• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

নবাব সলিমুল্লাহ’র উত্তরসূরি পরিচয়ে প্রতারণা, কোটি কোটি টাকা খোয়া!

কাজী ফয়সাল

  ৩০ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪৪
Askari's deception as the successor of 'Dynasty Nawab Salimullah', lost crores of rupees in faith!
নবাবি ঢঙে আলী হাসান আসকারি। ছবি: আসকারির ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রকৃত নাম আলী হাসান আসকারি। প্রায় ৫ বছর আগে নিজ নামের সঙ্গে বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের খেতাব ‘নবাব’ এবং বংশীয় ‘খাজা’ শব্দ দুটি যুক্ত করেন তিনি। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর ‘খাজা আমানুল্লাহ আসকারির’ ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন এই প্রতারক। এখানেই শেষ নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা বলেও নিজেকে মানুষের কাছে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন আলী হাসান আসকারি।

প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় হিসেবে গণভবনে নাকি তার যখন-তখন যাতায়াতের অনুমতি রয়েছে। দুবাইয়ে তার মালিকানায় নাকি গোল্ডের কারখানাও আছে। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। থাকেন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে। কেবল তা’ই নয়, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানায় অংশীদারত্ব রয়েছে তার পরিবারের।

এমন প্রেক্ষাপটে পারিবারিক ব্যবসার শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয় তার হাত ধরেই। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে দেখা গেছে, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে। লাল টি-শার্ট পরিহিত একঝাঁক বডিগার্ড নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি। নিজে থাকেন নেদারল্যান্ডসে। গত ৫ বছর ধরে দেশে আছেন। তিনি আবার দানবীরও। এরকম বহুমুখী পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন এই আসকারি। প্রকৃতপক্ষে তার দেওয়া সব পরিচয়ই ভুয়া ও সুপরিকল্পিত প্রতারণার কৌশল মাত্র। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই তার পেশা ও নেশা। প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

প্রভাবশালীদের সঙ্গে আঁতাত করেও শেষ রক্ষা হলো না আসকারির। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট তাকে গ্রেপ্তার করেছে। গেলো বুধবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৫ সহযোগীসহ আসকারিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিটিটিসির ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আসকারি একজন ভয়ঙ্কর প্রতারক। তিনি অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নবাবের বংশধর হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তিনি এসব প্রতারণা করতেন। প্রতারণার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফুপু বানিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নামও ভাঙিয়েছেন তিনি। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার প্রতারণার আরও কৌশল ও অর্থ কোথায় পাচার করেছে তা জানার চেষ্টা করছি’।

আসকারি’র প্রতারণা কৌশল

প্রায় ৫ বছর আগে নিজের নামের সঙ্গে খাজা শব্দটি যোগ করেন আলী হাসান আসকারি। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারির ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে এই প্রতারক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেকে নবাবের বংশধর হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। একইসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতো আসকারি। ওইসব ছবিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করে সাধারণ মানুষের নজরে আসতো এবং সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতো। মূলত এই ছবিগুলোই ছিল তার প্রতারণার প্রধান হাতিয়ার।

আসকারি তার প্রতারণার কাজে ১০-১২ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলো একটি চক্র। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতো। তারপর কৌশলে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে হাতিয়ে নিতো বিপুল অংকের টাকা। বিশেষ করে তার বাবার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে সাতশ’ নার্স নিয়োগ করা হবে জানিয়ে কর্মী দিতে বলতেন। নবাবের বংশধর হিসেবে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পরপরই তাদের ফোন আর ধরতেন না। মোবাইল নম্বর ব্লকলিস্টে রাখতেন। কেউ বাড়াবাড়ি করতে চাইলে হত্যার হুমকিও দিতেন। সিটিটিসি জানায়, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নার্স নিয়োগের নামে বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া পোলেন্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামেও টাকা নিয়েছেন তিনি।

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারি স্বীকার করেছে, তার এই প্রতারণার কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিল রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা, মীর রাকিব আফসার, সজীব ওরফে মীর রুবেল, আহাম্মদ আলী ও বরকত আলী ওরফে রানা। এর মধ্যে রাশেদ, আহাম্মদ ও বরকত আপন তিন ভাই। বড় ভাই আহাম্মদ তার ম্যানেজার ছিল। রাশেদকে বানাতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। আর ছোট ভাই বরকত ছিল তার বডিগার্ড।

