• ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

যশোরে চালু হলো অভিনব ভাসমান সেতু

যশোর প্রতিনিধি

  ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৪২

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের সঙ্গে ঝাঁপা গ্রামের মানুষের আদিকাল থেকে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌকা। এ দুটি গ্রামের মধ্য ঝাঁপা বাঁওড় হওয়ায় শত শত বছর ধরে ঝাঁপা গ্রামবাসী নৌকা পার হয়ে রাজগঞ্জ বাজারে আসতেন। একইভাবে পার হয়ে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করেন শতশত শিক্ষার্থী। নৌকা পার হতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকে পড়েছেন পানিতে, ভিজেছে পরিধেয় কাপড়সহ বই-খাতা। গ্রামবাসীর বহু বছরের এই দুর্ভোগ নিরসনে এবার এগিয়ে এসেছেন ঝাঁপা গ্রামের ৫৬ যুবক। উদ্যোগ নিয়েছেন নিজস্ব অর্থায়নে বাঁওড়ের ওপর ভাসমান সেতু তৈরির।

সেতু নির্মাণের জন্য গঠন করেছেন ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করেছেন এক হাজার ফুট লম্বা প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর লোহার পাত দিয়ে বানানো সেতু। তবে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নয়, হঠাৎ বুদ্ধিতেই তারা শুরু করেন কাজ। নেননি কোনো প্রকৌশলীর মতামত। নিজেদের পরিকল্পনা দিয়েই ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেলপাত ও ২৫০টি লোহার সিটের মাধ্যমে লোহার পাত দিয়ে একের পর এক ড্রাম যুক্ত করে তৈরি করেছেন চার ফুট চওড়া ও এক হাজার ফুট দীর্ঘ সেতুটি। সঙ্গে রয়েছেন রাজগঞ্জ বাজারের লেদ কারিগর রবিউল ইসলাম।

বাঁওড়ের ওপর সেতু হওয়ায় খুশি ঝাঁপা এলাকার প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ। যারা প্রতিনিয়ত একাধিকবার নৌকায় বাঁওড় পাড়ি দিয়ে আসেন রাজগঞ্জ বাজারসহ উপজেলা শহরে। খুশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এমনকি পথচারীরা। শুধু গ্রামবাসী ও পথচারী নয়, যারা বাঁওড়ে নৌকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন, সেই মাঝিরাও খুশি। সেতু নির্মাণে তারা জানিয়েছেন সাধুবাদ।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল বলেন, ‘বছর খানেক আগে বাঁওড় পারে বসে গল্প করছিলাম গ্রামের শিক্ষক আসাদুজ্জামানসহ ৫ থেকে ৬ জন। তখন বাঁওড় থেকে মেশিনে বালি তোলা হচ্ছিল। যেই মেশিনটি রাখা হয়েছিল প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর ভাসমান অবস্থায়। তাই দেখে হঠাৎ বুদ্ধি আসে মাস্টার আসাদুজ্জামানের। ড্রাম যদি ভারি মেশিন ভাসিয়ে রাখতে পারে, তবে সেতু কেন নয় ? আসাদুজ্জামানের যুক্তি মনে ধরে উপস্থিত সবার। শুরু হয় গ্রামবাসীর সঙ্গে বৈঠক। এরপর ফান্ড তৈরির কাজ।’

টুটুল আরো বলেন, ‘চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বসি। কয়েক দফা আলোচনার পর গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ৫৬ যুবকের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এরপর সবাই ২০-৩০ হাজার টাকা করে জমা দিয়ে তৈরি করি তহবিল। পরে আগস্ট মাসের দিকে শুরু হয় ভাসমান সেতু তৈরির কাজ। যদিও সেতু তৈরিতে কোনো প্রযুক্তি জ্ঞান ব্যবহার করা হয়নি। তবে আমরা উপজেলা প্রকৌশলীর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। এমনকি জেলা প্রশাসকের দপ্তরেও কথা বলা হয়েছে। সবাই পরিবেশবান্ধব সেতু তৈরিতে মত দিয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘আগে খেয়া পারাপারের জন্য মাঝিদের গ্রামবাসী সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে আর বছরে এক মণ করে ধান দিতে হত। একই খরচে গ্রামবাসী সেতুটি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্য এলাকার লোকজন যেমন টাকা দিয়ে খেয়া পার হতেন। সেতু পার হতে তাদেরকে সেই খরচ দিয়ে চলাচল করতে হবে। আর এই টাকা সংগ্রহ করবেন ঘাটে নৌকা চালানো পূর্বের চার মাঝি। এতে করে মাঝিদের সংসার যেমন চলবে তেমনি উঠে আসবে সেতু নির্মাণের খরচও।’

সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল, ভ্যান, নসিমন প্রাইভেটকারসহ মাইক্রোবাস পারাপার হতে পারবে বলে মত দেন তিনি।

ঝাঁপা বাঁওড়ের খেয়া ঘাটে গিয়ে নৌকা পার হতে দেখা যায় ওই গ্রামের বৃদ্ধ আবু দাউদকে। তিনি বাঁশের তৈরি বাঁকে করে তরকারি নিয়ে রাজগঞ্জ বাজারে যাচ্ছিলেন।

আবু দাউদ বলেন, ‘বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এভাবে খেয়া পারাপার হচ্ছি। পারাপারে অনেক সময় পানিতে পড়ে যেতে হয়েছে। বর্ষার সময় এই সমস্যা বেশি হয়। সেতু হওয়াতে এই সমস্যা থাকবে না। আমি এতে মহাখুশি।’

কথা হয় নৌকায় চড়ে বাড়ি ফেরা স্কুলছাত্র ফাহিম ও সজিবের সঙ্গে। তারা দুইজনে রাজগঞ্জ বাজারের গোল্ডেন সান প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ছাত্র। তারা জানায়, দুই বছর ধরে নৌকা পার হয়ে স্কুলে আসছি। প্রথমে ভয় হত, এখন হয় না। সেতু হলে আর নৌকার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব।

রাজগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ঘাটে নৌকার অপেক্ষায় ছিলেন যশোর সদর উপজেলার রূপদিয়া গ্রামের আব্দুল গফুর।

তিনি ঝাঁপা গ্রামে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে যাবেন। মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর থেকে গেলো ১৫-১৬ বছর এভাবে নৌকা পার হয়ে জামাইয়ের বাড়ি যাতায়াত তার। আব্দুল গফুরও এই সেতু তৈরিতে আনন্দিত। কথা হয় ঘাটের মাঝি শেখরচন্দ্রের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ঝাঁপা গ্রামের তিনজন মাঝি নৌকায় লোক পারাপার করি। এই করে তিন পরিবারের ১৫ জনের পেট চলে। কমিটি বলেছে ব্রিজ চালু হলে আমাদের কাজ দেবে। ব্রিজ পার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে আমরা টাকা তুলব। সেখান থেকে আমাদের সংসার খরচ দেয়া হবে। তাই আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এই ব্যাপারে লিখিত কোনো চুক্তি হয়নি। মৌখিকভাবে কথা পাকা হয়েছে।

মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ঝাঁপা বাওড়ের ওপর সেতু তৈরির কাজ আপনারা যেমন দেখেছেন। তেমন আমিও দেখেছি। কমিটির কেউ আমাকে বিষয়টি জানায়নি। সেতু পারাপারে গ্রামবাসীর নিজেদের মধ্যে অর্থ আদায়ের বিষয় থাকতে পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। তবে এ ব্যাপারে অতিরঞ্জিত কিছু হলে বা অভিযোগ পেলে তখন আমরা বিষয়টি অবশ্যই দেখব।

জেবি/পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
কালুরঘাট সেতুতে লাইটারেজ জাহাজের ধাক্কা
পদ্মা সেতুতে ১৫০০ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাইলফলক
ওবায়দুল কাদেরের পদত্যাগ চাওয়ায় শাহবাগ থানায় জিডি
বাতাসেই ভেঙে পড়ল সেতু
X
Fresh