• ঢাকা বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
logo

সরকারের ৩ বছর : বড় চ্যালেঞ্জ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

দুরুল হক

  ১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:০৬

টানা দু’মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্তি হলো আজ। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি, টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাত্রা করলেও ৩ বছর পেরিয়ে তা অনেকটাই কেটে গেছে। এখন বড় চ্যালেঞ্জ আসছে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা।

এদিকে, সরকার বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ায় আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ বছর পূর্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার রয়েছে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আলোচিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও দলের নেতৃত্বাধীন জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ২৩৪টি আসন। শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি এবং জাসদ ৫টি আসনে বিজয়ী হয়। জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। এ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন প্রার্থীরা। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ১২৭টি, জাতীয় পার্টি ২০টি, জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, জেপি ১টি আসনে জয়ী হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশের পরদিন ১০ জানুয়ারি দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এরপরই আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সংসদ নেতা মনোনীত হন। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এদিন সংসদ নেতা শেখ হাসিনাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি দু’বার (১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৩) প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

একই সঙ্গে এদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৮ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। মন্ত্রিসভা গঠনের শুরুতেই চমক তৈরি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বিতর্কিত ও প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাকে স্থান দেয়া হয়নি। অপেক্ষাকৃত তরুণ কয়েকজন নেতা যুক্ত হন মন্ত্রিসভায়। এতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও শরীক ৪টি দলের প্রতিনিধি স্থান পান। মন্ত্রিসভায় জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ৩ জন সদস্যকে স্থান পাওয়া নিয়ে তৈরি হয় ব্যাপক আলোচনা। একই সঙ্গে বিরোধী দল ও মন্ত্রিসভায় অংশ নেয়ায় বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়।

তৃতীয় বছর : অর্জন-বিসর্জন

২০১৬ সালটি সরকারের অন্যতম সফল বছর। এ বছর কয়েকটি বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে।

২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে এটি একটি মাইলফলক।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য চীন থেকে কেনা দুটি সাবমেরিন ‘জয়যাত্রা’ ও ‘নবযাত্রা’চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় ২২ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সফররত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ১৪ অক্টোবর বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল এবং চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

দেশের ১০ কোটি নাগরিককে মেশিন রিডেবল স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি কার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয় ২ অক্টোবর।

এ বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত দেশের প্রথম ৮ লেন সড়ক উদ্বোধন হয়। একইদিনে পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম এবং পদ্মাসেতুর মাওয়া ও শিবচর প্রান্তে পাঁচ্চর-ভাঙ্গা জাতীয় মহাসড়কে চার লেন প্রকল্পকাজ উদ্বোধন করা হয়। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলবে।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ’সিভিল সার্ভিস ইন ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন’ সামিট অনুষ্ঠিত হয় ২৮ জুলাই। এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনপ্রশাসনের উদ্ভাবনীমূলক কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়।

২০১৬ সালের ২৬ জুন দেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হয়। একইদিনে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের উদ্বোধনও হয়।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হয় ১০ এপ্রিল।

উল্লেখ্য, বিলুপ্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাদুঘর’ ও ‘জাতীয় চার নেতা স্মৃতি যাদুঘর’ স্থাপন করা হয়েছে।

বছরের ৩০ মার্চ ৭ রাস্তা-মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারেরও উদ্বোধন হয়।

ডিজিটাল অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ডিকোনমি’ শব্দটিকে মূল বিষয় ধরে জার্মানির হ্যানোভার শহরে ১৪-১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের সবচে’ বড় তথ্যপ্রযুক্তি মেলা সিবিট-২০১৬। যেখানে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশ নেয়।

বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। দেয়া হয় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।

পটুয়াখালি-কুয়াকাটা মহাসড়কে শেখ কামাল ও শেখ জামাল সেতু, সিলেট সড়ক জোনে একই সঙ্গে ১৬টি সেতু, টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা পানি শোধনাগার এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি।

বছরের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে দেশের প্রথম বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়। একইদিনে বন্দরনগরীতে কদমতলী ফ্লাইওভার, বাইপাস রোড, রিং রোড় এবং লালখান বাজার হতে হযরত শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ উদ্বোধন।

বাংলাদেশ বিমান বহরে মেঘদূত ও ময়ূরপঙ্খী নামে দুটি আধুনিক প্রজন্মের উড়োজাহাজ সংযোজন হয় ১২ জানুয়ারি।

জানুয়ারিতে গাছের শেকড়ের মতো ৫ কেজি ওজনের হাত নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন খুলনার দাকোপ উপজেলার আবুল বাজানদার। দেশের ইতিহাসেও এরকম ঘটনা এটিই প্রথম।

‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুকে ফুলের মতো ফুটবো/বর্ণমালার গর্ব নিয়ে আকাশজুড়ে উঠবো’ শ্লোগান নিয়ে সারাদেশে পাঠ্যপুস্তক উৎসব শুরু হয় ১ জানুয়ারি। ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি বই বিতরণ হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গেলো ১ জানুয়ারি ২০১৭ বিনামূল্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে।

সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা

বিশ্ব আজ সন্ত্রাস এবং সহিংস জঙ্গিবাদ নামক ২টি অন্যতম চ্যালেঞ্জের মুখে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নেয়। সাফল্য এসেছে জঙ্গিবাদ দমনে।

গেলো বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সংঘটিত হয় দেশের ইতিহাসে সবচে’ ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। এর কয়েকদিন পর ঈদে শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। এরপর কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, রূপনগর, আজিমপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাতে সফলও হয় তারা।

যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

এ বছরের ১০ মে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং ৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়।

বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার পরিমাণ ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ৭৮ শতাংশ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো লীগ সরকারের পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে একটি।

খেলাধুলায় এ বছর সর্বোচ্চ সাফল্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের টেস্ট জয়। এছাড়া আলোচনায় ছিল অলিম্পিক গেমস।

বিদায়ী বছরে উজ্জীবিত হবার মতো অনেক কিছু থাকলেও অনেক ঘটনা জাতিকে বেদনা ভারাক্রান্ত করেছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন জাতিসত্তাকে দিয়েছে নাড়া। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওপর পুলিশি সহিংসতাও দেশে-বিদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তোলে।

এ বছর পদ্মাসেতুর কাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে দেশের মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা।

বছরজুড়েই গণমাধ্যম সরব ছিল নারী নির্যাতন ইস্যুতে। মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে উদ্ধার করা হয় ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী তনুর লাশ। জুনে তোলপাড় তোলে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ড।

প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আগস্টে বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা। অক্টোবরে সিলেটে কলেজছাত্রী নার্গিসকে কুপিয়ে হত্যার অপচেষ্টা চালায় ছাত্রলীগ নেতা বদরুল।

দ্বিতীয় বছর: সাফল্য-ব্যর্থতা

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে শুরু করলেও সার্বিকভাবে দ্বিতীয় বছরটি ছিল সরকারের সাফল্য ও অর্জনের। বছর শুরুর রাজনৈতিক উত্তেজনা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র কোন কিছুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলার পথে বাধা হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ভূমিকায় নানা বাধা উপেক্ষা করে সরকার বেশ কিছু লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য পায়।

সরকারের একবছর পূর্ণ হওয়াকে কেন্দ্র করে টানা ৯২ দিন হরতাল-অবরোধ চালায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ২০দলীয় জোটের এই কর্মসূচি নাশকতা ও সহিংসতায় রূপ নেয়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নাশকতা নিয়ে সরকার কঠিন চাপের মধ্যে পড়ে। নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিরোধীদলের এ আন্দোলন কঠোরভাবেই দমন করে সরকার। সকল বাধা-বিপত্তি হটিয়ে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় বছরের অন্যতম সাফল্য- দেশি-বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখা। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় নানা চড়াই-উৎড়াই ডিঙিয়ে গেলো বছর তিন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করে সরকার।

দ্বিতীয় বছরে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য-ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত চুক্তি। ৬৮ বছরের বঞ্চনা আর ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবে রূপ পায় ৭ মে ভারতের পার্লামেন্টে বিল পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে। সীমান্ত চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১ ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১ ছিটমহল বিনিময় করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সীমান্তে ‘ছিটমহল’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা এটি।

এ সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো পদ্মা সেতু নির্মাণ।বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর অধরা কোনো কিছু নয়, বরং বাস্তব। এটি নিয়ে নানা মহল থেকে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। দুর্নীতির বানোয়াট অভিযোগ বিশ্বব্যাংক সহায়তা প্রত্যাহার করলেও দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে সরকার।তাছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরও যাত্রা শুরু হয়েছে এ বছর। সরকারের দ্বিতীয় বছরেও অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ ছয়-সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করে যাচ্ছে। ধারাবাহিক এই প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৫০ বিলিয়ন ডলারের সমান।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পান। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থার (আইটিইউ) ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ পান প্রধানমন্ত্রী। এ দুটি পুরস্কারকে সরকারের সাফল্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলা যেতে।

এবার সরকারের সমালোচিত বিষয়ে চোখ রাখা যাক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা উন্নয়নের নামে যে শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ ওঠেছে পিইসি আর জেএসসি নামের পরীক্ষা কেড়ে নিয়েছে কোমলমতি শিশুদের শৈশব। এর মাধ্যমে সরকার কোচিং ব্যবসা আর গাইড ব্যবসাকে পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন বলে সমালোচনা শোনা যায়।পাবলিক পরীক্ষার নামে এসব শিশুকে কোথাও কোথাও পরীক্ষায় নকল করার প্রথম পাঠ দেয়া হচ্ছে। জীবনের শুরুতে এসব শিশু শিক্ষার্থীর সুস্থ বিকাশের পথ বন্ধ করে দেয়ার দায় সরকার এড়াতে পারে না। এছাড়াও দু’বছরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের সংস্কৃতি শিক্ষার পরিবেশ অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ করতে গিয়ে মেধাবীরা ছিটকে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

সরকারের দ্বিতীয় বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও কলেজগুলোতে ছিল অস্থিরতা। বছর জুড়েই কোন না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও মাঝেমধ্যেই ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছে। এর ফলে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫জন। বিভিন্নস্থানে আহত হয়েছে ৫ শতাধিক নেতাকর্মী। শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারের সবচে’ নিন্দনীয় দিক হলো, মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারা। গেলো ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বছরশেষে পৌরসভা নির্বাচন ঘিরেও সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। জনগণের ভোট দেয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সকল সাফল্যের ওপর কালো একটি রেখা এঁকে দিয়েছে।

প্রথম বছর: অনিশ্চয়তা ও অস্বস্তি

বর্তমান সরকারের প্রথম বছরটি ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। তবে যে নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেটি অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ দেশের সম্ভাব্য সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা ও অস্বস্তি ছিল।

দেশীয়-আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের গতি অব্যাহত রাখায় নতুন সরকার গঠনের প্রথম বছরেই প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। নির্বাচন প্রশ্নে শুরুতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সরকারকে কিছুটা বেগ পেতে হলেও প্রথম বছরেই সরকার তা কাটিয়ে ওঠে। বিশেষ করে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন পদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) নির্বাচনে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর সভাপতি হওয়ার বিষয়টি সরকারের জন্য ইতিবাচক ছিল।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলার রায়কে সরকারের প্রথম বছরের অন্যতম সাফল্য হিসেবে ধরা হয়। প্রখম বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের মধ্যে ছিল প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘরে ধরে রাখা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান স্থির রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল প্রথম বছরে।

প্রথম বছরে সরকার সবচে’ সমালোচিত হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুন জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক জন্ম দিয়েছে। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোটকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি না দেয়া এবং তাদের নেতাকর্মীদের নামে একের পর এক মামলা দায়ের এবং গণহারে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করার বিষয়টি সমালোচিত হয়। প্রথম বছর উপজেলা নির্বাচন নিয়েও বিতর্কের মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন দল। প্রথম দু’দফা নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলেও তৃতীয় এবং চতুর্থ দফা উপজেলা নির্বাচনে সরকারী দলের কেন্দ্র দখল, কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাত ভোটকে করে তোলে প্রশ্নবিদ্ধ।

ডিএইচ/জেএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • এডিটর'স চয়েস এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh