• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

গল্পটা এখনও শেষ হয়নি

জান্নাতুল ফেরদৌস রিমু, আরটিভি অনলাইন

  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৪৯

অন্য দশটা সিনেমার পান্ডুলিপি কিংবা উপন্যাসে লেখকের রসবোধে সৃষ্ট কোনও কাহিনী নয় এটা। হারানো আর হাহাকারের প্রান্ত থেকে জীবন বদলে দেবার গল্প। শঙ্কা আর স্বপ্নের মাঝে লড়ে যাওয়ার গল্প। দিশাহীন দুটো মানুষের পথ ফিরে পেয়ে জ্বলে ওঠার গল্প, সাফল্যের গল্প।

দুটো মানুষ। হ্যাঁ, তাদের প্রেমের শুরুটা শৈশবে। ডাংগুলি আর বৌচি খেলা থেকে শুরু হয়েছিল অনেকটা অগোচরেই। শান্ত আর স্বল্পভাষী মহসিন নজর কেড়েছিল চঞ্চল আর বাকপটু শিল্পীর। তারপর জীবন ভাবনায় তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ভালবাসতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি ।

সেদিন এক কাপড়েই ঘর ছেড়েছিলেন তারা। এক মুহূর্তও দ্বিধা হয়নি। এমন না যে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছেন তারা। সব কিছু ঠিকই ছিল, বদলে গেলো শুধু দায়িত্বের ব্যাপ্তি। সম্পর্কের জটিলতায় একমাত্র সমাধান তখন এটাই বাকি ছিল দুজনের হাতে।

নতুন সংসারে চালচুলো ছাড়া দু'টো মানুষ নিজেদের ধূসর জৌলুসহীন স্বপ্নে ক্রমেই হঠাৎ আসা কালো মেঘের নিকষ ভয়ংকর রূপটাই কেবল দেখতে লাগল। শুধু একজনের আয়, তাও চাকরিটা টিকবে তো? শঙ্কায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় কুকড়ে যাওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না।

প্রথম সন্তান রাতু, তখন পেটে পৃথিবীর আলো দেখার অপেক্ষায়। সব প্রতিকূলতাকে জয় করে শূণ্য ঘরে আলো ছড়িয়ে রাতু'র আগমন এই ছোট সংসারে, মা হলেও শিল্পী তখনও কিশোরী, অপরিণত। জন্মের সপ্তম দিনের ঘটনা এটা। "মামনিটার গায়ের ময়লাগুলো আর কতদিন এভাবে রাখবো" অফিসে যাবার প্রাক্কালে মহসিনের কানে এমন কিছু কথাই এসেছিল।

নিতান্তই কোনটা ভালো বোঝার মতো জ্ঞান তখনও হয়নি সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানের বাবা-মার। বয়োঃজ্যেষ্ঠ কেউ যে পরামর্শ দিবেন, সে সুযোগটাই বা কই? সাতপাঁচ ভেবে তাই শিল্পীকে বলেই ফেললেন, 'করো, যেটা ভালো মনে হয়। দরকার হলে পাশের বাড়ির পারভিন আপাকে ডেকে নিও না হয়।' এই বলে বেড়িয়ে গেলেন তড়িৎ গতিতে।

অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে যে। সেদিন খুব যত্ন নিয়ে গোসল করিয়েছে মামনিকে- একমাত্র জাদুমনি বলে কথা। সাবান, গরম পানি, ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় শরীরটা একেবারে পরিষ্কার। ''একটা ময়লাও গায়ে আর নেই, ইশ এতদিন যে কেন অপেক্ষা করলাম' এইটা ভেবেই বিরক্ত লাগছিল শিল্পীর। তারপর সুন্দর জামা, মুখে-গলায় পাউডার, কপালে বড় করে কাজল। বড় মায়াময় লাগছিল জাদুমণিটাকে, কিন্তু হাল্কা নীল হতে থাকা শরীরটা চোখেই পড়লনা।

এক সপ্তাহ পরের কথা। আজ রাতুকে নিয়ে বাসায় যেতে পারবে শিল্পী, হাসপাতালে সব ফর্মালিটি শেষ করে সামনের বাসার পারভিন আপা যখন সিএনজিতে উঠলো তখন এক হাতে সাদা কাপড়ে জড়ানো রাতুর নিথর দেহটা। আরেক হাতে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া অচেতন শিল্পী- ডাক্তার এর মুখে মৃত ঘোষণা শুনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

ডাক্তার বলছিলেন, নাভিতে নাকি ইনফেকশন হয়ে গেছে। পুরুষদের কাঁদতে নেই, তাই প্রথম সন্তানের মৃত্যু শোকে কাতর হবার বিলাসিতা করার সুযোগ পাননি মহসিন। একদিকে ঘরে শিল্পীর পাগলপ্রায় অবস্থা, অন্যদিকে চাকরি-ওভারটাইম। ভয়ংকর সময়টা হঠাৎ করেই বাস্তবতার রূঢ় দিকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যেন খানিকটা জোর করেই।

এরই মাঝে সময়ের স্রোতে আবার জীবনযুদ্ধে রণাঙ্গনে নামতেই হয় শিল্পীর, তবে হঠাৎ হঠাৎ চোখে ভেসে ওঠা রাতুর মুখটা সবকিছু কেন যেন এলোমেলো করে দেয়। নিত্য টানের সংসারে স্বপ্নের বুনন চলতেই থাকে। বছর গড়িয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে সাত মাসেই যখন জন্ম হল ছেলেটার, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল তখন শিল্পী।

এই সেদিনের কথা যেন। অসুস্থ শরীরে রুগ্ন হাতটা তখনও মহসিনের হাতে। লেবার রুমে ঢুকানোর আগে ওর সেই কান্নাটা যেন আজও ভুলতে পারেন না। কিংবা প্রথম যখন টের পেয়েছিল পেটের ভিতর আরেকটা সত্ত্বার।

দুশ্চিন্তা, অপুষ্টি, শত নির্ঘুম রাত পার করে শরীরটা যে আর নিতে পারেনি। কাঁচা শরীরটা নিয়ে এইভাবেই একা হাতে সব সামলে নিল সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে। দিনভর সংসারের কাজ, কুয়ো থেকে পানি তোলা দিয়ে যার দিন শুরু হয়, শেষ হয় গভীর রাতে একা বারান্দায় বসে নিপুণ হাতে মহাজনের দেয়া পাঞ্জাবীর ঘুন্টির আর্জেন্ট অর্ডার কম্পলিট করে। দুটো বাড়তি পয়সা যা আসবে তা দিয়ে কোন একদিন নিশ্চয় একটু সুখের দিন আসবে।

এভাবেই দিন, মাস, বছর গড়ালো। মাঝে শিল্পীর কোলজুড়ে এলো আরো দুই সন্তান রিহান আর জারা। সময় একটু বদলেছে, পাঞ্জাবীর ঘুন্টি এখন আর তেমন চাপ নিয়ে করতে হয়না, মহসিনের চাকরীতেও নিয়মিত যা আসছে গ্রামে বাবা-মা এর জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে আর বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় খাবার কিনে তিনবেলা না হোক অন্তত দুবেলা ডাল-ভাত ওদের জুটেই যায়।

টানাটানির সংসারে নিত্য আত্বীয়-স্বজনের অসুখ বিসুখ, বেড়ানো উপলক্ষে এসে মাস কাটিয়ে যাবার রেশটা সহজেই অনুমেয় দুজনের উদ্ভ্রান্ত চোখ আর পাড়ার মোড়ের দোকানে বাকির খাতায় পৃষ্ঠা ভরে ওঠা থেকে। তাও সবকিছুর ভেতর থেকেই সুদিনের আশায় একে অপরকে সান্তনা দেয় নিরন্তর। বাচ্চারা যেদিন ভালো স্কুল, কলেজ পেরিয়ে সুশিক্ষিত হয়ে উঠবে কেবল সেদিনের অপেক্ষা।

নিজেদের সকল শখকে জলাঞ্জলি দেয়া মানুষ দু'জন আজ মধ্যবয়স শেষে জীবনের নতুন মোড়ে। চুলে পাক ধরেছে মহসিনের, হাজার কাজ মিনিটে করে ফেলা শিল্পী আজ দু'কদম পা ফেলতে হাটুতে ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন। কিন্তু তাদের চোখ আজও জ্বলজ্বলে, তৃপ্তির কথা বলে। তিন ছেলেমেয়েকে সৎ, আত্মনির্ভরশীল করবার যে প্রত্যয় নিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ সেই পথের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যেখানে বড় ছেলে রাহিন মিউজিসিয়ান, মেঝো ছেলে রিহান পিএইচডি করতে সুদূর আমেরিকায় আর একমাত্র মেয়ে জারা মেডিকেল কলেজে।

সবচেয়ে বড় কথা, বাচ্চারা পেয়েছে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধুকে - বাবা-মা হিসেবে। তা সে চলার পথে হোঁচট খেয়ে কান্নায় হোক কিংবা যৌবনে ভার্সিটি তে প্রথম দেখে দুই ছেলেরই কাউকে ভাল লাগে তা বলতেই হোক।

আজ সমাবর্তন। হ্যাঁ, সেদিন ওই বাবার হাত ধরে দুই বেনী করা চুলে, ছোট্ট পায়ে হেটে বেড়ানো মেয়েটা আমিই আজ ডাঃ জারা হয়ে অপেক্ষা করছি স্টেশনে। আজকের সমাবর্তন আমার জীবনে যতটা না তাৎপর্যময়, জীবনযুদ্ধে হার না মানা আমার বাবা মায়ের জন্য আরো বেশি আবেগের। আজ তারা শেষ বয়েসে আমার সুশিক্ষার শক্তিতে দাঁড়াবে ভাবতেই কেমন এক সুক্ষ ভাল লাগার অনুভুতি হচ্ছে।

'ট্রেন চলে এসেছে, ওই তো বাবা! হাজার মানুষের ভীড়ে আজও মাকে আগের মত আদুরে গলায় ধমকাচ্ছে, দেখে না হাটার জন্য। কত গোধূলি পার হলো এভাবে। বয়স বাড়ছে-আমারও, চির তরুণ এই টোনাটুনিরও। জীবনের মানে আজও শিখেই যাচ্ছি আমি সবসময়, সবখানে।'

চোখটা ছলছল করছে বড্ড! কিছু পড়েছে বোধহয়। হাতের আঙ্গুলটা চোখের কোণে আলতো ছুঁইয়ে খুব দ্রুত স্বাভাবিক হল জারা।

'মা আবার দেখে না ফেলে! ধুর, আমি এখনও বাচ্চাই রয়ে গেলাম। কথায় কথায় কিছু হলেই কেঁদে ফেলার স্বভাবটা যে কবে যাবে!' হাসি মুখেই বাবা-মা'র দিকে এগোতে থাকে সে।

জান্নাতুল ফেরদৌস রিমু: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

মন্তব্য করুন

daraz
  • শিল্প-সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পরিচয়ে লেখক, আদতে ভয়ঙ্কর শিশু পর্নোগ্রাফার
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প এবার স্টার সিনেপ্লেক্সে!
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাহিত্য একাডেমির আয়োজনে বৈশাখী উৎসব
সমুদ্রের রোমাঞ্চকর গল্প বলেন তারা, শোনান গান
X
Fresh