। এই দুই দেশের ব্যাপারে নীরবতা কেন? দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশি তৎপর ছিল আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিএনপির পক্ষে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছিলন পিটার হাস। সরকারকে চাপে রাখতে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একা না, তার মিত্রদেরকেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রকম তৎপরতায় সামিল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপতারার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হলেও আড়ালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো।’ বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল চীনও। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, ‘সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে নির্বাচন চায় চীন। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাই নির্বাচন নিয়ে বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপ আমরা চাই না।’ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছিল, বাংলাদেশের নির্বাচন কিভাবে হবে সেটি দেশটির জনগণই ঠিক করবে।  বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এক দিকে প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল চীন, রাশিয়া এবং ভারত। অথচ গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারকে সমর্থন করার দায়ে ‘ইন্ডিয়া আউট’প্রচারণা চলছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠেছে, শুধু ভারত বিরোধী কেন? ‘চীন আউট‘এবং রাশিয়া আউট’প্রচারণা চলছে না কেন? তারাও তো প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। বাংলাদেশে ভারত বিরোধী এই অবস্থান নতুন নয়। মূলত ধর্মীয় কারণে ভারত বিরোধী এবং পাকিস্তান প্রেমী মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার কারণেও তারা ভারতকে পছন্দ করে না। আবার চীন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলেও এ বিষয়ে তাদের কোনও ক্ষোভ দেখা যায় না। ভারত বিরোধীতা বাংলাদেশে ট্রাম কার্ড হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত পদ্ধতি। ভারত বিরোধী এই রাজনীতি তীব্র হয় ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর থেকে। জিয়াউর রহমানের আমল থেকে এরশাদ বা তার পরবর্তী সময়েও ভারত বিরোধীতা চলে এসেছে। নব্বই দশকে রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা কার্ডটি খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সময় ভোট আসলেই প্রচার চালানো হতো- ‘ভারতের বিভিন্ন স্থানে নৌকা টাঙানো রয়েছে’, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে ঢাকা হবে দিল্লি’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে আযানের পরিবর্তে উলুধ্বনী শোনা যাবে’। এ ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভারত বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী বীজবপণ করার চেষ্টা করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপিকে ভারত ইস্যুতে সরব হয়েছিল। আর ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের চুক্তি সম্পাদনের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে টানা ১৫ বছর আন্দোলন করে জনসমর্থন না পেয়ে ‘ভারত বিরোধী’সেই পুরোনা কার্ড ব্যবহার করছে বিএনপি। দলটির নেতাদের কথাতেও তাই ফুটে উঠেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ভারত সরকারের ক্ষমতার জোরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছে। আওয়ামী লীগ এখন একটি ভারতীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের জনগণ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাকশালী শাসনের পক্ষে সহযোগিতা করছে। সরকারও এ সুযোগে দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বানিয়েছে।’ আর বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন স্পষ্টতই বাধাগ্রস্ত করছে ভারত সরকার। তারা তাদের পছন্দের বাইরে যেতে পারছে না।’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধানকে সমর্থন করায় ভারতের ওপর এতো রাগ বিএনপির। কিন্তু একই কারণে চীন বা রাশিয়ার বিষয়ে কিছু বলছে না তারা। চীন বা রাশিয়ার পণ্য বয়কট নিয়ে মুখে রা নেই বিএনপি নেতাদের। তারা জানেন বিরোধীতার ক্ষেত্রে ধর্ম একটা বড় হাতিয়ার। পাকিস্তানকে এখনও বাংলাদেশের যত মানুষ বন্ধু ভাবে, তার মূল কারণ ধর্ম। একাত্তরে পাকিস্তানিদের গণহত্যা তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির মাঠে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে বারবার বেছে নিয়েছে বিএনপি। এবারের নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে আবারও ভারত বিরোধী মনোভাব কাজে লাগাতে চাইছে দলটি। যাকে ‘প্রেসার ডিপ্লোমেসি’ বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন,  প্রকাশ্যে ভারতের কঠোর সমালোচনা করে বিএনপি একটি বার্তা দিতে চাইছে যে, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে শেষ কথা নয়। যার ফলে ভারত তার নিজের স্বার্থের জন্যই যেন বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে- এটাই তাদের কৌশল। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী