শাশুড়িকে মা বানিয়ে জমি লিখে নিয়েছেন ছেলে

কাঞ্চন বিবি (৯০)। স্বামী মৃত জসিম উদ্দিন। বাড়ি ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নের বামুনেরকুটি গ্রামে। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। তিনি আট সন্তানের জননী। নিজের নামে ২৪ শতক জমি এবং স্বামীর দেওয়া সম্পত্তির অংশ সন্তানদের নামে লিখে দেন। সম্পত্তি বণ্টন হয়ে গেলেও ২০১৭ সালে মায়ের নামে ২৪ শতাংশ জমি নিজের নামেই জাল দলিল করে নেয় বড় ছেলে আব্বাস আলী(৬২)।

শাশুড়িকে নিজের মা বানিয়ে দলিল লেখক সমিতির সম্পাদক মিজানুর রহমানের যোগসাজসে এই জাল দলিল করেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, একই পন্থায় ২০১৮ সালে ছোট দুই বোনের নামে লেখা ৩৯ শতাংশ জমিও জাল দলিল করে নেন দলিল লেখক হারুনের সহযোগিতায়। বিষয়টি দীর্ঘদিন গোপন থাকলেও চলতি মৌসুমে ওইসব জমির আবাদ করা ধান কেটে নেয় আব্বাস আলী। একসঙ্গে জমির দখল করে নেন। কিছু অংশে দুই বোনের বাড়ি থাকায় উচ্ছেদের হুমকি দেয় সে। বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। পরে জাল দলিলের বিষয়টি সবার নজরে চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে গ্রাম আদালতে দারস্ত হয় ভুক্তভোগীরা। একাধিকবার নোটিশ দিলেও আব্বাস আলী হাজির হননি গ্রাম আদালতে।

অভিযোগ রয়েছে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে টাকা দিলেই জাল দলিলের মাধ্যমে জমি লিখে নেয়া যায়। দলিল লেখক আর সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজসে ভুয়া জমিদাতা দিয়ে রেজিস্ট্রার হয়ে পরিবর্তন হচ্ছে জমির মালিকানা। আর এসব কর্মকাণ্ড জানতেও পারছে না জমির আসল মালিক। জমি বেদখল হবার পর ঘটনা প্রকাশ পেলেও তখন আর কিছু করার থাকে না। ফলে মামলা মোকাদ্দমায় দীর্ঘ প্রতীক্ষার দিন পার করতে হয় আদালতের।

জমি এবং সদ্য চাষ করা ক্ষেতের ধান ছেলে জোর করে কেটে নিয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছে বৃদ্ধা কাঞ্চন বিবি। তিনি বলেন, বাবা আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমার ছইল আব্বাস ভুয়া দলিল করে নিছে। ধান আছিল তাও কাইটা নিয়া গেছে। কেমন কইরা যে দলিল করে নিলো আমি জানি না, আমার কাছে কোনোদিন টিপ নিবারও আসে নাই আব্বাস। আবার আমার অসহায় বেটি দু’টার জমির ধান কাইটা নিয়া গেছে। আমাক ধাক্কা দিয়া ফালায়া দিছে। আবার রাইতে আসিয়া একটা ঘর পোড়া দিছে বাবা কবার পাই না।

সোনাভান ও মনোয়ারা বেগম বলেন, বড় ভাই আব্বাস আলী কসাই আমাদের মায়ের ভোটার আইডি ঠিক রেখে তার শাশুড়ির ছবি বসিয়ে মায়ের নামের ২৪শতাংশ জমি জাল দলিল করেছে। একই কায়দায় এলাকার মুরুব্বির মাধ্যমে আমাদের দু’বোনকে সরকারি ঘর পাইয়ে দেবার কথা বলে ভোটার আইডির কপিসহ ছবি নিয়ে যায়। আইডি নম্বর ঠিক রেখে ছবি নকল করে দু’বোনের ৩৯শতাংশ জমির জাল দলিল করে নেয়। তারা বলেন, সাক্ষী ও মুহুরির মাধ্যমে জানতে পেরেছি এসব দলিল পার করতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করেছে আমার ভাই। চেয়ারম্যানসহ থানায় অভিযোগ দিয়ে কোনও প্রতিকার পাচ্ছি না। আমার দুটি প্রতিবন্ধী সন্তান। একটি মেয়ে কানে শোনে না কথাও বলতে পারে না এবং ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তাকে রশি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রাখি। এখন ভাইয়ের এমন অত্যাচারে আমরা কোথায় যাব জানি না। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও কোনও লাভ হয়নি।

দলিল সম্পাদনের সময় সাক্ষী প্রদানকারী মমিনুল বলেন,আব্বাস আলী আমাকে বলেন ভাই শাশুড়ি আমাকে দেড় বিঘা জমি লিখে দেবে তুই একটু থাকিস। সাক্ষী হতে হবে। সেই হিসেবে আমি সাক্ষী হই। কিন্তু পরে জানতে পারি এটা তার শাশুড়ির জমি নয় নিজের মায়ের জমি শাশুড়িকে মা বানিয়ে দলিল করে নিয়েছে।

নিজের শাশুড়িকে মা বানিয়ে জাল দলিল করার কথা স্বীকার করেন আব্বাস আলী। এজন্য সে মিজানুর মহুরিকে ২৮ হাজার টাকা দিয়েছেন বলেও জানান। এছাড়াও তিনি ছোট ভাইয়ের ১০শতাংশ জমি ক্রয় করে নেবার সময় দুই বোনের সম্পত্তিও ক্রয় করে নিয়েছেন বলে জানান। তবে তার বোনরা দলিল পার করার সময় উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু কিভাবে দলিল পার করে দিল হারুন মহুরি সে বিষয় তিনি চুপ থাকেন। কোনও উত্তর দেননি।

দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান এবং হারুন মহুরি অর্থের বিনিময়ে দলিল জালিয়াতির ঘটনার কথা অস্বীকার করেন। তারা দোষ চাপালেন জমি গ্রহিতার ওপর। তারা বলেন, ভোটার আইডির কপি, ছবি এবং সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে দাতাদের উপস্থিতিতে দলিল করা হয়। এখানে অনিয়ম করার কোনও সুযোগ নেই।

ভূরুঙ্গামারীর সাব-রেজিস্ট্রার নাবীব আফতাব জাল দলিলের বিষয়ে নিজের দায় এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ১০০/১৫০ দলিল পার করতে হয় আমাকে। এগুলো যাচাই-বাছাই করার সুযোগ কম থাকে। দলিল বাতিল করার ক্ষমতা আমাদের নেই। একমাত্র আদালতের মাধ্যমে সেটি হয়। তবে জাল দলিল বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।

জেবি