• ঢাকা শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
logo

দই বেচে বই কিনে শিক্ষার আলো ছড়ানো জিয়াউল পাচ্ছেন একুশে পদক

আব্দুর রব নাহিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি

  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:২৫
ছবি : আরটিভি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা বটতলা গ্রামের জিয়াউল হক এবার একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। গ্রামের অতি সাধারণ এ মানুষটি সমাজসেবায় অনন্য অবদানের জন্য মর্যদাপূর্ণ এ পদক পাচ্ছেন। গ্রামের এ সাদাসিধে মানুষটিই শিক্ষার আলো ছড়াতে গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার।

১৯৬৯ সালে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার। শুধু পাঠাগারই নয়, নানা প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন জিয়াউল হক। সামাজিক কাজে তিন কোটি টাকারও বেশি খচর করেছেন তিনি।

জিয়াউল হক বলেন, ভালো কিছু করলে ভালো কিছু পাওয়া যায়, আমাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সম্মান জানানো হবে এটা জানার পর আনন্দিত হয়েছি। এ বয়সে একুশে পদকের মতো এত বড় সম্মান পেয়ে আমি সত্যিই খুশি।

বেচি দই, কিনি বই

সাদাসিধে এ মানুষটি পেশায় দই বিক্রেতা। এক সময় সাইকেলে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে দই বিক্রি করতেন, ৯১ বছর বয়সেও তার রুটিরুজির অবলম্বন দই বিক্রি। জিয়াউল হকের দইয়ের খ্যাতি জেলাজুড়েই। খাটি গরুর দুধ দিয়ে দই বানানো, সেই সততার কারণেই ভোক্তাদের মনে জায়গা করে দেয় জিয়াউল হকের দই। অনেকেই তার দই কেনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে তার বাড়িতেও ছুটে যান।

মূলত দই বিক্রি করে এলাকার হত দরিদ্র তরুণদের মূলত পাঠ্য বই কিনে দিতেন জিয়াউল হক। নিজে অভাবের কারণে পড়ালেখা করতে না পারার সেই আক্ষেপ থেকে গ্রামের কারও পড়ালেখা যাতে অর্থের অভাবে বন্ধ না হয়ে যায়, সেই ভাবনা থেকেই পাঠ্যবই কিনে দেওয়া শুরু করেন জিয়াউল হক। বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে পাঠাগার গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা এলাকার বটতলা গ্রামে নিজ বাড়ির একটি কক্ষে গড়ে ওঠে পাঠাগার। জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার নামে সেই পাঠাগার দিন যত গড়িয়েছি ততই আলোক বর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ পাঠাগারে প্রায় ২০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে।

জিয়াউল হকের দেওয়া বই পড়ে আজ তারা শিক্ষক

জিয়াউল হকের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে শিক্ষক হয়েছেন ভোলাহাট উপজেলার পীরগাছি দারুস সুন্নাত দাখিল মাদরাসার মজিবুর রহমান (৫৯) ও মুসরীভূজা ইউসুফ আলী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিজুল হক (৪৫) জানান, জিয়াউল হকের কাছ থেকে পাঠ্যবইসহ সার্বিক সহযোগিতা না পেলে তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন না। এ জন্য তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার খবর পেয়ে তারা খুবই আনন্দিত। শুধু এ দুজনই নয়, আরও অনেকেই পড়ালেখা করেছেন জিয়াউল হকের পাঠাগারের বই নিয়েই।

জিয়াউল হক জানান, ১৯৬০ সালে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরনের কাজ শুরু করি। যা এখনও পর্যন্ত চলমান আছে।

মানুষের কল্যাণে খরচ করছেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা

পেশায় দই বিক্রেতা, সাদাসিধে জিয়াউল হক সামাজিক নানা কল্যাণে এখন পর্যন্ত খরচ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকারও বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অসহায় মানুষের ঘর নির্মাণ, টিউবয়েল স্থাপন, মসজিদ, কবরস্থানের উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই বিতরণসহ নানা খাতে তিনি ব্যয় করেছেন এ টাকা। জিয়াউল হকের সততার কারণে অনেকেই তার কাছে অনুদান পাঠিয়েছেন, সেই সব সহযোগিতা নিয়ে তিনি কল্যাণকর কাজে ব্যয় করেছেন।

সাদামনের মানুষ জিয়াউল হক বলেন, স্কুল কলেজে বই বিতরণ, অসহায় মানুষের ঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে যে সহযোগিতা করেছি তার মধ্যে দেড় কোটি টাকাই দিয়েছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষিরা। আর বাকিটা আমার এতো দিনের দই বিক্রি করেই করা।

পদকের অর্থে বানাবেন পাঠাগারের ঘর

জিয়াউল হকের নিজ বাড়ির একটি ঘরেই কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তার পাঠাগারের। বিকেলে অনেক শিক্ষার্থী বই পড়ার জন্য আসেন, কিন্তু তাদেরও বসার স্থান সংকুলান হয় না। পাঠাগারের পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা অনেক দিন থেকেই করছেন জিয়াউল হক তবে পেরে উঠছিলেন না। তাই পদকের থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই পাঠাগারের পরিসর বাড়ানোর চিন্তা গুণী এ মানুষটির।

পদকের অর্থ কি করবেন এ প্রশ্নে তাই জানালেন, পাঠাগারে জায়গার সংকুলান হয় না, আরও একটি ঘর করতে পারলে ভালো হয়, এ অর্থ দিয়ে পাঠাগারের আরও একটি ঘর বানাব।

ব্যক্তি জীবন

মরহুম তৈয়ব আলী ও শরীফুন নেসার দম্পতির ছেলে জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালে। ব্যক্তিগত জীবনে তার দুই স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক ছেলেসন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রী সারাবান তহুরার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী ফরিদা হককে নিয়ে বটতলা গ্রামে বসবাস করছেন।

আনন্দের বন্যা চাঁপাইনবাবগঞ্জে

একুশে পদকের জন্য সাদামনের মানুষ মনোনীত হওয়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে ভোলাহাটসহ গোটা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকেই তার ছবি পোস্ট দিয়ে জানাচ্ছেন অভিনন্দন। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই ফুল দিয়ে যাচ্ছেন জিয়াউল হকের বাড়িতে।

বুধবার তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছ জানায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা স্কাউটস। জেলা স্কাউট সম্পাদক গোলাম রশিদ জানান, সাদা মনের মানুষ জিয়াউল হকের একুশে পদকের জন্য মনোনয়ন পাওয়ায় জেলাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। তার এ সন্মানের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামটাও উজ্জ্বল হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনের সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান বলেন, যোগ্য একজন মানুষকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি দই বেচে বই কিনে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে এবং গরিব ছাত্রদের মাঝে বই বিলি করে সাদামনের মানুষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এরপর সমাজসেবাতেও অনন্য অবদান রেখেছেন। তার এই প্রাপ্তিতে জেলাবাসী গর্বিত।

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সরকার ব্যস্ত বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় : ভিপি নুর
মহানন্দায় গোসলে নেমে ২ শিশুর মৃত্যু
চাঁপাইনবাবগঞ্জে লালন ভক্তকুলের সাধুসঙ্গ
সাড়ে ৫ ঘণ্টা চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না যুবককে
X
Fresh