• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

জয়পুরহাট চিনি কারখানায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিকের বেতন-ভাতা বাকি

রাশেদুজ্জামান, জয়পুরহাট

  ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:২৮

দেশের সবচে পুরাতন ও বৃহত্তম জয়পুরহাট চিনি কলটিতে নেই প্রাণের স্পন্দন। সুদূর অতীতের চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ছিল অভিজাত শ্রেণির মতোই।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অতীতের সেই সোনালী দিনগুলো। প্রায়ই তাদের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলেও এবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী পাওনা বেতনের জের আর কখনও দেখা যায়নি। পাঁচ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীর প্রায় দুই কোটি টাকা বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে গেল দুই মাস ধরে। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তাদের অনেকেই।

জয়পুরহাট চিনিকলের শ্রমিক রমজান আলীর চাকরির বয়স ৫৫ বছর। তিনি দুই যুগেরও বেশি সময় পার করেছেন উত্তরাঞ্চলের ভারী এ শিল্প-কারখানায়। যৌবনের প্রথম ভাগে চিনিকলের চাকরির সঙ্গে ভালো বেতন ছিল বলে রমজান আলীর জীবনটাই ছিল অন্য রকম হাসি-খুশিতে ভরা। গেল দুই মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় তার অবস্থা খুবই দুর্বিসহ। বেতন নাই বলে কখনও চালান রিকশা আবার বন-জঙ্গলের প্রাকৃতিক শাক-সবজি তুলে বিক্রি করে তা দিয়েই চলছে রমজান আলীর অভাবী সংসার।

জয়পুরহাট চিনিকলের আরেক শ্রমিক বিদ্যুৎ বিভাগের হেল্পার জাফর আলী। তিনিও বেতন না পাওয়ায় সংসার চালাতে চাকরির সময় শেষ করে পরিবারকে না জানিয়ে চালান ব্যাটারিচালিত রিকশা।

শুধু জাফর আলী বা রমজান আলীই নন, ওয়ার্কশপ হেল্পার সমারু কর্মকার, ইলেকট্রিক মেকানিক প্রশান্ত কুমার, মিল হাউজের ফোরম্যান রফিক উদ্দিনসহ অনেকেই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে অথবা চাকরি শেষ করে আবার কেউ কেউ ছুটি নিয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। জয়পুরহাট চিনিকলে এক হাজার ৩০ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করে। এদের মধ্যে দুরবস্থার শিকার স্থায়ী ৫৩০ জন শ্রমিক-কর্মচারী বেতন পাননি গেল দুই মাস ধরে। বেতন-ভাতা না পাওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকা হয়ে পরেছে দুর্বিসহ। অন্যদিকে মৌসুমী ও চুক্তিভিক্তিক শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে ৫০০ জন। তারাও কাজে যোগ দিবে আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে।

চিনিকলের প্রশাসন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ২১৭ একর জমির ওপর জয়পুরহাট চিনিকলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাট চিনিকলটির প্রথম আখ মাড়াই শুরু হয়। গত মৌসুমের উৎপাদিত এক হাজার চার মেট্রিক টন চিনির মূল্য সাড়ে সাত কোটি টাকা এবং তিন হাজার তিনশ’ মেট্রিক টন চিটাগুড়ের (মোলাসেস) মূল্য চার কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে অবিক্রিত। অবিক্রিত থাকার কারণেই শ্রমিক কর্মচারী-কর্মকর্তার বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার মতো।

দীর্ঘদিন থেকে কর্তা ব্যক্তিরা মিলের উৎপাদিত চিনি ও মোলাসেস বিক্রি করে বেতন নেওয়ার কথা বলে আসছিলেন, এদিকে বাজারে চিনিকলের চিনি ও বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির চিনির মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় শ্রমিকদের বেতন ১৬ শতাংশ লোকসানে নিতে হবে। এই কারণে শ্রমিকরা তাদের বেতন না নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে মিল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাত থেকে সমন্বয় করে সম্প্রতি এক মাসের বেতন শ্রমিকদের প্রদান করে।

