করোনা পজিটিভকালে এবং সুস্থ হবার পর রোগীর জীবন-যাপন ও খাদ্য চাহিদা
করোনায় আক্রান্ত হবার পর একজন রোগীর ওপর দিয়ে অনেক ধকল যায়। যার ফলে রোগীর দুর্বলতা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। বিভিন্ন রকম Antibiotic এবং Antiviral সহ বিভিন্ন মেডিসিনের প্রভাবে রোগী নেতিয়ে পড়েন। Antihistamin, Bronchodilator, nebulizer পাশাপাশি Inhaler ব্যবহারের কারণে রোগীর গলা শুকিয়ে যায়। অনেক সময় বিভিন্ন রকম Steroid inhaler ব্যবহারের কারণে অরুচির সৃষ্টি হয় এবং মুখে ঘাঁ হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। করোনার অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম আরেকটি যখন হলো গন্ধহীনতা, অরুচি এবং মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের চিকিৎসায় যখন Steroid ব্যবহার করা হয়, অনেক রোগীরই তখন মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুধা হয়, কিন্তু গন্ধ বা স্বাদহীনতার জন্য খেতে পারেন না, পাশাপাশি বিভিন্ন মেডিসিনের কারণে রোগীর পেট ব্যথ্যাসহ আলসার হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা সেই সাথে একটি সুষম খাদ্যে তালিকায় পারে রোগীকে পরবর্তীতে একটি সুন্দর জীবনে ফিরে আনতে।
একজন স্বাভাবিক মানুষের দিনে যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, অসুস্থতা ও অরুচির কারণে এ সময় প্রয়োজনীয় ক্যালোরি গ্রহণ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভবপর হয়ে উঠে না। রোগের জন্য তো আছেই ক্যালোরির ঘাটতির কারণেও রোগী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পরেন। তাই করোনা আক্রান্ত রোগীদের এবং পরবর্তীতে সেরে উঠার পর খাবারের ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। এ সময় রোগীর খাবারে অবশ্যই Dehydration থাকতে হবে। অধিক ক্যালোরি সম্পন্ন কম মশলা যুক্ত নরম ও তরল খাবার দিতে হবে যাতে রোগীর ডাইজেশন এ কোন রকম সমস্যা না হয়। জ্বরের রোগীদের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবার কারণে প্রচুর ক্যালোরি বার্ন হয়। এতে করে মাংস পেশি শুকিয়ে যায় এবং ডিহাইড্রেশনও দেখা দিতে পারে।
কিছু রোগীর লক্ষণ পাতলা পায়খানা দিয়ে শুরু হয়। তাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডিহাইড্রেশনের সাথে Electrolytes imbalance হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি খারাপ হয়ে যাবার কারণে অনেক রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হয়। শ্বাসকষ্টের কারণে বা গলা ব্যথা থেকে যে, Panic attack তৈরি হয় এতে করেও অনেক রোগী খেতে চান না বা খেতে পারেন না।
করোনা কালে প্রতিটা রোগীর অসুস্থতার কারণে ক্যালোরির চাহিদা বেড়ে যায়। এই সময় রোগীকে অন্তত ১ মাস হাই-ক্যালোরি সমৃদ্ধ পুষ্টিযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে যা রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ক্ষেত্র বিশেষে তা ২ থেকে ৩ মাস ও হতে পারে। এ সময় সাধারণত পরে কেজি বডি ওয়েট এর সাথে ২৫-৩০ কিলো ক্যালরি বাড়িয়ে বিশেষ ডায়েট চার্ট প্রস্তুত করা হয়ে থাকে যার জন্য এ সময় একজন এক্সপার্ট বা পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী। করোনা পরবর্তী সময় রোগীর ওজন কমে যায়। চুল পরে যেতে পারে, ত্বক নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলো থেকে সেরে ওঠার জন্য রোগীকে অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। তার খাদ্য তালিকায় ভিটামিন বা মিনারেল এর যেন কোনো অভাব বা ঘাটতি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রোটিন:
একজন স্বাভাবিক মানুষের সারাদিনের খাদ্য চাহিদার খাদ্য চাহিদার ১৫-২০% হচ্ছে এই প্রোটিন প্রয়োজন। কিন্তু করোনা কালে প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এ সময় শরীরের বডি Immune system কে করোনার সাথে যুদ্ধ করে একটিভ থাকতে হয়েছিল। তাই রোগী সুস্থ হবার পর শরীরের ইমিউনিটি অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পরে, একারণে সে সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুর্ণস্থাপনের জন্য প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, উদ্ভিজ্জ প্রোটিন (বীজ জাতীয় খাবার ডাল) খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে যাদের কিডনি সমস্যা, গাউট বা লিভারের সমস্যা (Hepatic Encephalopatay) আছে, তাদেরকে পরিমাপ করে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। সারাদিনের খাদ্য তালিকার সাথে প্রোটিনটা যেন সুষমভাবে বণ্টিত হয় সে জন্য একজন এক্সপার্ট এর সহায়তা জরুরী। ফ্যাট: একজন স্বাভাবিক মানুষের সারাদিনের খাদ্য চাহিদার ২৫-৩০% ক্যালোরি ফ্যাট বা চর্বি হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। করোনায় শরীরের উচ্চ তাপমাত্রার (জ্বর) কারণে প্রচুর ক্যালোরি বার্ন হয়, পাশাপাশি মাংসপেশিও শুকিয়ে যায়। তাই এ সময় শরীরের চাহিদা মোতাবেক ভালো চর্বি (PUFA) যেমন সামুদ্রিক তৈলাক্ত মাছ, মাছের চর্বি, বিভিন্ন রকমের বাদাম খেতে হবে। যাদের কোন রকম কো-মরবিডিটিজ নেই যেমন হার্ট, বার্ন, কিডনি রোগ, স্থূলতা), তারা এসব খাবারের পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণে মাখন, পানির ও ঘি ও খেতে পারেন শরীরের চাহিদা বুঝে।
A এন্টি অক্সিডেন্ট (ভিটামিন এ ও সি)
শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে বুষ্টআপ করতে এ্যান্টিঅথিডেমম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে প্রতিদিন, যা শরীরকে ফ্রি রেডিকেল্স এর সাথে লড়াই করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুনরায় বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে। ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন আমলকি, পেয়ারা, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডালিম, কমলা, লেবু, মালটা এই ফলগুলোর কিছু না কিছু প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। আখরোট, চিনাবাদাম, পেস্তাবাদাম, এ জাতীয় খাবার থেকে সহজেই আমরা ভিটামিন ই পেতে পারি।
আয়রন:
করোনা কালে খাবারের অনিয়মের কারণে রক্তে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই যেসব খাবার আইরন সমৃদ্ধ, সেসব খাবার খাওয়ার পাশাপাশি আইরন যেনো খাবারের মাধ্যমে শরীরে ভালোভাবে absonptian হয় এর জন্য খাবারের সাথে লেবু যুক্ত করা যেতে পারে।
ভিটামিন ও শাকসবজি: আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পুনরায় সক্রিয় করার জন্য, পুর্ণস্থাপনের জন্য অবশ্যই ভিটামিন ও মিনারেল যুক্ত খাবার খেতে হবে। বিভিন্ন রকমের সবুজ হলুদ ও রঙিন শাকসবজি পাশাপাশি ব্রকলি, গাজর, মিষ্টিকুমড়া, ক্যাপসিকামসহ বিভিন্ন রঙিন শাক-সবজিকে খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম:
বর্তমানে আমাদের দেশে সিরাম ডি থ্রি লেভেল টেস্ট করলে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ভিটামিন ডি এর ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। দুধ, পনির, ডিমের কুসুম, সামুদ্রিক মাছ এসব খাবার ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণ
করে। পাশাপাশি প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২ টার মধ্যে অন্ততপক্ষে ১৫-২০ মিনিট শরীরে সরাসরি রোদ লাগাতে পারলে খুবই ভালো, কারণ সূর্যই হলো ভিটামিন ডি এর মুল উৎস। শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি থাকলে ক্যালসিয়াম এর শোষণ ক্ষমতাও কমে যায়। তাই ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার যেমন- ছোট মাছ, দুধ, পনির এসব খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার ও নিয়ম করে খেতে হবে।
