অবশেষে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ
ব্যাংক খাতে ‘সুশাসন' প্রতিষ্ঠার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে নতুন নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালায় এমডির যোগ্যতা, নিয়োগ পদ্ধতি ও অপসারণসহ বিভিন্ন বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।
বিশ্লেষদের একাংশ বলছেন, এমডিদের জন্য যে নীতি করা হয়েছে তা ইতিবাচক, তবে ব্যাংক খাতে সুশাসনের প্রধান অন্তরায় এখন পরিচালনা নীতি ও পরিচালনা পর্ষদ আইন, সেখানে পরিবর্তন না আনলে সুশাসনের পথে এগোনো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের নিয়োগ হবে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বয়স হতে হবে ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এমডি হতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে। কেউ হঠাৎ করেই এমডির পদ ছাড়তে পারবেন না।
আবার কোনো ব্যাংক চাইলেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অপসারণ করতে পারবে না। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, তাই চূড়ান্ত হবে। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ অবলোপন ও আদায়ে পারদর্শিতা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমডি পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই নীতি।
তবে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে এমডি থাকাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের পরিদর্শনে কেনো নেতিবাচক রিপোর্ট থাকতে পারবে না। এমডিদের এই সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তাদের দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এমডির পরিবারের কোনো সদস্য ওই ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। আর তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা কী হবে তা-ও বলা হয়েছে নীতিমালায়। বাংলাদেশে বিদেশি ব্যাংকের এমডি নিয়োগেও একই নিয়ম কার্যকর হবে।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতে সুশাসন আনার জন্য কিছু নীতিমালা করছে। এর আগে তারা পরিচালনা পর্ষদের গঠন কেমন হবে তা নিয়েও একটা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এখন এমডি নিয়োগের ব্যাপারে একটা নীতিমালা করলো। এমডি নিয়োগের নীতিমালাকে আমি ভালোই বলবো। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কমিটির মাধ্যমে তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার যে বিধান করেছে তাতে এখন থেকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে এমডি নিয়োগ দেয়া যাবে না। এর আগে আমরা দেখেছি শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ আরো অনেক বিষয় গোপন রাখা হয়েছে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে।
তবে তিনি মনে করেন, ব্যাংক খাতের সুশাসন নির্ভর করে বাস্তবায়নের ওপর। যেসব নতুন নীতি করেছে তা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে তার ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটি কতটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে সেটাও দেখার আছে। আরেকটি বিষয় হলো, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এখন একই পরিবারের তিনজনসহ তাদের পাঁচজন পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ আছে। তিনজন একই পরিবারের আর দুইজন তাদের প্রতিষ্ঠানের। ফলে তারা পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। পরিচালনা পর্ষদই ব্যাংকের মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, বলেন তিনি।
তার কথা, অনেক সময় একজন পরিচালকই তো অনেক কিছু করে ফেলেন তার প্রভাবের কারণে। সেখানে পাঁচ জন হলে তো কথাই নেই। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা ছাড়া সুশাসন সম্ভব নয়।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা পরিচালক হওয়ার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালক হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স করা হয় ৩০ বছর। আগে ২২ বছর বয়সেও ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার উদাহরণ আছে। এছাড়া ব্যবসা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা এবং ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নেয়া, কর খেলাপি, ঋণ খেলাপি না হওয়া, আর্থিক অপরাধে দণ্ডিত না হওয়া -এই বিষয়গুলো আছে।
কিন্তু যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি, সেই একই পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচজন পরিচালক হওয়ার বিধান বহাল আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ব্যাংকের সুশাসনের বড় অন্তরায় হলো পরিচালনা পর্ষদ। সেখানে আগে সংস্কার প্রয়োজন। এমডি নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি ঠিক আছে। তারা পরীক্ষা নেবে, সেটা হলে তাদের সার্টিফিকেট, অভিজ্ঞতা এগুলো চেক করবে। তারা এমডিকে একটা কমফোর্ট জোনে রাখতে চায়। এই বিষয়গুলো ভালো। কিন্তু মূল সমস্যা তো পরিচালনা পর্ষদে।
তিনি মনে করেন, আগে পরিচালনা পর্ষদের বিষয় ঠিক করতে হবে। সেটা না করে এগুলো খুব বেশি কাজে আসবে বলেন মনে হয় না। পরিচালনা পর্ষদের কাছে তারা তো অসহায়। এমডিরা চাইলেও তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের মেয়াদ তিন বছর করলেও অনেক ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদে এরই মধ্যে এমডি নিয়োগ করা হয়েছে।
তাদের ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বা নিয়োগ রিভিউ করা হবে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, যারা এখন এমডি হিসেবে নিযুক্ত আছেন, তাদের ব্যাপারে নতুন নিয়ম কার্যকর হবে না। তবে নতুন নিয়োগ এবং যখন নিয়োগ নবায়ন হবে, তখন নতুন নীতি কার্যকর হবে। নিয়োগ নবায়ন বা পুনর্নিয়োগ নতুন নিয়োগ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পাঁচজন নিযুক্ত হওয়ার নিয়ম বহাল থাকলেও আমরা নিয়ম করে দিয়েছি কত অংশ শেয়ার থাকলে কতজন পরিচালক হতে পারবেন। তার কথা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আমরা সংস্কার শুরু করেছি। এটা অব্যাহত থাকবে।
প্রসঙ্গত, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এজন্য দুর্বল ব্যাংকগুলো তাদের অবস্থার উন্নয়নে পাঁচ বছর সময় পাচ্ছে।
মন্তব্য করুন