আরটিভি নিউজ
১৩ জানুয়ারি ২০২১, ২০:০৯
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩৯
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩৯
অবুঝ দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জহিরের সুস্থতার ওপর

জহিরুল হক ও সন্তানরা
-অত্যন্ত দুঃখ ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, আমারই ৯৩ ব্যাচ এর স্কুল বন্ধু জহির আজ স্মৃতি হারানো (Frontotemporal dementia) রোগের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। ১৯৮৭ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বন্ধু জহিরের সাথে নোয়াখালী জেলার খিলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার প্রথম পরিচয়। তখন থেকেই বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ ছিলাম আমরা। আমার একটা আশ্রয় ছিল বন্ধু জহির। আমি যখন ঢাকা থেকে গিয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হই, তখন সেই গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়াটা খুব একটা সহজ ছিলনা ! কিন্তু জহির এর সহযোগিতায় আমি খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামের ছেলে মেয়েদের সাথে মিশে যাই। বন্ধু জহির পঞ্চম শ্রেণিতে ফাস্ট গ্রেড এ বৃত্তি পায় আর সবার মুখ উজ্জ্বল করে। বাবা মায়ের খুব আদরের ছেলে ছিল বন্ধুটি আমার। জহির গ্রাজুয়েশন করার পর যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে ঠিক তার কিছুদিন আগে তার বাবা এবং বড় ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান । অনেকগুলো ভাই বোন এর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট ছোট ভাইবোনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। এরইমধ্যে ফুটফুটে ছেলে মেয়ের বাবা হন। আমার সাথে অনেকদিন ধরে যোগাযোগ ছিল না জহিরের। আমি যখন আবুধাবিতে চাকরিতে ছিলাম তখন একদিন আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ হয় জহিরের; তখন পর্যন্ত জহির খুব ভাল ছিল। বাহারাইনে একটি মানি একচেন্জ কোম্পানিতে খুব ভাল বেতনে চাকরি করত জহির। পরিবার নিয়ে ভালোভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল বন্ধুটির। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে জানাতো। আমিও খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতাম। কিন্তু একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে যখন দেখলাম আর বন্ধুটি আমাকে ফোন করছে না তখন ভাবতে শুরু করলাম! কি হয়েছে ? সময়টা তখন ২০১৩ সাল। পরবর্তীতে জানতে পারি, জহির বাহারাইন প্রবাস জীবন ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে। তার শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিয়েছে, কোন কিছুই মনে রাখতে পারে না। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর আর প্রবাস জীবনে তার ফিরে যাওয়া হয়নি । চাকরি ছেড়ে চিকিৎসার জন্য সে ভারতে যায়। চিকিৎসা করায় কিন্তু কোন উন্নতি নেই। দিন দিন সে সবকিছু ভুলে যেতে থাকে ! কোন কিছুই মনে রাখতে পারে না। জহির এর ছোট ভাই আজিজ আমার সাথে যোগাযোগ করে, আমি যথাসাধ্য আমাদের স্কুলের ৯৩ ব্যাচ এর বিভিন্ন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি এবং তাদের সহযোগিতায় খুবই যৎসামান্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা করি। তা দিয়ে হয়ত খুব ভালোভাবে ওকে চিকিৎসা করানো যেত না কিন্তু সাময়িক সময়ের জন্য তার ঔষধ ও সন্তানদের ভরণপোষণের কিছু খরচ মেটানো হয়েছিল। আমাদের সাথে জহিরকে দেখা করানোর জন্য ওর ছোট ভাই আজিজ যখন জহিরকে নিয়ে আসলো সেইদিন এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল! আমাদের বন্ধুদের সামনে থেকে সে বাজারে হারিয়ে যায়,ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা যায়; জহির বাড়িতে ফিরেছে। আমরা নিজেরা আশ্বস্ত হলাম।

১৯৯০ সালে বন্ধু জহিরের সাথে মাছুদুল আমিন
এর মাঝে প্রায় এক থেকে দেড় বছর চলে গেল জহিরের আর কোন খোঁজ খবর নিতে পারিনি। হঠাৎ গতকাল জহির এর স্ত্রী ভাবি আমাকে ফোন করেন। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমাকে বলেন, ভাই ! আমার স্বামী আর সুস্থ হবে না; তার একটি পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, হাঁটাচলা করতে পারছে না। পায়খানা-প্রস্রাব বিছানায় করছে। স্মৃতিশক্তি একেবারেই চলে গেছে, কিছুই বুঝতে ও বলতে পারে না। শুধু এক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না ঝরে যায়। আমি দুটি সন্তানকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো, কি করব, কি ভাবে ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাঁচবো কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বলে আশ্বাস দিব ভাবিকে তা বুঝতে পারছিলাম না। শুধু এতটুকু বললাম, ভাবি আমার অন্য বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। পরদিন অফিসে এসে আমাদের ৯৩ ব্যাচের বন্ধু ডাক্তার মনসুর, নিউরো সার্জন (নিউরোসায়েন্স হসপিটাল) এর সাথে আমি যোগাযোগ করি। খুব আন্তরিকতার সাথে আমার কথাগুলো শুনে আমাকে আশ্বাস দেয় বন্ধু ডাক্তার মন্সুর। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে জহির এর চিকিৎসার জন্য। আমি জানি না এ পথে আমি পা বাড়ালে অন্য বন্ধুরা আমার পাশে দাঁড়াবে কিনা ! তবে কিছু সহপাঠীরা আমাকে আশ্বস্ত করেছে এই বলে যে, তারা যথাসাধ্য আমার পাশে থাকবে। আমিও একইভাবে জহিরের পরিবারকে আশ্বাস দিয়েছি যে, আমি চেষ্টা করব আমার সকল বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে জহিরের চিকিৎসা নিশ্চিত করার । আমি সমাজের সবাইর কাছে জহির ও তার পরিবারের জন্য সহযোগিতা চাই, আর যদি সহযোগিতা পাই তাহলে একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তি ও তার পরিবারকে আমরা কিছুটা আলোর পথ দেখাতে পারব, তার অবুঝ সন্তানদের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে পারব, ইনশাল্লাহ ! এরকম এক মহামারীর সময় আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে বিপর্যস্ত, তারপরেও আমাদের পৃথিবীতে বাঁচতে হবে একজন আরেকজনের সহযোগিতা নিয়েই ! আপনারা যদি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন, মহান আল্লাহতালা আপনাদের হাতকে আরও প্রসারিত করে দিবেন । আমি এক ক্ষুদ্র ব্যাক্তি! বন্ধুর জন্য একটু চেষ্টা করছি সকলের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি জানি না জহিরের চিকিৎসার খরচ কিভাবে ব্যাবস্থা হবে অথবা তার পরিবারকে কিভাবে আলোর পথ দেখাবো ? তবে সৃষ্টিকর্তা চাহে-তো সবই সম্ভব হবে ! এই দুঃসময়ে " মানুষ মানুষের জন্য " সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে বলে আশা করি। আবারো প্রমাণ করুন; আমরা কেহ আলাদা নই। এক আত্মা, এক জীবন আমাদের! জহিরের চিকিৎসা খরচের জন্য অথবা তার পরিবারের জন্য কিছু সহযোগিতা করতে পারেন আপনারা। বন্ধু ডাক্তার মনসুর জহিরকে অতি দ্রুত ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন। আগামী সপ্তাহে তাকে ঢাকায় নেয়া হবে। আল্লাহ আপনাদের হাত প্রসারিত করার তৌফিক দান করুক, আমিন।