এদিকে মিলের লোকসান ঠেকাতে এবং আয় বৃদ্ধি করতে মিলের অব্যবহৃত অসমতল জমিকে সমতল, পরিত্যক্ত ভবন এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে কচু চাষ, ড্রাগন, ভিয়েতনাম ওপি হাইব্রিড নারিকেল বাগান এবং মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। এতে করে লোকসান কমে যাওয়া তো দূরের কথা বোঝা আরও ভারি হচ্ছে বলে একাধিক শ্রমিকরা জানান।

জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম বলেন, এই শিল্পকে রক্ষা করা খুবই কঠিন, যদি বিকল্প হিসেবে অন্য কোনও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা না হয়, শুধু বেতন-ভাতা কেন দিন-দিন আরও খারাপের দিকে যাবে।

জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়ন সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে কর্মরত শ্রমিক খুরশীদ আলম জানান, সুগারমিলে তরল সুগার, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প একটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। কিন্তু এখন আমাদের আপদকালীন সমস্যা সমাধানে অন্যান্য সেক্টরের মত চিনি শিল্পতেও যদি সরকার ভর্তুকি দেয় তাহলেই এই সমস্যা সমাধান সম্ভব এছাড়াও সুগারমিলের চিনির দাম কমে দিয়ে বিক্রি করেও সমাধান করা যায়। মিল কর্তৃপক্ষ কচু চাষসহ বিভিন্ন প্রকল্প যে হাতে নিয়েছে এখানে শুধু বিক্রির টাকার কথা বলা হচ্ছে উৎপাদন ব্যয়ের কথা বলা হচ্ছে না, এতে করে মিলের এক ব্যয় যদি অতিরিক্ত হয় সেটাই মিলের জন্য ক্ষতি।

জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব রুমেল জানান, জয়পুরহাট চিনিকলের ৫০০ শ্রমিকের গত ২ মাসে বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। কল-কারখানার প্রাণ শ্রমিকদের এ পাওনা ভর্তুকি দিয়ে হলেও পরিশোধ করার দাবি করেন।

জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, বেসরকারি চিনিকলগুলো বাহির থেকে তরল সুগার নিয়ে এসে কম মূল্যে চিনি উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। আর আমরা আখ থেকে চিনি তৈরি করার কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় চিনি কম মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না, ক্রেতারা যে চিনি কম দামে পাবে সেটাই কিনবে। আমরাও যদি চিনির দাম কমে দেই, কোম্পানিগুলোও চিনির দাম কমে দেয়, ফলে আমাদের চিনি অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। যে কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই সমাধানে তরল চিনি, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। এগুলো হলে আর সমস্যা থাকবে না।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ কে এম দেলোয়ার হোসেন বলেন, চিনির মূল্য যদি লবণের মূল্যের কাছাকাছি আসে তাহলে এ শিল্প ভালো করবে না। সবকিছুর দাম বাড়লেও চিনির মূল্যে কমে বর্তমানে ৪০-৪২ টাকা কেজি। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চিনি শিল্প রক্ষার কাজ করা হচ্ছে। এ শিল্পকে লাভজনক করতে হলে মূল্যে বৃদ্ধি করাসহ বেশি বেশি আখ রোপণ করতে হবে তাহলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। আখের মূল্যে ৬০ টাকা মন থেকে এখন ১শ’৪০ টাকা করা হয়েছে। মিলের উৎপাদিত চিনি ও মোলাসেস বিক্রি করে বেতন নিতে হবে এবং এ খাতে সরকারের সরাসরি টাকা দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই। কোনও ব্যাংকই সুগারমিলকে ঋণ দিবে না তাই যা আছে তা দিয়ে সমন্বয় করে চলতে হবে এবং এই সমস্যা সম্পর্কে শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে তিনি আরও জানান।

জেবি

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
শিশুখাদ্যে অতিরিক্ত চিনির বিষয়টি ব্যাখ্যা দিলো নেসলে
শিশুখাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত চিনি, পরীক্ষা করবে বিএফএসএ
শিশুখাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত চিনি, ব্যাখ্যা দিলো নেসলে
পাবনায় ১২ ট্রাক ভারতীয় চিনি আটক
X
Fresh