করোনাকালে শিল্পীর দায়বদ্ধতা: মানুষের জন্য ছবি
এই করোনাকালে মানুষ যখন গুটিসুটি মেরে ঘরবন্দী হয়ে গেছে ভয় ও আতঙ্কে; তখন ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে ভয় আর আতঙ্ককে তুড়ি মেরে উড়িয়ে শিল্পীর দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিও। ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমিয় বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে যেন তারা ছুটে চলছেন করোনার ভয়কে জয় করতে মানবিক আহ্বানে।
প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক এই দুঃসময়ে বসে আছেন অনেকেই। কিন্তু মানুষের মানবিক প্রয়োজনে বসে নেই গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ছবি আঁকা শিল্পীত্রয় ড. মলয় বালা, অমিত নন্দী ও জাহাঙ্গীর আলম। জলরং, তেলরং ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে অঙ্কিত বিচিত্র বিষয়ে দুই শতাধিক চিত্রকর্মের সম্মিলন ঘটেছে এই তিন শিল্পীর অনলাইন শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ‘মানুষের জন্য ছবি’র আয়োজনে। মলয় বালার (Malay Bala) ফেসবুক আইডি থেকে খোলা ‘মানুষের জন্য ছবি’ পেইজে এই ছবিগুলো আপলোড করা হয়েছে।
‘মানুষের জন্য ছবি’ শীর্ষক অনলাইন শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পী অমিত নন্দীর আঁকা ছবি
করোনা মহামারি যখন মানুষকে ঘরবন্দি থাকতে কিংবা সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব মানতে বাধ্য করে; তখন গ্যালারিতে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর কথা চিন্তাই করা যায় না। সময়-স্রোতের মতো জীবন যেমন থেমে থাকে না, তেমনি শিল্পও। তাইতো অনলাইনে এ প্রদর্শনী শিল্পরসিক থেকে শুরু করে শিল্প-সংগ্রাহক সবার কাছেই বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। আয়োজনটি আরো ব্যতিক্রম এই কারণেই যে, কোনো চিত্রকর্মেরই মূল্য নির্ধারণ করে দেননি শিল্পীরা। যারা ছবি কিনছেন তারাই মূল্য নির্ধারণ করছেন। চিত্রকর্ম দেখে সংগ্রাহকের পছন্দ হলে ইনবক্সে পাঠানো মূল্যের ভিত্তিতে বিক্রি হচ্ছে ছবি। এভাবে ইতোমধ্যে বিক্রি হয়েছে কয়েক লাখ টাকার চিত্রকর্ম। আর ছবি বিক্রির পুরো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে করোনাকালীন অসহায় মানুষের জন্য। সেই তালিকায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চায়ের দোকানদার, ছিন্নমূল মানুষ থেকে মহামারিতে সমস্যাগ্রস্ত কারুশিল্পীরা। শুধু তাই নয়, চারুশিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সমস্যায় পড়েছেন তাদেরও শিল্পের উপকরণ কিংবা সরাসরি অর্থ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এমনকি লোকশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে যারা কাজ করছেন-যেমন কবিয়াল, কীর্তনিয়া, যন্ত্রশিল্পী, মৃৎশিল্পী, স্বশিক্ষিত শিল্পী, নৃত্য-গীত-বাদ্যশিল্পী বাদ যাননি তারাও। তবে ঢাকঢোল না পিটিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সহায়তা। এমনকি প্রকাশ করা হচ্ছে না সহায়তাপ্রাপ্তদের নামও। আর প্রচার-প্রচারণার কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ তারা এই কাজটি করে যাচ্ছেন নিরবে-নিভৃতে সময়ের প্রয়োজনে, প্রচারের জন্য নয়।
মহৎ এই কাজটি শুরু হয়েছিল ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা মিখাইল আই. ইসলামের অর্থায়নে করোনাকালীন সময়ের প্রথম থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে। সেজন্য অনিন্দ্য আমাতের সরাসরি পরিচালনায় শুরু হয় ‘ফুড প্রজেক্ট’। এই প্রকল্পে কবি অনিন্দ্য আমাত ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে দুঃস্থ মানুষদের বিশেষ করে রিকশাওয়ালা ও ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষ খুঁজে খুঁজে বের করে একটি টোকেন দিচ্ছেন। টোকেনটি নির্দিষ্ট দোকানে নিয়ে গেলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার খাদ্যসামগ্রী দেয়ার কাজ চলমান রয়েছে। এর বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের প্রতিকূল অবস্থার শিকার শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করে তাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং ফেসবুক পেজের মাধ্যমে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজন অনুসারে তাদের সরাসরি বিকাশ এর মাধ্যমে নগদ অর্থ কিংবা শিল্প উপকরণ পৌছে দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় ধাপে চারুকলার দেয়ালের সামনের ফুটপাতে ক্ষুদ্র পণ্য ব্যবসায়ীদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়া চারুকলা মডেল, অসহায় কর্মচারীদের তথ্য পেলে তাদেরকে অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
‘মানুষের জন্য ছবি’ শীর্ষক অনলাইন শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে শিল্পী জাহাঙ্গীর আলমের আঁকা ছবি
শিল্পীদের এই শিল্পীত-মানবিক উদ্যোগে প্রথমেই এগিয়ে এসেছেন যে শিল্পীত-মানবিক মানুষটি তিনি হলেন ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা মিখাইল আই. ইসলাম। বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও শিল্পের বিকাশে নীরবে-নিভৃতে তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আজকের এই আয়োজনের পেছনে তিনি যে সবচেয়ে অনুপ্রেরণার প্রধানতম উৎস, সে কথা ত্রয়ীশিল্পী অকুণ্ঠচিত্তে স্মরণ করলেন। তারই অনুপ্রেরণায় সারা দেশের তিন শতাধিক লোক ও কারুশিল্পীকে আর্থিক সাহায্যের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া যেসব উদ্যোক্তারা খাদ্য সহায়তার কাজ করছেন তাদের প্রকল্পের কাজেও যথাসাধ্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগে ইতোমধ্যে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী যুক্ত হয়ে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে নুসরাত মাহমুদ, গীতাঙ্ক দেবদীপ দত্ত, স্বপ্না ভৌমিক, কানিজ ফাতেমা কান্তা, আমিরুল রাজীব, দীপান্বিতা বাড়ৈ, রাখি বাড়ৈ তালুকদার, তানজেবা সোমা, কুদরত ই খোদা, মামুন অর রশিদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিওর স্বপ্নদ্রষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মলয় বালা আরটিভি নিউজকে বলেন, বৈশ্বিক মহামারির এই ক্রান্তিকালে আমরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টাডি গ্রুপের অঙ্গসংগঠন ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিওর এই শৈল্পিক উদ্যোগ সেই প্রচেষ্টারই প্রতিফলন। শিল্পের আশ্রয়ে অর্থ সংগ্রহের এ উদ্যোগে দারুণ সাড়া পেয়েছি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু চিত্রকর্ম বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ছবি কেনায় আগ্রহী হচ্ছেন। মূল্য নির্ধারিত না হওয়ায় শিল্প-সংগ্রাহকরাও নির্দ্বিধায় ছবি সংগ্রহ করছেন। সেই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে অসহায় মানুষের সেবায়।
আরেক শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক অমিত নন্দী বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রাচ্যকলাকে উজ্জীবিত রাখতে জুন মাস থেকে ওরিয়েন্টাল আর্ট বিডি (Oriental art BD) নামে পাবলিক গ্রুপে অনলাইন চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সৃষ্ট এই গ্রুপে শিক্ষার্থীরা করোনাকালীন সময়ে আঁকা ছবি প্রদর্শন করছে। বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের আলাদা করে এবং অ্যালামনাইদের এমনকি শিক্ষকদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য রয়েছে অর্থ ও আর্ট ম্যাটেরিয়ালস। ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিওর মূল সংগঠন Oriental Painting Study Group (OPSG) করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের এই প্রণোদনা দিচ্ছে।
শৈল্পিক সত্ত্বার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম দিয়ে বৈশ্বিক এই দুর্যোগে মানবিক এই উদ্যোগ বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে নিঃসন্দেহে। এমন একটি মহতী উদ্যোগ নিয়ে শিল্পীত্রয় প্রমাণ করেছেন তারা শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও কামরুল হাসানের যোগ্য উত্তরাধিকার। ধন্যবাদ প্রিয় এই তিন শিল্পীকে।
পি
মন্তব্য করুন