• ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

শরীয়তপুরে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী

শরীয়তপুর প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ২৩ জুলাই ২০২০, ২১:২২
Shariatpur, flooded, people, waterlogged
বন্যার চিত্র।

গত এক সপ্তাহ যাবত শরীয়তপুরে বন্যার পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এরমধ্যে গত দু'দিন যাবত অপরিবর্তিত রয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। আজও (২৩ জুলাই) বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি।

প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। ইতোমধ্যে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে জেলার প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে। হঠাৎ করেই উত্তরাঞ্চলের বন্যাকবলিত অঞ্চলের উজানের পানি নেমে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শরীয়তপুরে। চরম হতাশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে বন্যা কবলিত মানুষ। সরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করলেও যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। জেলার ৬ উপজেলার মধ্যে ৪ উপজেলার ২৬ ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভার ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। নদীর পাড় তলিয়ে গিয়ে পদ্মার ডান তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের বেশ কিছু সাইডের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাঁধের কাজ চলমান রয়েছে এবং কিছু কিছু ভাঙনপ্রবণ স্থানে জিও ব্যাগ।

প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত উজানের ঢলের পানি নেমে এসে শরীয়তপুরে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। অনেকেরই আশ্রয় হয়েছে উঁচু স্থান বা রাস্তার পাশে। কেউবা মাথা পেতে বাড়ির উঠানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। কেউ কেউ গরু ছাগল হাঁস মুরগি নিয়ে রাস্তার পাশে অস্থায়ীভাবে ছাউনি তুলে বসবাস করছেন। অনেক কষ্ট আর দুর্দশার মধ্যে কাটছে তাদের দিন। কিছু কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাব। টিউবওয়েল গভীর নলকূপ ডুবে গিয়ে তাদের এই বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়। সংকট দেখা দিয়েছে শুকনো খাবারের।

এছাড়া জেলার প্রতিটি উপজেলার প্রায় ইউনিয়নগুলোতে বন্যার পানি ঢুকে রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি তলিয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জনদুর্ভোগ। পদ্মা নদীর পাড় তলিয়ে সব এলাকাতেই ঢুকে পড়েছে পানি। প্রধান সড়কসহ ইউনিয়ন ও পাড়া-মহল্লার প্রায় সড়কেই ভেঙে গেছে পানির তোরে। এতে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দের। বন্ধ হয়ে গেছে যান চলাচল। এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বহুকষ্টে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে এসব মানুষগুলো।

জানা যায়, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। পাশাপাশি স্থানীয় সাংসদ সহ জনপ্রতিনিধিরাও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। ইতোমধ্যে নতুন করে আরও ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এরইমধ্যে নড়িয়া-সখিপুরের প্রায় ২ হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন, শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। এছাড়া শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু তার নির্বাচনী এলাকায় বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন।

এর পাশাপাশি জাজিরা উপজেলা সহ শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আজ তারা শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মার চরাঞ্চলে তিনশত বানভাসি পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন।

নড়িয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আহাদী হোসেন বলেন, নড়িয়া উপজেলাটি একেবারে পদ্মা নদীর কূল ঘেঁষে অবস্থিত হওয়ায় নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়। উজানের ঢলের পানি নেমে এসে ইতোমধ্যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে নড়িয়া উপজেলায়। এরইমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৭ হাজার মানুষের ঘরে পানি উঠে সম্পূর্ণরূপে পানিবন্দি হয়ে মারাত্মক দুর্ভোগের রয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে এসব বানভাসি মানুষের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১১২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া ইতোমধ্যে ৫০০ পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে যাতে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারে এজন্য উপজেলায় প্রায় ৩৪ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমাদের এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, হঠাৎই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বন্যার পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে উপজেলার সকল রাস্তাঘাট। এতে বন্যার পানির তোরে ভেঙে গেছে অসংখ্য রাস্তাঘাট।

নড়িয়া পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম বাবু রাড়ী বলেন, বন্যার পানি ঢুকে পৌরসভার প্রায় ৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে ত্রিশটি পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু পরিবার রাস্তার পাশে এসে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাদের সবার বাড়িতে ঘরের মধ্যে পানি উঠেছে থাকার অনুভূতি হওয়ার কারণেই তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় বারোশো পরিবারকে শুকনো খাবার ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। চলমান এই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া আমি প্রতিদিনই পানির মধ্যে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের খোঁজখবর নিচ্ছি এবং যাদের খাদ্যাভাব রয়েছে তাদেরকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছি। আমাদের এই বৃহত্তর অন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এছাড়া অন্য যেকোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এরই মধ্যে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম আমাদের এমপি মহোদয় তিনি নিজে স্ব-শরীরে এসে বানভাসিদের খোঁজখবর নিয়েছেন এবং তাদের মাঝে শুকনো খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন এবং তিনি বলেছেন আমাদের একটি লোক না খেয়ে থাকবে না সবার ঘরে ঘরে খাদ্য বা ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হবে।

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, জাজিরা উপজেলায় ইতোমধ্যে ১২টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এই উপজেলায় সাড়ে আঠারো হাজার পরিবারের প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন এবং প্রতিটি পরিবারের এই বাড়িতেও ঘরে পানি ঢুকেছে সবাই অতি কষ্টের দিনযাপন করছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আজ পর্যন্ত ৮০ মেট্রিক টন চালসহ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের ২৬০ মেট্রিকটন চাল জাজিরা উপজেলার জন্য বরাদ্দ এসেছে। পাশাপাশি আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে বরাদ্দকৃত ভিজিএফের চাল তাও বিতরণ শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি এই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে একটি লোকও না খেয়ে থাকবে না। আমরা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ত্রাণ শুকনো খাবার ও খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি।

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা তানভীর আল নাসিফ জানান, পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর মধ্যে বন্যার পানি ঢুকে সখিপুর থানার ৫ টি ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার লোক পানিবন্দী রয়েছেন। এসব পানিবন্দী মানুষের মাঝে ত্রাণ ও শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে এবং পানিবন্দী হচ্ছেন মানুষ। আগামীকাল থেকে আমাদের চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে প্রতিটি ইউনিয়নে। বন্যার পানি ঢুকে কাচিকাটা, চরভাগা, চরসেনসাস, উত্তর তারাবুনিয়া ও দক্ষিণ তারাবুনিয়া বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমাদেরই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এছাড়া আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে ভিজিএফের চাল বিতরণ কার্যক্রম দু-একদিনের মধ্যে শুরু হবে।

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান শেখ জানিয়েছেন, পালং উপজেলায় ইতিমধ্যে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে এবং প্রায় তিন হাজারের অধিক পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। বাড়ি বারি গিয়ে আমরা তাদেরকে ত্রাণ ও শুকনো খাবার দিচ্ছি। ইতোমধ্যে দুই হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। আশাকরি আগামী কালকের মধ্যে বাকিদের ঘরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে পারব। এছাড়া স্থানীয় সাংসদ ইকবাল হোসেন অপু তিনিও বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বানভাসিদের খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছেন। এর বাইরে যদি কোন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবো এরকম সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অপরদিকে বিশুদ্ধ পানি খাবার স্যালাইন সহ অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ চলছে। পানি যদি এর চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ ঘরে থাকার সুযোগ না থাকে তাহলে তাদেরকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে রাখার জন্য আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জিএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
অস্ত্র নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হোক মানুষের কল্যাণে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘দেশের মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চায় সরকার’
ভোটের ওপর আস্থা ফিরেছে মানুষের: ইসি আলমগীর
হিলিতে ঘনঘন লোডশেডিং, ভোগান্তিতে মানুষ
X
Fresh