• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

ঢাকা ওয়াসায় বেড়েছে স্বচ্ছতা, কমেছে ভোগান্তি

  ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ২১:৪৬
ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে পড়া শেষে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। তিনি কলেজে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে কলেজ জীবন শেষে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য চলে যান রাশিয়া। সেখানে ৬ বছর মাস্টার্স শেষে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় ‘স্টার মার্ক’ পেয়েছেন। শুধু মেধাবী ছাত্র ছিলেন তাই নন, রাজধানীতে বসবাস করা কোটি মানুষের কাছেও ১২ বছর ধরে প্রতিমুহূর্তে পানি সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলতার পালন করে যাচ্ছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। ঢাকা ওয়াসার এই সফলতার পেছনে সংস্থাটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরলস ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন এই প্রকৌশলী।

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকা। এই শহরের বাসিন্দারা ২০০৯ সালের আগমুহূর্তে খাবার পানির জন্য হাহাকার করেছিল। রাত জেগে হাড়িপাতিল, ড্রাম কিংবা বালতি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির জন্য অপেক্ষা করেছেন নগরবাসী। মাত্র ১২ বছরের ব্যবধানে রাজধানীবাসীর সেই দুর্ভোগ ও ভোগান্তির চিত্র পাল্টে গেছে। এই চিত্র পাল্টানোর বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কথা বলেছেন আরটিভি নিউজের সঙ্গে।

তার অভিমত, ঢাকাবাসীর পানি সংকট দূর করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর দায়িত্ব দেন। এরপর থেকেই ঢাকা ওয়াসার উন্নয়নে বড় বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা হয়। কারণ, ঢাকা ওয়াসার উন্নয়ন মানেই সরকারের উন্নয়ন, ঢাকা ওয়াসার সাফল্য মানেই সরকারের সাফল্য। প্রধানমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেটি কোনোভাবেই যেন ব্যর্থ না হয়, সেজন্য প্রতিমুহূর্তে চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলছে ঢাকা ওয়াসা। এখন রাজধানীর সকল মানুষ শতভাগ পানি পাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। ঢাকা ওয়াসার অগ্রগতি ও আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আলম

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসা এক যুগ দায়িত্ব পালনে কোন অর্জনকে বড় করে দেখছেন? দীর্ঘ এ সময়ে সংস্থাটির সফলতা কী কী?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসার পানি সংকটে নগরবাসী চরম ভোগান্তি পড়েছিলেন। এমনকি সংস্থাটি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আমি ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর এ দুটি বিষয়ে সবার আগে নজর দেওয়া হয়। বর্তমানে ঢাকায় পানির সংকট যেমন দূর হয়েছে, তেমনি ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতি কমেছে। দুর্নীতি দূরীকরণে পানির বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিল পরিশোধে অ্যানালগ থেকে ডিজিটালাইজেশনে ( মোবাইলে বিল পরিশোধ) রূপান্তর করা হয়। সংস্থা মানুষকে সেবা দেবে এবং সংস্থার ভেতরে দুর্নীতি দূর করবে, এর চেয়ে বড় অর্জন কিছু হতে পারে না। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলোয় পানি সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা রোল মডেল। এমনকি ঢাকা ওয়াসা তার ‘ঘুরে দাঁড়াও’ রোডম্যাপ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরংচো ঢাকা ওয়াসা মাস্টারপ্ল্যান করেছে, যা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

আরটিভি নিউজ: ঢাকা ওয়াসা ‘রোল মডেল’ কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। বাস্তবে কি রোল মডেল হতে পেরেছে?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : কোনো বুলি নয়, ‘রোল মডেল’ হিসেবে বাস্তবে রূপ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। অন্যান্য বছরের মতো চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীতে পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। এই সফলতার পেছনে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরসল পরিশ্রম রয়েছে।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে কতটুকু সক্ষম?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ২০০৯ সালের আগ মুহূর্তে ঢাকা শহরে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ পানি পেত। বাকি মানুষ পানির জন্য হা হা কার করতেন। কারণ ওয়াসার পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদন ঢাকা শহরের মানুষের চাহিদার চেয়ে বেশি। ওয়াসার দৈনিক পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২৬৫ কোটি লিটার। ঢাকা শহরে শীত-বর্ষা অনুযায়ী ২১০ থেকে ২৪৫ কোটি লিটার পর্যন্ত চাহিদা রয়েছে। এখনও ২০ কোটি লিটার পানি বেশি উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ঢাকা ওয়াসার।

আরটিভি নিউজ : করোনা মহামারিতে ঢাকা ওয়াসার কর্ম পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছে?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির ঊর্ধ্বমুখীর মধ্যেও দেশের অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোর মতো ঢাকা ওয়াসা মানুষকে প্রতিমুহূর্তে পানি সরবরাহ করে গেছে এবং যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোথাও পানির সংকট হয়নি। মহামারির মধ্যেও ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছে এবং করছে। অনেকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তারা চিকিৎসা নিয়ে আবারও কাজে ফিরেছেন। করোনা মহামারির মধ্যেও ঢাকা বাসীকে নিরলসভাবে পানি সরবরাহ করে যাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

আরটিভি নিউজ : শীতকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকট দেখা দেয়? এর কারণ কি?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : শীতকালে নদীতে পানি কমে যাওয়া এবং গভীর নলকূপের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কিছু এলাকায় পানির সমস্যা হয়। কিন্তু এবার শীতের মৌসুমে কোথাও পানি সংকট দেখা যায়নি। পানির পাম্পগুলোয় যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কোনো এলাকায় পানির সংকট হলে তাৎক্ষণিকভাবে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারী ছুটে যাচ্ছেন। এছাড়া ওই এলাকায় পানির সংকট দূর করতে দ্রুত পানির গাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসা দুর্নীতি দূরীকরণে কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিলেন। তখন আমরা ডিজিটাল ওয়াসা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। সেখানে প্রথমে ঢাকা ওয়াসার অ্যানালগ বিলিং সিস্টেম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ অ্যানালগ বিলিং সিস্টেমে দুর্নীতি ও অনিয়ম করার সুযোগ থাকে। তখন ২০০৯-১০ সালে বিলিং সিস্টেম অটোমেশন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে ঢাকা ওয়াসার গ্রাহকের উপকারের পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়বে। এছাড়া পানির বিল জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি ব্যাংকের পরিবর্তে সব ব্যাংকে বিল জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ধাপে ধাপে ২০১২ সালে একটি ব্যাংকের তিনটি ব্র্যাঞ্চ অনলাইন ব্যবস্থা থাকায় সেটিতে বিল জমা দেওয়ার সিস্টেম চালু করা হয়। এটির মাধ্যমে পানির বিল পরিশোধে প্রথম অটোমেশন চালু হয়।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতির বড় মাধ্যম কোনটি ছিল বলে মনে করেন?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : পানির বিল পরিশোধে গ্রাহক ও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সোজসাজস্যে করতেন। এটিই ছিল ওয়াসার দুর্নীতি-অনিয়মের বড় ক্ষেত্রে। যা ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিল। এছাড়াও পানির বিল পরিশোধে বিলের গায়ে যে ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চের নাম লেখা ছিল। সেই ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চে গ্রাহকরা টাকা জমা দিতে পারতেন না। এতে গ্রাহক নিজের কাজ রেখে ওয়াসার পানির বিল পরিশোধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দিতেন। গ্রাহকের ভোগান্তি দূরীকরণে ঢাকা ওয়াসা বিল পরিশোধে সব ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ পদ্ধতি চালু করে। এখন ঢাকা ওয়াসার বিল কালেকশনে ৩৬টি ব্যাংক ও তিনটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এখন ঘরে বসে গ্রাহক মোবাইলের মাধ্যমে পানির বিল দিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘বিল কালেকশন অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে ওয়াসা। এতে গ্রাহকদের পানির বিল পরিশোধ সহজ হওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি কমেছে। পানির বিল পরিশোধে পরিবর্তন আনায় ঢাকা ওয়াসার আমুল পরিবর্তন হয়েছে।

আরটিভি নিউজ : দুর্নীতি বন্ধে কৌশল হিসেবে কী অবলম্বন করেছেন?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি দূর করতে চাইলে মুখে মুখে বললেই হবে না। কারণ দুর্নীতি দূর করা খুবই কঠিন কাজ। একটি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা একদিক দিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করবেন, অন্যদিক দিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করবেন। তাই কোনো সংস্থার দুর্নীতি বন্ধ করতে চাইলে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তার সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং দুর্নীতি বন্ধে পদ্ধতিগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে প্রথমে দুর্নীতির পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করতে হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্র চিহ্নিতের পর ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নিতে হবে। হঠাৎ করে একটি সংস্থার দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ঢাকা ওয়াসার ভেতরে দুর্নীতির পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করা হয়েছে।

আরটিভি নিউজ : ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছে কিনা?

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান : ঢাকা ওয়াসার মূল লক্ষ্যই রাজধানীর বাসিন্দাদের পানি সরবরাহে সেবা দিয়ে যাওয়া। সেবা দিতে এসে নগরবাসী ভোগান্তির শিকার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। তাই গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে ঢাকা ওয়াসা সর্বপ্রথম কল সেন্টার ১৬১৬২ খুলেছে। গ্রাহকদের ওয়াসা ভবনে এনে অভিযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাসায় বসে থেকে মোবাইলের মাধ্যমে কল সেন্টারে অভিযোগ করতে পারেন। গ্রাহকদের অভিযোগ কল সেন্টারে রেকর্ড হয়ে থাকে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রাহকদের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে। একইসঙ্গে রাজধানীর নিম্ন আয়ের এলাকার আদর্শ গ্রাহকদের সম্মাননা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে ঢাকা ওয়াসা।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ঢাকা ওয়াসার এমডি দায়িত্ব পালন করে আসছেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। দীর্ঘ এই সময়ে রাজধানীর সব বাড়িতে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আরও তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

এফএ/টিআই

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পানির দাম বাড়ানো নিয়ে যা বললেন ওয়াসার ডিএমডি
X
Fresh