দুর্নীতির শেষ নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে!
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই সরকারি হাসপাতালে রয়েছে রোগীদের চেয়ে দালালাদের কদর বেশি। ওই হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতির ছত্র-ছায়ায় এসব অপকর্ম হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ কারণে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙ্গে পড়ায় চরম দুর্ভোগে আছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর এ হাসপাতালটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নতি করা হয়। হাসপাতালের শয্যার উন্নতি হলেও বাড়তি কোনও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে ৩১ শয্যার জনবল দিয়েই চলছে এ হাসপাতালটি। কিন্তু ৩১ শয্যা হাসপাতালে ২০ চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক আছেন ৮ জন। এছাড়া জনবল ও যন্ত্রাংশ সংকটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আল-বেলাল ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতি নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
ফলে ফায়দা লুটছেন স্থানীয় ক্লিনিক মালিকরা। এতে চরম ভোগান্তিতে উপজেলাবাসী। গেলো বছরের ২৫ অক্টোবর কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রবীর কুমার সরকার ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতির বদলি হয়। কিন্তু আরএমও ডা. নাজমুন নাহার ওই বদলি বাতিল করে ফের এই হাসপাতালে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে রোগী ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম করে আসছেন। তার ছত্র-ছায়ায় সুপারভাইজার নাসরিন নানা অপকর্ম করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতি হাসপাতালের আয়া, নাইট গার্ড, আনসার, বাবুর্চি, চালকসহ বিভিন্ন লোকের নামে ভর্তি দেখান। শুধু ভর্তি রেজিস্ট্রারে নাম ভর্তি দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কেউ ভর্তি হননি। ভুয়া ভর্তি দেখিয়ে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা আত্মসাৎ করছেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার নাজমুন নাহার ইতি। তার রেজিস্ট্রার খাতায় রোগীর নাম থাকলেও বাস্তবে কোনও মিল নেই।
এদের মধ্যে গোয়ালবাথান এলাকার মুক্তা আক্তারকে গেলো বছরের ১২ ডিসেম্বর ভর্তি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-২৯৪২। পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে একই দিন পুনরায় তাকে ভর্তি দেখানো হয়েছে। যার রেজি নম্বর-২৯৯৪। এরপর ২৬ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে একই দিন তাকে আবার ভর্তি দেখানো হয়। এছাড়াও গেলো বছরের ১২ ডিসেম্বর মুক্তার মা জাহানারা বেগমকে ভর্তি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-২৯৮৩। গেলো বছরের ১৩ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে একই দিন আবারও তাকে ভর্তি দেখানো হয়েছে। যার রেজি নম্বর ২৯৯৬ এবং ২৬ ডিসেম্বর তাকে ছুটি দেখানো হয়। গেলো বছরের ১২ ডিসেম্বর জানেরচালা এলাকার সোলাইমানের মেয়ে জান্নাতকে ভর্তি দেখানো হয়।
যার রেজি নম্বর ২৯৮৫। পরে ১৩ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে একই দিন আবারও তাকে হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়। এরপর ২৬ ডিসেম্বর তার তাকে ছুটি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-২৯৯৩। এরপর জান্নাতের মা মর্জিনা বেগমকে ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর ২৯৮৪। পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে একই দিন পুনরায় তাকে ভর্তি দেখানো হয়। এরপর একই দিন আবার তাকে ভর্তি দেখিয়ে ২৬ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর- ২৯৯৫। নলোয়া এলাকার শওকত হোসেন। তিনি ওই হাসপাতালে আনসার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গেলো ৮ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়েছে। যার রেজি নম্বর ২৯৫৪।
পরে ১৭ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখিয়ে পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর তাকে আবার ভর্তি দেখানো হয়। এরপর ২৬ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-৩০৩৫। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর ওই হাসপাতালের আয়া আনোয়ারাকে ভাল খাবারের জন্য ভর্তি হন। একই দিন তার ছুটি হয়। যার রেজি নম্বর-৩০১৪। একই দিন ভালো খাবারের জন্য হাসপাতালের বাবুর্চি আঙ্গুরী ও ঝাড়–দার রহিমা বেগমকে ভর্তি ও ছুটি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-৩০১৫। ৯ ডিসেম্বর একাদশীকে ভর্তি দেখানো হয়। যার রেজি নম্বর-২৯৬৮ এবং ১৯ ডিসেম্বর তার ছুটি দেখানো হয়। ভর্তি দেখানো মুক্তা আক্তার বলেন, আমি কখনও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। ভর্তি খাতায় আমার নাম রেজিস্ট্রেশন কিভাবে হলো আমার জানা নেই। এছাড়াও হাসপাতালে আসা রোগীদের চেয়ে দালালদের বেশি কদর দেখানো হয় বলেও রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ।
অপরদিকে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতির স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়ার পরও দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতার দাপটে পুনরায় এ হাসপাতালে চলে আসে। সরকারি কোয়াটারে থাকার কথা থাকলেও তিনি মির্জাপুর থেকে এসে ডিউটি করেন। তার সরকারি কোয়ার্টারে অন্যের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। হাসপাতালে দ্বিতীয় শ্রেণির কোয়ার্টারে ফিল্ড স্টাফদের থাকার ব্যবস্থা করে।
দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সরা চতুর্থ শ্রেণির কোয়ার্টারে থাকেন। হাসপাতালের খাবারসহ নানা সামগ্রী ক্রয়ের ব্যাপারে আগে জেলা সিভিল সার্জন নিয়ন্ত্রণ করতো। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আল-বেলাল ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতি খাবার ও মালামাল ক্রয়ের ঠিকাদার নিয়োগ দেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও নার্সিং সুপারভাইজার নাজনিন ছুটি ছাড়া বাড়ি চলে গেলেও সাত দিন পর হাসপাতালে এসে তিনি খাতায় সই করেন। ওই হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী হৈমন্তী বাসফুর (৫২) অসুস্থ হয়ে ছুটির জন্য ঘুরছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তার দপ্তরে। ঢাকা হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলেও অজ্ঞাত কারণে তাকে ছুটি না দিয়ে শুধু ঘুরাচ্ছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নাজমুন নাহার ইতি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। তা ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি কোনও বক্তব্য দিতে পারব না। কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আল বেলাল আরটিভি নিউজকে জানান, আমি কোনও বক্তব্য দিতে পারব না। বক্তব্য দিতে হলে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে। কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী হাফিজুল আমিন আরটিভি নিউজকে জানান, হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেবি
মন্তব্য করুন