করোনাযুদ্ধে সবার ওপরে থাকা ৬ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই নারী!
তখন সবেমাত্র মারণ ভাইরাস করোনা বিশ্বে সাম্রাজ্য তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসের শুরুর দিকে। যে সময়টায় নারী দিবস উদযাপন করে বিশ্ব। আর ঠিক সেই সময়েই বিশ্বের যে গুটিকয়েক দেশগুলোতে নারী প্রধানমন্ত্রীরা রয়েছেন, তারা করোনা রুখতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে দেন। খবর এই সময়ের।
করোনা মোকাবিলায় প্রথম সারির সফল কিছু দেশের মধ্যে রয়েছে নারী নেতৃত্ব থাকা এসব দেশ। আর সেই দেশগুলো হলো- জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং ডেনমার্ক। এই দেশগুলোর মধ্যে করোনার হানায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছিল ডেনমার্কের। কিন্তু সেই ডেনমার্কও শক্ত হাতে করোনার মোকাবিলা করে আজ প্রায় সংক্রমণ রুখেই দিয়েছে দেশে।
আসুন একবার দেখে নেয়া যাক, করোনা মোকাবিলায় এই ছয় দেশের প্রধানমন্ত্রীদের অনস্বীকার্য অবদান।
নিউজিল্যান্ড:
দেশে সন্ত্রাসী হামলার সময়ই বিশ্বজোড়া খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। জেসিন্ডার সেই নিউজিল্যান্ডই পুরো বিশ্বের কাছে করোনা মোকাবিলায় যেন অন্য এক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। যেমনই আক্রান্তের সংখ্যা কম, তেমনই কম মৃতের সংখ্যাও। গত শুক্রবার পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা ছিল এক হাজার ২৩৯। যার মধ্য়ে ৩১৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে গেছেন। সেই নিউজিল্যান্ডেই মঙ্গলবার আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৭২। সুস্থ হয়েছেন ৬২৮ জন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে জেসিন্ডার দেশে ৯ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দেশবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর আর্জি ছিল, অভিনয় করুন, যাতে মনে হয় আপনার শরীরে করোনাভাইরাস আছে। যে পদক্ষেপই এখন নেবেন, সেটা অন্য কারও কাছে ঝুঁকিপূর্ণ। আর সেই কারণেই পরিবার, বন্ধু, সন্তান, দাদা-দাদী, বাবা-মা-- নিকটস্থ সবার সঙ্গে তাই দেখা করা এখন বন্ধ। নিউজিল্যান্ডে কিন্তু এখনও লকডাউন চলছে।
জার্মানি:
মার্চ মাসের শুরুর দিকেই দেশবাসীকে সতর্ক করে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলে দিয়েছিলেন, জার্মানির ৭০ শতাংশ মানুষ করোনা আক্রান্ত হবেন। তার হাতে গোনা এক সপ্তাহের মধ্যেই এক ডাক্তারের কাছ থেকে নিউমোকোকাল ভ্যাক্সিন নেন জার্মান চ্যান্সেলর। কিন্তু সেই ডাক্তারের শরীরেরই করোনা ধরা পড়ে। তারপরই নিজেকে কোয়ারেন্টিনে রাখেন মার্কেল। তবে জার্মানিতে শুরুর দিকে হু হু করেই বাড়ছিল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। যদিও সেই সংখ্যাটা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আর সেই সংখ্যাটা কমানোর একমাত্র কারিগর মার্কেল নিজেই। গত শুক্রবার পর্যন্ত জার্মানিতে করোনা পজিটিভের সংখ্যা এক লাখ ১৮ হাজার। যার মধ্যে ৫২ হাজার ৪০৭ জন মানুষ সুস্থ হয়েছে। সেই সংখ্যাটাই ১৪ এপ্রিল আক্রান্তের হিসেবে এক লাখ ৩০ হাজার ৭২। মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার ১৯৪ জনের। সুস্থ হয়েছে ৬৮ হাজার ২০০ জন।
বেলজিয়াম:
বেলজিয়ামের ১৮৯ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোনও নারী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসেন। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন সোফি উইলমেস। তবে করোনার ধাক্কা সামলাতে প্রাথমিকভাবে হিমশিম খাচ্ছিলেন সোফি। ঝড়ের গতিতে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল সে দেশে। ইতালি, স্পেনের পরই একটা সময়ে হু হু করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল বেলজিয়ামে। বাড়ছিল মৃতের সংখ্যাও। গত ১৪ মার্চ বেলজিয়ামের জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিল জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেছিল পুরো দেশে। দেশের অর্থমন্ত্রী সে সময়ে জানিয়েছিলেন, দেশের ১০ লাখ মানুষকে অস্থায়ী বেকার বলা যেতে পারে। সবচেয়ে চমকে ওঠার মতো কাণ্ড ঘটে যখন বেলজিয়ামেই বিশ্বের প্রথম কোনও পোষ্য করোনা আক্রান্ত হয়। একটি বিড়ালের শরীরে মেলে করোনাভাইরাস। তবে এই মুহূর্তে চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই। তবে পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যা কমছে। এখন বেলজিয়ামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কমেছে ৫০ শতাংশ এবং সেরেওঠার প্রবণতা প্রায় ৬৭ শতাংশ। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩১ হাজার ১১৯। মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ১৫৭ জনের। আর পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে ছয় হাজার ৮৬৮ জন।
ফিনল্যান্ড:
বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী ফিনল্যান্ডেরই। সানা মারিনের ফিনল্যান্ডেও এখন করোনা সংক্রমণ খুবই কম। একই সঙ্গে মৃতের সংখ্যাও কমছে ফিনল্যান্ডে। অনেকটা আগেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। করোনাভাইরাসে সংক্রামিত বেশিরভাগ রোগীই দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের। তাই রাজধানী হেলসিংকিসহ দক্ষিণ ফিনল্যান্ডকে সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। অবস্থাটা এখনও ঠিক তাই। জানুয়ারির শেষদিকে উত্তর ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ডে আগত ৩২ বছর বয়সী এক চীনা নারীর মধ্যে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়েছিল। সেই ফিনল্যান্ডেই এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ১৬১। সুস্থ হয়েছে ৩০০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের। মে মাসের মাঝামাঝি সময় অবধি লকডাউন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সানা মারিনের দেশে।
আইসল্যান্ড:
করোনা সংক্রমণ রোধে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আইসল্যান্ড। পুরো বিশ্ব যখন মহামারি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে। সেই সময়ে আইসল্যান্ড কিন্তু লকডাউনের রাস্তাতেই হাঁটেনি। বরং সংক্রমণ রুখতে দেশের ৪ লাখ মানুষের প্রায় সবাইকেই করোনার টেস্টিংয়ের আওতায় নিয়ে এসেছে এই দেশ। কিন্তু লকডাউন কেন নয়? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আইসল্যান্ডের গবেষকরা দাবি করেছিলেন, লকডাউনের থেকেও ব্যাপক হারে টেস্টিং করোনার সংক্রমণ রোখার চাবিকাঠি হতে পারে। পাশাপাশিই তাদের আরও দাবি, টেস্টিংয়ের মাধ্যমেই একমাত্র করোনা সংক্রমণের আসল রূপরেখা ধরা সম্ভব। আর গবেষকদের দেখানো সেই পথে হেঁটেই আইসল্যান্ডে এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৭১১। মৃত আটজন এবং সুস্থ হয়েছে ৯৩৩ জন। আর আইসল্যান্ডে করোনার আঁচ আসতে না দেয়ার কারিগর অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকবসডোটির।
ডেনমার্ক:
করোনা ঠেকাতে শুরু থেকেই তৎপরতা দেখিয়ে এসেছে ডেনমার্ক। গোটা দেশে লকডাউনের কারণে বেকারত্ব ঠেকাতে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফেডেরিক্সন ১৫ মার্চ একটি চুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। কর্মীদের চাকরি যাওয়া বাঁচাতে দেশের ব্যবসায়ীদের মোটা অর্থ সাহায্যে করে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ফেডেরিক্সনের বক্তব্য ছিল, আপনারা কর্মচারীদের দুই সপ্তাহের জন্যে ছুটিতে পাঠান তবে কাউকে বরখাস্ত করবেন না। আর তার এই বক্তব্য আর চুক্তির পেছনে যুক্তি ছিল, দেশের অর্থনীতিতে যেন ভাঁটা না পড়ে। অর্থনীতির পাশাপাশিই করোনা সংক্রমণ রোধেও জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ফেডেরিক্সন। এই মুহূর্তে ডেনমার্কে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৪৬৯। মৃত্যু হয়েছে ২৮৫ জনের আর সুস্থ হয়েছে দুই হাজার ২৩৫ জন।
এ
মন্তব্য করুন