• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

নাসার ইনজেনুইটি হেলিকপ্টার কি পারবে মঙ্গলের বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করতে? 

  ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৭:৩০
Ingenuity helicopter poised for first-ever flight on Mars, RTV
মঙ্গলপৃষ্ঠে দাাঁড়িয়ে আছে ইনজেনুইটি হেলিকপ্টার (সংগৃহীত)

শৈশবকালে বইয়ের পাতায় যেমন রঙিন মনভুলানো ছবি দেখতাম আমরা ঠিক সেরকম দেখতে এক যন্ত্র বানিয়েছে নাসা। সেই যন্ত্র আবার উড়তে পারে। যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইনজেনুইটি হেলিকপ্টার’। এই হেলিকপ্টার কিন্তু আমরা পৃথিবীর আকাশে যেমন উড়তে দেখি তেমন নয়।

তেমন হবেই বা কেন? ইনজেনুইটি যে উড়বে লালগ্রহ মঙ্গলের আকাশে। মঙ্গলের পাথুরে জেজেরো ক্রাটারের তলায় কি আছে তারও খোঁজ চালাবে এই কপ্টার। গ্রহটির আকাশে যন্ত্র উড়ানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীবাসীর প্রথম চেষ্টার সাক্ষী হতে চলেছে এই ইনজেনুইটি।

নাসার রোভার পারসিভারেন্সে এর পেটের মধ্যে করে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে নেওয়া হয়েছে এই সুনিপুণ হেলিকপ্টারটি। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলে অবতরণ করে রোভার পারসিভারেন্স। এরপর সম্প্রতি নাসা জানায়, পারসিভারেন্সে চেপে পৃথিবী থেকে ২৩৯ মিলিয়ন মাইলের যাত্রা শেষ করে ইনজেনুইটি হেলিকপ্টার মঙ্গলের মাটিতে নেমেছে। রোভারের পেট থেকে চার ইঞ্চি লাফ দিয়ে মঙ্গলপৃষ্ঠে নামে কপ্টারটি।

মঙ্গলপৃষ্টে নেমেই চার ফুটের এই রোবোট কপ্টার প্রথমে পা সোজা করে দাঁড়ায়। এরপর মঙ্গলের সূর্যের পানে মেলে দেয় তার সোলার প্যানেল। এই সোলার প্যানেলই তার শক্তির মুল উৎস। লালগ্রহের রাত্রিকালে বিরাজমান মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকে থাকতে কপ্টারটির রয়েছে নিজস্ব হিটার। সেটিই তাকে গরম রাখবে। সেই হিটারসহ কপ্টারটি উড়তে যে শক্তির প্রয়োজন তার পুরোটাই আসবে সোলার প্যানেল থেকে।

মঙ্গলে নিয়ন্ত্রণে রেখে কোনো রোবট উড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। লাল গ্রহের মোটামুটি মধ্যাকর্ষণ থাকলেও (পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ), তার বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বের তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ। তাই কপ্টারটির পাখা বা রোটরগুলো অনেক বড় রাখতে হয়েছে। আবার পারসিভারেন্সে করে আসার জন্য তাকে আকারে ছোট আর পাতলা ঘনত্বের মঙ্গলীয় বায়ুমণ্ডলে উড়ার জন্য হালকাও হতে হয়েছে।

ছোট অথচ যুগান্তকারী এই কপ্টারটি ১১ই এপ্রিল মঙ্গলের আকাশে উড়ানোর কথা ছিল নাসার। তবে উড্ডয়নের তারিখ আরও সপ্তাহখানেক পিছিয়েছে তারা।

প্রথম উড্ডয়নে ইনজেনুইটিকে সোজা উপরের দিকে এক মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে উড়ানো হবে। তিন মিটার বা ১০ ফুট উচুঁতে নিয়ে ২০ সেকেন্ড অব্দি রাখা হবে। এরপর একই গতিতে নিচে মঙ্গলপৃষ্ঠে নেমে আসবে সেটি। প্রথম এই উড্ডয়ন প্রক্রিয়া ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে শেষ করা হবে। যেখানে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ১৯০৩ সালে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর আকাশে ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত উড়তে পেরেছিল।

ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থা অ্যারোভাইরনমেন্ট ইনজেনুইটি রোবোটটির পাখাসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ বানিয়ে দিয়েছে নাসাকে। কপ্টারটি পাখা বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি করেছে তারা। সংস্থাটির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার বেন পিপেনবার্গ বলেন, ১ দশমিক ৮ কেজি ওজনের এই উড়োযানটিকে হেলিকপ্টার বলা হলেও আসলে এটি একটি ছোট আকারের ড্রোনের মতোই।

