• ঢাকা রোববার, ০২ জুন ২০২৪, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
logo
সাংবাদিকতায় ডিগ্রি-দক্ষতা দুটোই জরুরি
সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগলের ‘সুখি ছবি’, যা বলছে ‘পরকীয়া’ আইন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই যুগল পিকচার অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর নানা রঙের নানা ঢঙের ছবি আপলোড করে থাকে। এর মাধ্যমে তারা মূলত বোঝাতে চায় যে, ‘দেখো, আমরা কতটা হ্যাপি। কতটা আনন্দের লাইফ লিড করতেছি।’ তারা কি আসলেই সুখি? আনন্দে আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যেতে হবে ‘গবেষণায়’। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্বামী-স্ত্রীর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে জানান দিচ্ছে যে তারা খুব সুখে আছে। খুব শান্তিতে আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সুখে কিংবা শান্তিতে নেই। তারা মূলত নিজেদের ভেতরে বহন করা চাপা কষ্ট লুকাতে এসব করছে মাত্র। তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে ‘দেখানো’ এই দেখো আমরা ‘হ্যাপি’। বাস্তবতা হচ্ছে, যারা প্রকৃত সুখি পরিবার, যারা আসলেই সংসার জীবনে শান্তিতে আছে তারা কখনোই স্বামী-স্ত্রীর ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছেড়ে জানান দেয় না। তাদের স্বামী কিংবা বউদের সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘যুগল’ ছবি পোস্টাইয়া প্রমাণ দিতে হয় না, ‘এই যে আপনারা সবাই দ্যাখেন, আমরা কত্ত সুখি! আমরা কত্ত আনন্দে আছি।’ আমুদে-আহ্লাদি সব পোচ দিয়ে ‘যুগল’ ছবি তুলে তা ইচ্ছেমতো এডিট করে ফেসবুকে পোস্টানোর সময় দেওয়া হয় বাহারি ক্যাপশনও। তাতে থাকে, জীবন তুমি, মরণ তুমি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন তোমারই থাকি। কেউ কেউ লিখে- বেঁচে আছি যতদিন তুমি আছো ততদিন। যুগলরা ‘হাত’ ধরে ছবি তুলে ক্যাপশনে বলে, ‘এই হাত ছাড়ব না কভু’। এখন প্রশ্ন হলো। এত এত ভালোবাসা। অনলাইনে আনন্দ-সুখ-শান্তি জানান দেয়ার পরেও কিভাবে দেশে মহামারি আকার ধারণ করলো পরকীয়া? প্রায় প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হয় ‘পরকীয়া’ প্রেম। কোথায় ছড়ায়নি এই ভাইরাস। শহর থেকে গ্রামে- সর্বত্র এর সংক্রমণ। চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও আজ পরকীয়ায় লিপ্ত। এই অবৈধ প্রেম রুখবে কে?  কথা প্রসঙ্গে চলে এলো আমার পরিচিত এক সুখি কাপলের কথা। নাম প্রকাশ না করেই বলছি। তারা ফেসবুকে খুব সুখি জানান দিতো। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তারা সুখি জীবনের ব্যাপক প্রচারণা চালাতেন। কিন্তু বউ ও জামাই দুজনই খুব অশান্তিতে ছিলো। ঝগড়া ছিলো তাদের নিয়মিত ঘটনা। তবে ফেসবুকে তারা বেজায় ‘সুখি কাপল’! এমন উদাহরণ কম নয়। এবার আসি পরকীয়া নিয়ে দেশের আইন কী বলে। মূলত দেশের প্রচলিত আইনে ‘পরকীয়া’ সম্পর্কে জাড়ানোকে ব্যভিচার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী স্ত্রীর পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার রয়েছে। তবে একইভাবে স্বামী যদি পরকীয়ায় জড়ায় তখন তার বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকার নেওয়ার সুযোগ নেই। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় স্ত্রী পরকীয়া করলে আইনগত প্রতিকার রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি অন্যের স্ত্রী’ অথবা ‘যাকে সে অন্য কোনো ব্যক্তির স্ত্রী বলে জানে’ বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ আছে এমন কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া এরূপ যৌন সঙ্গম করে, যা নারী ধর্ষণের শামিল নয়, তবে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের জন্য দোষী হবে। এমন অপরাধে সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এক্ষেত্রে দুষ্কর্মের সহযোগী হিসেবে স্ত্রী দণ্ডিত হবে না। অর্থাৎ স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরকীয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে যার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছে, সেই ব্যক্তির এমন কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।  তবে স্ত্রী যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার সুযোগ থাকলেও স্বামী পরকীয়ায় জড়ালে তার বিরুদ্ধে বা সে যার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে নেই। পরকীয়ার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকারে এই বৈষম্য নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি ‘রিট’ বিচারাধীন আছে। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থী, ঢাকা ল’ কলেজ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদস্বরূপ
কিভাবে বাংলাদেশে কোয়ান্টাম নিরাপদ করা যায়?
আমাদের তরুণরাও অনেক কিছু পারে
ড. জেকিল ও মি. হাইড চরিত্রে অভিনয়, অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর ধমক 
আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো গো মরার কোকিলে
সম্প্রতি জাপানে অনুষ্ঠিত হলো ২৩ তম টোকিও বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল ১৪৩১। এ উপলক্ষে প্রতিবারের মতো দেশ থেকে কিছু শিল্পী আসার কথা ছিলো। কিন্তু ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসের কতিপয় বেরসিক কর্মকর্তা তাদের ভিসা না দিয়ে নাকি জাপানে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় শিল্পীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রবাসীদের বিনোদন দিতে সহযোগিতা করেননি। তাই তড়িঘড়ি করে আমেরিকা থেকে আমেরিকান পাসপোর্টধারী বাংলাদেশী খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। শিল্পী বেবী নাজনীন যেহেতু আমেরিকার পাসপোর্টধারী তাই তাকে আমেরিকা থেকে জাপান আসতে ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সমস্যা হবে না মনে করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সমস্যা অবশ্য একটা ঘটেছিল অন্যত্র। নির্ধারিত সময় শিল্পী জাপানের উদ্দেশ্যে আমেরিকা থেকে রওনা হলে হঠাৎ একটি দুঃসংবাদ পান। ( মায়ের মৃত্যু ) এতে পথ ঘুরিয়ে তিনি চলে যান বাংলাদেশে। কারণ, সেই মূহুর্তে তাঁর মায়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে কিছুটা হলেও মর্মাহত করে। ( আল্লাহ শিল্পী বেবী নাজনীনের মায়ের আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন)। মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে মন শক্ত করে যথাসময় চলেও আসেন তিনি জাপান। জাপানে শিল্পী বেবী নাজনীনের আসার সংবাদে মেলার আগেরদিন বাঙালী কমিউনিটিতে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে। এই জোয়ার বইতে দেখা যায় শিল্পীর ভক্তদের চেয়ে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের শিবিরে। স্থানীয় কয়েকজন আমার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে কথা বাড়াইনি। কারণ, অধিকাংশের কথা ছিলো, বেবী নাজনীনের জাপান আগমনে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে তিনি একজন শিল্পী এটাহ বড় পরিচয়, তাই। আমিও তখন তাদের সেই যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছি। কিন্তু ফেসবুকে কয়েকজনের স্ট্যাটাস দেখে পরবর্তীতে সেটা আর মনে হয়নি। মনে হয়েছে সকলের যুক্তির উল্টো কথা। জাপানে যারা রাজনীতি সচেতন বলে দাবীদার তাদের কয়েকজনের সাথে এবিষয়ে কথা বলে ঠিক এমনটাই মনে হয়েছে যে, বেবী নাজনীন শুধুই একজন কন্ঠশিল্পী। জাপানে তিনি কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আসেননি। রাজনৈতিক ইস্যু টেনে আমি যেন কোনো কথা না বলি। শুনে ভালো লেগেছে এই জন্য যে, একটা বিষয়ে অন্তত মানুষগুলোর বোধোদয় হয়েছে। এটাকে রেফারেন্স ধরে হলেও আগামীতে কথা বলা যাবে। আর এখানেই আমার মনে হয়েছে, শিল্পীর জনপ্রিয় এক গানের কথা, " আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো গো মরার কোকিলে "। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই রেফারেন্স যে কাজ হবে না, তা বুঝে গেলাম বৈশাখী মেলার দিন শিল্পীকে নিয়ে ঘটে যাওয়া হট্টগোল দেখে। আর তখনই মনে হলো গানের পরের লাইন, " আমায় পাগলও করিলো গো মরার কোকিলে "। জাপানে এবার ২৩তম বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই মেলা জাপান প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রাণের মেলা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভান্ডারে ২৩তম মেলা করতে প্রতিবার ছোট বড় এমন ২৩টি ঘটনার জন্ম হয়েছে। আর এসবে জন্ম হয়েছে দেশের রাজনৈতিক দলের কথিত সমর্থকদের আচরণ থেকে। তারপরেও দেশের বাইরে এতো সুন্দর একটি অনুষ্ঠান করতে তাদেরই বারবার অংশগ্রহণ কেন জরুরী? তারা কি খরচ দিয়ে মেলা চালায়? নাকী এর পিছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে? আশা করি বেবী নাজনীন ইস্যুতে বিষয়টি পরিষ্কার করার পরিবেশ তৈরী হয়েছে এবার।  দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মুখে যেভাবে খই ফোটার মতো বলতে শুনেছি, বেবী নাজনীন একজন কণ্ঠশিল্পী, তাকে নিয়ে বিতর্ক চলে না। এখন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, দেশ থেকে খ্যাতিমান সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দীন অতীতে বৈশাখী মেলায় উপস্থিত হলে তাদের বেলায় কি আচরণ করা হয়েছিল? কি হয়েছিল দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর কালের দৃশ্য? আপনারা এতো সহজে সেসব ভুলে যান কি করে? ভুললে চলবে না কোনোটাই। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর জন্য রাস্তায় ফুল ছিটান। তবেই আমাদের রাজনীতির পথ সুন্দর ও প্রশস্ত হবে। হবে আমাদের মঙ্গলও। আমরা সব মানি তবে তালগাছ আমার বললে কখনও ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।  টোকিও তথা জাপানে বাঙালী কমিউনিটি আয়োজিত সবচেয়ে বড় ইভেন্ট এই বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল। এই একটি আয়োজনের জন্য সারাটা বছর অপেক্ষায় থাকে জাপান প্রবাসী বাংলাদেশী সহ অনেকে। অনুষ্ঠানস্থলে প্রতিবছরই কোনো না কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। রাতের অন্ধকারে সংশ্লিষ্টরস মাপ চেয়ে সাময়িক সমাধানও করা হয় মূচলেকা দিয়ে। যে কারণে পরবর্তীতে একই ঘটনা ঘটাতে সাহস পায় তারা। এর স্থায়ী সমাধান কাম্য। মেলাকে ধরে রাখতে এবং জাপানের মাটিতে বাঙালির সংস্কৃতিকে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে চাইলে আবেগ আর লোভ সংবরণ করে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। যেমন, রাজনৈতিক পরিচয় বহনকারী কেউই মেলার কোনো দ্বায়িত্বে রাখা যাবে না। যারা একবার মেলা স্থলে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সাথে জড়িত হয়েছে তাদের মেলায় নিষিঘোষণা বা পুলিশ অনুমোদন নিয়ে মেলা স্থলে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি ভালো কিছু প্রত্যাশা করা হয় তাহলে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে, সেসকল সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে জাপানে বসবাসরত বাঙালীরা তাদের সুনাম ধরে রাখতে পারবে না।  আমার প্রত্যাাশা করছি, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবারের বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভেলে ঘটে যাওয়া বেবী নাজনীনকে নিয়ে ঘটানো ঘটনা থেকে। লেখক : জাপান প্রবাসী সাংবাদিক
কারও জন্য কিছুই করা হয়ে ওঠে না!
আমি সাংবাদিক, আমি সম্পাদক, নেতা কিংবা প্রভাবশালী কেউ। কিন্তু এ সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারি না, কিছুই করা হয় না। বক্তৃতা, বিবৃতি, টক শোতে সমাজকে উদ্ধার করতে, দেশকে এগিয়ে নিতে কতই না বাহাদুরি আমার। অথচ সমাজ বিনষ্টকারী, তরুণ-যুবদের নষ্ট পথের দিশারী, বেশ পরিচিত এক মাদক ব্যবসায়ীকে ভালো হওয়ার সুযোগটুকু দিতে পারি না আমি। ওই মাদক ব্যবসায়ী আকুতি জানিয়ে বলেছিল, আমি অন্ধকার পথ ছেড়ে আলোর পথে আসতে চাই। নোংরা কর্দমাক্ত পথ চলতে চলতে ক্লান্ত আমি। গাড়ির ড্রাইভিং ভালো জানি, লাইসেন্সও আছে - তবে মেয়াদোত্তীর্ণ। একটা লাইসেন্স করে ড্রাইভিংয়ের চাকরি দিয়ে দেন প্লীজ। ৮-১০ হাজার টাকা বেতন হলেও হবে। বিশ্বাস করুন আমি সব ছেড়ে ভালো হয়ে যাবো। তার করুন আকুতিতে মন গলেছে আমার,,, কিন্তু দুই মাসেও তাকে লাইসেন্স করিয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারিনি। আরেকজন তরুণীকে চিনি আমি। যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর প্রতি ভোরে কোরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে দিন শুরু হতো তার। নিজের মা, দুই সন্তান আর দুই ভাতিজির সংসার নির্বাহ করতে গিয়ে দিশেহারা ওই নারী। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা গার্মেন্টেও একটা চাকরি জোটাতে পারেননি। উপায়ন্তরহীন অবস্থায় বারের  ড্যান্সার হয়ে কোনমতে জীবন চালাচ্ছেন। এরমধ্যে তিন ওয়াক্তের নামাজ বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়েছে কোরআন তেলওয়াতও। কিন্তু সম্ভ্রম ধরে রাখা ডান্সারের আয়েও সংসারের চাকা চলছে না তার। সব কিছুতে রাজি থাকলে তিন বেলা খাওয়া পড়ার নিশ্চয়তা মিলবে। কিন্তু ওই নারী এখন হন্যে হয়ে একটা বৈধ কাজ খুঁজছেন, নিদেনপক্ষে কোনো দোকানের সেলস এর কাজ হলেও চলবে তার। মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন হলেও ১২ ঘণ্টা করে শ্রম দিতে তার অনিহা নাই।  ভালো থাকার নিদারুণ আকুতিতে মন গলেছে আমার, তার চোখের পানি আমাকেও ব্যথিত করেছে, কিন্তু তাতে কি? আমিতো তার জন্য একটা সেলসম্যানের চাকরিও জুটিয়ে দিতে পারিনি। আরেকজন তরুণকে চিনি আমি, যে অসহায় মাকে গ্রামের বাড়ি রেখে এক পোশাকে ঢাকায় এসেছে। বলে এসেছে, মা ঢাকায় কামলাগিরি করে হলেও তোমার খরচ পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি চার মাস যাবত ঢাকায় ঘুরে ঘুরে বড়ই ক্লান্ত। এখানে চাকরি বাকরি দূরের কথা নিজের খাওয়া থাকারও নিশ্চয়তা করতে পারেনি। বেশ কদিন ধরে কমলাপুর স্টেশনেই রাত কাটায় সে, দিনে একবার খাওয়ারও পথ নেই তার। দুদিনের অনাহারী অবস্থায় এনে তিন দিন আমার বাসায় রেখেছি, শেষ দিন দুপুরে খাইয়ে ৫শ টাকা ধরিয়ে বিদায় দিয়েছি তাকে। গত ১০/১২ দিন সে কোথায় থাকছে, কি খাচ্ছে, তার মায়ের অবস্থাই বা কি সেসবের কিছুই জানা হয়নি আমার। প্রতিবেশী অপরাধীকে মাদক ব্যবসা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল শরিফুল। একই টিনশেড বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকায় রাত দিন মাদকসেবীদের আনাগোনায় স্বপরিবারে শরিফুলের অবস্থান করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ জন্যই অনুরোধ করেছিল যে, বাসার বাইরে মাদক ব্যবসা চালাতে। এতে ওই মাদক ব্যবসায়ী মাইন্ড করেছে। তাই সে রাতেই বিশ পিচ ইয়াবা দিয়ে উল্টো শরিফুলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। কোলের শিশু সন্তান নিয়ে খুব বিপাকে পড়েন শরিফুলের স্ত্রী। বলেন, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে মুদি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করা শরিফুল জীবনে পান, সিগারেট, চা পর্যন্ত পানাহার করেন না।  যে রাতে শরিফুলকে গ্রেফতার হন পরদিন সকালে রান্নার মত একমুঠো চাল কিংবা বাজার বলতে কিছুই ছিল না তার ঘরে। হাতে ছিল না টাকা পয়সাও। কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না শরিফুলের অসহায় স্ত্রী। বিলাপ কান্না ছাড়া যেন কিছুই করার ছিল না তার। যাকে পাচ্ছিলেন তারই হাত পা জড়িয়ে ধরে তিনি শুধু শরীফুলকে মুক্ত করে দেয়ার আর্তনাদ করছিলেন। বলছিলেন, স্বামীকে ছড়াতে পারলে এক মুহূর্তও আর ঢাকা থাকবেন না তিনি, চলে যাবেন ভোলার গ্রামে। তার কান্নাকাটিতে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যন্ত্রণায় ব্যথিত হয়ে নিজের মনটাও। থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, শরিফুলকে গ্রেফতারের পরদিনই আদালতে চালান দেয়ায় জেলে পাঠানো হয়েছে তাকে। এবার উকিল, আদালত, জামিন আবেদনের দীর্ঘ সূত্রীতায় আটকে পড়ে শরিফুলের জীবন। অপরদিকে মাত্র ৭/৮ দিনের ব্যবধানে ঘর ভাড়া প্রাপ্তির অনিশ্চয়তায় শরিফুলের তরুণী স্ত্রীকে বিতাড়িত করে দিয়েছে বাড়ির মালিক। শহরের কিছু না চেনা মেয়েটি তার কোলের শিশু নিয়ে কোথায় ঠাঁই জুটিয়েছে, কোথাও কি মিলছে দু'মুঠো খাবার? সে খবরটুকু জানাও সম্ভব হয় না আমার। জীবনের এমন ছোট ছোট আর্তি আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নানা সীমাবদ্ধতায় সেগুলোর দায় এড়িয়ে চলি আমরা, গায়ে মাখাই না। মনে করি উটকো ঝামেলা। অথচ আমাদের কারো কারো উদ্যোগহীনতায় একেকটি জীবন ঝরে যায়, ধ্বংস হয় অজস্র পরিবার। আসলে বক্তৃতার মঞ্চে, ফেসবুকের টাইম লাইনে অনেক কিছু বলা যায়, অনেক কিছুই করে ফেলা যায় কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি কঠিন। সেখানে কারো জন্য মঙ্গলজনক কিছু করা হয়ে উঠে না সহজে। এরজন্য প্রয়োজন সমমনাদের সমন্বিত উদ্যোগ, এগিয়ে আসার আন্তরিকতা। লেখক: সিনিয়র অনুসন্ধানী সাংবাদিক
আগে ঘরের ছেলেরা নিরাপদে ঘরে ফিরুক
আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে পথে রয়েছে এমভি আবদুল্লাহ। ৩২ দিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ২৩ নাবিক এখন পাড়ি দিচ্ছে এডেন উপসাগর। বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে জাহাজটি ঘেরা হয়েছে কাঁটাতার দিয়ে। আরও নিরাপত্তার জন্যে জাহাজের ডেকে যুক্ত করা হয়েছে ফায়ার হোস পাইপ। যাতে আবার কোনো বিপদ হলে নিরাপত্তাকর্মীরা শত্রুর দিকে গরম পানি ছিটাতে পারে। নাবিকরা যেন লুকিয়ে থাকতে পারেন সেজন্যে প্রস্তুত রয়েছে নিরাপদ গোপন ঘর সিটাডেল। আর সব শেষ নিরাপত্তার জন্যে এমভি আবদুল্লাহকে পাহারা দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ।  জাহাজটির মালিক কেএসআরএম গ্রুপের কর্মকর্তারা এসব তথ্য দিয়েছেন গণমাধ্যমে। তারা বলছেন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও এমভি আবদুল্লাহ এখনও উচ্চঝুঁকিপ্রবণ এলাকা অতিক্রম করেনি। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই নিয়মের কারণেই তারা সাংবাদিকদের বলেননি, কী পরিমাণ মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি মুক্ত হলো। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একজন জলদস্যুর বরাত দিয়ে, মুক্তিপণের পরিমাণ উল্লেখ করা করা হলেও তা স্বীকার করেনি কেএসআরএম।  এদিকে জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, জলদস্যুদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে সমঝোতা করা হয়েছে। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন ধরনের চাপ দিয়ে মুক্ত করা হয়েছে আব্দুলাল্লাহকে। অনেকে ছবি দেখাচ্ছেন, এ ছবিগুলোরও কোনো সত্যতা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিপিং ডিপার্টমেন্ট, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম উইং, ইউরোপিয়ান নেভাল ফোর্স, ভারতীয় নৌবাহিনী এবং সোমালিয়ার পুলিশ এই উদ্ধার কাজে এখনও সহায়তা করছে।  আমরা যদি একটু পেছনে যাই দেখব, ছিনতাই হওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় সোমালিয়ার উপকূল থেকে জিম্মি জাহাজ ছাড়িয়ে আনার নজির প্রায় নেই। ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হয় ১২ মার্চ। জাহাজটি মুক্ত হয় শনিবার রাত ১২টা ৮ মিনিটে। এ হিসাবে ৩২ দিন পর জাহাজটি মুক্তি পেলো। এর আগে ২০১০ সালে এই একই গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। সেটি উদ্ধার করতে তিন মাস নয় দিন সময় লেগেছিল। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুদের চূড়ান্ত অত্যাচার ছিল ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০১১ সালে ৩১টি জাহাজ জিম্মি করেছিল সোমালীয় দস্যুরা। এর প্রত্যকেটিকেই মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছিল। প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে সময় লাগে গড়ে ১৭৮ দিন। সোমালিয়ায় নাবিকদের দীর্ঘ সময় জিম্মি থাকার ঘটনা মালয়েশিয়ার জাজাজ এমভি আলবেদো জাহাজের। তাদের ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর জিম্মি করেছিল দস্যুরা। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে নাবিকেরা মুক্তি পেয়েছিলেন। মুক্তির সব শেষ ধাপটি ছিল ২০১৪ সালের ৭ জুন।  জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসি এর তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল ছিনতাই হওয়া মিয়ানমারের একটি মাছ ধরার জাহাজটি মুক্ত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। জাহাজটির ২৪ জন নাবিকের মধ্যে ৬ জন অসুস্থ হয়ে মারা যান। মিয়ানমারের ১৪ জন নাবিক মুক্তি পান ২০১১ সালে। বাকি ৪ জন মুক্তি পান ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। শেষ ৪ জন মুক্তি পান ৪ বছর ৩১৩ দিন পর। সোমালিয়ান দস্যুদের মুক্তিদেয়ার এত ফিরিস্তি এখনে দিলাম, কারণ প্রথমত বলতে চাইলাম এরা ভয়ঙ্কর হতে পরে। দ্বিতিয়ত সম্প্রতি যেভাবেই আমাদের নাবিকরা মুক্তি পান না কেন, খুব কম সময়ে তারা ঘরে ফেরার পথে আছেন, কিন্ত তারা এখনও শতভাগ বিপদমুক্ত নন।  অনেকে আমার এমন কথায় আঁতকে উঠতে পারেন। ভয় পাওয়ার হয়তো কিছু নেই। কিন্তু কিছু অদ্ভুত বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এবার এই বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি হওয়ার পর আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখলাম সোমালিয়া উপকূলে এই অপহরণের বিষয়টি যেন কোনো অপরাধ নয়। একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ডাকাতরা রীতিমতো দক্ষ। তারা প্রযুক্তি জানে।  আধুনিক অস্ত্র আছে। এমনকি তাদের পক্ষে কথা বলার মত বৈধ প্রতিষ্ঠান আছে। ডাকাতির মতো একটি ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সঙ্গে মধ্যস্ততার জন্যে প্রকাশ্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে লন্ডন আমেরিকার মত দেশে। রাষ্ট্র শক্তির মতো কোনো অমোঘ শক্তি পেছনে না থাকলে কী এই দৌরাত্ম সম্ভব? তাই কারা দস্যুদের পক্ষে কারা বিপক্ষে তা বোঝার ঝুঁকি তো রয়েই যায় শেষ মুহূর্তে। পাঠক আসুন আবারও প্রেক্ষাপটে ফিরি। জিম্মি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিক মুঠোফোনে তার স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিও। অর্থাৎ প্রথম থেকেই ২৩ নাবিকের বেঁচে থাকার আকুতি বাংলাদেশের কাছে ছিল। যে কারণে নাবিকদের যেন ন্যূতম ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি প্রথম থেকে খুব মুখ্য ছিল। তাই এ কথা আর বলতে বাঁধা নেই যে, জিম্মি হওয়ার পর ২৩ নাবিকই শুধু  চূড়ান্ত ঝুঁকির মুখে পড়েননি। ঝুঁকির মুখে ছিলেন যারা তাদের উদ্ধার করতে চাইছিলেন তারাও। তাদের সামনে একদিকে ভয়ঙ্কর জটিল কূটনীতি অন্যদিকে ২৩ জনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়। সবকিছু মিলিয়ে সবাকে কৌশলী হতে হয়েছে। শুধু কৌশলী বললে ভুল হবে, বলতে হবে সুক্ষ্ম কৌশলী। যে কারণে বার বার অভিযানের প্রস্তাব আসলেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। জাহাজ জিম্মি হওয়ার খবর প্রথম জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনী। তাদেরকেও বাংলাদেশ শুধু অনুসরণ করার অনুরোধ করেছিল। সেখানো ভারতীয় নৌবাহিনীরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারাও বিশেষ নজর রেখেছিলেন, নাবিকদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।  এখনও পর্যন্ত উদ্ধার কাজের পুরো প্রক্রিয়া প্রকাশ্য হয়নি। কিন্তু সার্বিক বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, ২৩ জন  নাবিক যে নিরাপদে ফিরতে যাচ্ছেন, এটা একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নয়। এটা রীতিমতো কূটনীতিক সাফল্যই বলতে হবে। যারা কাজ করেছেন, তাদের কাউকে ছাড়া কারো পক্ষে এতদূর এগোনো সম্ভব ছিল না। আর সম্ভব হলেও সেই মাসের পর মাসের ধাক্কা ছিল হয়তো। থাক আর হয়তো বলে মন খারাপ করতে চাই না। কারণ এই ‘হয়তো’ আমাদের সামনে অনেক বিপজ্জনক প্রশ্ন আনতে পার। তাই আর প্রশ্ন না বাড়িয়ে শুধু বলি, গোটা প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে ধান ভানতে এই  শিবের গীত গাইতে হলো। ছবির যে প্রসঙ্গ খোদ প্রতিমন্ত্রী তুলেছেন, সেই ছবিটি আমিও দেখেছি। আজকের এই ফেক ভিডিও ছড়ানোর যুগে আমার মনেও যে প্রশ্ন ওঠেনি তা নয়। একদল ডাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে, প্লেনে বহন করে পর পর ৩টি ডলারের প্যাকেট ফেলা খানিকটা সিনেম্যাটিক। কিন্তু সত্য যে হতে পারে না, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে টাকা যদি দিয়েই থাকে, তাহলে ফেরত আসার পথে এত নিরাপত্তা লাগছে কেন? আর যেখানে আমরা জলদস্যু দলপতির চিঠির কথা জেনেছি। যে চিঠিতে তিনি বলেছেন এই চিঠি দেখালে কেউ তাদের আটকাবে না। তারপরেও এত সতর্কতার কারণ কী শুধুই আন্তর্জাতিক নিয়ম? যে কারণে বলতেই হচ্ছে জাহাজ এবং নাবিক উদ্ধার কূটনীতি এখনও সক্রিয়। যাই হোক, বিমান থেকে টাকা ফেলার ছবি, কেএসআরএম এর বিবৃতি এবং প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে এক ধরণের অমিল খুঁজে পাচ্ছেন কেউ কেউ। এটা কোন কোন গণমাধ্যম থেকে সংক্রামিত হয়ে  মানুষের মনেও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। সেই ধোঁয়াশা ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একটা সফল অপারেশনের শেষ সময়ে এটা আসলেই প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ এই তিন বক্তব্যে আপাত দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ মিল হয়তো নেই, কিন্তু আমাদের ভাবা দরকার গোটা বিষয়টা একটা কূটনীতি। এখানা নানা কৌশল থাকবেই। তাই ধোঁয়াশাও থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা ২৩ জন নাবিকসহ জাহাজটি এখনও সমুদ্রে। নিশ্চয়ই ঘরের ছেলেরা ঘরে ফেরার পর অনেককিছু প্রকাশ্য হবে। আর যদি নাও হয়। তারাতো ফিরলো। না হয় এই সুযোগে একবার নজরুল চর্চা করে নেবো " মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহীয়ান'। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী  
পরিবহন শ্রমিক : আমাদের ক্ষোভ বনাম বাস্তবতা
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। এই উৎসবের আমেজ এখন সর্বজনীন। ঈদের এই আনন্দের শুরুটা হয় প্রিয়জনদের সাথে ঈদ উদযাপনে বাড়ির পথে যাত্রা করার সময় থেকে। আমাদের এই ঈদযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ গণপরিবহনের চালক, সুপারভাইজার ও হেলপাররা। আর তাদের রক্তে রঞ্জিত হল কিনা আমাদেরই হাত! গণমাধ্যমে খবর, বাড়তি ভাড়া চাওয়াকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটির জেরে যাত্রীদের বেধড়ক পিটুনিতে ইতিহাস পরিবহনের বাসচালক ও সুপারভাইজর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে আশুলিয়ার ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ (ডিইপিজেড) এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। যাত্রীরা এমন বর্বর হতে পারে, ভাবা যায়?  এ ঘটনায় যথারীতি দুটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: ১. পরিবহন খাত কতটা নিয়ন্ত্রণহীন হলে যাত্রী-শ্রমিকের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে? এভাবে ভাবতে গেলে অবশ্য যাত্রী কর্তৃক পরিবহন শ্রমিক হত্যার বিষয়টি হালকা হয়ে যায়। ২. বেশি ভাড়া চাইলেই মেরে ফেলতে হবে? হামলা করতে হবে? উত্তর অবশ্যই না। এসব প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতে এবার কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। পরিবহন শ্রমিকরা বাড়তি ভাড়া চাওয়াটা আইনত বৈধ না হলেও কোন যুক্তিতে আসলে তারা এটা দাবি করছে? এটার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? সহজ করে যদি ভাবি, তাতে কিছু ব্যাপার উঠে আসে। আপনার আমার যেমন ঈদ আনন্দ আছে, তাদেরও তা আছে। আর প্রিয়জনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য এই সময়ে আমাদের যে বাড়তি খরচ রয়েছে, পরিবহন শ্রমিকরা নিশ্চয়ই এর বাইরে নয়। এখন আপনি যদি একজন ব্যবসায়ী হন, তবে এই মাসে বাড়তি বিক্রি কিংবা মুনাফা থেকে রমজান-ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে পারবেন। সবথেকে বড় কথা আপনি ব্যবসায়ী হিসেবে খুব সহজে এসব খরচের যোগান দিতে পারেন। আর চাকরিজীবীদের জন্য বেতনের সাথে বোনাস তো আছেই। দেশে বর্তমানে অর্ধ কোটিরও বেশি গণপরিবহন শ্রমিক রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে যাদের বাড়তি কোনো আয়ের নিয়মতান্ত্রিক কোনো সুযোগ নেই। দৈনিক যে মজুরি, সেটাও চলার জন্য যথেষ্ট নয়।  বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, দেশে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত মোটরযান ৫৮ লাখ ৯৭ হাজার ২৪১টি। এ সংখ্যা থেকে ব্যক্তিগত শ্রেণির ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৪টি গাড়ি বাদ দিলে আর থাকে ৫৪ লাখ ৩০৭টি। এর মধ্যে বাস ৫৪ হাজার ১৫৮টি, কাভার্ডভ্যান ৪৭ হাজার ৬৪টি, মাইক্রোবাস ১ লাখ ২০ হাজার ৯৩টি, মিনিবাস ২৮ হাজার ৩০৯টি, হিউম্যান হলার ১৭ হাজার ৩৮৭ এবং মোটরসাইকেল আছে ৪২ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩০টি। ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ, ২০০৬ সালের শ্রম আইন এবং সর্বশেষ সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী নিয়োগপত্র, বেতন, মজুরি, বোনাস, ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ থাকলেও বেশিরভাগ বেসরকারি পরিবহন মালিক অতি মুনাফার লোভে চালক-শ্রমিকদের এসব বিষয় নিশ্চিত করেন না। অর্থাৎ আইন থাকলেও রাষ্ট্রীয় তদারকি অভাবে তার বাস্তবায়ন নাই। অন্যদিকে কল্যাণ তহবিলের নামে শ্রমিকদের কাছ থেকে শ্রমিক সংগঠন নিয়মিত যে চাঁদা নেয় তা থেকেও দুর্দিনে তেমন কোনো সাহায্য পান না তারা। তাই কোনো দিন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কাটাতে হয় মানবেতর জীবনযাপন। অনেকটা দিনে এনে দিনে খাওয়ার মত সাদামাটা জীবন। মোদ্দাকথা মালিক, শ্রমিক সংগঠন ও সরকার সব পক্ষেরই উদাসীনতার বলি দেশের অন্যতম বৃহৎ এ খাতের শ্রমিকেরা।  সাপ্তাহিক কিংবা সরকারি ছুটির দিন, আমাদের জীবনে সব থাকলেও এ খাতের মানুষগুলো কখনো সেসব ছুটির স্বাদ নিতে পারেন না। আমাদের গতিময় জীবনকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বছরের প্রতিটা দিন নিরাপদ কোনো ভবিষ্যৎ না থাকা সত্ত্বেও তারা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বিরামহীন ঘাম ঝরিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোরও ইচ্ছে হয়, এই ঈদে প্রিয়মুখে হাসি ফোঁটাতে, প্রিয়জনদের সাথে ঈদ কাটাতে। আমাদের মত ঘরে থেকে পরিবার, স্বজন কিংবা বন্ধুদের সাথে ঈদ উদযাপনের সুযোগ যদিও তাদের নেই। এতে যে আমাদের ঈদযাত্রা, ছুটিতে ঘুরাঘুরি বন্ধ হয়ে যাবে! নিজেদের ঈদ আনন্দ বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে এই মানুষগুলো শুধু চেয়েছে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের চেহারায় ঈদ আনন্দ দেখতে। যৎসামান্য ঈদ উপহার পরিবারের সদস্যদের দিতে। আর এটা নিশ্চিত করতে বাড়তি যে অর্থের প্রয়োজন সেটার যোগান আসলে কোথায়? না পাচ্ছে বিধিসম্মত কোন বেতন-বোনাস, না আমরা দিচ্ছি কোন বকশিস? তাই হয়তো কিছু টাকা বাড়তি নেয় ভাড়া হিসেবে। তাতে যদি ঈদ আনন্দটা পাওয়া যায়। সেটা অবশ্য বছরের পর বছর ধরে আমরা দিয়ে আসছি। যদিও তাদের চাওয়ার ধরন খুব একটা সুন্দর না। এটাকে আবদারের চেয়ে অধিকার হিসেবে দেখিয়ে ফেলে। এটাও তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজন আছে বলেই যে যাত্রীদের কাছ থেকে গলাকাটা ভাড়া আদায় করবে সেটা কখনো কাম্য নয়। ঠিক এ জায়গায় আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি, অপরাধ জেনেও তাদের গায়ে হাত তুলছি।   আচ্ছা, আমরা কি কখনো ভেবেছি, পরিবহন শ্রমিকদের ত্যাগ, বঞ্চনার কথা। অনেক না পাওয়ার জীবনে ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকা আদায়ের পেছনের কথা। হয়তো ভাবি না। আমরা শুধু খিটখিটে মেজাজের পরিবহন শ্রমিকদের রূঢ় আচরণটাই দেখি। আমাদের চোখে এরা আজন্ম লোভী, শিষ্টতাহীন, অশিক্ষিত এক শ্রেণি, তাইতো? লোভ, শিষ্টাচারের আর শিক্ষার কথাই যেহেতু এসেছে তাহলে বলুন, দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বড় পদের বড়কর্তারা কি লোভহীন? তবে হাজার কোটি টাকা যায় কোথায়? যখন সেবা প্রত্যাশী হিসেবে তাদের কাছে যান তখন কতটাই বা শিষ্টাচার উনারা প্রদর্শন করেন? এখানেই আমরা চুপ, নীরবে মেনে নিই সব। যত প্রতিবাদ আর ক্ষোভ এসব দুর্বল, কম শিক্ষিত মানুষগুলোর উপর। তাদের কাছ থেকে সুন্দর আচরণ প্রত্যাশার আগে কখনো ভেবে দেখি না যে, হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষগুলোর বিদ্যার দৌড়ই বা কতটুকু? যেখানে শিক্ষিত বড় কর্তাদের উচ্চতর ডিগ্রি, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ থাকার পরও সদয় আচরণ অনিশ্চিত, সেখানে লেখাপড়া না জানা, ন্যূনতম প্রশিক্ষণ না পাওয়া এই পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার আশা করা কতটা সমীচীন? আর আমরা নিজেরাই বা তাদের প্রতি কতটা সম্মান দেখাই? সর্বশেষ কবে তাদেরকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেছি তা মনে আছে? কখনো তাদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘শুভ সকাল! কেমন আছেন?’ এসব আমরা ভাবতেও পারি না। সবমিলিয়ে আস্থা আর সম্মানের জায়গায় বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে সহজে অনুমেয়, উভয় পক্ষের মনে এ ক্ষোভের জন্ম একদিনে হয়নি। দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর রাতের বেলা বাসের করিডোর কিংবা ছাদে মশার কামড়ে ঘুমানো। ভাসমান এ জীবন যাদের তাদের জন্য এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে শুধুমাত্র দুর্ঘটনা রোধে আইন করে চালক-সহকারীর শাস্তি নিশ্চিত করলেই হবে না। সেইসাথে প্রয়োজন তাদের জীবনমান উন্নয়নে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যার অংশ হিসেবে শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি, বোনাস, চিকিৎসাভাতা, ইনসুরেন্সের, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরদারি ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে মালিকপক্ষ ও সরকার উভয় পক্ষের ভূমিকা থাকবে। অর্থের যোগান মালিকপক্ষ দিবে, আর পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে সরকারের। এর পাশাপাশি যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে পরিবহন পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং যাত্রীদের সাথে সুন্দর আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই ব্যাপারে যাত্রীদেরও সচেতন করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে। সবমিলিয়ে বলা যায়, রাষ্ট্রপক্ষ সরব হলে মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোও তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবে। তাতে যাত্রী-শ্রমিক অসন্তুষ্টি দূর হয়ে পরিবহন খাতে সত্যিকারের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। সৃষ্টি হবে ন্যায্য ভাড়া আদান-প্রদানের পরিবেশ।  লেখক : বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের মৃত্যু যেন এক নক্ষত্রের পতন
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগদান করেছি দু’দিন হলো মাত্র; আমার রিপোর্টিং বস প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব স্যারের সঙ্গে পরিচয়ের পর খুব ফর্মাল কিছু কথাবার্তা হয়েছে। অফিসে কাজ করছি এমন সময় স্যারের টেলিফোন। রাশভারী কণ্ঠস্বর, ‘ইমরুল, তুমি কি অফিসে?’ তটস্থ হয়ে উত্তরে বললাম, ‘ইয়েস স্যার।’ আবার সেই মায়াবী কণ্ঠ, ‘তোমার গাড়ি কি অফিসে আছে?’ আমার প্রত্যুত্তর, ‘ইয়েস স্যার।’ স্যারের আবারও প্রশ্ন, ‘তুমি কি এখন বাইরে কোথাও যাবে?’ আমার উত্তর, ‘নো, স্যার।’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে স্যার আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ভাবি দেশের বাইরে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ারপোর্টে নামবে; তোমার গাড়িটি কি একটু পাঠাতে পারবে?’ ক্যাডার সার্ভিসের অফিসার হিসেবে বসের সার্বক্ষণিক নির্দেশ পালন করতেই অভ্যস্ত আমরা; এ পরিস্থিতিতে স্যারের ভদ্রতা পরম মুগ্ধতায় গ্রাস করল আমাকে। এভাবেই প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম হেলাল স্যারের সঙ্গে আমার পথ চলা শুরু। ১০ মার্চ। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে প্রেস সচিব স্যারের মিসেস আমাকে ফোন করে জানালেন, স্যারের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভাবির কণ্ঠস্বর আমাকে উতলা না করে পারল না। আবার মনে মনে এটাও ভাবছিলাম-স্যার তো গ্রেট ফাইটার, বারবার নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি ফিরে এসেছেন, এবারও নিশ্চয়ই আমাদের হতাশ করবেন না। কিন্তু রাত ৮টার দিকে বাস্তবিকভাবেই সেই নির্মম সংবাদটা পেলাম! টানা ২ মাস ১০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে আমাদের প্রিয় স্যার ইহসানুল করিম হেলাল মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি অবিশ্বাস করার জন্য বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, ডাক্তাররা কনফার্ম করেছে কিনা। নিরুপায় হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম। নিঠুর হৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে প্রধানমন্ত্রীর শোক বার্তাটি টাইপ করা শুরু করলাম। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না! হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। দীর্ঘ প্রায় ৫২ বছরের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার। ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান দুই ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উভয়েরই প্রেস সচিব। তার আপন চাচা জাওয়াদুল করিমও ছিলেন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব। ১৯৭২ এ যে প্রতিষ্ঠানে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন, সেই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান হন ২০০৯ সালে। তিনি ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যুরো চিফ ছিলেন। বিবিসি, জাতিসংঘ, ওআইসি এবং কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। ভারতীয় পত্রিকা দি স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়া টুডে এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেছেন। এছাড়া ইহসানুল করিম অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এবং বেলারোট কুরিয়ার পত্রিকায়ও কাজ করেন। ইহসানুল করিম পড়াশোনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব নিউজ এজেন্সি জার্নালিজম এর ডিগ্রি নিয়েছেন, সেখানে পেয়েছেন বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ও পড়ালেখা করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে তিনি তৎকালীন কুষ্টিয়া সদর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আমাদের জীবনের মহোত্তম অর্জন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়; সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ ৮ বছর ৩ মাস স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি আমি। তিনি ছিলেন আমার ডাইরেক্ট বস, অথচ কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বসিং অনুভব করিনি। আমার পিতার চেয়ে বছর কয়েকের বড় হয়েও তিনি আমাদের সঙ্গে মিশেছেন বন্ধুর মতো অথচ কাজকর্মে ছিলেন দায়িত্বশীল। প্রেস ম্যাটারগুলি বুঝিয়ে দিতেন সহজ সাবলীলভাবে। আমাদের ভুলত্রুটি নির্দ্বিধায় শোল্ডারিং করতেন পরম মমতায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, চরম পরোপকারী ও প্রচণ্ড ক্ষমাশীল একজন মানুষ। আমার নিজের চোখে দেখা, স্যারকে নিয়ে কটূক্তি করা কিংবা তার অমঙ্গল কামনা করা ব্যক্তির জন্যও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিমকে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন যোগ্য ও দক্ষ ক্যাপ্টেনের ন্যায়। দেশে-বিদেশে স্যারের সঙ্গে আমার শত শত স্মৃতি! কোনটা রেখে কোনটা বলি! অফিসে প্রায়ই তিনি আমার রুমে আসতেন; তার বিশাল অভিজ্ঞতার গল্প শুনাতেন। কতবার বলেছি, স্যার আপনার এই বিরল অভিজ্ঞতাগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যান। ছাত্র জীবনে তিনি ক্রিকেট ও ফুটবল দু’টিই খেলতেন সমান তালে; ছিলেন ফার্স্ট ডিভিশনের প্লেয়ার। মঞ্চ নাটকেও করতেন অভিনয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতিটি খেলা দেখতেন খুব আগ্রহ নিয়ে। দলের যে কোন বিজয়ে যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন বার্তা দিতে দেরি করতাম, সঙ্গে সঙ্গে স্যারের ফোন-‘ইমরুল, সবকিছুই কি আমার খেয়াল রাখতে হবে?’ কোন বিষয়ে শোক বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতো।  বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের প্রতি ছিল তার নিখাদ দরদ ও অনুভব। জাতির পিতাকে হত্যার পর শেখ হাসিনা যখন পরিবার নিয়ে ভারতে ৬ বছর বাধ্যতামূলক নির্বাসিত জীবন যাপন করেন, তখন স্যার বঙ্গবন্ধুকন্যাদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাদের নয়াদিল্লির বাসায় যেতেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি তার ছিল নিরন্তর ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি নির্দেশ পালন করতেন অক্ষরে অক্ষরে। নেত্রীর ব্র্যান্ডিং ও সংবাদ প্রচারের জন্য প্রতিনিয়ত আমাদের দিকনির্দেশনা দিতেন। কীর্তিমান ইহসানুল করিম ১৮ জুন ২০১৫ হতে ১০ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন এই কারণে যে, এ বিশেষ সময়টাতে জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল; বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশে; জাতিসংঘ আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আর সারাবিশ্বে আমরা আজ আত্মমর্যাদাশীল জাতির পরিচিতি পেয়েছি। মহান সৃষ্টিকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইহসানুল করিম হেলাল স্যারের ইহকালের সকল নেক কর্মকাণ্ডের পুরস্কার নিশ্চয়ই পরজনমে পরিপূর্ণভাবেই দেবেন-এ প্রার্থনা করি। লেখক: প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব
নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না
বাংলাদেশে নির্বাচন একটি মজার ও ভয়ানক বিষয়; অনেকক্ষেত্রে তা উৎসবেরও। দেশের ৫৩ বছরের কাঠামো প্রথম দুটি বিষয়ের জন্য দায়ী। তৃতীয় বিষয়টির জন্য বাঙালির যেকোনো কাজকে উৎসবে রূপান্তর করার প্রয়াস কারণ। এ দেশে নির্বাচন কোনো সময়েই সঠিক হবে ধরা যায় না। এর পেছনে নানা কারণ জড়িত। নির্বাচন যেকোনোভাবেই জিতে আসার মানসিকতা এ দেশের প্রায় সবার মাঝেই আছে। এ থেকেই নির্বাচন বিষয়টি ভয়ের সৃষ্টি করে। মানুষের মৃত্যুও হয় এ নির্বাচনকে ঘিরে। সব ছাপিয়ে নির্বাচন মানেই উৎসবের বিষয়। উৎসব খুব বেশি পায় না এ দেশের মানুষ। ফলে নির্বাচন অবশ্যই ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করে। এ থেকেই উৎসবের জন্ম।  উৎসব হওয়ার নানা কারণ আছে। যেকোনো নির্বাচনে এ দেশে প্রার্থীকে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। যদিও তা হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দাঁড়িয়েছেন এ প্রচার সংশ্লিষ্ট সবাই অর্থাৎ ভোটারের কাছে পৌঁছালেই হতো। এ বার্তাটুকু পৌঁছার জন্য অঢেল অর্থ খরচ করতে হয় না। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। যেকোনো নির্বাচনে এ দেশে প্রার্থীকে একটি বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে ধরে নিয়েই মাঠে নামেন তিনি। ফলে অর্থ চারপাশে বিলি করেন প্রার্থী। অনেকেই তা পান এবং দেদার খরচ করেন। অনৈতিক অর্থ খরচ হয় বলেই নিবাচন উৎসবের রূপ নেয়। ভোট কেনাবেচাও হয়। ফলে একটি উৎসব ভাব বিরাজ করে।    আরেকটি বিষয় আমাদের দেশে নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। আপনার অবশ্যই পেশিশক্তি থাকতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন ‘সুষ্ঠুভাবে’ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল থাকতে হবে। না হয় যত যোগ্য ও সৎই হন না কেন নির্বাচনের ফলাফল আপনার পক্ষে আসবে না। নির্বাচনে আরেকটি বিষয় কাজ করে কেন্দ্র দখল করে ফেলা। পরে একের পর এক ব্যালট পেপারে সিল মারা।  শুরুর প্রসঙ্গে ফেরা যেতে পারে। নির্বাচন মজার এসব নিয়েই। যেকোনো নির্বাচনে যতজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন; তাদের মাঝে একজন ভোটার যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকে ভোট দিবেন এই তো সহজ ও সাধারণ বিষয়। কিন্তু এসবের মাঝে অনেক বিচ্যুতি ও অনিয়ম ঢুকে পড়ার ফলে পুরো বিষয়টির মজার মানে হাসি-তামাশার হয়ে দাঁড়ায়। শুধুই সৎ কিংবা যোগ্য হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন না আপনি। তার জন্য অনেককিছু লাগবে। এসবের কারণেই নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায় ভয়ের। আর খুব বেশি অর্থের ওড়াউড়ি ওই সময়টাই হয় বলে তা উৎসবের আমেজ পায়। আর তা যদি স্বাভাবিক রূপ পেত তবু উৎসব হতো। পরের উৎসবটি সুস্থ হতো। একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একজন সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি মিলবে। তিনি যে শাখার প্রতিনিধি হয়েছেন সে শাখাটিতে ক্রমশ নিজের কারিশমা দেখাবেন; এ ভিন্ন উৎসব। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় অন্য উৎসব। অঢেল অর্থ ওড়ে নির্বাচনে। তরুণ-যুবকরা পরিবার ছাড়াও ভিন্নভাবে অর্থ পান। যা খরচ করতে কখনোই তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে তাদের অন্যায় পথে পা বাড়াতে দেখা যায়। আর এমন নির্বাচনের ফসল একজন অযোগ্য প্রতিনিধি যিনি যেকোনোভাবে পাস করেছেন; অন্যায়ভাবে এর সুবিধা নেবেন বলে। আমাদের দেশে চারপাশে এমন নির্বাচন দেখছি কিনা? নির্দিষ্ট করে কোনো নির্বাচনকে ইঙ্গিত না করে পাঠকের দৃষ্ঠিকে একটু গভীরে নেওয়ার অনুরোধ করছি। চারপাশের অসংখ্য নির্বাচন এমন উদাহরণ সৃষ্টি করছে কিনা?  একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে কিছু চিত্র তুলে ধরব। তাতে নির্বাচনের বাংলাদেশের সংস্কৃতির কিছু পাঠ পাওয়া যেতে পারে। আমার জন্ম একটি গ্রামে। সেখানেই কেটেছে আমার বালকবেলা-কৈশোরকাল। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পাড়ার ‘মেম্বার’ প্রার্থীর জন্য মিছিল করেছি। মিছিল যত বড় তার জনপ্রিয়তা তত বেশি এমন ভাবনা ভোটারের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য। তার সুফল বাংলাদেশে সব নির্বাচনেই মেলে। ঘুরেফিরে নির্বাচন মানেই ‘শোডাউনের’ বিষয়। নির্বাচনকালীন প্রার্থীর বাড়িতে সারাক্ষণ খাবার ও চায়ের ব্যবস্থা থাকত। প্রার্থীর হয়ে ‘মাইকিংয়ের’ শব্দে মুখর থাকত এলাকা। রাতে বাড়ি বাড়ি পোস্টার সাটানো হতো। এ পোস্টার পাওয়ার জন্য প্রার্থীর বাড়িতেও যেতাম। পোস্টারের উপর পোস্টার সাটানোয় জগড়া লাগতেও দেখেছি। বড় ভাইয়ের কল্যাণে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীর নানা উপহার সরঞ্জাম বাড়িতে আসত। তার মাঝে থাকত অনেককিছু।  বাবা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় ওই সময়টিতে বিভিন্ন নির্বাচনের প্রিসাইডিং অফিসার হতেন। তিনিই কেন্দ্রের প্রধান। তার জন্য উৎকণ্ঠাও হতো। অনোচনীয় কালি পেতাম তার জন্য। নিজেও সাহস নিয়ে নানা নির্বাচনী কেন্দ্রে ঢু মারতাম বালক হয়েও। দেখেছি কেন্দ্র দখল। অসংখ্য যুবক হন্যে হয়ে ব্যালটের পর ব্যালট সিল মারতে দেখেছি। তখন অনেকের উৎকণ্ঠা দেখেছি এই বুঝি ম্যাজিস্ট্রেট আসল, এই বুঝি সেনাবাহিনী আসল। গোলযোগ হলে তাদেরকেই ভয় পেত সংশ্লিষ্টরা।  আমার আপন বড় কাকা দুটি সংসদ নির্বাচন করেছেন। এ থেকেও নির্বাচনের বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক বেশি ধারণা জন্মেছে। মাকে দেখেছি মানুষের সেবা-যত্ন করতে। বাবা ‘নির্বাচনী খরচ’ চারপাশে বিলাতেন। সৎ হওয়ার পরও তাকে এটি করতে হতো; অনিচ্ছা সত্বেও। এমনও দেখেছি যিনি প্রতিদিন আমাাদের কাছ থেকে নির্বাচনী খরচ নিতেন তিনিই কিনা অন্য প্রার্থীর হয়ে গেছেন ভোটের সকালে।  একটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের সকালে কেন্দ্রে পোস্টার লাগাতে গেছি। পুরো কেন্দ্র পোস্টারে ছেয়ে আছে এর মাঝেই একজন পুলিশ বললেন এখানে পোস্টার লাগানো যাবে না। বালক আমার মেজাজ চরম বিগড়ে উঠল। বললাম সব পোস্টার আগে তুলেন; তারপর না হয় লাগাব না। তিনি অন্য একজনের কাছে আমার পরিচয় জানলেন। পাবিারিক পরিচয় পেয়ে বুঝলেন এ সহজ বালক না।  তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। সবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। গ্রামীণ কিশোর পুলিশ দেখলেই ভয় পাওয়ার কথা। নির্বাচন মানেই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পুলিশ আসবে। সচরাচর ওই সময়টি মানে আশির দশকে গ্রামে পুলিশ মানেই ভয়ের কিছু। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরছি। নির্বাচন মানেই স্কুল বন্ধ। খোলা থাকবে কীভাবে স্কুলই যে কেন্দ্র। তো কাজহীন আমি আর কী করতে পারি? আর এ দিনে অন্য কিছু করাতে অ্যাডভেঞ্চার কই? নির্বাচনই তো বেশি অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়। এই বুঝি মারামারি লেগে গেল। বালকের কাছে মারামারির চেয়ে বেশি অ্যাডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? তো ঘুরছি; এমন সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য আমাকে ডাকলেন। আবারো বলছি আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। পুলিশ ডাকলে ভয়ে দৌড়ে পালানোর কথা। আমি এগিয়ে গেলাম। সঙ্গিরা ভাবলেন এই বুঝি ‘থাবড়া’ খাব। তিনি আমাকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। জানালেন তিনি বাবার ছাত্র। আমাকে আদর করে সত্যিকার বুলেট দেখালেন। আমি শিউড়ে উঠলাম। শেষে বললেন- স্যারকে সালাম দিবা। আমি তোমাদের বাসায় এসে পড়েছি। আমাকে কিছু টাকা দিলেন। আমি তৎক্ষণাত তা দিয়ে লোভনীয় খাবার কিনে ফেললাম। এমন অসংখ্য সুখ-দুঃখের স্মৃতি আছে নির্বাচন নিয়ে।  একটি দুঃখের স্মৃতি বলতে পারি। অজ পাড়াগাঁয়ে যেকোনো একটি নির্বাচনে বাবা গেছেন প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে। ভোট শেষে ব্যালট বক্স নিয়ে ফিরছেন। অল্প পুলিশ ও আনসার সদস্য থাকায় বা তাদের গাফিলতিতে বাবার হাতে ব্যালট বক্সের একটি ছিল। ছাত্র পরিচয় দিয়ে এক যুবক এসে বললেন স্যার এটি আমাকে দিন। আপনি কেন কষ্ট করবেন। বলে রাখা ভালো আমার বাবা এখনো বদ্ধমূল বিশ্বাস নিয়ে আছেন কোনো ছাত্র তার ক্ষতি কোনোকালে করতে পারে না। তার বিশ্বাস ঠিকই আছে। ওই যুবকটি ছাত্রের ভান ধরেছে। ফলাফল বাক্সসহ সে উধাও। এবং বাবাকে নিয়মরক্ষার খাতিরে একরাত থানায় থাকতে হয়েছে। খুব ছোটবেলায় কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝেছি কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। এবং দিনের আলো ফোটায় তিনি বাড়িতে আসলেন। তাকে স্বর্ণ-রূপার পানিতে গোছল করানোর পরে ঘরে ঢুকানো হলো।  আরেকটি ক্ষুদ্র কষ্টের কথা। বাবার ব্যাগে থাকা নির্বাচনের অমোচনীয় কালি হাতে মাখলে উপকার পাব এমনটি জানালেন আপন চাচাত এক বড় ভাই। আমি তাই করলাম। পাঠক বাকি কষ্টটা ধরার চেষ্টা করুন।  এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে বাড়ির বাইরে থাকি। রাজধানীতে থেকে নির্বাচন খুব বেশি টানে না। নির্বাচনে অন্য অনেক নাগরিকের মতো আমারো ঘৃণা জন্মেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বিগত অনেক নির্বাচনে ‘প্রেস কার্ড’ নিয়ে গিয়েছি। যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এ দেশের নির্বাচনের উৎসব আমেজ ফিঁকে হয়ে গেছে। নির্বাচন হয়ে গেছে জোয়ার বোর্ড। তার দেখভাল করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এবং ক্ষমাতাসীন দলের ক্যাডাররা। এসব বলা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইদানিং সাংবাদিক সংগঠনের অনেক নির্বাচনে থেকেছি উপকারি কিছু মানুষ প্রার্থী হওয়ায়। দেখেছি নির্বাচন মানেই একটি দুষ্ট খেলা। বিরুদ্ধ গোষ্ঠী প্রার্থীর গায়ে অপবাদ দিয়ে বেড়ায়। এতে লাভও হয়। আরো দেখেছি সৎ ও যোগ্য হওয়া আর নির্বাচনে জেতা এক জিনিস না। নির্বাচন মানেই ভিন্ন বিষয়। নানাভাবে ভোট জোগার করতে হবে আপনাকে। অর্থ কিংবা পেশির বলে। এবং আরো অনেককিছু থাকতে হবে।  সব মিলিয়ে এ দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না। যেকোনো নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কমিশনও সৎ ও শক্তিশালি না। ফলে উৎসব আমেজ না ছড়িয়ে এ দেশের নির্বাচন তামাশা ও ভয় ছড়ায়। আগেই অনেকে জেনে যায় কী হচ্ছে। তারা উদযাপনও করে ফেলে ভুলে-বেভুলে। কী বলা কিংবা ভাবা যায় নতুন করে? এ যে রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশ। প্রতিটি স্তরের নির্বাচন এমনটি বলে!  লেখক : কবি ও সাংবাদিক।
এতিমদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ, এগিয়ে আসুক দূর্বার তারুণ্য
প্রতি বছর শবেকদরের দিন থেকেই মাদরাসাগুলো ঈদের ছুটিতে বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অভিভাবক এসে তাদের সন্তানদের নিয়ে যান। কিন্তু সেসব মাদরাসায় অবস্থানকারী বেশ সংখ্যক শিশু শিক্ষার্থীকে কেউ নিতে আসে না। এমন সামাজিক পোস্ট বারবার পাঠ করেও আলাদা অনুভূতি জাগেনি আগে। তবে আজই ছুটে গিয়েছিলাম রাজধানীর ভাটারা থানার দুটি এতিমখানা ও মাদরাসায়।  ঈদ ঘিরে এক সপ্তাহের ছুটিতে অনেক শিক্ষার্থী হাসিমুখে বাড়ির পথে মাদরাসা ছাড়ছে। তারই সহপাঠী এতিম শিশুরা ব্যাগ-ব্যাগেজ রিকশা-অটোরিকশায় তুলে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে- বন্ধুর চলে যাওয়া পথের দিকে। মাদরাসার মেইন গেট নামের দরজার চৌকাঠে বসেই আছে ছয় থেকে সাতজন, আজ যেন সবাইকে বিদায় দেওয়াই তাদের দায়িত্ব। সহপাঠী বন্ধুদের আনন্দ উচ্ছ্বাস উপভোগের জন্য স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে নিজেরা আটকে পড়ছে গুমরে কান্নায়। তারা এতিম, তাদের কারও বাবা-মা বেঁচে নেই, তেমন স্বজন-পরিজনও নেই খোঁজ নেওয়ার। সহপাঠী বন্ধুরা ঈদ ছুটিতে চলে যেতেই নিজেদের কষ্ট যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে তারা। কোনো শান্তনায় মনে প্রবোধ মানে না, ভেঙে পড়ে কান্নায়। সারা বছর তারা কাঁদে না, শুধু ঈদ ঘিরেই বাঁধ ভাঙ্গা চোখের পানিতে বুক ভাসে তাদের। এতিম এ শিশুরা জানে কেউ তাদের নিতে আসবে না‌, তাদের যাওয়ারও কোন জায়গা নেই। ঈদ আনন্দের রঙিন উচ্ছ্বাস, শিশুসুলভ হৈচৈ, খেলাধুলা এ শিশুদের ভাগ্যে জোটে না। তাই এই ঈদে আপনার কাছাকাছি কোনো এতিমখানায় যান। বন্ধু-বান্ধব কিংবা নিজ সন্তানদের সঙ্গে নিয়েই যান, খোঁজ নিন এতিম শিশুদের। তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটান, সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করার চেষ্টা করুন। দেখুন, নিজের ঈদ আনন্দ কতটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। আমি নিশ্চিত, অন্যরকম প্রশান্তি পাবেন অন্তরে। লাখ লাখ মানুষ এটুকু করবে তা আশা করার দরকার নেই। এই লেখাটুকু যে বা যারা পাঠ করছেন তারা অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য কোনো না কোনো এতিমখানায় হাজির হই। কেউ না থাকা শিশুদের হাতে বাসায় রান্না করা মাংস ও পায়েস না দিতে পারি,  দুই-চারটা চকলেট, এক খণ্ড কেক তো কিনে দিতে পারব? নাইবা দিলাম কিছু, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর স্নেহের পরশ দেওয়াও কি অসম্ভব? আমার বিশ্বাস, আবু আবিদ এর দূর্বার তারুণ্য যদি ‘এতিমখানায় ঈদ আনন্দ’ শীর্ষক কোনো কার্যক্রম ঘোষণা করে- তা ছড়িয়ে যেতে পারে সারাদেশে। তবে মায়ের কাছে সন্তান মৃত্যুর অনুভূতি জানতে চাওয়ার মতো কোনো টিভি চ্যানেল এতিমখানায় না গেলেও চলবে। ঈদের দিনেও এতিম শিশুদের কাছে তাদের মা-বাবা না থাকার কষ্ট কিংবা আনন্দময় ঈদের স্মৃতি জানতে চেয়ে ব্যুম ধরার দরকার নেই। মমত্ববোধে সদয় না হলে সমস্যা নেই, কিন্তু যন্ত্রণাকাতর এতিমদের প্রতি নির্দয় হবেন না প্লিজ। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক / সম্পাদক, দৈনিক দেশবাংলা