• ঢাকা রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
logo

এক টাকায় ক্ষুধার রাজ্য জয়

সরোয়ার আমিন বাবু ও মো. শাহীনুজ্জামান,চট্টগ্রাম

  ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:০১

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮০ কোটি মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে ঘুমাতে যায়। এই ক্ষুধার্ত মানুষদের আবার বিশাল একটি অংশ শিশু। ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্ষুধার রাজ্য জয় করতে পেরু প্রবাসী এক ব্যক্তি শুরু করেন ‘এক টাকায় আহার’ নামে একটি প্রকল্প। গেলো বছর চট্টগ্রাম থেকে শুরু হওয়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি নিয়মিতভাবে চলছে। ক্ষুধার্ত শিশুদের ক্ষুধা মেটাতে কাজ করে যাচ্ছে।

ইমন (১০), শরীফ (৯) এবং সোহেল (১০) তারা তিন বন্ধু চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেটের কর্ণফুলী মার্কেটে কাজ করে। এখানে যারা বাজার করতে আসে তাদের বাজারের ব্যাগ রিকশায় বা গাড়িতে পৌঁছে দেয়। ক্রেতারা খুশি হয়ে যা দেয়, সেটাই তাদের আয়। দুপুর দুইটার আগে এই তিন বন্ধু ষোল শহর রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে এক টাকার বিনিময়ে দুপুরের খাবার কিনতে। আরটিভি অনলাইনকে তারা জানায়, ‘ভাইয়ারা, আপুরা প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসে আমাদের জন্য। খাওয়া শেষ হলে আবার কাজে চলে যাই। এক টাকায় অনেক ভালো খাবার পাওয়া যায়।’ ষোল শহর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, খাবারের ভ্যান আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এক টাকা নিয়ে ভিড় জমিয়েছে খাবার কিনতে।

সালমা (৭), পারুল (৬), কুলসুম (১২) এরা পাশের বস্তিতে থাকে। তারাও প্রতিদিন আসে এক টাকার বিনিময়ে খাবার কিনতে। তাদের চোখে মুখে ফুটে সন্তুষ্টির ছাপ। মো. সাগর (১২) ষোল শহর স্টেশন এবং আশপাশের এলাকায় খবরের কাগজ বিক্রি করে। সে জানায়, হোটেলে খেতে গেলে এক বেলায় ৩০ টাকা লাগে। এখানে খেলে তার প্রতিদিন ২৯ টাকা বেঁচে যায়। তার বাবা নেই, এই বাড়তি টাকাটা সে তার মাকে দিতে পারে। ৪ বছরের সাকিবও এখানকার নিয়মিত ক্রেতা। তাকে অবশ্য খাইয়ে দিতে হয়।

খাবারের মেন্যুতে থাকে শনিবার ভাত-ভর্তা-ডাল, রোববার ডিম-খিচুড়ি, সোমবার ভাত-মুরগী গিলা কলিজা, মঙ্গলবার ডিম খিচুড়ি, বুধবার ভাত-ভর্তা-ডাল, বৃহস্পতিবার সবজি খিচুড়ি এবং শুক্রবার ডিম-পোলাও। তবে কারো সহায়তায় যখন বিশেষ মেন্যু হিসেবে যখন মোরগ পোলাও থাকে তখন তাদের আর আনন্দের সীমা থাকে না।

মূলত ২০১৬ সালের ১৫ মে চট্টগ্রামের এই ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘এক টাকায় আহার’ নামে এই প্রজেক্টটি চালু হয়েছিল ছিন্নমূল এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের জন্য। এর উদ্যোক্তা বর্তমানে ল্যাটিন আমেরিকার পেরু প্রবাসী কিশোর কুমার দাশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, রাজবাড়ি, রাজশাহী, রংপুর এবং ময়মনসিংহে এই প্রজেক্টটির মাধ্যম প্রায় দেড় হাজার পথশিশুদের মাঝে খাবার বিক্রি করা হয়। এইসব শিশুরা যাতে ভিক্ষাবৃত্তিতে অভ্যস্ত না হয় এবং তাদের আত্মসম্মানবোধও যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য তাদের কাছ থেকে এক টাকা নেয়া হয়। যাতে তারা ভাবে যে তারা খাবার কিনে খাচ্ছে।

শুরুর পর থেকে এই প্রকল্পটি এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। এমনকি ঈদের দিনও চলে এই খাবার বিতরণ। চট্টগ্রামে ২ নম্বর গেইটের নুরুল আলম মাস্টার লেনের ১১৭ নম্বর বাড়িতে চলছে বিদ্যানন্দের এ কার্যক্রম। বিদ্যানন্দের ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কেউ যুক্ত হতে পারবেন এ কার্যক্রমের সঙ্গে। আসছে মে মাস থেকে শুরু হওয়া পবিত্র রমজান মাসে চট্টগ্রামে ৫০ হাজার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করার পরিকল্পনাও আছে বিদ্যানন্দের।

চট্টগ্রামে বিদ্যানন্দের সমন্বয়কদের একজন আলাউদ্দীন। তিনি আরটিভি অনলাইনকে জানান, এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার ছিলেন খুবই সাধারণ পরিবারের। ঠিকমতো খাবার পেতেন না তিনি। বিভিন্ন মন্দিরে যেতেন খাবারের আশায়। কখনো পেতেন, আবার কখনো খাবার না পেয়ে খালি পেটেই ফিরে আসতেন। তখন থেকেই তারা প্রতিজ্ঞা ছিল এইসব ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কিছু একটা করার। তার সেই ভাবনা থেকেই আজকের এই ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্প। শুরুতে শুধুমাত্র কিশোর কুমারের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্পটি চললেও এখন অনেকেই এই প্রকল্পের সঙ্গে সানন্দে যুক্ত হয়েছেন।

সমন্বয়কদের আরেকজন হামিদুর রহমান (হামিদ) জানালেন, প্রতিদিন নগরীর দুই থেকে তিনটি স্পটে ১৫০ থেকে ২০০ জনের খাবার বিক্রি করা হয়। ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন, তুলাতলী বস্তি, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, তালতলাসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবার বিক্রি করা হয়। সঙ্গে এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের চুল এবং নখও কেটে দেয়া হয়। চট্টগ্রামে তাদের প্রায় ৫০ জন নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবক, ৪০ থেকে ৪৫ জন অনিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবক এবং ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি আছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের ৮ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী উম্মে রাখাইন আরটিভি অনলাইনকে জানান, বিদ্যানন্দের কাছ থেকে বছরে ৩০ হাজার টাকা বৃত্তি পান তিনি। তার মতে বিদ্যানন্দের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো সাদা মনের। এখানকার বাচ্চদের আমি পড়াই, পাশাপাশি খাবার বিতরণ করতে যাই। ওদের হাত ধুইয়ে দেই, কখনো নিজ হাতে খাইয়ে দেই। সেসময় যে উপলব্ধি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

স্বেচ্ছাসেবক শাহীনউদ্দীন জানাল, এইসব শিশুদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অসাধারণ বলতে পারেন। আর প্রত্যেকটা ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানোর অনুভূতিটাই আলাদা।

বিদ্যানন্দের কর্মীদের পরিশ্রম এবং বিনিয়োগ এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অনিশ্চিত চলার পথকে কিছুটা হলেও মসৃণ করছে। তবে হামিদ জানায়, খাবার শেষ হয়ে গেলে এসব শিশুদের অনেকেই খালি পেটে ফিরে যায়। তখন খুবই খারাপ লাগে। এ সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো প্রতিদিন ১ লাখ লোকের মাঝে এই এক টাকার বিনিময়ে খাবার বিতরণ করা।

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh