• ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
logo

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করার উপায় কী?

সরোয়ার আমিন বাবু ও মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান, চট্টগ্রাম

  ২১ জুলাই ২০১৭, ১৭:৩৭

গেলো দুই দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার নাম ‘জলাবদ্ধতা’। শত শত কোটি টাকা খরচ করে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও জলাবদ্ধতার এই সংকট কমেনি, বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।

আর সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। আর জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব যাদের ওপর সেই চসিক, ওয়াসা, সিডিএ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডও যেন কোনো কূল কিনারা করতে পারছেনা।

তাহলে কি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়? এমন প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছে আরটিভি অনলাইন।

সেখান থেকে যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে সেটি হল বিশেষজ্ঞ মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে ‘দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি নির্ভুল মাস্টারপ্ল্যান’ তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা। আর এটি করা হলে শুধু জলাবদ্ধতা নয় যানজটসহ অন্যান্য যেসব সমস্যা রয়েছে বর্তমানে চট্টগ্রামে তাও স্থায়ীভাবে নিরসন করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবশ্য চট্টগ্রামের একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘সানমার’ অনেক আগে থেকেই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে তাদের কাজের একটি নিজস্ব প্যাটার্ন বা একটি সফল মডেল দাড় করাতে পেরেছে। আর এর স্বীকৃতি স্বরূপ চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লুতে এ বছর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামে আবাসন খাতে তাদের সার্বিক অবদানের জন্য রিহ্যাবের পক্ষ থেকে স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছে।

সানমারের প্রধান প্রকৌশলী এমডি এ এস এম মইন আরটিভি অনলাইনকে জানান, আমাদের কোম্পানিটির দেশি এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান আছে। আমরা যেসব স্থাপনা তৈরি করি তার তার অ্যাসথেটিক ডিজাইন করা হয় ইংল্যান্ডে এবং স্ট্যাকচারাল ডিজাইন করা হয় দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে। ফলে ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ এবং দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে এই সমন্বয়ের ফলে চট্টগ্রামেই সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি মানসম্পন্ন স্থাপনা আমরা তৈরি করতে পারছি। আমরা যখন কোনো প্রজেক্ট শুরু করি তা বাস্তবায়নের জন্য যেমন একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকে তেমনি এটি শুরু করার পর একটি মাস্টার প্রোগ্রামও থাকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বা সিডিএ চাইলে জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে আমাদের কাজের এই প্যাটার্নটি বা মডেলটি অনুসরণ করতে পারে।

এই প্রকৌশলী আরো বলছেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ করা প্রয়োজন। যারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মনিটরিং করবে। পাশাপাশি প্রত্যেকটি উইংকে সফলভাবে কাজ করতে হবে। আমার মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে বেশ কয়েকবছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে দেখেছি তাদের নগরের জন্য একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান আছে এবং প্রত্যেকটি কাজ করা হয় সেই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী। অথচ চট্টগ্রামে এধরনের কোন সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান নেই। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যদি একটি মাস্টাপ্ল্যান করে কাজ করা হত, তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হত না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম আরটিভি অনলাইনকে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাসহ যেসব সমস্যা বর্তমানে রয়েছে তা সমাধানের জন্য দেশি এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। ধরেন, বর্তমানে সি লেভেলর হাইট (সমুদ্রের উচ্চতা) বাড়ছে, যার প্রভাব চট্টগ্রামের ড্রেনেজ সিস্টেমের ওপর পড়ছে। ফলে এ ধরনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এখনো আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই জলাবদ্ধতা বা যানজটের মত বিষয়গুলো সমাধানের ব্যাপারে যেসব দেশের বিশেষজ্ঞরা সফল হয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে যুক্ত করতে হবে বা তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হবে।

সাবেক এই উপাচার্য আরো বলছেন, সিডিএ ১৯৯৫ সালে যে মাস্টারপ্ল্যান করেছিল তার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। আর সেটিও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরই মধ্যে চসিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তাতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, ভুল ছিল সেকারণেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সঠিক মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে সেটি বাস্তবায়ন করতে পারলে সমস্যার সমাধান মিলবে। এটি করা গেলে সরকার বা অথরিটি পরিবর্তন হলেও কাজের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না এবং সব ধরনের বিতর্কেরও অবসান হবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া আরটিভি অনলাইনকে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে চসিক এবং সিডিএকে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ যারা এসব বিষয়ে এক্সপার্ট, তাদের পরামর্শ নিয়েই কাজ করতে হবে।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমরা পরিকল্পিত চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে শিগগিরই নেদারল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছি। সেখানকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, তাদেরকে কোনো ধরনের কনসাল্টেন্সি ফিও দিতে হবেনা। চসিক বা সিডিএ চাইলে খুব সহজেই এসব বিদেশি অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের তাদের কাজের সাথে যুক্ত করতে পারে। সিডিএ বা চসিক ওইসব বিদেশি কনসালট্যান্টদের সহায়তা নিতে চাইলে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা আমরা দেবো।

এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরো বলছেন, সিডিএ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য সম্প্রতি একনেকে যে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাঠিয়েছে তাতে দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত না করলে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ আমরা দেখেছি বিশেষজ্ঞ মতকে উপেক্ষা করে চসিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর আগে শত শত কোটি টাকা খরচ করেছে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করতে। কিন্তু অবস্থার তো উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। আর পুরো টাকাটাই অপচয় হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা আরটিভি অনলাইনকে জানান, যারা চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেদারল্যান্ডসহ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলছেন তার সাথে আমি একমত নই। কারণ সেখানকার জলাবদ্ধতার সমস্যা এবং আমাদের জলাবদ্ধতার সমস্যা এক নয়। আমাদের এই জলাবদ্ধতার সমস্যা আমাদের বিশেষজ্ঞদের দিয়েই সমাধান করতে হবে।

তবে দেশীয় বিশেষজ্ঞরাই সিটি করপোরেশনের এই মতের সাথে একমত নন। তারা বরং বলছেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর করতে চাইলে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ের মাধমেই তা করতে হবে।

জেবি/এসজে

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh