অলিম্পিকের ইতিকথা
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ৫ আগস্ট শুরু হচ্ছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াযজ্ঞ ৩১ তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ও ১৫ তম প্যারালিম্পিক গেমসের আসর।অংশ নিচ্ছেন ২০৭টি দেশের প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ক্রীড়াবিদ৷
ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হবে আসর। সেখানেই ২১ আগষ্ট পর্দা নামবে মহাযজ্ঞের। অলিম্পিকের শুরুর দিকের দিনগুলো নিয়ে থাকছে আমাদের আজকের আয়োজন।
শুরুর ইতিহাস: ৭৭৬ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ৩৯৩ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বছর প্রাচীন গ্রীসের এলিসের অলিম্পিক ভিলেজে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতা জিউসের উদ্দেশে ৪ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হত অলিম্পিক গেমস।
প্রাচীন অলিম্পিক
প্রাচীন গ্রীসে দেবতা জিউসের আবাসস্থল অলিম্পিয়ায় ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে অলিম্পিক গেমস হত। মূলত প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাই এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। সাধারণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও আয়োজনে মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, রথ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। জানা যায়, বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের মধ্যে দন্দ্ব বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও প্রতিযোগিতা চলাকালীন তা স্থগিত থাকত। এ সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘অলিম্পিকের যুদ্ধবিরতির নীতি’ বলা হত। অলিম্পিকের জন্ম আজও মানুষের কাছে একটি রহস্য। তবে জনপ্রিয় একটি গল্পকথা মতে দেবতা জিউস এবং তার ছেলে হেরাক্লিস বা হারকিউলিস অলিম্পিক গেমসের জনক। গল্পকথার মতে হেরাক্লিসই এ অনুষ্ঠানকে অলিম্পিক নাম দেন এবং প্রত্যেক চার বছর পর পর গেমস আয়োজনের প্রচলন করেন।
প্রাচীন লিপি থেকে জানা যায়, অলিম্পিকের সূচনা খৃষ্টপূর্ব ৭৭৬ সালের দিকে। ওই লিপিতে চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম লিপিবদ্ধ ছিল। লোকগাঁথা মতে কোরিবাস নামের ইলিস শহরের এক পাচক অলিম্পিকের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হন।
আধুনিক অলিম্পিক
আধুনিক অলিম্পিক গেমস বলতে ১৭শ’ শতাব্দীর দিকে শুরু হওয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এ ধরণের প্রথম আয়োজন ছিল ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া কোটসউল্ড গেমস বা কোটসউল্ড অলিম্পিক গেমস। ১৬১২ থেকে ১৬৪২ সালের মধ্যে এই কোটসউল্ড গেমসের প্রধান আয়োজক ছিলেন রবার্ট ডোভার, যিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ আইনজীবী। লন্ডনে ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমসের বিদায়ী অনুষ্ঠানে সপ্তদশ শতকের এই ঘটনাকে বৃটেনের অলিম্পিকের সূচনার অভ্যূদয় হিসেবে ঘোষণা করে।
১৮৫০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারের মাক ওয়েনলকে আধুনিক যুগের মত করে অলিম্পিক গেমসের প্রচলন শুরু করেন ডঃ উইলিয়াম পেনি ব্রুকস।তিনি এই গেমের নাম দেন ওয়েনলক অলিম্পিয়ান গেমস। এ ক্রীড়াযজ্ঞটিই ধারাবাহিকভাবে আজ পর্যন্ত চলে আসছে। ডঃ ব্রুকস এ গেমের জন্য ১৮৬০ সালের ১৫ নভেম্বর ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের লিভারপুলে জন হুলি এবং চার্লস মিলির তত্ত্বাবধানে বার্ষিক অলিম্পিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ওই আসরে শুধুমাত্র ভদ্র সমাজের শৌখিন এবং অপেশাদার খেলোয়াড়রাই অংশ নিতে পেরেছিলেন। তবে ১৮৯৬ সালের গ্রীসে অনুষ্ঠিত আধুনিক অলিম্পিক ছিল লিভারপুলে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের মতো। ১৬৬৫ সালে জন হুলি এবং ডঃ ব্রুকস ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন গঠনের পথ প্রদর্শকের কাজ করে। শুধু তাই নয় এই সংস্থার সংবিধানের বিভিন্ন পরিচ্ছেদের ভিত্তিতেই অলিম্পিক সনদ লেখা হয়। ১৮৬৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে একটি জাতীয় অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করা হয়।
পুনর্জাগরণ
অটোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হতে ১৮২১ সালে গ্রীসে যুদ্ধ হয়।এতে জয়ী হবার পর থেকেই গ্রীকরা অলিম্পিক গেমসকে পুনর্জীবিত করার চিন্তাভাবনা করছিল। অলিম্পিকের পুনর্জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন প্যানাজিওটিস সটসস। যিনি ছিলেন একাধারে কবি ও সংবাদপত্রের সম্পাদক। ১৮৩৩ সালে ডায়ালগ অব দি ডেড নামে একটি কবিতায় তাঁর এ চিন্তা তুলে ধরেন। পরবর্তীতে ইভাঞ্জেলোস জ্যাপ্পাস নামের এক বিত্তশালী এবং লোকহিতৈষী গ্রীসের রাজা অট্টোকে চিঠির মাধ্যমে অলিম্পিক গেমস ফের স্থায়ী ভাবে চালুর জন্য একটি তহবিল গঠনে সহায়তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ইভাঞ্জেলোস জ্যাপ্পাসের পৃষ্ঠপোষকতাতেই অ্যাথেন্সের সিটি স্কোয়ারে অলিম্পিক গেমস হয়, যেখানে অটোমান সাম্রাজ্য এবং গ্রীসের ক্রীড়াবিদেরা অংশ নিয়েছিল। এছাড়াও নিজের অর্থ দিয়ে একটি স্টেডিয়ামও সংস্কার করে দেন।জ্যাপ্পাসের সংস্কারকৃত স্টেডিয়ামে ১৮৭০ এবং ১৮৭৫ সালের অলিম্পিক গেমস আয়োজন হয়। ১৮৭০ সালের অলিম্পিকে প্রায় ত্রিশ হাজার দর্শক উপস্থিত হয়।১৮৯০ সালের ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটির অলিম্পিয়ান গেমস দেখে ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা পান।
অলিম্পিকের প্রকারভেদ :
সাধারণভাবে অলিম্পিক গেমস বলতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসকে বোঝানো হলেও ১৯২৪ সাল থেকে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের প্রচলন হয়। শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক একই বছর অনুষ্ঠান শুরু হলেও ১৯৯২ সালে এসে শীত এবং গ্রীষ্ম অলিম্পিক ২ বছর পর পর অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ অলিম্পিক গেমস বা ‘প্যারা অলিম্পিক গেমস’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৯৬০ সাল থেকে। অলিম্পিক গেমসের আয়োজক শহর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের পরপরই প্যারালিম্পিক গেমসের আয়োজন করে থাকে। তরুণ বয়সীদের জন্য ‘ইয়ুথ অলিম্পিক গেমস’প্রথম অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্গাপুরে ২০১০ সালে।
প্রতীক
অলিম্পিকের প্রতীক যা বাংলায় অলিম্পিক বলয় বা অলিম্পিক নিশান হিসেবে পরিচিত মূলত পাঁচটি বলয় একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। পতাকার এই পাঁচটি বলয় আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া, ওশেনিয়া এবং ইউরোপ মহাদেশকে নির্দেশ করে। পাঁচটি বলয়ের পাঁচটি রঙ নীল, হলুদ, কালো, সবুজ ও লাল চয়ন করার মূল কারণ হল এই পাঁচটি রঙের অন্তত যেকোন একটি বা একাধিক রঙ প্রত্যেক দেশের পতাকায় ব্যবহৃত হয়েছে। পতাকাটি ১৯১৪ সালে সর্বপ্রথম গৃহীত হয় তবে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ওড়ানো হয়।
অলিম্পিকের মূলমন্ত্র :
অলিম্পিকের বিশ্বাস এবং মূলমন্ত্র হল - ক্ষিপ্রতা, উচ্চতা এবং শক্তি। ১৯২১ সালে পিয়েরে ডি ক্যুবার্তা প্রচলন করেন। ১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে বিশপ তালবোটের দেয়া বক্তৃতার অংশ হল অলিম্পিক গেমসের মূল বিশ্বাস।
অলিম্পিক ক্রীড়াসমূহ
৩৫টি ক্রীড়া, ৩০টি শাখা ও প্রায় ৪০০টি বিভাগের সমাহার হল অলিম্পিক ক্রীড়াসমূহ।কুস্তি, যার দুটি শাখা : গ্রেকো-রোমান এবং ফ্রিস্টাইল। ওজনের ভিত্তিতে ১৪টি পুরুষদের ও ৪টি মহিলাদের বিভাগও বর্তমান। বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ২৬ টি ক্রীড়া ও শীতকালীন অলিম্পিকে ১৫ টি ক্রীড়ার প্রতিযোগিতা হয়।
মন্তব্য করুন