• ঢাকা রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

দেশ-বিদেশের বাউল সাধকদের পদচারণায় মুখর মেঘনার তীর

লক্ষ্মণ বর্মন, আরটিভি নিউজ

  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:২২
নরসিংদীতে মেঘনার তীরে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা
ছবি : সংগৃহীত

নরসিংদীতে মেঘনার তীরে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। ভারতসহ দেশ-বিদেশের শতাধিক বাউল সাধকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে মেলা। আত্মশুদ্ধি আর আত্মমুক্তির লক্ষ্যে বাউলদের কীর্তন, গীতা পাঠসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সরব হয়ে উঠেছে মেঘনা পাড়ের বাউল আখড়াধাম। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব ধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বনী করছেন বাউল সাধকরা। দেশ-বিদেশের ভক্তদের উপস্থিতিতে বাউল ঠাকুরের আখড়া পরিণত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মাবলম্বীদের মিলনমেলায়।

নরসিংদী শহরের কাউরিয়া পাড়ায় মেঘনা নদীর তীরে বাউল আখড়াধামে গত শুক্রবার সকালে প্রথম বাতি ও যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলার আনুষ্ঠানিকতা। এরই মধ্যে দেশ বিদেশের শতাধিক বাউল সমবেত হয়েছেন আখড়ায়। ৭ দিনব্যাপী এই মেলা চলবে আগামী বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত।

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সরেজমিনে নরসিংদী বাউল মেলা ঘুরে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে মেঘনার পাড়ে শিশুদের হরেক রকমের খেলনা, খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাঝিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ি সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই মাঘী পূর্ণিমার দিনে শ্রী চৈতন্য দেবের জন্ম তিথী উপলক্ষে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে ঘিরে নরসিংদীর কাউরিয়া পাড়া এলাকার মেঘনা নদীর তীরে সমাগম ঘটে লক্ষাধিক নারী-পুরুষের। নদীতে চলে পূণ্যস্নান। পাশেই রয়েছে বাউল ঠাকুরের আখড়া। যেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউল শিল্পীরা এসে বসিয়েছে বাউল গানের আসর। মেলাকে ঘিরে মেঘনা নদীর পার ঘেঁষে জমে উঠেছে খেলনা, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরি কুটির শিল্প সামগ্রীর বেচাকেনা। এছাড়াও শিশুদের আকৃষ্ট করতে মেলায় বসেছে পুতুল নাচ, নাগর-দোলাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক রাইডস।

এদিকে বাউল ভক্তরা সারি বেঁধে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ঘি-প্রদীপ, মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পুজো দিচ্ছেন আর প্রার্থনা করছেন পরিবার ও দেশের সকল মানুষের কল্যাণসহ সব ধরনের অশুভ শক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে নিস্কৃতি পেতে।

কথিত আছে, ৭০০ বছর আগে নরসিংদীতে এক বাউল ঠাকুর ছিলেন। তিনি নিজেকে শুধু বাউল বলেই পরিচয় দিতেন। এজন্য বাউল ঠাকুরের প্রকৃত নাম জানেন না এখানকার কেউই। সেই বাউল ঠাকুরের স্মরণে তার আখড়া ধামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই বাউল মেলা। তবে কে প্রথম এখানে বাউল মেলার আয়োজন করেন তার প্রকৃত তথ্য কারোই জানা নেই । সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখন পর্যন্ত মেলার আয়োজন করছেন রাম চন্দ্র বাউল, জিতেন্দ্র চন্দ্র বাউল, ডা. মনিন্দ্র চন্দ্র বাউল ও তার পরবর্তী প্রজন্ম। গত দুই বছরের মধ্যে নরসিংদীর বাউল আখড়াবাড়ির সেবায়েত তত্ত্বাবধায়ক প্রাণেশ কুমার ঝন্টু বাউল ও মৃদুল বাউল, মিন্টু বাউল এ তিন ভাই মৃত্যুবরণ করায় তাদের স্থলে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাধন চন্দ্র বাউল।

বাউল ভক্ত ও দর্শনার্থী জানায়, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) গট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। সবার মধ্যিখানে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা বৈঠক ঘর। শুক্রবার দেবতা ব্রহ্মার পূজা মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয়। ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।

প্রতিবছরের মতো এবারও মেলা উপলক্ষে আখড়াধামে হাজির হয়েছেন পাশের দেশ ভারতসহ দেশ-বিদেশের শতাধিক বাউল সাধক। এসব সাধকের কাছে সাধনাই মূল ধর্ম। আত্মশুদ্ধি আর আত্মমুক্তির জন্য এই মেলায় আসেন তারা।

বাউল মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিরায়ত গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার ও বাহারি পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে আমিত্তি, জিলেপি, সন্দেশ, বারো মিঠাই, দই, মুড়ালি, গুড়ের তৈরি মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, তিলের মোয়া, তিলের সন্দেশ, খাস্তা, কদমা, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, খাজা, গজা, নিমকি, মনাক্কা, গাজরের হালুয়া, পিঠাসহ রকমারি খাবার। এছাড়া শিশুদের খেলনা, ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, মাটি ও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের স্টল নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাউল আখড়াবাড়ির বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সাধন চন্দ্র বাউল বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে যজ্ঞানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। কোনও ধরনের প্রচার ছাড়াই প্রতিবছর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে এ মেলা। আগামী বৃহস্পতিবার এ মেলার সমাপ্তি ঘটবে।

তিনি বলেন, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কীভাবে সহজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে, সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে ভেদাভেদ না করে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবেসে যাচ্ছি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মিলন ঘটানোর জন্যই শত শত বছর ধরে মেলার এ আয়োজন হয়ে আসছে।

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
নরসিংদীতে ইসতিসকার নামাজ আদায়
প্রেমিকার ১৯ দিন পর প্রেমিকের আত্মহত্যা
প্রেমিকাকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে প্রেমিক গ্রেপ্তার
নরসিংদীতে ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধার মৃত্যু
X
Fresh