জিংক ও সেলেনিয়াম:
বীজ জাতীয় খাবার, লাল মাংসে প্রচুর পরিমাণে জিংক থাকে। তবে কিডনি রোগীদের পরিমিত পরিমাপে হিসেব করে খেতে হবে।
প্রোবায়োটিক:
এ সময় প্রোবায়োটিক এর ভূমিকা অপরিসীম। যা অনায়াসে টক দই থেকে পাওয়া যেতে পারে। কোভিড রোগী সুস্থ হবার পরবর্তী সময়ে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং তরল খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার পাশাপাশি মুরগীর সুপ, সবজির সুপ, ফ্রুট জুস, কচি ডাবের পানি খাওয়া উচিত। তবে রোগীর রোগ ভেদে যেমন- ডায়াবেটিস, প্রেশার, কিডনি রোগ, স্থূলতা) এবং করোনার বিভিন্ন লক্ষণ সমূহের উপর ভিত্তি করে প্রেশার (যেমন- পাতলা পায়খানা, বমি, শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা) একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদই পারেন শরীরের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী খাদ্য তালিকাকে সাজাতে এবং খাবারের বৈচিত্র্যটা বা ভিন্নতা আনতে। যারা করোনা আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হচ্ছেন, পরবর্তীতে আবারো আক্রান্ত হলে আগে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কমে গিয়েছিল, পরবর্তীতে আক্রান্ত হলে ভঙ্গুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রোগীকে আরও দুর্বল করে দিয়ে কমপ্লিকেশন আরো বাড়িয়ে তুলবে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যখনই করোনায় আক্রান্ত হবেন পাশাপাশি সেরে উঠবেন, তখন থেকেই সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখতে হবে।
যে খাবার গুলোকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে:
অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, চর্বি জাতীয় শক্ত খাবার, টিন্ড ফুড, প্রোসেস ফুড, জ্যাংক ফুড, ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংকস, হালকা সিদ্ধ মাছ বা মাংস। নিয়মিত খাবার গ্রহণের পাশাপাশি কিছু নিয়ম ও মেনে চলতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম এ সময় বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। নিয়ম করে প্রাপ্ত বয়স্কদের নূন্যতম ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। করোনা পরবর্তী সময়ে অনেকেই ডিপ্রেশনে ভোগেন। যা শরীরের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। প্রতিদিন হালকা হাঁটাহাঁটি বা লাইট ফ্রি ব্যান্ড এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। তবে খুব বেশি ধকল নেবার দরকার নেই। কারণ এসময় শরীর এমনিতেও দুর্বল থাকে।
যারা ঘরে বসে চিকিৎসা নিয়েছেন, করোনা নেগেটিভ হয়ে যাবার পরও সুষম খাদ্যের অভাবে অনেক সময় ইলেকট্রলাইটস্ ইমবেলেন্স হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অনেক সময় ফেরেটিন লেভেল বা ডি ভাইমার বাড়তে পারে, চাপ পড়তে পারে লিভার ও কিডনির উপর। আবার স্টেরয়েড নেবার কারণে ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত হবার কারণে ফুসফুস কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বয়স অনুপাতে মাথায় রক্তক্ষরণ-জমাট বাধার ঝুঁকি কতদূর, এসব ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এ সময় অবশ্যই রোগীকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে রুটিন চেক আপগুলো করে নিতে হবে। অন্যথায় নানারকম ঝুঁকি সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
লেখা-
ডা: মৌসুমী আফরিন ইভা
ফ্রন্ট লাইন ফাইটার (কোভিড যোদ্ধা) হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
কনসালট্যান্ট- ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, ডায়াবেটোলজিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১৪৫/২, নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ, ঢাকা
জিএ
মন্তব্য করুন