• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

আগুনে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা, পথে ব্যবসায়ীরা

মিথুন চৌধুরী

  ০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:২৪

প্রতি বছর বাড়ছে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ। সঙ্গে তাল দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। লোকসান তোপের মুখে হাজারো ব্যবসায়ী। সরকার সহাযোগিতা দিলেও পাচ্ছেন না সব ব্যবসায়ীরা। ফলে অকালে ধুলিসাৎ ঘটছে স্বপ্নের। পথে বসছেন ব্যবসায়ীরা।

২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ক্ষতির পরিমান ১ হাজার কোটি টাকা। এ বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হন ১ হাজার ২০ জন, নিহত ৩০ জন।

সবশেষ সোমবার রাতে রাজধানীর ডিসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। এতে ধসে পড়ে ডিসিসি ভবনের বেশ কিছু অংশ। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট। আগুনে কসমেটিকস, সুগন্ধি, কাপড়, জুয়েলারি, জুতা, কনফেকশনারিসহ প্রায় ২ শতাধিক দোকান পুড়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা শত কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।

গেলো নভেম্বরে সাভারের আশুলিয়ায় একটি গ্যাস লাইটার তৈরি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কালার ম্যাচ বিডি লিমিটেড নামের কারখানায় আগুনে ৩০ জন শ্রমিক দগ্ধ হন। এতে বেশ কয়েকজন মারা যান। ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকা।

গেলো বছরে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার প্রিমিয়াম প্লাজা, কাওরান বাজারের হাসিনা মার্কেট, বসুন্ধরা সিটিতে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি কোটি কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সুরু রাস্তা ও পানির অভাব না হলে ক্ষতি আরো রোধ করা সম্ভব হতো।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সালে দেশে সংঘটিত ৯১ হাজার ২৩০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা গেছেন ১০২০ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ১২০ জন। ২০১৫ সালে সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ সংখ্যা ৫ হাজার ৯২৩টি। দ্বিতীয় কারণ ছিল রান্নার চুলা থেকে সৃষ্ট আগুন। ৩ হাজার ৩৬৬টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে রান্নার চুলা থেকে। সিগারেট থেকে ২ হাজার ৫৩২টি, শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৫২৬টি, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষজনিত কারণে ২৪৪টি, অগ্নিসংযোগে ২৩৮টি, মানবসৃষ্ট হাঙ্গামায় ৯৬৩টি, মিস ফায়ারে ৫৯২টি এবং বাকিগুলো অন্যান্য কারণে সংঘটিত হয়। এসব ঘটনার প্রায় ৮০ ভাগই অসাবধানতা ও অসতর্কতার কারণে ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য অফিস, কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ঘরবাড়ি। সেগুলোয় ব্যবহৃত হয় লাখ-লাখ কম্পিউটার। কাজ শেষে ব্যবহারকারীরা কম্পিউটার বন্ধ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সচল থাকে আইপিএসের লাইন। কোনোরকম বৈদ্যুতিক গোলোযোগ হলেই সেসব আইপিএসের মাধ্যমে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধ গ্যাস সংযোগে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার। এ ছাড়া পাইপের লিকেজ বা চুলার চাবি নষ্ট হয়ে গেলে, এমনকি গ্যাসের চুলা চালু করে অন্য কাজ বা এর ওপর কাপড় শুকাতে দিলেও অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।

এদিকে, ৪০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ নির্বাপণ করতে সমর্থ হচ্ছে।

এক জরিপে দেখা গেছে, অগ্নিনিরাপত্তার স্বার্থে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ ভবনেই স্যান্ড টাব নেই। ৮২ থেকে ৯৫ ভাগ সুউচ্চ ভবনে নেই স্মোক ডিটেক্টর ও হিট ডিটেক্টর। ৬২ ভাগেরও বেশি ভবনে নেই ফায়ার অ্যালার্ম। ভবন তৈরিতে যথাযথ বিল্ডিং কোডও অনুসরণ করা হয় না। জরুরি পরিস্থিতিতে সুউচ্চ ভবনগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ডে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আবার অনেক স্থানে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুত পৌঁছতে পারে না। কারণ রাস্তা সরু বা রাস্তা নেই। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাধারণ মানুষও অনেক সময় আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের সহযোগিতা না করে উল্টো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

গেলো বছর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা ও অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ফায়ার সার্ভিসের একটি তদন্ত কমিটি ২৭টি সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

সুপারিশে বলা হয়, দুর্ঘটনা এড়াতে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী; বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি, ভবন তৈরি শেষে ফায়ার সার্ভিসের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ বাধ্যতামূলক, স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা, প্রতিটি ভবনের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার কনটিনজেন্সি প্ল্যান রাখা, ১৫তলা ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড স্থাপন, জনসচেতনায় নিয়মিত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অনুষ্ঠান প্রচার, বড় দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারি উদ্যোগে স্থায়ীভাবে কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা দরকার।

এ ছাড়াও ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে টিটিএল ও স্নোরকেল গাড়িসহ অন্যান্য গাড়ির পরিমাণ বাড়ানো, বিশেষ টিম সংরক্ষণ, লোকবল বৃদ্ধি ও রাজধানীর মিরপুরের ট্রেনিং কমপ্লেক্সকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করে একাডেমিতে রূপান্তর করার সুপারিশ ছিল।

নগরীতে বহুতল ভবন তৈরির নকশা অনুমোদন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু নকশা অনুমোদন ছাড়াই পুরান ঢাকার চকবাজার, কোতোয়ালি, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, বাসাবো, সূত্রাপুর ও গেণ্ডারিয়াসহ সারা ঢাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে অসংখ্য ভবন। একই সঙ্গে কিছু কিছু ভবন অনুমোদন ছাড়াই উঁচু করা হচ্ছে। পুরান ঢাকায় ভবনের ছড়াছড়ি। বেশিরভাগ ভবন প্রধান সড়কের পাশেই অবস্থিত। যেগুলোর নিচতলায় রয়েছে দোকানপাট বা মার্কেট।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বেশি ঘটে। এ সময় পানিরও সংকট থাকে। রাজধানীতে মূল সমস্যা পানির সংকট। প্রকৃত পানির উৎসগুলো এখানে নেই বললেই চলে। বড় কোনো পুকুর নেই, ঝিল নেই। এমনকি যেসব বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেসব বাড়িতেও পানির রিজার্ভের কোনো চেম্বার পাওয়া যায় না। আমরা এতোটাই অসচেতন যে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলছি। জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এরকম ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। সড়কগুলো প্রশস্ত করতে হবে। তা না হলে আমাদের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবে না। নতুন হাউজিং কোম্পানিগুলো ফায়ার স্টেশনের কোনো জায়গা রাখছে না। এটাও আমাদের ভাবতে হবে। বড় হাউজিং হচ্ছে অথচ তারা থানা, ফায়ার স্টেশনসহ জরুরি সার্ভিসের জন্য কোনো সার্ভিস বাহিনীকে জায়গা দিচ্ছে না।

এমসি/ডিএইচ

মন্তব্য করুন

daraz
  • অপরাধ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh