• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বালাপুর জমিদারবাড়ি

লক্ষ্মণ বর্মণ, নরসিংদী সংবাদদাতা

  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:২৩
সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বালাপুর জমিদারবাড়ি
সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বালাপুর জমিদারবাড়ি, ছবি: প্রতিনিধি

শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ও কালেরসাক্ষী নরসিংদীর বালাপুর জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ আমলের ইট, সুরকি ও রড দিয়ে তৈরী বাড়িটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার আভিজাত্য নিয়ে। বাড়িটিজুড়ে নান্দনিক, দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর কারুকাজ ঐতিহ্যের নিদর্শন ও প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। নরসিংদী সদর উপজেলার পাইকারচর ইউনিয়নের মেঘনা নদীর পাড়েই বালাপুর জমিদারবাড়ি। প্রায় ৩২০ বিঘা জায়গার ওপর নবীনচন্দ্র সাহা বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দেবোত্তর সম্পত্তি হওয়ায় সরকারের কোনো সুনজর নেই বাড়িটির উপর। স্থানীয়রা বলছেন, বালাপুর জমিদার বাড়িটি সরকারিভাবে সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে দিনে দিনে বিলীন হয়ে যাবে। ইতিহাস থেকে মুছে যাবে ঐতিহ্যবাহী এই জমিদারবাড়িটি।

ইতিহাস ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, বালাপুর জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবীনচন্দ্র সাহা। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয় তা জানা যায়নি। প্রায় ৩২০ বিঘা জমির উপর এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এখানে একটি একতলা ভবন, একটি দোতলা ভবন ও একটি তিনতলা ভবন তৈরি করা হয়েছিল, যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই জমিদারবাড়ির জমিদাররা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। সন্ধ্যা নামলেই জমিদার বাড়িতে প্রতিদিন ঢাক-ঢোলের বাজনা শুরু হতো। বিভিন্ন নাটক, পালা গানসহ আরো অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে তারা তাদের জমিজমা মন্দিরের নামে উইল করে দিয়ে কলকাতায় চলে যান।

জমিদার নবীনচন্দ্র সাহার তিন ছেলে কালীমোহন সাহা, আশুতোষ সাহা ও মনোরঞ্জন সাহা। নবীনচন্দ্র সাহা মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে কালীমোহন সাহা জমিদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এই বিলাসবহুল নান্দনিক কারুকার্য সমৃদ্ধ জমিদারবাড়ির ভবনটিতে ১০৩টি ছোট-বড় কক্ষ রয়েছে। যার প্রতিটি কক্ষই মোজাইক করা। ঘরের সব দরজা-জানালাগুলো ফুল লতা-পাতাসহ বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর কারুকার্য মণ্ডিত ছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এসব কারুকার্য। অধিকাংশ দরজা জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনটির পূর্বদিকে তিনতলার দরজা-জানালা ধসে পড়ছে। উত্তরদিকে একতলা জরাজীর্ণ অবস্থা। দক্ষিণে দ্বিতীয়তলা ও পশ্চিমদিকে দ্বিতীয়তলা একই অবস্থা। পশ্চিম পাশে একটি গেট রয়েছে। বিশাল এই জমিদার বাড়িতে আরও আছে শান বাঁধানো পুকুরঘাট, কারুকার্যখচিত দুর্গাপূজার মণ্ডপ। মণ্ডপের ভিতরের কারুকাজ দেখেই ধারণা করা যায় বাড়ির অতীত ঐতিহ্য।
জমিদারবাড়িতে সেই সময় অতিথিদের থাকা-খাওয়া ও ঘুমানোর জন্য ছিল দুর্গা মন্দিরের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে কয়েকটি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন ভবন। যা বর্তমানে এক একটি ইট, দরজা-জানালা একটি ইতিহাস। মন্দিরে দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি ছোট খাল।

এছাড়াও জমিদার নবীনচন্দ্র সাহা বাড়ির মূল গেটের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী শ্রী মদনমোহন জিউ মন্দির। বাড়িটি তত্ত্বাবধানের অভাবে চারদিক লতাপাতায় জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলায় কারুকার্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

৩২০ বিঘা জমির উপর একটি একতলা, একটি দোতলা ও একটি তিনতলা ভবন রয়েছে। তিনতলা ভবনটি একশত এক কক্ষ বিশিষ্ট ভবন। ৯২ শতক জমিজুড়ে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটিতে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি ঘাট রয়েছে। বর্তমানে শান বাঁধানো পুকুরঘাটগুলো ইট সুরকি উঠে গিয়ে অনেক স্থানে ধসে গেছে। বাড়ির পাশেই আছে বিশাল আকারের খেলার মাঠ। এছাড়াও ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বালাপুর নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

জমিদারবাড়ি ঘুরতে আসা প্রীতম রায় আরটিভি নিউজকে বলেন, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি নরসিংদীর কাছে বালাপুর জমিদারবাড়ির কথা। তাই বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে এলাম। ঘুরতে এসে বর্তমানে জমিদারবাড়ির অবস্থা দেখে আমরা হতাশ। এক সময় যে বাড়িটি সুন্দর একটা পরিবেশ ছিল, তা আজ ধ্বংসের মুখে। সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের মতো বাংলাদেশের সকল জমিদারবাড়িগুলো সংরক্ষণ করা উচিৎ।

জমিদারবাড়িতে বসবাস করা সুজন ভুইঁয়া আরটিভি নিউজকে বলেন, এক সময় পুরো জমিদারবাড়িতে লোকজন বসবাস করতো। রানা প্লাজা ধসের পরপরই নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেন। তখন বসবাসরত সবাইকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে জমিদার বাড়ির আশেপাশে বর্তমানে ২৭টি হিন্দু পরিবার বসবাস করছে।

জমিদার বাড়িতে ৭০ বছর ধরে থাকা প্রবীণ রতন সরকার আরটিভি নিউজকে বলেন, আমার দাদা ও বাবারা এই জমিদারবাড়িতে কাজ করতেন। দেশ ভাগের পর জমিদাররা তাদের সকল সম্পত্তি মন্দিরের নামে দিয়ে যান। এরপর থেকেই আমরা এখানে বসবাস করছি। নয়-দশ বছর আগে আমরা সবাই জমিদারবাড়ির ভিতরে বসবাস করতাম। একদিন সরকারি লোকজন এসে আমাদেরকে বাড়ির ভিতরে থেকে সরিয়ে দেন। বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখে। সরকার যদি একটু সুনজর দিত, তাহলে পূর্বপুরুষের কাজ করার স্থানটি আগলে বাঁচতে পরতাম।

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাহিনুর মিয়া আরটিভি নিউজকে বলেন, জমিদার নবীনচন্দ্র সাহা প্রতিষ্ঠা করেন এই বালাপুর জমিদারবাড়ি। এই জমিদার বাড়ির পাশেই মেঘনা ঘাট। ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটির নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন ও চমৎকার। বর্তমানে জমিদার বাড়িটির অধিকাংশ জমি ভূমি খেকোদের দখলে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তি নিজ নামে করে নিয়েছে। এই সমস্ত সম্পত্তি সরকার দখলমুক্ত করে সংরক্ষণ করলে জমিদার বাড়িটি একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে।

এ ব্যাপারে নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদি মোর্শেদ আরটিভি নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবো। কোনো কিছু করা যায় কিনা দেখবো।
পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রাষ্ট্রের সব স্তম্ভ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে : মির্জা ফখরুল
অবশেষে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ
বেড়িবাঁধ সংস্কারে বন উজাড়, ঝুঁকিতে সমুদ্র উপকূলের মানুষ
‘প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলেই নতুন তহবিল পাবে বাংলাদেশ’
X
Fresh