• ঢাকা শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

লেগুনায় পিষ্ট শৈশব

মিথুন চৌধুরী

  ২৮ মার্চ ২০১৭, ১৩:৫২

ওস্তাদ ডাইনে পেলাস্টিক (প্রাইভেট গাড়ি) বলেই লক্করঝক্কর লেগুনার দরজায় ঝুলে ভাড়ার জন্য হাঁক দিচ্ছে রাইসুল। বয়স কতো? ১০ থেকে ১১ বছর হবে। এক হাতে কোনোভাবে লোহার রডে ঝুলে আছে। এই বুঝি ছিটকে পড়লো। কিন্তু তার কোমল হাতে এখন বইয়ের পাতা ওল্টানোর কথা। অথচ ওল্টাচ্ছে জীবন পাতা। শুধু রাইসুল নয়, তার মতো কয়েকশ’ শিশু এভাবে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজধানীতে লেগুনার হেলপারি করছে। যাদের বয়স ৯ থেকে ১৫ বছর।

কয়েক বছর হেলপারি করে গেলো মাসে ফামর্গেট-নিউ মার্কেট রুটে লেগুনার চালক হয়েছে ১৫ বছরের মোহাম্মদ আনোয়ার। মা কাজ করেন বাসাবাড়িতে। বাবা নাই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ৯ বছরে সংসারের অভাব-অনটন দেখে এ পেশায় আসার কথা জানায় সে।

ড্রাইভার হবার পর প্রতিদিন গড়ে ৮-৯শ’ টাকা আয় হয় সাগরের। চালকের সহকারি থাকার সময় যা ছিলো ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা। কয়েকহাজার টাকা খরচ করে ভুয়া লাইসেন্সও বানিয়েছে সে। পুলিশ লাইসেন্সের জন্য ধরে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাগর জানায়, ধরলে মালিককে ফোন দিই। পরে পুলিশ ছাইড়্যা দেয়।

ফার্মগেট থেকে মিরপুরের যাত্রী তুলতে বেশ ব্যস্ত ১০ বছরের সুজন। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখেনি। মা বলেছিল, বিয়ের ক’দিন পর তার বাবা পালিয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে মা অনেক অভাব অনটনে তাকে বড় করে। তাই একটু বড় হয়ে সে হেলপারির খাতায় নাম লেখায়। এখন ফার্মগেট-মিরপুর ২ রুটে ১০ থেকে ১৪ ট্রিপ ডিউটি করে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা দৈনিক আয় করে।

গুলিস্তান-হাজারীবাগ রুটে লেগুনা চালকের সহকারি ৯ বছরের সুমন জানায়, শিশু শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সে এ কাজে চলে এসেছে। বাবা-মা অনেক বললেও আর স্কুলে পাঠাতে পারেনি।

যখন-তখন কাজ করার স্বাধীনতা, ছোট বয়সে ‘অল্প কষ্টে’ হাতে কিছু টাকা পাওয়ায় শিশুরা এ পেশায় ঝুঁকছে। এমনটাই মনে করে লেগুনা ড্রাইভার সানোয়ার। সে ৮ বছর ধরে বিভিন্ন রুটে লেগুনা চালিয়েছে। এপ্রিল থেকে বাস চালাবে বলে জানায় সানোয়ার।

রাজধানীতে লেগুনার প্রায় সব রুটেই বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করতে দেখা যায় শিশুদের। দৈনিক ভিত্তিতে বেলা শেষে মাইনে হিসেবে পায় ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। শিশু শ্রমিকদের কেউ অভাবের টানে, কেউবা আবার ইচ্ছা করেই লেগুনা চালকের সহকারির পেশায় এসেছে। যা চালকের আসনে পৌঁছাতে পারলে ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা দাঁড়ায়।

মূলত চালকের আসন ঘিরে থাকে শিশু হেলপারদের স্বপ্ন। তাই কাজের ফাঁকে লেগুনা সিরিয়াল করা। সুযোগ বুঝে চালানোর চেষ্টা করে তারা। তবে অদক্ষ হয়ে চালকের আসনে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ট্রিপ মারার আশায় প্রতিনিয়ত বেপরোয়া হয়ে রাজধানীতে লেগুনা চালায় তারা।

বিআরটিএ’র কাছে লেগুনা বা হিউম্যান হলারের কোনো হিসাব ও নীতিমালা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ৬৮ রুটে লেগুনা চলছে প্রায় ৬ হাজার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীর ১৫টি রুটে লেগুনা চালকের ৩৫ শতাংশই শিশু। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৮ এর মধ্যে। যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, পোস্তগোলা, জুরাইন, গুলিস্তান, মাতুয়াইল রোডে নিয়মিত লেগুনা চালাচ্ছে এসব শিশু। এছাড়া গুলিস্তান থেকে কেরানীগঞ্জ, আজিমপুর, খিলগাঁও রোডেও নিয়মিত লেগুনা চালাচ্ছে তারা।

বিভিন্ন সময় চালকদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিলেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে তারা মুক্ত হয়ে ফিরে আসে চালকের আসনে।

২০০৬ সালের শ্রম আইনানুযায়ী, কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে শিশু নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেয়া যাবে না। ২০১৩ সালের শিশু আইনে শিশুর নতুন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয় ১৮ বছর। ওই বয়স পর্যন্ত কাজে জড়ানোর আইনি বৈধতা নেই। তবে সুনির্দিষ্টভাবে লেগুনা বা টেম্পোতে কতো শিশু শ্রমিক কাজ করে তার হিসেব পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাকডাকা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এখানে তারা কাজ করে। যেটা কোনো আইনের মধ্যে পড়ে না। এ অবস্থায় কাজ করা বড়দের জন্যও বৈধ নয়। শিশু আইন ও শ্রম আইনে অনেক উপায় বলা আছে। আইন প্রয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার। আইনের কঠোর প্রয়োগ করে পুলিশ চাইলে একদিনেই বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করলে ১০ থেকে ২০ হাজার শিশুশ্রমিক যাবে কোথায়? এ কারণে পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেয়া উচিত। সেখানে সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞানের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে পরবর্তী জীবনের জন্য তারা তৈরি হয়।

এমসি/ডিএইচ/এমকে

মন্তব্য করুন

daraz
  • এক্সক্লুসিভ এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh