• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
logo

মরদেহ বহন করাই যার কাজ

আরিফুল হক সোহাগ, নওগাঁ

  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:৪৬

নওগাঁর রাণীনগরের মইন আলীর পেশা মরদেহ বহন করা। অভাব-অনাটনের সংসারে অনেক কষ্ট করেই কিনেছেন একটি ভটভটি। প্রায় ২/৩ বছর ধরে ভটভটি দিয়ে সড়কে যাত্রী বহনের কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ এক দিন তার গ্রামের একটি লোকের অর্ধগলিত মরদেহ তার গাড়িতে বাধ্য হয়ে বহন করতে হয়। ওই মরদেহ বহনের পর মনের ভেতর জেগে যায় ধর্মীয় অনুভূতি, নামাজ পড়তে শুরু করলেন, মুখেও দাড়ি রাখলেন মইন আলী। তখন তার মাথায় চিন্তা আসে যে, সবাই তো যাত্রী বহন করে, মরদেহ বহন করার লোক পাওয়া যায় না।

মরদেহ নিয়ে পরিবারের লোকজনদেরও থানা পুলিশদের নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পচন ধরা অর্ধগলিত মরদেহ গাড়িতে বহন করতে চায় না কেউ। ঠিক তখনই অর্থাৎ গত প্রায় ১৪ বছর আগে মইন আলী সিদ্ধান্ত নেয় তিনি শুধুমাত্র মরদেহ বহন করবেন। তিনি থানা পুলিশকে বলেন, ‘স্যার মরদেহ নিয়ে আপনাদের আর কোনও সমস্যায় পড়তে হবে না! আমাকে খবর দিবেন, আমি লাশ বহনের জন্য চলে আসবো।’

সেই থেকে রাণীনগর উপজেলায় ব্যক্তি পর্যায় ও থানা পুলিশের পক্ষ থেকে মরদেহ বহনের কাজটি মইন আলীকে দিয়েই চলছে। এপর্যন্ত তিনি প্রায় ১১০ টি মরদেহ বহন করেছেন।

অজ্ঞাত পচন ধরা বা ভাসমান দুর্গন্ধ হওয়া মরদেহ, রেল ও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া, হত্যা-আত্মহত্যাসহ সব ধরণের মরদেহ কাপড় বা চাটায় দিয়ে মোড়ানো ও বহনের ক্ষেত্রে মইন আলীই যথেষ্ট।

ঘটনাস্থল থেকে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেয়া থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত মরদেহ দায়িত্বে থাকতে হয় মইন আলীকে। মরদেহ নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য কাজ করতে মন চায় না মইনের। মরদেহ বহন করতে পাড়লেই যেন তার মনে তৃপ্তি আসে। মরদেহ বহনের জন্য তিনি নিজেই তৈরি করেছেন সাদা পোশাক। ঘটনাস্থল যত দূরে ভাড়াটাও তত বেশি পান মইন। পচনশীল লাশের ক্ষেত্রেও ভাড়াটা একটু বেশি হয়।

একটি মরদেহ নিয়ে আসা বা নিয়ে যাওয়ায় প্রায় দেড় থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া পান এই লাশ বাহক। এছাড়াও বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে মরদেহ বহনের মাধ্যমে এক রকম সহযোগিতাও করেন তিনি। এতে বিপদগ্রস্ত পরিবারের লোকজন তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বলে জানান মইন আলী।

তিনি আরও জানান, সব সময় মরদেহ বহনের কাজ হয় না। মাসে দু’একটি করে মরদেহ আনা নেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। তাই অন্য সময় আমার গাড়ি দিয়ে যাত্রী বহন করতে গেলে মরদেহের গাড়ি বলে গাড়িতে কেউ উঠতে চায় না। তবে শতাধিক মরদেহ বহন করাটা তার জীবনের বড় সফলতা অর্জন বলে মনে করেন তিনি।

রাণীনগর উপজেলা সদরের সিম্বা গ্রামের মৃত আশরাব আলী মণ্ডলের ছোট ছেলে মইন আলী (৩৫)। বাবার মৃত্যুর পর চার ভাই-বোনের সংসার ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠা মইন আলী কিছুদিন পর বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেন। বছর কয়েক পর মইন আলীর অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম নেয় এক মেয়ে। পরে জন্ম নেয় আরেক ছেলের। ভটভটি চালিয়ে মেয়েকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা-পড়া করিয়েছেন। ছেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। অভাবের সংসারে বেশি দূর পর্যন্ত লেখা-পড়ার খরচ ব্যয় করা অসম্ভব। তাই বড় মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

কয়েক বছর পর মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মইন কিন্তু বিয়ের খরচ বাবদ কোনও টাকা-পয়সা তার কাছে নেই, তাই টাকার প্রয়োজনে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দেড় শতক ভিটে-মাটি বড় ভাইদের কাছে বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি করা বসত ঘর ছেড়ে দিতে হয় তাদের। কোথায় থাকবে? কি করবে? এমন দুঃসময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলমের ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম চাঁদের শরণাপন্ন হলে তিনি এলাকার ঝিনা গ্রামের পার্শ্বে গড়ে উঠা গুচ্ছগ্রামে তাকে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মইন আলী ওই গুচ্ছ গ্রামেই বসবাস করছেন।

উপজেলার সিম্বা গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইদুল ইসলাম ফকির আরটিভি অনলাইনকে জানান, মইন আলী আমার গ্রামের ছেলে। তিনি ১৫/১৬ বছর আগে একটি ভটভটি কিনে এই এলাকায় যাত্রী বহনের কাজ করত, বছর কয়েক পর যাত্রী বহন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মরদেহ বহনের কাজ শুরু করেন। তবে আমার জানা মতে, এই কাজ করে তিনি ভালই উপার্জন করেন।

রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ এএসএম সিদ্দিকুর রহমান আরটিভি অনলাইনকে জানান, আমি এই থানায় আসার পর থেকেই দেখছি মরদেহ বহনের কাজ মইন আলীই করছে। শুনেছি তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। থানায় মইনের মোবাইল নাম্বার রাখা আছে। যখন প্রয়োজন পড়ে তখন মইনকে ফোন করে ডেকে নেয়া হয়।

এসএস

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh