• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

অবহেলা-অব্যবস্থাপনা ও লাইনচ্যুতির রেলওয়ে

ডয়েচে ভেলে

  ২২ মার্চ ২০২৪, ১২:১২
লাইনচ্যুত
সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ায় রেলওয়ের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতি নিয়ে৷ সংসদীয় কমিটি দুর্ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্ঘটনার আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন বন্ধের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রেললাইন, সিগনাল লাইট ও রেলের ইঞ্জিন, কোচ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তারা রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নতুন কেনাকাটায় বেশি আগ্রহী৷ কারণ, সেখানে অর্থ বরাদ্দ অনেক বেশি, লুটপাটের সুযোগও বেশি৷ বাংলাদেশের ৬৩ ভাগ রেললাইন এখন মেয়াদোত্তীর্ণ৷ ফলে বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে৷

গত রবিবার দুপুরে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিজয় এক্সপ্রেসের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়৷ ট্রেনটিতে মোট ১৮টি বগি ছিল৷ বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ৩০ জন আহত হন৷ ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে জামালপুর যাচ্ছিল৷ ই দুর্ঘটনার ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের সাতটি ট্রেন আটকা পড়ে৷ তারপর সোমবার রাতে ঢাকাগামী পঞ্চগড় এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধুর সেতুর পূর্বপ্রান্তে লাইনচ্যুত হয়৷ এতে রাজধানীর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে৷ আবার সিগনাল ত্রুটির কারণেও বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ আছে লেভেল ক্রসিংয়ে গেট না থাকা এবং ঠিক সময়ে না আটকানোর কারণে দুর্ঘটনা৷

গত বছরের অক্টোবরে ভৈরবে সিগনাল ত্রুটির কারণে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৮ জন নিহত হন৷ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২৩ সালে ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত ও ২৯৬ জন আহত হয়৷

আর যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হয়েছিল৷ ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছেন৷ এসব হিসেবে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাও রয়েছে৷

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, গত এক যুগে রেলে এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার শতকরা এক ভাগও যদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কাজে ব্যয় করা হতো, তাহলে রেলের এই করুণ পরিণতি হতো না৷

তার কথা, প্রায় ৬৩ ভাগ রেল লাইন এখন মেয়াদোত্তীর্ণ৷ এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ৷ তবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এর ঝুঁকি এড়ানো যায়৷ ফিসপ্লেট ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না৷ সিগনাল, লেভেল ক্রসিং কিছুই ঠিক নেই৷ আবার বগির সঙ্গে ইঞ্জিনের সংযোগও সঠিকভাবে হয় না৷ এর বাইরে রেললাইনের দুই পাশে অবৈধ হাটবাজার, অবৈধ লেভেল ক্রসিং, লেভেল ক্রসিংয়ে লোক না থাকা৷

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের কথা, রেল সবচেয়ে কম খরচের আর জনপ্রিয় বাহন৷ এটা সারা দেশে আরো বিস্তৃত হওয়া দরকার৷ কিন্তু যা আছে, তা রক্ষণাবেক্ষণ না করলে তো কোনো লাভ হবে না৷ সেদিকে নজর নেই ৷ বরাদ্দ নেই৷ নতুন প্রকল্প নেয়া হয় লুটপাটের জন্য৷ এখানে একটি চক্র আছে, যারা লুটপাট ছাড়া আর কিছু বোঝে না৷

রেল মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে; সারা দেশে ৩১৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে৷ এর মধ্যে ১৪৩টি ট্রেন বিগত ১৫ বছরে চালু করা হয়েছে৷ এ সময়ের মধ্যে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে৷ এক হাজার ৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন মেরামত করা হয়েছে৷ রেলে বর্তমানে কোচ আছে এক হাজার ৭৮৮; যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ৷ আর সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫, যার ৬০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ৷ মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা তিন হাজার ২৪৭, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ৷ রেলওয়েতে ৪৭ হাজার ৬০০ জনবলের বিপরীতে ২৪ হাজার জনবল রয়েছে৷

বাংলাদেশে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং আছে দুই হাজার ৫৪১টির মতো৷ প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটা করে লেভেল ক্রসিং৷ এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশে কোনো গেট নেই বলে উল্লেখ পাওয়া যায়৷ রেল ট্র্যাকের ১০ ফুটের মধ্যে সব সময় অলিখিতভাবে ১৪৪ ধারা জারি থাকার কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে রেললাইনের ওপরই ৬৬টি হাটবাজার গড়ে তোলা হয়েছে৷ আর রেললাইনের পাশে ছোটখাটো হাটবাজারের অভাব নেই৷

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রেল খুব ধীর গতির ৷ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার চলে৷ যদি নিয়মিত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো- এইসব হাটবাজার তুলে দেয়া হতো, তাহলে এই রেলই ৫০ কিলোমিটার বেশি গতিতে চলতো৷

রেল মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বুধবার রেল নিয়ে বৈঠক করেছে৷ বৈঠকে একের পর এক ঘটে যাওয়া রেল দুর্ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্থায়ী কমিটি৷ কমিটির বৈঠকে কেন এসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ বিশেষ করে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য পেতে ট্রেনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন ও দুর্ঘটনার আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন বন্ধের জন্য সেন্সর সিস্টেম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে৷
অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সহকারি অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, এই রেল ট্র্যাকের সমস্যা, ফিস প্লেট, সিগনাল এগুলো ঠিক রাখার জন্য অনেক প্রযুক্তি আছে৷ তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তারও আগাম সিগনাল পাওয়া যায়৷ এগুলো অল্প খরচেই সম্ভব৷ আসল সমস্যা হলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি রেল কর্তৃপক্ষের আগ্রহ নেই৷ কারণ, এই খাতে কম বরাদ্দ৷ তাই এখানে লাভও কম৷ নতুন প্রকল্পে অনেক বরাদ্দ, লাভও বেশি৷ আর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব যাদের, তারা দায়িত্ব পালন করেন না৷ তাদের দক্ষতাও কম৷

রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী রেলের এই ত্রুটির কথা স্বীকার করে বলেন, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, সেটা না হলে তো প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটতো৷ তা তো হচ্ছে না৷ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এই ছয়মাসে একটি দুর্ঘটনা ঘটলো৷ এটা তো আপনার জার্মানিতেও হয়৷

তিনি জানান, রেল ট্র্যাক পুরোনো, ইঞ্জিন, বগি পুরোনো৷ এর মধ্যে কিছু কিছু মেরামত করা হচ্ছে৷ আবার কিছু কিছু মেরামতের অযোগ্য৷ আবার যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও দাম বেশি, বরাদ্দ কম৷ তারপরও আমরা চেষ্টা করছি৷ আমাদের জনবলও কম৷ এই খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে৷ আমরা আধুনিক প্রযুক্তির কথা চিন্তা করছি৷ সংসদীয় কমিটিও বলেছে৷ এখন সেটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে আছে কিনা দেখতে হবে৷

দুর্নীতি ও অবহেলার প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা অভিযোগ পাই৷ তবে এখন থেকে কোনো সতর্কীকরণ বা ছাড় নয়৷ কঠোর ব্যবস্থা নেবো৷

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
গরমে ট্রেনের হাইড্রোলিক ব্রেকে আগুন, আহত ১০
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেল প্রতিবন্ধী নারীর
X
Fresh