• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

শতবর্ষে বিদ্রোহী কবিতা : একটা চকিত আলোচনা

আলমগীর মোহাম্মদ

  ২০ মার্চ ২০২২, ১৩:৪৯

আসলে বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা খুব একটা পাই না আমরা। বেশির ভাগ আর্টিকেল, প্রবন্ধ ও আলোচনায় কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবন, প্রমিলা, নার্গিস, ফজিলাতুন্নেছা এবং নজরুলের দারিদ্র্যেরস্বরূপ নিয়ে কথা হয়। সবাই ঘুরেফিরে সেই একই কথা বলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কনকনে এক শীতের রাতে পল্টনফেরত বাইশ বছর বয়সী কবি বিদ্রোহী কবিতা রচনা করেন। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ ছিলেন প্রথম পাঠক। বিজলী পত্রিকায় ছাপা হয়। প্রথম মুদ্রণ দ্রুত শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়। একটা হিসেবে দেখানো হয় প্রায় ২৯ হাজার কপি বিক্রি হয়; যা একজন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী কবির জন্য একটা বিশাল আনন্দ ও গর্বের বিষয়।
বিদ্রোহী কবিতার সাফল্যে কবি নিজেও কিছুটা তুষ্ট হয়েছিলেন সেই কথা আমরা আঁচ করতে পারি নাট্যকার ইবরাহীম খাঁকে লেখা কবির চিঠি পড়ে।
‘বিদ্রোহীর জয় তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়।... আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যে, কলুষিত, পুরাতন, পচা- সেই মিথ্যে সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ চেতনার উত্স সম্পর্কে কবি আবদুল কাদির লিখেছেন—
‘নজরুলের পত্রোপন্যাস ‘বাঁধনহার’র মূলে ছিল প্রেমের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতা শেষে রূপান্তরিত হয়েছিল বিদ্রোহে। এই পত্রোপন্যাসে ‘সাহসিকা’র এক সুদীর্ঘ পত্রে যে বিদ্রোহের বর্ণনা আছে তারই পূর্ণ প্রকাশ পরবর্তীকালে তার সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় দেখা যায়। [কবির জীবনকথা/নজরুল প্রতিভার স্বরূপ]
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত, সমালোচিত, প্রশংসিত, নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু সব সমালোচনা নির্মোহ সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়নি বা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকেও হয়েছে। সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টিতে আলোচনা করতে গিয়ে কবি আবদুল কাদির লিখেছেন— ‘মাত্র দু’বছর আগে যিনি লেখকমহলে দেখা দিয়েছেন, সেই বাইশ বছর বয়স্ক তরুণ কবির হাতে ‘বিদ্রোহী’র মতো প্রাণবন্ত কবিতা বের হওয়া এক বিস্ময়কর ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পাঠকের শ্রবণে আনে বেগবতী স্রোতস্বিনীর উপলাহত কালধ্বনি, কিন্তু নজরুলের ‘বিদ্রোহী’তে রূপায়িত হয়েছে উদ্দাম প্রাণশক্তি, অকুণ্ঠিত উচ্ছ্বাস।’ [নজরুল পরিচিতি। পৃষ্ঠা ১০-১১]
প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্য সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান নজরুলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—‘নজরুল ইসলামের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত শৃঙ্খলিত কাব্যধারাকে নিশ্চিন্তে ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। এর প্রথম প্রমাণ আমরা পেলাম ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে। এ কাব্যে আমরা কোনো শিল্প-কুশলী কবিকে আবিষ্কার করি না। কিন্তু একজন চঞ্চল, সাহসী এবং নিঃসংশয় ভাষণের অধিকারী কবিকে আবিষ্কার করি। ‘অগ্নিবীণা’ কোনো মহৎ সৃষ্টি নয় এবং এর মধ্যে কাব্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য পঙক্তির সংখ্যাও খুব কম। কিন্তু ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তিনি কৃপণের ধনসঞ্চয়ের মতো শব্দকে আড়াল করেননি। তিনি বেহিসাবি যুবকের মতো যৌবনের উচ্ছ্বাসে শব্দকে আপন ধনভাণ্ডারের মতো উজাড় করে দিয়েছেন। ‘অগ্নিবীণা’য় লক্ষ্য করি যে, এখানে শব্দ নির্বাচিত নয়, তত্সম, তদ্ভব এবং দেশজ শব্দের মধ্যে কোনো জাতি বিচার নেই; একটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ধূলিকণা, তৃণগুচ্ছ এবং বৃষ্টির বিন্দু যেভাবে একসঙ্গে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়, তেমনি ‘অগ্নিবীণা’য় কবির শব্দগুলো নিশ্চিন্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনোরূপ বিচার-বিবেচনা না মেনে চিত্তের স্বাধীন স্ফূর্তিতে নজরুল ইসলাম অগ্রসর হয়েছিলেন। এভাবেই ‘অগ্নিবীণা’য় বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আমরা একজন নতুন নায়ককে পেলাম।’ [আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে]
বিশ শতকের বাংলা কবিতার তিনটি ধারা ছিল। সামাজিক বাস্তবতা উপস্থাপননির্ভর বয়ান, ক্লাসিস্ট ও রোমান্টিক। নজরুল সেসব ধারা ভেঙে নতুন এক নজির স্থাপন করেছেন বিদ্রোহীর মাধ্যমে। এই কবিতার গুরুত্ব বোঝাতে এই একটা তথ্য তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বিদ্রোহী এ পর্যন্ত অনুদিত হয়েছে তেত্রিশটি ভাষায়।
স্বাধীনতা, বিদ্রোহ ও আত্মোপলব্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সবার আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সব নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। নজরুল তা পেরেছেন। আমেরিকার দার্শনিক রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসনকে উদ্বৃত করা যায় এই প্রসঙ্গে;
‘A foolish consistency is the hobgoblin of little minds, adored by little statesmen and philosophers and divines. With a consistency a great soul has simply nothing to.’
ব্যক্তিজীবন থেকে লেখালেখি কোনোক্ষেত্রেই নজরুল এই নির্বোধ আঁকড়ে থাকাকে সমর্থন করেননি। বিদ্রোহী কবিতায় উল্লিখিত নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে অনেকে আপাত স্ববিরোধিতার অভিযোগ করে থাকেন। এটা ঠিক যে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করলে বিদ্রোহীতে কবির আবেগের প্রাবল্য দেখা যায়, সেটা আসলে তার ব্যক্তিত্বের কারণে। নজরুল এমারসনের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কি না, জানা যায় না। তবে এটা অনুমান করা যায় তিনি এমারসনের দর্শনের পথে ছিলেন। এমারসন বলেছিলেন ব্যক্তিসত্তা দৃঢ় করতে নিজের আবেগকে বিশ্বাস করতে। নজরুল সেটাই করেছিলেন।
বিদ্রোহী কবিতায় কবির বক্তব্য স্ববিরোধী- এই অভিযোগ খণ্ডন করতে আমরা হুইটম্যানকে স্মরণ করতে পারি। হুইটম্যান বলছেন,
‘Do I contradict myself?
Very well, then I contradict myself.
(I am large, I contain multitudes.)’
বিশ্বসাহিত্যে একমাত্র কবিতা বা কর্মের জন্য স্বীকৃত এমন অনেক লেখক আছেন। যেমন, জন বানিয়ান তার ‘পিলিগ্রমস প্রগ্রেস’, এডমুন্ড স্পেন্সার ‘দ্য ফেইরি কুইয়িন’, টিএস এলিয়ট ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ দান্তে ‘ডিভাইন কমেডি’ ছাড়া আর কিছু না লিখলেও সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকতেন। বিদ্রোহী ও নজরুল সম্পর্কেও এই কথা বলা যায়।

লেখক : শিক্ষক, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা

মন্তব্য করুন

daraz
  • নির্বাচিত কলাম এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
‘চান উইল্ল্যে চান উইল্ল্যে, হালিয়ে ঈদ’
লেনিনের মৃত্যু শতবর্ষ পালন করলেন রুশ কমিউনিস্টরা
লাঠিতে ভর করে ভোটকেন্দ্রে শতবর্ষী পার্বতী 
শতবর্ষী মাকে নিয়ে ভোট দিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল
X
Fresh