• ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
logo

পঞ্চব্রীহি ধান একবার রোপণে পাঁচবার ফলন

আরটিভি নিউজ

  ১৫ মে ২০২৪, ২২:৫২
ছবি: সংগৃহীত

জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী, ধান গবেষক ও লেখক। আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির গবেষকদের একজন। তিনি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় বসবাস করছেন।

ড. আবেদ চৌধুরী উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে, যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন স্টেট ইনিস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়োলজি এবং ওয়াশিংটন স্টেটের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ ইনিস্টিটিউটে।

১৯৮৩ সালে পিএইচডি গবেষণাকালে তিনি রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন যা নিয়ে আশির দশকে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক গবেষণা হয়। অযৌন বীজ উৎপাদন (এফআইএস) সংক্রান্ত তিনটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে এই জিনবিশিষ্ট মিউটেন্ট নিষেক ছাড়াই আংশিক বীজ উৎপাদনে সক্ষম হয়। তার এই আবিষ্কার এপোমিক্সিসের সূচনা করেছে যার মাধ্যমে পিতৃবিহীন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থায় বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত গবেষকদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এযাবৎ তার সফল গবেষণা পঞ্চব্রীহি ধান। সম্প্রতি এই অভাবনীয় সাফল্য ঘটে গেছে বাংলাদেশে। জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী একটি নতুন জাতের ধানগাছ উদ্ভাবন করেছেন, যেটি একবার রোপণে পাঁচবার ধান দেবে ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে। তার উদ্ভাবিত এই ধানগাছের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। পঞ্চ মানে ‘পাঁচ’ আর ব্রীহি মানে ‘ধান’।

জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী ধান গাছের দ্বিতীয় জন্ম নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের অধিক সময় ধরে গবেষণা করেন। তিনি চেয়েছিলেন আম-কাঁঠালের গাছ যেমন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে, ঠিক তেমনই ধানগাছগুলো দীর্ঘআয়ু পাক। দিনরাত কাজ করে যান ২০ প্রকারের ভিন্ন জাতের ধানগাছ নিয়ে। প্রথমে নতুন ধানের শিষ হয়, এমন ভিন্ন জাতের ১২টি ধানবীজ সংগ্রহ করেন। গেল কয়েক বছর ধরে এই ১২ ধরনের ধানের জাতগুলো চাষ করে তিনি নিজে পর্যবেক্ষণ করেন। যেখানে দেখা যায় নিয়মিতভাবে দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে এই ধানগুলো। অতঃপর তিনি একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা শুরু করেন এবং তাতেও সফল হন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে চারটি জাত ছাড়া অন্যগুলো চতুর্থবার ফলনের পর ধ্বংস হয়ে যায়। এই ৪ জাতের ধানের ওপর আবারও ১০ বছর ধরে গবেষণা চালান বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী।

কৃষির আধুনিকায়নে পঞ্চব্রীহি ধান দেশের কৃষকদের জন্য একটি আশার বিষয়। তার এই গবেষণাটি অতুলনীয় যা সামাজিক মাধ্যমে আমার দৃষ্টকটু হয়েছে। প্রবাসে থাকলেও দেশের ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন তিনি। নিজের উদ্ভাবিত জাতের ধান উৎপাদনে জন্মস্থান কানিহাটি গ্রামের পারিবারিক জমিতে গড়ে তুলেছেন খামার। প্রথমবারের মতো একই গাছে এক বছরে পাঁচবার ফলন এসেছে।

বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এমপির নেতৃত্বে আমস্টার্ডামে অনুষ্ঠিত রাউন্ড টেবিল অন বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার টোয়ার্ড এ প্রসপোরাস ফিউচার, সেমিনার টিমে ডেলিগেট হিসাবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেখানে দ্য সিলেট পোস্ট-এর চিপ এডিটর সাংবাদিক নজরুল ইসলাম কথা বলেছেন জীন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরীর সাথে তার সফল উদ্ভাবনি গবেষণা ‘পঞ্চব্রীহি’ ধান নিয়ে।

নজরুল ইসলাম: আপনি কেমন আছেন স্যার?
ড. আবেদ চৌধুরী: আমি বেশ ভাল আছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

নজরুল ইসলাম: স্যার আপনি আমস্টার্ডাম কেন এসেছেন একটু জানতে পারি?
ড. আবেদ চৌধুরী: বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ এমপির নেতৃত্বে আমস্টার্ডামে বাংলাদেশের প্রতিনিধি টিম অংশগ্রণ করে। প্রতিনিধি টিমে ডেলিগেট হিসাবে আমি অংশগ্রহণ করি। একটি ইউনিভার্সিতে ‘রাউন্ড টেবিল অন বাংলাদেশ এগ্রিকালচার টোয়ার্ড এ প্রসপোরাস ফিউচার’ সেমিনারে আমি বাংলাদেশের কৃষি ও আমাদের সাফল্য নিয়ে কথা বলেছি। মন্ত্রী মহোদয়ের আমন্ত্রণে আপনিও এসেছেন। আপনাকে পেয়ে আমি বিষম খুশি।

নজরুল ইসলাম: একজন জীন বিজ্ঞানী হিসাবে দেশের কৃষকদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
ড. আবেদ চৌধুরী: কৃষকদের সাথে আমার সম্পর্ক আত্মার। আমি দেখেছি আমারদের কৃষক ধান চাষ করেন তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন না। তাদের খরচ অনেক বেশি, খরচ করার জন্য যা ধান পান, ওটা বিক্রি করে তাদের পোষায় না। যারা ধানের উপর নির্ভরশীল, তারা দরিদ্র থেকেই যান। ধান বিক্রির টাকা, উৎপাদন খরচ দিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। এটাই বাস্তবতা। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল।

নজরুল ইসলাম: আমাদের দেশের লোকজন কৃষিনির্ভর, কৃষির আধুনিকায়ন মানে তাদের জীবন মান উন্নয়ন, আপনি কি ভাবছেন?
ড. আবেদ চৌধুরী: আমি দেখছি দেশে কৃষি নির্ভর পরিবার খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কম দামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা যে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাবছি কৃষিতে কিভাবে আয় বাড়ানো যায়, ব্যয় কমানো যায়, এটা নিয়ে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করি। একটা ধান জমিতে থাকবে, বিশাল আকার ধারণ করে অনেক অনেক ধান দেবে। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমি ইতোমধ্যে এটা করতে পেরেছি।

নজরুল ইসলাম: পঞ্চব্রীহি ধানের চাষাবাদের জন্য কৃষকদের মাঝে কিভাবে জাগরণ তৈরী করা যায়?
ড. আবেদ চৌধুরী: কৃষি এমন একটি শিল্প যা কঠোর পরিশ্রম, স্থিতিস্থাপকতা, শক্তি এবং সহায়ক সম্প্রদায়ের জন্য পরিচিত। যাইহোক, খামার পরিবারগুলি প্রায়শই অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় যেমন কম পণ্যের দাম, অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া, অসময়ে সরঞ্জামের ভাঙ্গন, এবং দৈনন্দিন এবং মৌসুমী কাজগুলি সম্পূর্ণ করার সুযোগের একটি সংকীর্ণ উইন্ডো যা প্রায়ই খামার পরিবারের জীবনে চাপ সৃষ্টি করে। কৃষকদের আমার উদ্ভাবনি নতুন জাতের বীজ সংগ্রহের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করি নতুন উদ্ভাবনকারী এই ধান ব্যবসায়িকভাবে ফলনে কৃষকরা অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হবেন।

