• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অসুখের দিনগুলোতে প্রেম

আরটিভি অনলাইন ডেস্ক

  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১৫

গত শীতের কথা। এক সকালে হঠাৎ বড় ভাইয়ের ফোন। একটি দৈনিক পত্রিকার পাঠক বন্ধুদের সংগঠনের প্রধান এই বড় ভাই। আজ রাত্রে খুব ভালো একটা কাজ হবে। শীতের মাঝরাতে পথে-ঘাটে শুয়ে থাকা অসহায় মানুষের হাতে তুলে দিবে শীতের পোশাক- কম্বল, সোয়েটার এসব। ভাগ্নের জন্মদিনের অনুষ্ঠান কিংবা হোস্টেলে বারবিকিউ পার্টি, কিংবা লেপের তলায় ফেসবুকিং, অনেক লোভনীয় আকর্ষণ ছিল। তবে ভাই সবার আগে।

সাড়ে এগারোটার দিকে টিএসসির মোড়ে আমরা জনা পঁচিশেক নবীন ‘যোদ্ধা’ হাজির। আড্ডা, শীত, বাঙালি আলসেমি’র সাথে যুদ্ধ করে এসে মনে হয় ভুল করিনি। একটা প্রকট দৃশ্যমান শক্তির বলে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করলাম। শীতের কাপড়ের বস্তা কাঁধেও তুলে নিলাম। শক্তির উৎসের কথা বলতে একটু লজ্জা লাগছে। মহতি একটা কাজে এসে একটা মেয়ে, জুনিয়র-টুনিয়র হবে হয়তো, নীল একটা জিন্সের সাথে কালো টিশার্ট, গলায় একটা মাফলার, আর আমি সারাটাক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি, অন্যায়, ভীষণ অন্যায়।

--------------------------------------------------------
আরও পড়ুন: ‘ভ্রাম্যমাণ ভালোবাসা’
--------------------------------------------------------

‘আমি তুষার, শীতের তুষার।’

‘আমি রোদেলা। তুষার সংহারক।’

পরের কথাটি বলেনি অবশ্য মেয়েটা। তার আগেই আরেকটা বাচ্চার কাছে এসে পড়েছে। মেয়েটাকে নিজের হাতে সোয়েটার পড়িয়ে দিবে।

‘আমি বুয়েটে আছি, সিভিলে, লাস্ট ইয়ার, আপনি?

‘হুম, আচ্ছা আপনাদের সিলেবাসে ভূমিকম্প নিয়ে কোনো চ্যাপ্টার আছে? যা ভয় পেয়েছিলাম গতমাসে? পুরো হোস্টেলটা মনে হচ্ছিল ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে।

এখন যেমন আমার হৃদয়টা ভাঙছে, ভাবলাম। মানে, আপনি কোথায় আছেন?

-আপাতত কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন।

ডাক পড়ে গেছে আবার। ফেরত যাব। আরও কয়েকটা মেয়ের সাথে সাদা একটা মাইক্রোবাসে উঠছে রোদেলা। কী মনে করে নামল মেয়েটা।

‘তুষার ভাই, আমি আপনাদের কাছাকাছিই আছি। ডিএমসি’তে চতুর্থ বর্ষে। আবার দেখা হবে।’

বড় ভাইয়ের সৌজন্যে মেয়েটার আরও কিছু তথ্য জেনে গেছি পরের দুই দিনে। ফোন নম্বর পেলাম না। তবে ফেসবুক আইডি পেয়ে গেছি। ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পাঠানোর পরই মনে হলো একটা মেসেজ পাঠানো দরকার। ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন। কমলাপুর রেলওয়ে... শীতের একটা রাত... শীতের তুষার???’

দুইটা দিন আরও পার হয়ে গেল। কোনো উত্তর নেই। মেয়েটা প্রাইভেসি সেটিংস ভালোই জানে! কিচ্ছু নেই ফেসবুকে। ছবি, স্ট্যাটাস, রিলেশনশিপ সবকিছুতেই রেস্ট্রিকশন। ‘রোদেলা’ একটা মিসনোমার নাকি!

আমি গল্পের কোনো চরিত্র নই, নাটকের কোনো নায়কও নই। তবু কী করে যেন কিছু গোয়েন্দা বন্ধু হাজির হয়ে গেল। বন্ধু শাহিনের বড় বোন ডিএমসিতে ইন্টার্ন করে। আমার বিপদে সে হাজির হলো গুগল হয়ে। রোদেলা হোস্টেলে থাকে, খুব পড়ুয়া মেয়ে, বাইরে ঘুরঘুর করার অভ্যাস নেই, সিঙ্গেল, তবে মিরাজ, ইন্টার্ন ডাক্তার মেয়েটাকে পছন্দ করলেও করতে পারে। হয়তো ওয়ান সাইডেড রিলেশন থাকলেও থাকতে পারে।

হোস্টেলের পাশে ঘোরাঘুরি করতে করতে একদিন দেখা হলো।

‘এই এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। কেমন আছেন?’

‘আপনি কয়েকদিন ধরেই এখান দিয়ে যান-আসেন, খেয়াল করছি। দেশে আমার জানামতে উজবুক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনও আসেনি। নাকি এসেছে? আসেন, যান। আপনার ইচ্ছে।’

হচ্ছে না, কিছুই হচ্ছে না। একদিন হাসপাতালের ওয়ার্ডে সিকিউরিটির ঝাড়িও খেলাম। অযথা ঘুরঘুর করতে দেখে দালাল ভেবে আরেকটু হলে তুলে দিচ্ছিল পুলিশের হাতে। আমিও ব্যাপারটার একটা গতি করব বলে চ্যালেঞ্জ নিলাম। একটা সপ্তাহ গুলিস্তানের ফুটপাথে ফুচকা, চটপটি খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। ঠিক একটা টাইফয়েড বাধিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে। রোদেলার এখন মেডিসিন চলছে, পাকা খবর।

তবে রোদেলাই আমাকে রিসিভ করবে, ওর স্যারের ইউনিটেই ভর্তি হতে হবে, প্রতিদিন ফলোআপে আসবে মেয়েটা, এতটা ভাবা বাড়াবাড়িই হয়ে যেত। তবু হলো। বাড়াবাড়িই হলো একটা।

মেয়েটাকে ভুল বুঝেছিলাম। কঠিন আবরণের ভেতরে মিষ্টি, ভদ্র একটা মেয়ে। একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়ে এসেছে বোধ হয়। বন্ধুত্বের একটু কম আরকি। ফেসবুকের কথা বললে জানাল, সপ্তাহে এক-দুইবার বসা হলেও হয়, তবে সবসময় না। এই গত কুড়ি দিনে একবারও না। তবু ছুটির দিন জানাল, আমরা এখন ফেসবুক ফ্রেন্ড।

যুদ্ধ জয় ভেবে-টেবে আমি তো অস্থির। কিন্তু সব গুড়ে বালি। মেয়ে আবার স্পর্শের বাইরে। এবার আরেকটু বড় পাগলামি করতে হবে। অনেক যত্ন করে, কায়দা করে গোড়ালিটা মচকে নিলাম। এবার অর্থোপেডিক্সে ভর্তি হতে হবে। রোদেলার মেডিসিন তো শেষ!!!

‘আপনি কি পাগলামি শুরু করেছেন?’

‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। রোজই করে। কী আর করব। ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হলে হাসপাতালেই তো আসতে হবে, নাকি?’

‘এসে লাভ?’

‘আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।’

‘তার মানে কাল প্রপোজ করে বসবেন?’

‘বিশ্বাস নেই।’

রাগে গটগট করে চলে গেলেও ওকেই প্লাস্টার করতে হলো। প্রফেসরের হুকুম বলে কথা। সুন্দরীদের রাগ যত তাড়াতাড়ি চটে, তারচেয়ে দ্রুত নামেও। আমরা এখন আসলেই বন্ধু। রিলিজের দিন মেয়েটা হেসে বলল, ‘দেখো তুষার, তুমি কেন এমন পাগলামি করছ। ইন্টার্ন করে বিসিএস, এফসিপিএস, আমার অনেক স্বপ্ন। আমি এখনই কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না। আশা করি, তুমিও পড়াশোনা শেষ করে গুছিয়ে নেবে। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে থাকব। এর বেশি না।’

‘প্রেম করে কেও বিসিএস করে না? তোমার এফসিপিএস করা ম্যাডামরা ভালোবাসেনি।’ ভেবেছিলাম বলব। চুপ করে চলে এলাম। পরের কয়েকটা দিন গেল যন্ত্রণায়। আমার মুঠোফোন বন্ধ, ফেসবুক বন্ধ, কলেজ যাওয়া বন্ধ, আমি নিজেও বন্ধ হয়ে গেলাম। রোদেলা কি আমাকে ভুলে যাবে এই কয়টা দিনে? ও কি অন্য কাওকে পছন্দ করে? এড়িয়ে চলছে আমাকে? জীবনে প্রথম একটা মেয়েকে ভালোবাসলাম, তার এই পরিণতি? ‘আরেকদিন যদি হাসপাতালে দেখি আপনাকে, আর কথাও বলব না’, কেন বলল মেয়েটা? কিছুই ভালো লাগছে না। ঘুম হচ্ছে না কয়েকটা রাত। সারাদিন রুমে ঝিম মেরে থাকি। বন্ধুরা টেনে নিয়ে যেতে চায় ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, আড্ডায়। ওদের সাথে শুধু শুধু রাগারাগি করি। হঠাৎ একদিন রাতে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি আমি দরদর করে ঘামছি। বুকটায় প্রচণ্ড ব্যথা করছে, একেবারে বাঁ দিকটায়, হৃদয়টা যেখানে ধুকধুক করে। আমি হা করে শ্বাস নিচ্ছি কিন্তু এক ফোঁটা বাতাস নেই। আর কিছু মনে নেই আমার।

আমি এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা কামরায়। আমার নাকে নল, অক্সিজেন নল। হাতের শিরাটা ফুঁড়ে স্যালাইন ঢুকছে ফোঁটায় ফোঁটায়। আমার একটা হাত ধরে আছে মিষ্টি একটা মেয়ে। এপ্রোন পরা, গলায় স্টেথোস্কোপ জড়ানো মেয়েটার চোখে জল। আমি কিছুই জানি না। আমাকে কেউ বলছে না আমি এখন হাসপাতালের একটা সিসিইউ’তে ভর্তি। ইকোকার্ডিওগ্রাফি বলেছে আমার হৃৎপিণ্ডে একটা ছিদ্র, আজন্ম লালিত ছিদ্রটার অস্তিত্ব আমি কোনোদিনও বুঝতে পারিনি। গ্রামে মা-বাবার কাছে খবর চলে গেছে। তাদের ছেলের বুকে খুব দ্রুত একটা অপারেশন করা লাগবে। তারা এই আসলো বলে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু শুনতে পারছি, চারদিকের নাম না জানা মনিটরগুলোর অসহ্য পিপ পিপ ভেদ করে সেই মেয়েটা আমাকে বলছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। সারাটাজীবন আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।’

আমার বেডের ঠিক সামনে দরোজায় উল্টো করে লেখা সিসিইউ।

‘বিশ্বাস কর রোদেলা, আমি জানতাম না তুমি এখন সিসিইউ’তে প্লেসড।’

কাছে আসার আনন্দে, আর কিইবা বলতে পারি আমি!

❤ ahad adnan

আরও পড়ুন:

মাতুয়াইল, ঢাকা।

* BiskClub-ভালোবাসার গল্পসল্প থেকে বাছাই করা পাঠকদের গল্প নিয়ে rtvonline ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে।

সি/

মন্তব্য করুন

daraz
  • চলুন ভালোবাসার গল্প শুনি এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
প্রেমিকার ১৯ দিন পর প্রেমিকের আত্মহত্যা
প্রেমিকাকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে প্রেমিক গ্রেপ্তার
প্রেম করে বিয়ের ২ মাসের মাথায় প্রবাসীর স্ত্রীর আত্মহত্যা 
প্রেমিকাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে পাগলা মসজিদের দান বাক্সে চিঠি
X
Fresh