এক ব্যক্তির কাছ থেকেই নিয়েছেন সোয়া ৩ কোটি টাকা

ফেনীর রাশিদীয়া মাদরাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুল আহাদ সালমান আরটিভি নিউজকে জানান, চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে আলী হাসান আসকারির সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় তার। পরিচয়ের পর আসকারি নিজেকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। সালমান তার ফেসবুকের প্রোফাইলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি দেখে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন। পরিচয়ের একপর্যায়ে তাদের মধ্যে মোবাইলে কথা হয়। তাদের মাদরাসায় স্থায়ীভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা দান করতে চায় আসকারি। এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই আসকারি তাকে জানায়, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার অংশীদারত্ব রয়েছে। হাসপাতালে সাতশ’ নার্স নিয়োগ করা হবে। তাকে কিছু কর্মী দিতে বলে। বিনা খরচে এসব লোকজনকে বিদেশে পাঠানো হবে বলেও জানান আসকারি।

আব্দুল আহাদ সালমান আরও জানান, আসকারির কথা বিশ্বাস করে তিনি এলাকার যারা সিঙ্গাপুর যেতে চায় এরকম প্রায় ৪০০ লোক সংগ্রহ করেছেন। তাদের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বিষয়টি আসকারিকে জানানো হয়। পরে আসকারি তাদের প্রত্যেককে মেডিকেল করতে হবে বলে জানায়। এজন্য প্রত্যেকের সাড়ে আট হাজার টাকা করে খরচ হবে। মেডিকেলের কথা বলে তাদের দুই দফায় মোহাম্মদপুরের ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় আসকারী। পরে প্রত্যেককে একটি করে নার্সিং সার্টিফিকেট যোগার করতে বলে সে। সালমান নার্সিং সার্টিফিকেট ম্যানেজ করতে না পেরে আসকারির কাছে সহযোগিতা চান। এ সময় আসকারি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একজন কর্মকর্তার নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আসলে বিএমডিসির কথিত ওই কর্মকর্তা ছিল আসকারির প্রতারণার সহযোগী রাজু ওরফে রাশেদ। রাশেদকে ফোন দেওয়ার পর তিনি বিষয়টি গোপনে করে দিতে পারবেন জানিয়ে এজন্য প্রত্যেক সার্টিফিকেটের বিপরীতে ৭৫ হাজার টাকা করে দাবি করেন।

সালমান জানান, প্রথমে বিষয়টি নিয়ে তার সন্দেহ হলেও পরে রাজি হয়ে যান। বিদেশগামী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা করে নিয়ে তিনি কয়েক দফায় মোট সোয়া তিন কোটি টাকা আসকারি ও রাশেদের হাতে তুলে দেন। এরপর থেকেই আসকারি টালবাহানা শুরু করেন। পরে বুঝতে পারেন তিনি আসলে প্রতারিত হয়েছেন। পরিচয়ের পর তিনি যখন আসকারির সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসেন, তখন তার সঙ্গে একবার ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে ও পরবর্তীতে ধানমন্ডির জাহাজবাড়ির সামনে দেখা করেন। আসকারি এ সময় তাকে জাহাজবাড়িটি তার বাবার এবং বাবা সেটি সংস্কার কাজ করাচ্ছেন বলে সালমানকে জানান। সালমান বলেন, ‘নবাব পরিবারের বংশধর হিসেবে আমি তার সব কথাই বিশ্বাস করেছি।’

ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একজন কর্মকর্তা জানান, আসকারি নিজের সম্পর্কে এমনভাবে প্রচারণা করতো যে, সাধারণ মানুষ সহজেই তাকে বিশ্বাস করে ফেলতো। প্রতারণার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সামনে পিন্টুর মাধ্যমে কয়েকজন যুবকসহ কথিত ‘নবাব’ আসকারির অনুসারী হিসেবে একটি সংগঠনের ছবি তুলে তা ফেসবুকে প্রচার করেছে। মালয়েশিয়াতেও তার নামে সংগঠন রয়েছে বলে ব্যানার বানিয়ে কয়েকজন যুবকের মাধ্যমে কয়েকটি ছবি তুলে সেগুলোও প্রচার চালিয়েছে।

পুলিশের এডিসি তৌহিদুল ইসলাম আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ৩ দিনের রিমান্ড চলছে। আজ তাদের রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন চলছে। ইতোমধ্যে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ পুরোপুরি শেষ হলে আরও অনেক তথ্য জানা যাবে।

কেএফ/জেবি

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
লোভনীয় অফার, অনলাইনে সক্রিয় প্রতারক চক্র
প্রতারক চক্রের বিষয়ে তিতাস গ্যাসের যে বার্তা
গোপালগঞ্জে নারীসহ প্রতারক চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার
নারীবাদী ৯০ শতাংশ নির্মাতাকে প্রতারক বললেন অনুরাগ
X
Fresh