• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

দেশের প্রথম রেলস্টেশন কী বিলুপ্ত হয়ে যাবে? (ভিডিও)

শেখ হাসান বেলাল, কুষ্টিয়া

  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:৫৮
দেশের প্রথম রেলস্টেশন কী বিলুপ্তি হয়ে যাবে?
দেশের প্রথম রেলস্টেশন

কুষ্টিয়ার জগতি। বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ১৫৮ বছর বয়সী রেল স্টেশনটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ রেলস্টেশনে দু’টি লোকাল ট্রেন ছাড়া আর কোনও ট্রেন থামে না।

যে স্টেশন জুড়ে থাকতে মানুষের ব্যস্ততা, জ্বলেছে চকচকে আলো, সেখানে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ। পরিত্যক্ত দ্বিতল ভবনটি এক সময়ের বিখ্যাত জগতি রেলস্টেশন। ভবনে ফাটল ধরায় উপর তলাতে যাওয়া নিষেধ। ভেঙে পড়েছে ওয়েটিং রুম আর ক্ষয়ে গেছে প্ল্যাটফর্ম। ১৯৮৪ সালেও যেখানে ২৬ জন কর্মকর্তা ছিল এখন সেখানে এখন মাত্র একজন কর্মকর্তা পাহারা দিয়ে রেখেছেন স্টেশনটি।

জগতি রেলস্টেশন দেখাশোনার জন্য দায়িত্বে নিয়েজিত পিম্যান বিল্লাল হোসেন বলেন, আমি এখানে সাত বছর আছি। এই সাত বছর আগেও এখানে ছয়জন স্টাফ ছিলাম। এখন শুধুমাত্র আমি স্টেশনটি পাহারা দিয়ে রেখেছি। স্টেশনের পাশ দিয়ে একটি রেল গেট রয়েছে মাঝে মাঝে সেটিও আমাকে দেখতে হয়। ট্রেন আসলে আমি ঘণ্টা দেব, নাকি রেল গেট ফেলবো, একা এসব করা যায় না। তারপর সন্ধ্যা হলে এখানে কুকুর বিড়ালও আসে না, বিদ্যুৎ নেই, হারিকেনে তেল থাকে না, মাঝে মাঝে অন্ধকারে থাকি। সন্ধ্যার পরে ভূতুড়ে পরিবেশ হয়। এ সময় নেশাখোররা এসে এটা ওটা চুরি করে নিয়ে যায়। বাথরুম নেই, গোসলখানা নেই, এভাবে এখানে থাকা যায় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বললে তারা বলেন, ইচ্ছে হলে চাকরি করেন না হলে না করেন। বৃদ্ধ বয়সে পেটের দায়ে চাকরি করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, এখন সারাদিনে মেইল ও স্যাটল ট্রেন দুইবার করে থামে।

এর আগে বিল্লাল হোসেন ‘৮৪ সালে এখানে চাকরি করে গেছেন। তিনি বলেন, সেই সময়ে ২৬ জন স্টাফ ছিল। তখন ঈগল পাখির পাখার মতো দেখতে সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি এখানে ঢোকা ও বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ হতো। টিকিট কাউন্টার ছিল, সেইসব কিছুই নেই। সেইসব যন্ত্রাংশ কিছুই নেই। আরো কিছু আছে যা পড়ে থেকে থেকে নষ্টের খাতায় চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি সেই সময়ে ব্রডগেজ রেলপথ ধরে রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে একটি ট্রেন এসে থেমেছিল কুষ্টিয়ার এই জগতি রেলস্টেশনে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এই জগতিতে রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। পরবর্তীতে এখানে ‘কুষ্টিয়া চিনিকল’ প্রতিষ্ঠিত হলে আখ সরবরাহ ও অর্থনৈতিক কাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই রেলস্টেশন।

গেল ৩০ বছর ধরে রেল স্টেশনে চায়ের দোকান দিয়ে বসে আছেন ফিরোজ আলী। তিনি বলেন, জগতি হেভি স্টেশন, ছোট বেলায় মানুষের আর রেল গাড়ির ভিড়ে এখানে আসা যেত না। রেল গাড়ির নিচ দিয়ে এখানে আসতাম। স্টেশন তারকাটা দিয়ে ঘেরা থাকতো, আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। স্টেশনে লোকজন বোঝাই থাকতো। মানুষের ভিড়ে অনেক সময় ট্রেনে উঠাই যেত না। এখন স্টেশনে কিছুই নেই। স্টেশনটি ভালো হলে শুধু আমাদের নয়, সবারই ভালো হবে। সরকারের আয় বাড়বে, এ এলাকারও উন্নয়ন হবে।

এলাকাবাসী বজলুর রশিদ বলেন, এই সেদিনের কথা তখনও দু’টি ইন্টারসিটি রেল গাড়ি এখানে দাঁড়াত। ডাবল রেল লাইন ছিল। এখন আর ইন্টারসিটি দাঁড়ায় না, ডাবল লাইন উঠে গিয়ে এখন সিঙ্গেল লাইন হয়েছে। যাত্রীদের অসুবিধে হয়। কখন কোন রেলগাড়ি দাঁড়ায় আমরা টেরও পাই না। এ জন্য যাত্রীও কমে গেছে। তিনি বলেন, দেশের প্রথম রেল স্টেশন এটি কিন্তু এ পর্যন্ত এর গায়ে হাত দেয়া হয়নি (উন্নয়ন কাজ হয়নি)। বাথরুম, গোসলখানা থেকে শুরু করে এখানে সবই ছিল। আস্তে আস্তে এগুলোর কিছুই এখন নেই। ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলের দৃষ্টিনন্দন বিল্ডিংও পরিত্যক্ত হয়েছে। যেকোনো সময় এটি ভেঙে পড়তে পারে।

বয়সে প্রবীণ আফতাব উদ্দিন বলেন, জগতি খুব বড় স্টেশন ছিল। এরকম দোতালা স্টেশন আমার জানামতে আর নেই। এর সবই নষ্ট হয়ে গেল। বহু বছর হলো বৃট্রিশ আমলে তৈরি বিল্ডিংটিতে কেউ যায়নি। ভেতরে গাছ জন্মেছে। ওয়াল ফেটে ভেঙে গেছে। মানুষ এখন এখানে ১০ মিনিট বসবে সেই জায়গাও নেই। মাঝে পাথরের দিতে রেল গাড়ি এসে দাঁড়ায়। পাথরওলারা যেটুকু জায়গা রয়েছে সেটিও দখল করে রেখেছে।

তিনি বলেন, আমরা দেখছি দেশের সব স্টেশনে কাজ হচ্ছে বা হয়েছে তবে, দেশের প্রথম এই রেল স্টেশনের কাজ কেন হয় না, কেন এখানে ইন্টারসিটি দাঁড়াবে না? এর ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, অন্যকোন দেশ হলে ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই জগতি রেলস্টেশনকে ঐতিহাসিক স্থানে রূপ দিত। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এখানে ট্রেন না থামা, শহর গড়ে না ওঠা, সড়ক পরিবহনের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চক্রান্তের ফলে গুরুত্ব হারিয়েছে দেশের প্রথম রেলস্টেশনটি। যে কারণে এটি উন্নয়ন বঞ্চিত।

বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. আমানুর আমান বলেন, কেন এই স্টেশনের কাজ হয়নি, মূলত এটি আমাদের একটি যন্ত্রণার কারণ। অন্যান্য দেশ হলে এই জগতি রেল স্টেশনটি হতো বিশ্ব হেরিটেজের অংশ। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি। দেশের প্রথম রেল স্টেশন হিসেবে এটির আরও উন্নয়ন করা দরকার ছিল। কিন্তু কোনও সরকারই এটি করেনি। এর ফলে রেলের ইতিহাসই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটিকে হেরিটেজের অংশ করা উচিত ছিল।

ড. আমানুর আমান জগতি রেল স্টেশনের গুরুত্ব হারানোর পেছনে সরকারের উদ্যোগ না দেয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, সেই সময়ে এটির উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হলে কুষ্টিয়া শহরটিই হয়তো জগতি কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো।

তিনি আরও বলেন, এখনও সময় আছে আমি মনে করি সদাশয় বর্তমান সরকার সেই উদ্যোগ নেবেন।

এসব বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে জগতি রেলস্টেশনের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে জায়গা দখলমুক্ত করা হবে এবং স্টেশনটি আধুনিকায়ন করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হবে।

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh