এক মিনিটের জন্য মাঠে না নেমেও যিনি ফুটবলের ‘মহাতারকা’
‘তার বাচনভঙ্গি এতটাই মধুর ছিল, যদি আপনি তাকে মুখ খোলার সুযোগ দেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে মুগ্ধ করবে। আপনি চাইলেও তাকে এড়াতে পারবেন না।’ কথাগুলো বলছিলেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক বেবেতো। যাকে নিয়ে বলছিলেন তার নাম কাইজার। কালোর্স কাইজার। লোকে তাকে বেবোতো, রেনেতো ও গাউচোর মতো ব্রাজিলের হয়ে খেলা বড় তারকাদের বন্ধু হিসেবে চিনতো। কাইজারের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল একজন ফুটবলার হিসেবে। নাম লিখিয়েছেন তিন দেশের মোট নয়টি ক্লাবের সঙ্গে । ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এতগুলো দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েও একটিবারের জন্যও পেশাদার ম্যাচ খেলেননি। ভাবছেন ঠিক পড়ছি তো? ঠিকই পড়ছেন, একবারও মাঠে নামেননি তিনি!
পেশাদার ক্যারিয়ারে ব্রাজিলের বোটাফোগো, ফ্লেমেঙ্গো, বাঙ্গু, ফ্লুমিনেনসে, ভাস্কো ডা গামা, এল পাসো সিক্সশুটার ও আমেরিকার (আরজে) সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়েছেন। চুক্তি করেছেন ম্যাক্সিকোর পুইবলা ও ফ্রান্সের গ্যাজিলিক আজাসিওর সঙ্গে। যদিও নানা অজুহাতে একবারও মাঠে নামেননি কাইজার।
১৯৬৩ সালের ২ এপ্রিল ব্রাজিলেরন রিও পার্দোতে তার জন্ম। পরিবারের পক্ষ থেকে তার নাম রাখা হয় কার্লোস হেনরিক রাপসো। যদিও নামটা খুব কমই ব্যবহার করা।
কার্লোস কাইজার
জার্মান মহাতারকা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে ‘ডের কাইজার’ বলা হতো। এর অর্থ সম্রাট। সত্তরের দশকের জার্মানির অধিনায়কের মাঠের দাপটের সঙ্গে জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। প্রচলিত আছে বেকেনবাওয়ারের মতো চেহারায় অনেকটা মিল হওয়ায় কার্লোস হেনরিক রাপসো ধারণ করেন ‘কালোর্স কাইজার’ নাম।
১৯৭২ সালে রিও ডি জেনেরিওর দল বোটাফোগোতে ফুটবলের হাতেখড়ি। পরের বছর নাম লেখান ফ্লেমেঙ্গোর হয়ে। ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো সিনিয়র লেভেলে যোগ দেন ম্যাক্সিকান দল পুইবলার হয়ে।
ব্রাজিলে ফিরে কয়েকটি অখ্যাত সংবাদপত্রের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সামনে আসেন। সবাইকে জানানো হয়, পুইবলার জার্সিতে এতটাই ভালো খেলেছেন যে তারা তাকে ম্যাক্সিকো জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য বলা হয়েছে। যদিও দেশের টানে তিনি তাদের ‘না’ বলে দিয়েছেন।
সাংবাদিক, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী ও মডেলদের নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। এর মাধ্যমে ক্লাবগুলোকে আকৃষ্ট করতেন তিনি। রিও ডি জেনেরিওর সমুদ্র সৈকত ও নাইট ক্লাবগুলো আয়োজন করতেন রঙিন পার্টি।
১৯৮১ সালে ছোটবেলার দল বোটাফোগোতে ফিরে আসেন। সেখানে পুইবলার মতো বানোয়াট ইনজুরি দেখিয়ে দুই মৌসুম কাটিয়ে দেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন ফ্লেমেঙ্গোতে। চুক্তির পয়সা হাতিয়ে নিয়ে এখানেও মাঠে না নামার একই কারণ দেখান। শেষ পর্যন্ত দল থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়।
অ্যাতলেটিকো টলারের্সের নাম ভাঙিয়ে ১৯৮৪ সালে কোপা লিবারটাডোরেস ও ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন বলে দাবি করেন কাইজার। যদিও আর্জেন্টাইন দলটির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই ছিল না। না খেলেই দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাবগুলোর মহাদেশীয় দুটি টুর্নামেন্ট জিতেছেন এমন মিথ্যা দাবি করে এবার ইউরোপে পা রাখেন।
কাইজারের সঙ্গে গাউচো ও রেনেতো
১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের দ্বিতীয় সারির লিগের দল গ্যাজিলিক আজাসিওতে খেলতে যান। চুক্তির পর ফ্রেঞ্চ ক্লাবটি তাকে নিয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মাঠে থাকা দর্শকদের দিকে বল ছুড়ে কোনও মতো পার পান তিনি। শেষ পর্যন্ত নানা কারণ দেখিয়ে মাঠে নামেননি। আবার ফিরে আসেন বাড়িতে।
গ্যাজিলিক আজাসিওর হয়ে সেরা গোলদাতা হয়েছেন, এমন মিথ্যা সংবাদ ছেপে ১৯৮৮ সালে ব্রাজিলের একটি ছোট দল বাঙ্গুর সঙ্গে চুক্তি করেন কাইজার। দলটির প্রধান ছিলেন ক্যাস্টর ডি আনদ্রাডে। তৎকালীন রিও ডি জেনেরিওর অন্যতম ত্রাস ছিলেন তিনি। রেফারির ভুল সিদ্ধান্তের জন্য মাঠে বন্দুক চালানোর রেকর্ড ছিল ক্যাস্টরের।
