• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালের হিসাব রক্ষকের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে

স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ

  ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ২১:৫৮

মানিকগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালের হিসাব রক্ষক সৈয়দ মো. মাহমুদ ফুয়াদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের সরকারি টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এবং কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল করে কোটেশনের মাধ্যমে এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার এই অনৈতিক কাজে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মো. সাইফুর রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
হিসাব রক্ষকের নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) বরাবর অভিযোগ দাখিল করেন ওই হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী। এর প্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ এবিএম মুজহারুল ইসলাম মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ মো. মিনহাজ উদ্দিনকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন।
১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও দুই মাসের অধিক সময় ধরে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সাক্ষী, জবানবন্দি এবং দপ্তরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে ওই হিসাব রক্ষকের সরকারি টাকা আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম এবং তার এই অনিয়মের পেছনে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের ইন্ধনের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান ওই তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই হিসাব রক্ষক সৈয়দ মো. মাহমুদ ফুয়াদ কোটেশনের মাধ্যমে ৪২ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা, ইউজার ফির ২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪০ টাকা, জেনারেটরের জ্বালানী তেল ক্রয়ের নামে ৪ লাখ, ৫৮ হাজার ১৯১ টাকা, হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতার নামে ১৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাসা ভাড়ার ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা সরকারি খাত থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন।
তিনি গত অর্থ বছরে ১০টি স্থানীয় কোটেশনের মাধ্যমে হাসপাতালের জন্য নানা ধরণের জিনিষ ক্রয়ের নামে কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল করে ৪২ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করেন।
হাসপাতালের স্টোর কিপার মো. সাজিদ হাসান জানান, স্থানীয় কোটেশনের মাধ্যমে ৪২ লাখ ৬,৫০০ টাকা মূল্যে ক্রয়কৃত দ্রব্যাদি স্টোরের স্টক লেজারে এন্ট্রি হয়নি। আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তাও উপরোক্ত মালামাল সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাত ও উপখাতে স্থানীয় কোটশনের তুলনামূলক বিবরণীতে কোটেশন কমিটির সদস্য-সচিব ডাঃ মো. লুৎফর রহমানের স্বাক্ষর না থাকলেও জেলা হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ে রক্ষিত অর্থ উত্তোলিত বিলে তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে হাসপাতালটির আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডাঃ লুৎফর রহমান বলেন, তিনি কোনও অনৈতিক কাজে সায় দিবেন না জেনেই হিসাব রক্ষক তার স্বাক্ষর জাল করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডাঃ মো. লুৎফর রহমান বলেন, কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তিনি তার স্বাক্ষর জাল করে সরকারি টাকা আত্মসাতের অপরাধে ওই হিসাব রক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন, যাতে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় এবং ভবিষ্যতে কেউ যাতে এ রকম দুর্নীতি করার সাহস না পায়।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গৃহীত হাসপাতালের ইউজার ফির সঙ্গে সরকারি কোষাগারে জমাকৃত অর্থের মধ্যে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪০ টাকার অসঙ্গতি দেখা যায়। অর্থাৎ এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে তিনি পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে পরিচ্ছন্নতা কর্মী বেতন বাবদ তিনি ১৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। অথচ ওয়ার্ড মাস্টার মো: শাহজাহান মিয়া পরিচ্ছন্ন কর্মীর মজুরি বাবদ তার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন মাত্র ৪ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ এই খাতে তিনি ১৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
গেল বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে হাসপাতালের জেনারেটরের জ্বালানীর তেল খরচ বাবদ উত্তোলন করেছেন ৫ লাখ ২১ হাজার ৬৬৪ টাকা। অথচ পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী ওই ৬ মাসের দৈনিক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য সাট-ডাউন প্রদান ও লোডশেডিং এর কারণে বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল ৩৯ ঘণ্টা ৬ মিনিট। প্রতি ঘণ্টায় ২৫ লিটার ডিজেল ব্যবহার হলে মোট ডিজেল লাগে ৯৭৬.৫ লিটার। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬৫ হলে ৬ মাসের ডিজেলের প্রকৃত খরচ হয় ৬৩ হাজার ৪৭২ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ, জেনারেটরের জ্বালানী তেল ক্রয়ের নামে তিনি আত্মসাৎ করেছেন ৪ লাখ ৫৮ হাজার ১৯১ টাকা।
এছাড়া, তিন বছর পর পর রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন (শ্রান্তি ও বিনোদন) ভাতা পাওয়ার বিধান থাকলেও তিনি তা ভঙ্গ করে এক বছরের মধ্যে (১৬/১০/২০১৬ এবং ১২/১২/২০১৬) ১৮ হাজার করে মোট ৩৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেন।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি সাতজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের নামে ২০১৫ সালের ১ জুলাই ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেলের বকেয়া প্রাপ্য বেতনের অতিরিক্ত একমাসের বেতনের (প্রতিজনের ৪, ৮১৪ টাকা) ৩৩ হাজার ৬৯০ টাকা উত্তোলন করে তাদেরকে না দিয়ে তার পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেন বলেও খোঁজ নিয়ে জানা যায়।
শুধু তাই নয়, মাহমুদ ফুয়াদ বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালের ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন (শ্রান্তি ও বিনোদন) ভাতা হিসেবে উত্তোলিত ৩ লাখ ৩২ হাজার ৬২০ টাকার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৬ হাজার ৫২৪ টাকা কর্তন করেছেন। অন্যান্য স্টাফদের কাছ থেকেও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের বিল থেকে ১০ থেকে ২০ শতাংশ টাকা কর্তন করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২০১৭ সালের ৪ মার্চ থেকে তিনি হাসপাতালের ভেতরে সরকারী বাসায় বসবাস করছেন। তার মূল বেতনের (১৮,৮৬০) ৪০ শতাংশ হিসেবে প্রতি মাসে ৭ হাজার ৫৪৪ টাকা বাসা ভাড়া প্রদান করার বিধান থাকলেও তিনি বাসা ভাড়া প্রদান করছেন না। এমনকি তিনি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিলও প্রদান করছেন না। অর্থাৎ এই খাতেও তার কাছে সরকারের পাওনা প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থানীয় কোটেশনের সকল ধাপে (বিজ্ঞপ্তি, যাচাই-বাছাই বিবরণী, তুলনামূলক বিকরণী, বিল উত্তোলন) হিসাব রক্ষক একাই দাপ্তরিক কার্যাবলী সম্পাদন করেছেন। হাসপাতাল ও জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে রক্ষিত স্থানীয় কোটেশনের কাগজপত্রে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি স্থানীয় কোটেশনের সদস্য-সচিবের স্বাক্ষর জাল করেছেন যা সরকারী বিধি পরিপন্থী।
স্থানীয় কোটেশনের মাধ্যমে কথিত ক্রয়কৃত মালামাল স্টোরে জমা নেই। ক্রয়কৃত মালামাল সার্ভে কমিটির মাধ্যমে স্টোরে তোলার কথা থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক বিধানটি উপেক্ষা করেছেন। ফলে আর্থিক কেলেঙ্কারি তরান্বিত হয়েছে।
এছাড়া মাহমুদ ফুয়াদের বিরুদ্ধে মাসের বেশীর ভাগ সময়ই হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে তত্ত্বাবধায়ক পূর্বের আদেশটি বাতিল না করে একাই ৩য় শ্রেণির বাসাটি ডরমেটরি ঘোষণা করে একই ব্যক্তির নামে পুনরায় সীট বরাদ্দ দেন এবং এতে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাসপাতালের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মো. সাইফুর রহমান (কোড-৩৮৯৮০২) বাসা বরাদ্দ, স্থানীয় কোটেশন, জাল স্বাক্ষরে বিল উত্তোলন, মালামাল স্টোরে তোলা, জেনারেটরের রক্ষণাবেক্ষণ, হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আবাসিক চিকিৎসককে আড়ালে রেখে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন যা সরকারি আর্থিক ক্ষতিকে প্রভাবিত করেছে।
এদিকে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগসমূহের সুষ্ঠু তদন্ত, দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান এবং আত্মসাৎকৃত সরকারের টাকা সরকারি কোষাগারে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান অভিযোগকারী হাসপাতালের কর্মচারীরা।
হাসপাতালের কর্মচারীরা বলেন, দুই একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে গোটা বিভাগের বদনাম। তাই বিভাগের সুনাম ফিরিয়ে আনতে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দরকার।
তবে যার বিরুদ্ধে এত অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে, সেই হিসাব রক্ষক সৈয়দ মো. মাহমুদ ফুয়াদ বলেন, এসব তদন্ত করে কিছুই করতে পারবে না। অতীতেও এই ধরণের অভিযোগের তদন্ত হয়েছিল। কিছু করতে পারেনি।
তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মো. সাইফুর রহমান বলেন, কোনও অনিয়ম থাকলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন। তবে এইসব ব্যাপারে তার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবী করেন তিনি।
অভিযোগ তদন্ত করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও কেন এতো বিলম্ব হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, তদন্তকালে তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তেমন কোনও সহযোগিতা না পাওয়ার কারণেই বিলম্ব হচ্ছে।
বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আবুল কালাম আজাদ জানান, তিনি তদন্ত রিপোর্টটি পেয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিবেন।
উল্লেখ্য, অভিযুক্ত সৈয়দ মো. মাহমুদ ফুয়াদ ১৯৯৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সহকারী স্টোর কিপার হিসেবে ভোলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯৫ সালের ২ এপ্রিল তিনি বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ক্যাশিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। যদিও এই ধরণের পদোন্নতি দেয়া ওই কমিটির এখতিয়ার বহির্ভূত। এরপর তাকে একই বছরের ১ অক্টোবর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলী করা হয়।
২০১৬ সালের ১ জুন তাকে প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক পদে পদায়ন করা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে সেখান থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে বদলী করা হয়। তিনি বর্তমানে এখানে হিসাব রক্ষকের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি গত দুই বছর ধরে ক্যাশিয়ারের দায়িত্বও পালন করছেন।
এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
কাভার্ডভ্যানচাপায় প্রাণ গেল ২ সবজি বিক্রেতার 
বর্ষবরণ উদযাপন করল হরিরামপুর বন্ধুমঞ্চ  
মানিকগঞ্জে গঙ্গাস্নানে পুণ্যার্থীদের ঢল
৪৪ বিলিয়ন ডলার জালিয়াতির দায়ে ভিয়েতনামের ধনকুবেরের মৃত্যুদণ্ড
X
Fresh