• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

‘আমার খুব কষ্ট হলো এবং চোখে পানি চলে এলো’

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০২
ছবি : আরটিভি

ইটের স্তূপ এবং দেয়াল দেখলাম, স্থানীরা যতগুলো ইট তুলে রেখেছে আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি একটা সাইটে এত পরিমাণ ইট তুলে কেউ গুছিয়ে রাখেনি। আমার খুব কষ্ট হলো এবং চোখে পানি চলে এলো ঢাকার কাছে এত বড় একটা প্রতিস্থাপন, যেখানে কলচুরির রাজা লক্ষ্মকর্ণের ইতিহাসের কথা বলা হয়, লক্ষ্মকর্ণের কথা বলা হয়, এটা আমাদের পাশের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া দুর্গের কাছেই। এটা ইতিহাসের সমৃদ্ধ একটা স্থান এবং ইতিহাসের পাশাপাশি পর্যটন সম্ভাবনার একটা জায়গা। এটা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে এখানে দেশের কোনো শাসক আছে বলে মনে হয় না। এখানে কোনো কাস্টোডিয়ান আছে বলে মনে হয় না।

শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গা ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামের বড়-দিঘি ও এর আশপাশের এলাকা দিনব্যাপী ঘুরে এসব মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আরও বলেন, কর্ণপুর এখন একটি গ্রাম। কিন্তু একসময় যে এটা কত সমৃদ্ধ বসতি ছিল, কেউ এ জায়গায় না এসে বলতে পারবে না।

তিনি বলেন, এখানকার স্থানীয় লেখকরা সরকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ আসেননি। এখানকার ইট দিয়ে কেমন করে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে, সবকিছু কেমন করে ধূসর হয়ে যাচ্ছে, যেটা খুবই দুঃখজনক। এখানকার সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। তারা অবশ্যই তাদের জায়গার ইতিহাস দেখবেন এবং সংরক্ষণ করবেন। সংবিধানেও নিজ এলাকার ইতিহাস সংরক্ষণ করার কথাটি স্পষ্ট করে বলা আছে। তাহলে তারা কি তাদের সংবিধান মানছেন না?

শুধু তারাই নয়, আমারা যারা গবেষণা করি, অধ্যাপকরাও দায়ী, মন্ত্রণালয় দায়ী, সরকার দায়ী। সকলেই আমরা একটা ধংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছি। এটা কোনোভাবেই একটা দেশের জন্য শুভকর নয়। দেশকে বাঁচাতে গেলে ইতিহাস আমাদের একটা পরিচয়। সেই পরিচয় আমরা মুছে দিতে পারি না। খুব দ্রুত সরকারের উচিত এখানে এসে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। তারপর যারা গবেষক তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া। এটা নাহলে দেশ এগোতে পারবে না।

স্থানীয় আবদুল হাকিম আকন্দ বলেন, বড়-দিঘি থেকেই পাকিস্তান আমলে শ্রীপুরের কালু মণ্ডল সাহেব ইট তুলে নিয়েছিলেন। এরপর আমরাও সেখান থেকে কমপক্ষে দুই ফুট প্রশস্তের দেয়াল দেখেছি। স্থানীয়রা নানা প্রয়োজনে এসব সংগ্রহ করে নিজেদের প্রয়োজনে স্থাপনা করেছেন।

স্থানীয় বৃদ্ধ সিরাজ উদ্দিন বলেন, ইট সরিয়ে নেওয়ার পর পাথর বের হয়। দিঘির পাড়ের অনেকের বাড়িতেই ইট পাথর পাওয়া যাবে। নানান ধরনের নকশা করাও রয়েছে এসব পাথরে।

এর আগে ড. সুফী মোস্তাফিজ একই ইউনিয়নের খোঁজেখানী গ্রামের কিছু পুরাকীর্তির চিহ্ন দেখতে পান। ওই এলাকার আকন্দপাড়া, শেখপাড়া, টেক্কার ভিটার টেক-টিলা, একটি মাজারের আশপাশ ও প্রাকৃতিক অবকাঠামো ঘুরে দেখেন। সেখানে থাকা প্রাচীন ইটের খণ্ড খণ্ড অংশ পর্যবেক্ষণ করেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের দরদরিয়া দুর্গের পশ্চিমে তথা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গা ইউনিয়নের খোঁজেখানী গ্রামের অবস্থান।

অধ্যাপক সূফী জানান, খোঁজেখানী গ্রামে যেসব পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে ,সেগুলো মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতাব্দী বা তার পরে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত সময়ের বলে মনে হচ্ছে। কোথাও স্থাপিত দেয়ালের অংশবিশেষের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ইতিহাস থেকে বলা যায়, দরদরিয়া যদি একদল দুর্গ হয় তাহলে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর এলাকায় তুঘলকির অবস্থান ছিল। তুঘলকি নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এখানে সেনাবাহিনীর বসতি ছিল এটা একটা একটা ক্লু। এসব জায়গায় প্রাচীন বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে।

ইট, মৃৎপাত্র, ছোট একাধিক ডিবি পাওয়া গেছে। এগুলো চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে আমরা সেগুলো কোন সময়ের সেটা বলার চেষ্টা করি। এটা খনন করার দরকার। খনন করা হলে বেশি নিশ্চিত হওয়া যাবে। খোঁজেখানী গ্রামের কিছু কিছু অংশ খনন করা হলে ভালো কিছু পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। খননকাজে নিজেকে যুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বেশি প্রয়োজন।

খোঁজেখানী গ্রামের আবুল হাশেমের স্ত্রী হেলেনা আক্তার বলেন, চার কোণাকৃতির যেসব ইট পাওয়া যায় সেগুলো গুঁড়া করে এলাকার অনেকেই বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছে। এগুলো বেশ শক্ত। তারাও এগুলো ব্যবহার করেছে। আরেক গৃহিণী রুনা আক্তার বলেন, আশপাশের জমিগুলো খনন করলে ইটের স্তর বের হতো। এখনও ইটের ভগ্নাংশ পাওয়া যায়।

স্থানীয় লেখক মিশকাত রাসেল বলেন, ছাত্রজীবন থেকে বিশেষ করে এক যুগেরও আগে তিনি একটি বইয়ে ইতিহাস পড়ে এসব এলাকায় প্রাচীন স্থাপনার খোঁজ নিতে আসেন। বছরের পর বছর ধরে খোঁজ করতে করতে প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন পাওয়া যায়। তিনি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কয়েকটি প্রবন্ধ তৈরি করেন। প্রত্নতত্ত্ব গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কেউ কেউ তার আহ্বানে সাড়া দেন। এখন এগুলো জনসম্মুখে আসতে শুরু করেছে।

শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান ও সিনিয়র সাংবাদিক আবু বাক্কার ছিদ্দিক আকন্দ বলেন, প্রাচীন স্থাপত্য-কীর্তি একটি এলাকার মানুষের ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে। যেগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে দ্রুত সময়ে সেগুলোর সংরক্ষণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর মাধ্যমে প্রমাণ হয় বাঙালিরা অনেক আগে থেকেই কর্মে বেশ সুদক্ষ ছিল। প্রাচীন পুরাকীর্তির সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি এলাকা পর্যটন-সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে। এতে মানুষের মানসিক চাহিদার পূরণের পাশাপাশি সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। পুরাকীর্তির এসব স্থাপনা অনুসন্ধান করে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতও সমৃদ্ধি অর্জন করবে।

পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেকের বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ফুল ও ছকের আকৃতিবেষ্টিত পাথর বসানো রয়েছে। কেউ কেউ বাড়ির আঙিনা কাদামুক্ত রাখতে প্রশস্ত ইট বিছিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রশস্ত ইটগুলো সংরক্ষণ করেছেন পরবর্তী কোনো কাজের উদ্দেশ্যে।


মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
মৃত্যুর কারণ জানা গেল মহাসড়কে পড়ে থাকা সেই হাতির
নারীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক
শ্রীপুরে শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ 
শ্রীপুরে পৃথক স্থান থেকে গৃহবধূ ও হিজড়ার মরদেহ উদ্ধার
X
Fresh