প্রতিকী ছবি
বাঙ্গুতে যোগ দিলেও পুরাতন ইনজুরির কারণ দেখিয়ে দিনের পর দিন বিশ্রামে ছিলেন কাইজার। ক্যাস্টর তাকে পছন্দ করতেন কারণ রিও ডি জেনেরিওতে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কাইজার। নিজ দলে এমন তারকা পেয়ে বেশ খুশিই ছিলেন বাঙ্গু প্রধান।
ইনজুরিতে থাকা অবস্থায় মধ্যরাতে পার্টি করছেন কাইজার। এমন তথ্য পেয়ে ডন ক্যাস্টর বেশ খেপেছিলেন। তার মধ্যে একের পর এক ম্যাচ হারছিল বাঙ্গু। অবশেষে দলের সবচেয়ে বড় তারকাকে নামানোর প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো বিপাকে পড়েন কাইজার। হয় খেলো অথবা মরো।
সাইডবেঞ্চে বসে মানসিকভাবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পেশাদার ফুটবলে প্রথমবার মাঠে নামবেন কাইজার। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে বদলির সময় এলো। ঠিক তখন এক কাণ্ড ঘটালেন তিনি। গ্যালারিতে গিয়ে দর্শকদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন। তাই লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকেই বিদায় জানানো হলো তাকে।
ম্যাচের পর যখন ক্যাস্টরের মুখোমুখি হলেন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। এই বুঝি বন্দুকের গুলিতে শেষ হয়ে গেল জীবন! এমন মুহূর্তে কাইজার বলে উঠলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমার বাবা-মাকে নিয়ে গেছেন। তবে আরেকজন বাবাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। গ্যালারি থেকে যখন তার নামে বাজে শব্দ আসে অবশ্যই আমি প্রতিবাদ করবো। এটা আমার দায়িত্ব। চিন্তা করবেন না। আমার চুক্তির কয়েকদিন বাকি। এরপরই আমি চলে যাবো।’
এমন কথা শুনে মন গলে গেল ক্যাস্টরের। তার সঙ্গে চুক্তি মেয়াদ বৃদ্ধি করল ক্লাব। সঙ্গে দাপটও বেড়ে গেল কাইজারের।
যদিও তারকা খ্যাতির জন্য ফ্লুমিনেনসে যোগ দিতে সক্ষম হন। ভাস্কো দ্য গামা, এল পাসো সিক্সশুটার হয়ে ১৯৯০ সালে রিওর আমেরিকা ক্লাবে এসে থামেন তিনি।
রেনোতো ছিলেন আশির দশকে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অন্যতম তারকা। কাইজার বেশিরভাগ সময় রেনেতোর সঙ্গে কাটাতেন। সঙ্গে থাকতেন গাউচোসহ অন্য ফুটবলাররা। রিওর জগৎখ্যাত কার্নিভালগুলোতে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রাজিলিয়ান তারকা রোমারিও থেকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা পর্যন্ত।
রেনোতো, রোমারিও ও তুলিও তিন সেরা ফুটবলার নিয়ে ১৯৯৫ সালে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন হয়। বিষয় ছিল, রিও ডি জেনেরিওর রাজা কে? শেষ পর্যন্ত রেনেতো জিতেছিলেন এতে। যদিও সমসাময়িক আরেক ফুটবলার অ্যালেক্সজান্দ্রো তোরেসের মতে সত্যিকারের রিওর রাজা ছিলেন কাইজার। ফুটবল না খেলেও যিনি সেরা তারকাদের তুলনাও বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেছিলেন।
কাইজারের বর্তমান
২০১১ সালে কাইজারের বিষয়গুলো সামনে আসতে থাকে। চার বছরের মাথায় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রোডাকশন সংস্থা নডম অ্যান্ড ভ্যালির সঙ্গে চুক্তি করেন। তার পুরো গল্প সিনেমায় নিয়ে আসার জন্য। ২০১৬ সালে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ হয়। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় ‘দ্য গ্রেটেস্ট ফুটবলার নেভার টু প্লে ফুটবল’ সিনেমাটি। কার্লোস আলবার্তো তোরেস, জিকো, রেনেতো, বেবেতো ও রিকার্ডোর মতো ব্রাজিলের তারকা ফুটবলাররা এই সিনেমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। একই বছর রব স্মিথের ‘দ্য গ্রেটেস্ট ফুটবলার নেভার টু প্লে ফুটবল’ বইটিও প্রকাশ পায়। বর্তমানে নারীদের একটি ফিটনেস ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করছেন ৫৭ বছর বয়সী কাইজার।
রব স্মিথকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সেরা খেলোয়াড়দের মতো খ্যাতি চেয়েছিলাম। আমার খেলার কোনও ইচ্ছা ছিল না। আমি ছাড়া সবাই আমাকে ফুটবলার হিসেবে দেখতে চাইতো। সৃষ্টিকর্তাও সবার ইচ্ছায় সন্তুষ্ট ছিল না। তাতে আমার এখানে কি করার?’
ওয়াই/জেবি
মন্তব্য করুন