গত কয়েক বছরে এই যানটিকে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের জন্যে উপযোগী করে তোলা হয়েছে। হেলিকপ্টারের তুলনায় এর ব্লেডগুলো আকারে বড় এবং পাঁচ গুণ বেশি ঘোরে। চার ফুট উচ্চতার এই যানটির রয়েছে বাক্স-আকৃতির অবয়ব। রয়েছে দুটি ক্যামেরা, কম্পিউটার ও নেভিগেশন সেন্সর।

আবার রাতে মঙ্গলের তাপমাত্রা মাইনাস ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায় বলে যানটির ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্যে রয়েছে সোলার সেল। কেবল মঙ্গলীয় হিমশীতল ঠাণ্ডাই নয়, কপ্টারটি উড়ানোর সময় এর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হতে পারে। সেটিও খেয়াল রেখে ডিজাইন করা হয়েছে ইনজেনুইটি।

পিপেনবার্গ আরও বলেন, ঠাণ্ডা আবহাওয়ার পাশাপাশি মঙ্গলে জটিল বিকীরণের মুখেও পড়তে হবে ইনজেনুইটিকে। মঙ্গলের আকাশে রোবটটি উড়ানো সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জের।

নাসার কর্মকর্তা টিমোথি ক্যানহাম জানান, সুনিপুণ দক্ষতায় তৈরি এই রোবটে আছে একগাদা সেন্সর। কোনো সেন্সর সেটিকে সঠিকভাবে উড়তে, কোনোটি আবার কত উচ্চতায় উড়ছে সেটি পরিমাপ করতে সাহায্য করবে রোবট ড্রোনটিকে। আবার মঙ্গলীয় ঝড়ো বাতাসেও যাতে সেটি ঠিকমতো উড়তে পারে সেটির জন্যও আছে সেন্সর। এমনকি উচুঁ-নিচু পৃষ্ঠে অবতরণ করলে সেটিও জানিয়ে দেবে ইনক্লাইনোমিটার সেন্সর।

তিনি আরও বলেন, নির্দিষ্ট পথে উড়তে এতে লাগানো হয়েছে ইন্টারশিয়াল সেন্সর। আছে লেজার অ্যাল্টিমিটার। এই মিটার ড্রোনটি কেমন জমির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে তার হিসেব কষবে। এতে লাগানো হয়েছে নিম্নমুখী হাই রেজুলেশন ক্যামেরা। এটি প্রতি সেকেন্ডে ৩০টি করে ছবি তুলতে পারবে। ক্যামেরাটি নির্দিষ্ট অভিমুখে ড্রোনের যাত্রাপথের ছবি তোলাসহ এর গতি নির্ণয় করতেও সক্ষম।

আরেক ইঞ্জিনিয়ার জশ র‌্যা ভিচ জানান, আধুনিক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্ট ডিভাইসে যে ধরনের রঙিন ক্যামেরা থাকে এতেও অনেকটা সেই ধরনের ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বিশেষ ওই ক্যামেরা তোলা ছবিতে প্রকৃত রং ফুটিয়ে তুলতে পারবে বলে আশা করছেন তারা। তবে রোভার পারসিভারেন্স বেশ কয়েকটি ক্যামেরা থাকলেও ইনজেনুইটতে কেবল দুটি ক্যামেরাই লাগানো হয়েছে।

মূলত এই রোবট ড্রোন কিংবা হেলিকপ্টার যেটাই বলেন না কেন এটি বানানো হয়েছে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। পরবর্তী মঙ্গলীয় হেলিকপ্টার কেমন হবে তার পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতেই কপ্টারটি পাঠানো হয়েছে মঙ্গলে। ৩০ সলস (মঙ্গলের দিনকে সলস বলা হয়) লালগ্রহে থাকবে ইনজেনুইটি। এই কদিনে ৫টি পরীক্ষা চালানো হবে রোবটটি দিয়ে। প্রথম উড্ডয়ন সফল হলে দ্বিতীয় উড্ডয়নে ইনজেনুইটিকে আরও উচুঁতে উঠানো হবে। তৃতীয় উড্ডয়নে সেটিকে ১৬৪ ফুট অব্দি উড়ানো হবে। প্রত্যেকবারেই গতি বাড়ানো হবে ড্রোনটির। তবে ৯০ সেকেন্ডর মধ্যেই উড়ানপ্রক্রিয়া শেষ করা হবে।

চতুর্থ আর পঞ্চম ধাপে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে কপ্টার বা ড্রোনটি। এসব ধাপে ইনজেনুইটির মঙ্গলীয় দিনের আবহাওয়ায় বেশি বাতাসে ওড়ার ক্ষমতা, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উচ্চতায় উড়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হবে। এই ইনজেনুইটির সফলতা মঙ্গলের বুকে তো বটেই পৃথিবীর বুকেও মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ইতিহাস রচনা করবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নাসার এই ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক প্রজেক্ট এখন কতটা সফল হয়, সেটাই দেখার বিষয়। সূত্র : আল জাজিরা

টিএস/পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • আন্তর্জাতিক এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh