• ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
logo

৪৬ বছরের বিড়ম্বনা ঘুচলো ৬ বীরাঙ্গনার

জামালপুর প্রতিনিধি

  ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৮

জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার ছয় নারীকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। রাষ্ট্রীয় এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ৬ বীরাঙ্গনার ৪৬ বছরের বিড়ম্বনা ঘুচলো।

সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৪৪তম সভায় পাক সেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার ১৬ জন নারীকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাওয়া ১৬ জন নারীর মধ্যে ইসলামপুরের এই ছয় নারী রয়েছেন।

প্রায় ৪৬ বছর ধরে গৃহহীন অবস্থায় চরম লাঞ্ছনা, অবহেলা আর অভাবে কোনো রকমে বেঁচে ছিলেন এই নারীরা। দীর্ঘদিন পর হলেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাওয়ায় নির্যাতিতরা এখন সমাজে মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।

ইসলামপুরের কুলাকান্দি গ্রামের ছকিনা বেগম। যুদ্ধের সময় বাড়িতে হানা দিয়ে স্বামী সামাদ খানকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাক সেনারা। সঙ্গে নিযে যায় ছকিনাকেও। গ্রামের একটি স্কুলে নিয়ে সামাদ খানকে গুলি করে হত্যার পর পাশের একটি জঙ্গলে নিয়ে ছকিনার ওপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি সেনারা। পরের দিন সকালে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে তার ভাই। সেদিন ছকিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও ৪৬ বছর ধরে স্বামী আর সন্তানহীন অবস্থায় মানুষের অবহেলা, লাঞ্ছনা আর দু’মুখো ভাতের আশায় বাড়ি বাড়ি কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছেন তিনি। দুর্বিষহ স্মৃতি মনে হলে এখনও ভয়ে শরীর শিউরে উঠে ছকিনা বেগমের।

ছকিনা বেগম জানান, যুদ্ধের সময় কুলকান্দি গ্রামে এক দিনেই এলাকার ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মধ্যে স্বামী সামাদ খানও ছিল।

সামাদ খানকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার ৪০ দিন আগে ছকিনা বেগম সন্তান প্রসব করেছিল। এই অস্থাতেও তাকে নির্যাতন থেকে রেহায় দেয়া হয়নি। নির্যাতনের শিকার হওয়ার কিছুদিন পর শিশু সন্তানও মারা যায়। তিনি বলেন, স্বামী সামাদ খানকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে হত্যা করলেও আজ পর্যন্ত শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়নি।

শুধু ছকিনা বেগমই না, ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়নের চিনারচর গ্রামের মো. ভোলা শেখের স্ত্রী মোছা. রঙ্গমালা খাতুন, ওই গ্রামের মাহফুজুল হকের স্ত্রী সামছুন্নাহার বেগম, কুলকান্দি ইউনিয়নের কুলকান্দি গ্রামের জসিজলের স্ত্রী রাবেয়া বেগম, আ. রহিমের মেয়ে শেফালী বেগম এবং পৌর এলাকার পলবান্ধা গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী সখিনা বেগম পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

চিনারচর গ্রামের সামছুন্নাহার বেগম বলেন, যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতাম। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দেয়ার সময় বাঙালিরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। এসময় আমাকে ঝগড়ারচর ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে এবং অমানুষিক নির্যাতন চালায়। যখন আমি মৃত্যু শয্যায় ঠিক সেই সময় আমাকে ছেড়ে দেয়। তার কয়েকদিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হলেও এতটা বছর ধরে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

একই গ্রামের রঙ্গমালা খাতুন বলেন, যুদ্ধের কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়। নববধূ থাকা অবস্থায় ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই পাকবাহিনী আমাকে ধরে নিয়ে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের শিকার হতে হতে এক সময় কৌশলে আমি সেই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোক আমাকে আর ঘরে উঠতে দেয় নাই।

একই অবস্থা বীরাঙ্গনা রাবেয়ার। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে আমাকে আটকে রেখে দিনের পর দিন আলবদর, রাজাকাররা আমার প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করেছে। সেই কথা মনে হলে এখনও শরীর শিউরে উঠে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মানুষজন আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানা অবজ্ঞা আর লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। এতো কিছুর পরও অনেক যন্ত্রণা নিয়ে আজো বেঁচে আছি।

ইসলামপুর পৌর এলাকার পলবান্ধা গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী সখিনা বেগম জানান, যুদ্ধের সময় আমার বয়স অনেক কম ছিল। সেই সময় স্থানীয় রাজাকাররা বাড়ি থেকে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে সিরাজাবাদ ক্যাম্পে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। প্রায় ছয় মাস ধরে আমার উপর নির্যাতন হয়েছে। পরে মুক্তিযোদ্ধা জালাল কোম্পানি আমারে সেই নরক থেকে উদ্ধার করে। সেই সময়ের প্রতিটা দিন আমার জন্য জাহান্নামে থাকার মতো মনে হয়েছে। স্বাধীন দেশেও প্রতিনিয়ত অবজ্ঞার শিকার হয়েছি।

বীরাঙ্গনা শেফালী বেগম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বিয়ের কথা চলছিল। এসময় বদরদের সহযোগিতায় হঠাৎ বাড়িতে পাকবাহিনীরা এসে আমার বাবা নুরু খানকে বেঁধে নিয়ে যায়। এ সময় অন্যরা আমাকে আমার বাড়িতেই শারীরিক নির্যাতন করে।

ইসলামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মানিকুল ইসলাম মানিক বলেন, দীর্ঘ ৪৬ বছর পর হলেও ইসলামপুরের ৬ নারীকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়ায় সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এই এলাকায় আরও নির্যাতিত নারী রয়েছে। তাদেরও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ ফরিদুল হক খান দুলাল বলেন, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ স্বাধীন হয়েছে, তেমন ৬ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রমাণ হলো তাদের ত্যাগ বৃথা যায়নি। ইসলামপুরের ৬ বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দেয়ায় আমি গর্বিত। তারা আমাদের গর্বিত জননী। এখন থেকে এই বীর মায়েরা সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবেন।

পি/

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh