হাঁটু দিয়ে ঘাড় চেপে ধরার পর কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যু, যুক্তরাষ্ট্রে ৪ পুলিশ বরখাস্ত
যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ঘাড়ের ওপর একজন পুলিশ কর্মকর্তা হাঁটু চেপে রাখার পর ওই ব্যক্তি দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসের কর্মকর্তারা এ কথা জানিয়েছেন। খবর সিএনএনের।
ওই ঘটনার ভিডিও’র একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে পড়ার পর নিন্দার ঝড় ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই এ ঘটনার তদন্তে নেমেছে।
জর্জ ফ্লয়েড নামের ৪৬ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদের মঙ্গলবার মিনিয়াপোলিসের রাস্তা নেমে আসে শত শত মানুষ। সোমবার ফ্লয়েড যে জায়গায় এ ঘটনার সম্মুখীন হন, বিক্ষোভকারীরা মুখে মাস্ক পরে সেখানে জড়ো হয়ে ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ সাইন প্রদর্শন করে ও স্লোগান দিতে থাকে। এসময় তাদের সমর্থনে হর্নও বাজায় কিছু মোটরিস্ট।
পুলিশ বিভাগের পাবলিক ইনফরমেশন অফিসের পরিচালক জন এলডার বলেন, বিক্ষোভকারীরা একটি কাঁচের জানালা ভেঙে ফেলার পর সন্ধ্যায় তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ।
মঙ্গলবার পুলিশের একজন মুখপাত্র গ্যারেট পারটেন বলেন, ওই চার পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
পুলিশ প্রধান মেডারিয়া আররাডোনডো ওই চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার পর এক বিবৃতিতে সেখানকার মেয়র জ্যাকব ফ্রে বলেন, আমি আপনার সিদ্ধান্তকে শতভাগ সমর্থন করি। এটা আমাদের শহরের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। এটা আমাদের কমিউনিটি, মিনিয়াপোলিস পুলিশ বিভাগের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত।
পুলিশ জানিয়েছে, জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে এমন খবর পেয়ে সোমবার ঘটনাস্থলে যায় ওই পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা প্রথমে জানায় একজন ব্যক্তি, পরে তাকে সাসপেক্ট হিসেবে শনাক্ত করা হয়, গাড়িতে বসে রয়েছেন এবং তিনি কোনও কিছুর প্রভাবে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেন, যিনি ওই সময় গাড়ির ভেতর বসা ছিলেন এবং পুলিশ জানায় যে, তাকে বের হতে বলা হলে তিনি ‘শারীরিকভাবে প্রতিরোধের’ চেষ্টা করেন। ওই কর্মকর্তারা তাকে হাতকড়া পরায় এবং তিনি ‘মেডিকেল ডিস্ট্রেস’ ছিলেন এমনটা মনে হচ্ছিল বলে জানায় পুলিশ। এর কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তি হাসপাতালে মারা যায়।
মেয়র জ্যাকব ফ্রে বলেন, যে টেকনিকে জর্জ ফ্লয়েডের মাথা মাটির সঙ্গে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল তা পুলিশ বিভাগের নিয়ম বহির্ভূত।
ঘাড়ের ওপর একজন পুলিশ কর্মকর্তার হাটু রাখা অবস্থায় কয়েক মিনিট ধরে আকুতি মিনতি করেন ফ্লয়েড। কিন্তু এরপর কিছুক্ষণ পর তার নড়াচড়া, চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
টাউন হল থেকে ফেসবুকে স্ট্রিম করা এক ভিডিওতে ফ্রে বলেন, ওই ব্যক্তির ঘাড়ে হাঁটু রাখার কোনও কারণই ছিল না ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে।
তিনি বলেন, যে টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে তা অনুমোদিত নয়; প্রশিক্ষণের সময় পুলিশদের এ ধরনের টেকনিক শেখানোও হয় না। ফ্রে, আমাদের চিফ (পুলিশ প্রধান) এ ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। কারও ঘাড়ের ওপর হাঁটু রেখে এ ধরনের চাপ দেয়ার কোনও কারণ নেই।
ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন পুলিশ কর্মকর্তা একজন ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে রেখেছিলেন। কি কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা তিনি কীভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন ওই ভিডিওতে তা ধরা পড়েনি।
নিঃশ্চুপ হয়ে যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট ধরে ‘প্লিজ, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ বলে চিৎকার করেন ফ্লয়েড। এসময় পাশে দাঁড়িয়ে মানুষজনও তার ঘাড় থেকে হাঁটু সরিয়ে নিতে ওই কর্মকর্তার প্রতি অনুরোধ জানায়।
সিভিল রাইটস অ্যাটর্নি বেঞ্জামিন ক্রাম্প এক বিবৃতিতে ওই ব্যক্তিকে ফ্লয়েড হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, আমি তার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছিলাম। মেয়রও তাকে টুইটারে চিহ্নিত করেন।
ক্রাম্প বলেন, আমরা সবাই জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর ভিডিও দেখেছি যেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে পুলিশের গাড়ি নিয়ে যেতে ও তার ঘাড় থেকে হাঁটু সরিয়ে নিতে ওই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছিল। এই অবমাননাকর, অত্যধিক ও অমানবিক শক্তি প্রয়োগের কারণে একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলো, যাকে নন-ভায়োলেন্ট একটি অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করেছিল।
