• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য সড়ক পরিবহন খাত

মিথুন চৌধুরী

  ০১ মার্চ ২০১৭, ১৬:০৭

দেশে সড়ক পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেকোনো অজুহাতে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকে যাত্রীদের দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেয়ার ঘটনা প্রায় ঘটছে।

এছাড়া বেপরোয়া ভাবে পরিবহন চালানো, লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, আইন তোয়াক্কা না করা, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিংকালে নিয়ম ভঙ্গ, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগসহ নানারকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নিত্যদিন বাড়ছে দুর্ঘটনা। ঘটছে মূল্যবান জীবনের প্রাণহানি। নয়তো পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে জীবন-যাপন করছে হাজারো মানুষ।

ধর্মঘট
পরিবহন খাতের ওপর জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। দেশে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম বাস। আর পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ট্রাক। এ দুই মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। তাই এ বিষয়টাকে পুঁজি করে ইচ্ছামত ধর্মঘট ডেকে বসে পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট নেতারা। এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এক জেলায় তো অন্যদিন আরেক জেলায়। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মঘট ডেকে বসে বাস, ট্রাক, সিএনজি অটো রিক্সা, টেম্পো, লরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, গেলো ৫ বছরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রায় শতাধিক ধর্মঘট ডাকে এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া ডাকা এসব ধর্মঘটে সাধারণ মানুষই বেশি বিপাকে পড়ে। এছাড়া পণ্য পারাপার হতে না পারায় লাগামহীন ভাবে বেড়ে যায় পণ্যমূল্যের দাম। ফলে একদিকে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি।

অবৈধ চালক
গাড়ির চালাতে পারলেই চলে। তার লাইসেন্স আছে কি বা নাই সেটা দেখার মাথা ব্যথা কারো নেই। আর এর জন্যই প্রশিক্ষণের অভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় হাজারো যাত্রীর প্রাণ। দুর্ঘটনার পরে লাইসেন্সবিহীন গাড়ির কথা উঠে আসলেও হাজারো তদন্তের ভিড়ে হারিয়ে যায় এমন ঘটনা।

সারাদেশে সড়কপথে পরিবহন চালক কতো? সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এ সংক্রান্ত সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। অভিযোগ আছে এক চালকের লাইসেন্সের নামে বেশ কয়েকজন ড্রাইভার নাম বদল করে লাইসেন্স বানিয়ে নেয়। গেলো বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বর্তমানে তালিকাভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছে প্রায় ১৬ লাখ। সে হিসেবে দেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। যা নিসচা, যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ বেসরকারি বেশ কয়েকটি সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুসারে বেশি।

পরিবহন সংখ্যায় গরমিল
গেলো বছরের ৩১ আগস্ট সারাদেশে বিআরটিএ’র তালিকাভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৭ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪টি। এরমধ্যে বাসের সংখ্যা ৩৮ হাজার। কার্গো ভ্যান ৬ হাজার ৬০৮টি। মাইক্রো ৮৯ হাজার ৭৩১টি। মিনিবাস ২৭ হাজারেও বেশি। কাভার্ডভ্যান ১৯ হাজার, ডেলিভারি ভ্যান ২৪ হাজার, প্রায় ১৬ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে সারাদেশে। এছাড়াও এক লাখ ১৮ হাজার ট্রাক, ২৩ লাখ ২৪ হাজারের বেশি অটোরিকশা, তিন লাখ ২৬ হাজার প্রাইভেটকার ছাড়াও আছে অন্যান্য পরিবহন। শুধু মাত্র রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত পরিবহনের সংখ্যা ১০ লাখ ২২ হাজার ৬১৯। তবে বেসরকারি সংগঠনগুলোর দাবি করিমন, নসিমন, বটবটি, শুধুমাত্র জেলায় চলাচল করা পরিবহন নিয়ে এর সংখ্যা কোটি’র কম নয়।

সুপারিশে মিলে লাইসেন্স
মোটরযান আইনে অনুসারে যানবাহনের ৫০টির বেশি কারিগরি পরীক্ষা নিশ্চিত করেই চলাচলের সনদ দেয়ার কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব যাচাই করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু দেশে বেশিরভাগ লাইসেন্স হয় কাগজে কলমে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও পরিবহনের সংগঠনগুলোর সুপারিশে মিলে লাইসেন্স। যাকে বৈধ লাইসেন্স বলা হয়। এদিকে দেশে চালকের তুলনায় পর্যাপ্ত ট্রেনিং সেন্টার নেয় বলে দক্ষ চালক তৈরি করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

ফিটনেস বিহীন গাড়িতে সয়লাব
দেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে, সারাদেশে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং এ ধরনের যানের সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ২৩০টি। এর সব ক’টির সামনে-পেছনে লাগানো হয়েছে অতিরিক্ত কাঠামো (বাম্পার)। আবার বডির দুই পাশে লাগানো হয় তিন কোনা বড় আকৃতির লোহার পাতের অ্যাঙ্গেল ও লোহার হুক।

সড়ক দুর্ঘটনা
সড়ক দুর্ঘটনা যেনো নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও ঠেকানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার ৯৯৫টি। এতে দুর্ঘটনাস্থলেও হাসপাতালে নেয়ার পর প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এছাড়া আহত হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫ জন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও নিসাচা’র গড় হিসেব থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

বৈধ-অবৈধ সংগঠন
মূলত ধর্মঘট, চাঁদাবাজি, নৈরাজ্য ও দুর্নীতির জন্য দায়ী পরিবহন খাতের অবৈধ সংগঠনগুলো। ছোট-খাট ঘটনাকে বড় আকার ধারণ করে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় এরাই জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব সংগঠনের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। দেশের সড়ক পরিবহন সেক্টরে মালিক ও শ্রমিকদের মোট ৯৩২টি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে ৬৮৬টি সংগঠনই অবৈধ। আর এসব অবৈধ সংগঠন নিয়ে রীতিমতো বিপাকে রয়েছে বৈধ সংগঠনের নেতারা। তারা বলছে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এরা আর দোষ কাঁধে তুলে দেয়া হয় আমাদের। তাই সরকারের উচিত এসব সংগঠনগুলোকে নিঃশেষ করে দেয়া।

চাঁদাবাজি
মূলত পরিবহন খাতের শ্রমিকরা সাধারণ মানুষের মতো জিম্মি হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ যেমন তাদের অসহযোগ আন্দোলনে জিম্মি। তেমনটাই পরিবহন খাতের শ্রমিকরা জিম্মি হয়ে পড়েছে চাঁদাবাজ ও প্রশাসনের কিছু অসৎ লোকদের হাতে। ফলে দিনে বেশি টাকা আয় করতে নিয়ন্ত্রনহীনভাবে গাড়ি চালানোর মানসিকতা তৈরি হয় এবং নিজের আয় উঠাতে দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালাতে হয় তাদের। ফলে দুর্ঘটনার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া ফেডারেশনের নামে সংগঠন পরিচালনায় খরচের জন্য শ্রম আইনে যে চাঁদার কথা বলা হয়েছে, তা দৈনিক নয় মাসিক কিংবা বার্ষিক। কিন্তু এখন ফেডারেশন ও শ্রমিক ইউনিয়ন আলাদাভাবে প্রতিদিন ও প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করছে। যার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা।

এমসি/এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh