লেবুর গ্রাম ‘বালিয়াখোড়া’
আমাদের দেশে প্রায় সারা বছরই লেবু পাওয়া যায়। লেবু খুবই জনপ্রিয় তাই সব সময় এর চাহিদা থাকে। লেবুর চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাড়তি আয় করাও সম্ভব। ভিটামিন ’সি’ সমৃদ্ধ ফলের মধ্যে লেবুই একমাত্র ফল যা সারা বছর কম বেশি পাওয়া যায়। তাই মানুষের চাহিদা মেটাতে এবং স্বল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় অনেকেই করেন লেবু চাষ।
তেমনই লেবুর গ্রাম ‘বালিয়াখোড়া’। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লেবু গাছ। আছে দেড়শতাধিক ছোট-বড় লেবুর বাগান। এলাচি, কাগজি ও কলম্বো-এই তিন জাতের লেবু হয় এখানে। তবে কাগজি এবং এলাচির তুলনায় কলম্বো লেবুর চাষ একটু বেশি হয়।
সুগন্ধি, সুস্বাদু ও প্রচুর রসযুক্ত হওয়ায় এই গ্রামের লেবুর কদর সবচাইতে বেশি।
মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নে এই বালিয়াখোড়া গ্রামের অবস্থান। সম্প্রতি বালিয়াখোড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় ওই গ্রামের লেবুচাষিদের সঙ্গে। তারা জানান, তাদের উৎপাদিত লেবু বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজার, শ্যামবাজার ও গাজীপুরের টঙ্গী বাজারে।
বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান আরটিভি অনলাইনকে বলেন, বালিয়াখোড়া গ্রামে ৩শ’ পরিবার বাস করে। এই গ্রামে ছোট-বড় মিলে কমপক্ষে ১৫০টি লেবুর বাগান আছে। তবে সব বাড়িতেই লেবু গাছ আছে। এই গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ লেবু চাষের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সারাবছরই তারা বাগানে মাটি তোলা, চারা তৈরি, সার দেয়াসহ লেবু তুলে বাজারে বিক্রি করাসহ বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন।
তিনি বলেন, লেবু চাষে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ সার, ভিটামিন এবং কীটনাশক লাগে। কৃষি বিভাগ থেকে লেবু চাষিদের কোনো সহায়তা দেয়া হয় না। কৃষি বিভাগ একটু নজর দিলে লেবুচাষিরা আরও ভাল করবে।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র বাচ্চু বলেন, তার বাবা রুহিণীকান্ত হোড় খোকাবাবু পার্শ্ববর্তী গ্রামের আলী হোসেন ঘড়ি মিয়ার নিকট থেকে ১০টি লেবু গাছের চারা নিয়ে এই গ্রামে প্রথম লেবু চাষ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর থেকে তিনি এই লেবু বাগানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তার ৪টি লেবুর বাগান আছে। ১৫০ শতাংশ জমির এই বাগানগুলোতে তিনি এলাচি, কাগজি ও কলম্বো-এই তিন জাতের লেবুর চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১০০ শতাংশ জমিতে কলম্বো, ৪০ শতাংশ জমিতে এলাচি ও ১০ শতাংশ জমিতে কাগজি লেবুর চাষ করেন।
তিনি বলেন, অনেক সময় গাছে পোকা লাগে, গাছ মরে যায়। কিন্তু কৃষি বিভাগের কেউ তাদের খোঁজ নেন না। তাদের দিকে সরকারের কোনো নজর নেই।
৩৫ বছর বয়সী জুয়েল মিয়া জানান, তিনি তার বাবা জাফর হোসেনের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ৪টি লেবু বাগান পেয়েছেন। ১৫০ শতাংশ জমির ওপর তিনি এলাচি ও কলম্বো জাতের লেবুর চাষ করছেন। এর মধ্যে ১০০ শতাংশ জমিতে কলম্বো এবং ৫০ শতাংশ জমিতে এলাচি লেবুর আবাদ করা হয়েছে।
তিনি আরটিভি অনলাইনকে বলেন, অনেক সময় অজ্ঞাত কারণে গাছ মরে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় থেকে কেউ এসে তাদের খোঁজ নেন না। তাদের উৎপাদিত লেবু বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রয় করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানীসহ ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার বাগান থেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা কিনছেন আরও কম দামে। তাই তারা সরকারের কাছে তাদের উৎপাদিত লেবুর সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থার দাবী করেন।
৪০ বছর বয়সী মফিজুল ইসলাম দীপন বলেন, তার বাবা প্রয়াত মাসুদুল হক ৩৫ বছর আগে লেবুর বাগান করেন। বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইরা মিলে এই লেবুর চাষ করছেন। বর্তমানে ২৪০ শতাংশ জমিতে লেবুর চাষ হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা তাদের কোনো খোঁজ নেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা দিলে তারা লেবু চাষে আরও সফল হতে পারবেন বলেও জানান।
৪৫ বছর বয়সী নিজাম রবিন সোরহাব বলেন, তিনি ১০৫ শতাংশ জমিতে লেবুর চাষ করেছেন। কৃষি বিভাগ যদি তাদের সার, ভিটামিন ও কীটনাশক সরবরাহ করলে তাদের সুবিধা হতো।
ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশরাফ উজ্জামান খান আরটিভি অনলাইনকে বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আছেন। তারই মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের সমস্যার সমাধার দেয়ার কথা। যদি কোনো গাফিলতি করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষি বিভাগ থেকে ওই এলাকার লেবুচাষিদের সবধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
তবে কৃষি বিভাগ কাউকে সার-কীটনাশক দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান চৌধুরী।
এসএস
মন্তব্য করুন