হেনেনপিন কাউন্টি মেডিকেল পরীক্ষকের কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণ এবং পদ্ধতিটি এখনও পেন্ডিং আছে এবং স্থানীয়, রাজ্য এবং ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এটির তদন্ত করছেন।
মিনেসোটার সিনেটর অ্যামি ক্লুবুচার এক টুইট বার্তায় এই ঘটনাকে ‘আফ্রিকান আমেরিকান মৃত্যুর আরও একটি ভয়াবহ ও বেদনাদায়ক ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন।’
ফ্রে মঙ্গলবার ফ্লয়েডের পরিবারের প্রতি শোক জানিয়েছেন। এসময় তিনি বলেন, যা আমরা দেখেছি তা ভয়াবহ, সম্পূর্ণ এবং পুরোপুরিভাবে গোলমেলে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ মিনিট ধরে আমরা দেখেছি একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে রেখেছিল।
তিনি বলেন, যখন শুনবেন কেউ সাহায্যের জন্য ডাকছে, তখন আপনার উচিত তাকে সাহায্য করা। ওই কর্মকর্তা মৌলিক মানবিক সেন্সের জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। শিকাগো এবং গত রাতে এখানে যা ঘটেছে এটা ভয়াবহ। এটা ট্রমাটিক ছিল এবং এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের আরও কত দূর যেতে হবে।
ফ্রে বলেন, আমেরিকায় কালো হওয়া একটি ‘মৃত্যুদণ্ড’ হওয়া উচিত নয়।
মিনিয়াপোলিস পুলিশ অফিসার্স ফেডারেশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ওই কর্মকর্তারা তদন্তে সহযোগিতা করছেন। সেখানে বলা হয়েছে, এখনই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো এবং তাৎক্ষণিক আমাদের কর্মকর্তাদের নিন্দা জানানোর সময় আসেনি। বিবৃতিতে বলা হয়, ওই কর্মকর্তারা যে বক্তব্য দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তাদের কর্মকাণ্ড এবং প্রশিক্ষণের প্রটোকল খুব ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হবে।
সোমবার ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা ফ্লয়েডের ঘাড় থেকে সরে যেতে ওই কর্মকর্তার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে। দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডকে ধরে রেখেছিল এবং আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের ওপর নজর রাখছিল।
ফ্লয়েড ওই কর্মকর্তাকে বলেন, আমার পেট ব্যথা করছে। আমার ঘাড় ব্যথা করছে, সবকিছু ব্যথা করছে। একটা সময় গিয়ে ফ্লয়েড বলেন, আমাকে পানি বা কিছু দিন। প্লিজ, প্লিজ।
এসময় একজন নারী বলেন, তার (ফ্লয়েডের) নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আরেক ব্যক্তি বলেন, তিনি গ্রেপ্তারে বাধাও দিচ্ছেন না। তিনি আর সাড়া দিচ্ছেন না।
ফ্রে বলেন, তিনি কমিউনিটির মানুষজনের ক্ষোভটা বুঝতে পারছেন কিন্তু করোনাভাইরাসের ঝুঁকির কথাও তিনি বিক্ষোভকারীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা চাই সবাই, যারা বিক্ষোভ করছে তাদের ও তাদের পরিবারকে নিরাপদ রেখেই যেন তারা মতামত প্রকাশ করে। তাই দয়া করেন, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন, দয়া করে মাস্ক ব্যবহার করুন।
মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় লিখেন, এই ডিস্টার্বিং ভিডিওতে মানবতার অভাব খুব অসুস্থ পর্যায়ে দেখা গেছে। আমরা উত্তরের অপেক্ষা করবো এবং ন্যায়বিচার চাইবো।
মিনেসোটার সেন্ট পলের মেয়র মেলভিন কার্টার এই ঘটনার ভিডিওকে, ‘আমার মধ্যে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ ও হৃদয় বিদারক চিত্র বলে বর্ণনা করেছেন। কার্টার বলেন, যে অফিসার পাহারা দিচ্ছিল সেও তার পার্টনারের মতো সমান অপরাধী, তাদের পুরোপুরি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এটা এখনও বন্ধ হওয়া দরকার।
এসিএলইউর পুলিসিং পলিসি অ্যাডভাইজার পেইজ ফার্নান্দেজ বলেছেন, এ ঘটনাটি ২০১৪ সালের নিউইয়র্কে এরিক গার্নারের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যিনি একজন পুলিশ অফিসার তার গলায় ফাস দিয়ে ধরে রাখার পর বেশ কয়েকবার ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ বলেছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় গারনার মারা যায়, ওই ঘটনাটি ভিডিওতেও ধরা পড়েছিল।
ফার্নান্দেজ এক বিবৃতিতে বলেন, যদিও মিনিয়াপোলিসের মতো জায়গায় গলায় হাত দিয়ে ফাঁস দেয়া টেকনিক্যালি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তারপরও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা ছোটখাটো অপরাধের জন্য পুলিশের অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় সহিংসতার শিকার করা হচ্ছে। ভুলের কোনও সুযোগ নেই: আজ জর্জ ফ্লয়েডের বেঁচে থাকা উচিত ছিল। দায়ী কর্মকর্তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতায় আওতায় আনতে হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘট্নার শরীরে থাকা ক্যামেরা সচল হয়ে যায়।
এ
মন্তব্য করুন