নজরুল ইসলাম: এযাবৎ আপনার সফল গবেষণা পঞ্চব্রীহি ধান, এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই-
ড. আবেদ চৌধুরী: নতুন জাতের ধানগাছ উদ্ভাবন করেছি, যেটি একবার রোপণে পাঁচবার ধান দেবে ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে। এই পাঁচ প্রকার ধান হলো বোরো একবার, আউশ দুবার ও আমন দুবার। অর্থাৎ তিন মৌসুমে বা বছরজুড়েই ধান দেবে এই গাছ। তিনি উদ্ভাবিত এই ধানগাছের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। পঞ্চ মানে ‘পাঁচ’ আর ব্রীহি মানে ‘ধান’। বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পাকঁবে। ওই একই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুইবার আউশ এবং দুইবার আমন ধান দিবে। কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে, প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। আপাতত এর নাম পঞ্চব্রীহি রেখেছি। পরবর্তী সময়ে চিন্তা ভাবনা করে নাম নির্ধারণ করবো। ‘ষষ্ঠবার ফলনে সফল হলে এই জাতের নামকরণ ‘ষষ্ঠব্রীহি’ করা যেতে পারে। আবার ‘বর্ষব্রীহি’ বলা যায়, যেহেতু বছরজুড়ে ফলন হয়। ‘চিরব্রীহি’, ‘অমরব্রীহি’ নামও রাখা যেতে পারে, যেহেতু গাছটি মরছে না। আবার আমার গ্রাম কানিহাটির নামেও রাখতে পারি।

নজরুল ইসলাম: আপনার গবেষণালব্ধ এ ধান কি পরিবেশবান্ধব?
ড. আবেদ চৌধুরী: এ ধরনের ধান গাছকে পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক জমি একাধিকবার চাষ দিলে মিথেন গ্যাস ও কার্বনড্রাইঅক্সাইড প্রচুর নির্গত হয়, যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু এ ধান একবার চাষে উৎপাদন খরচ অনেকটা কম হবে। চাষাবাদ অন্য ধানের মতোই সহজ। এজন্য একে পরিবেশবান্ধব, জলবায়ু পরিবর্তন বান্ধব বলে থাকি আমি। আমার উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধানের নাম আমার গ্রামের নামে কানিহটি ১ থেকে ১৬ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।

নজরুল ইসলাম: আপনার গ্রামের কৃষি খামার কে দেখাশুনা করেন?
ড. আবেদ চৌধুরী: স্থানীয়ভাবে কৃষকরা আমার খামার দেখাশুনা করছেন। তারা প্রতিবেশী কৃষকদের উৎসাহিত করছেন। তাদের সাফল্যের গল্প শুনে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন।

নজরুল ইসলাম: পঞ্চব্রহী ধান চাষ করেছেন, ফসল ঘরে তুলেছেন এমন দুই একজন কৃষকের কথা শুনতে চাই-
ড. আবেদ চৌধুরী: আমার খামার দেখভাল করেন রাসেল মিয়া নামের একজন। তার সাফল্যের কথা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি। রাসেল, পরীক্ষামূলকভাবে দুই বিঘা জমিতে ধান রোপণ করে সফলভাবে পাঁচবার গাছ থেকে ধান কেটেছেন। প্রথমবার উৎপাদনে যে খরচ হয়, পরের বার উৎপাদনে তেমন খরচ নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কৃষকরা খুব কম খরচে এই ধান উৎপাদন করতে পারবেন। আরেক কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের এলাকায় জন্ম নেওয়া আবেদ চৌধুরী একটি ধান আবিষ্কার করেছেন। ধানটা খুবই ভালো। একবার রোপণ করলে পাঁচবার কেটে নেওয়া যায়। আমিও এই ধান এনেছি। এই ধানটার জন্য আমি গর্বিত। আমরা সবাই আগ্রহী যাতে এই ধান আরও বেশি বেশি উৎপন্ন হয়।

ড. আবেদ চৌধুরী আমস্টার্ডামে আপনার ব্যস্ত সময়ে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. আবেদ চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
চীনে চালু হলো বিশ্বের প্রথম এআই হাসপাতাল
শামুক নিয়ে গবেষণায় রাবির গবেষক দলের সাফল্য
শরীরে শ্বেত রক্তকণিকা বাড়াবে যেসব খাবার
নদীর পানির রং কমলা, শঙ্কায় গবেষকরা