• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

আইসিইউ বেড পেতে একজনের মৃত্যুর অপেক্ষায় আরেকজনের স্বজনরা

  ২৪ এপ্রিল ২০২১, ২৩:৫৪
আইসিইউ বেড পেতে একজনের মৃত্যুর অপেক্ষায় আরেকজনের স্বজনরা

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত মোকাবিলায় সরকারের সুপরিকল্পনার অভাবে রোগীরা যথাযথ সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না এবং সংক্রমণ মোকাবিলাও সম্ভব হয়নি। এতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বেড ও সাধারণ শয্যার সংকট প্রকট হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে একটি আইসিইউ বেডের রোগী মারা গেলে তবেই আরেকজন ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে। কক্সবাজার, রাঙামারি, বান্দরবান, চিড়িয়াখানাসহ অনেক জায়গায় বিনোদনের নামে মানুষ ভিড় জমিয়েছে। এসব ঘটনার কারণে চলতি বছরে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ বাড়ছে। এখন সরকার সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউন দিয়েছে। এই লকডাউন দেওয়ার আগেই যদি করোনা সংক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করতো তাহলে চলতি বছরে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না মানুষকে। তবে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সরকারের মন্ত্রীরা মুখেমুখে বললেও তা মোকাবিলায় পরিকল্পিত কোনো কাজ করেনি। এতে আইসিইউ সংকট তৈরি হয়েছে, আইসিইউয়ের অভাবে করোনা রোগী মারা যাওয়ার নজির হরহামেশায় দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট। একটি আইসিইউ পেতে অপেক্ষায় থাকেন কয়েকজন রোগী। একজন রোগীকে আইসিইউ থেকে বের করলে পরবর্তী যে রোগী জটিল তাকে আইসিইউতে ভর্তি করাচ্ছেন চিকিৎসকরা। করোনা রোগীদের শ্বাসকষ্টের কারণে অধিকাংশ সময়ে দরকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) একটি বেড। কিন্তু হাসপাতালে আইসিইউর সব বেডই রোগীতে পরিপূর্ণ। একজনের সুচিকিৎসার জন্য আরেকজনের মৃত্যুর অপেক্ষা। কঠিন এ সময়ের মধ্য দিয়ে স্বজনদের দিন পার হচ্ছে দেশের করোনা হাসপাতালে। করোনা রোগীদের আইসিইউ বেডে ভর্তি করাতে হাহাকার করছে স্বজনরা। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রতিটি কোভিড-১৯ হাসপাতালের আঙিনা জুড়ে সারাক্ষণই অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজ আর মৃত রোগীদের নিয়ে যাওয়ার ব্যস্ততা। মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ।

গত ১৭ এপ্রিল কবি মোহন রায়হানের মা মাহমুদা খাতুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তাকে ঢামেকের আইসিইউতে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেন স্বজনরা। তবে এসময় ঢামেকের আইসিইউতে কোনো সিট পায়নি। এর আগে ২ এপ্রিল শ্বাসকষ্টের রোগী মায়ের অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য ছেলে একের পর এক ঘুরেছেন পাঁচ হাসপাতাল। কোথাও পাননি অক্সিজেন সাপোর্ট। শেষ পর্যন্ত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মা। মায়ের লাশ জড়িয়ে আজাহারি করছিলেন ছেলে রায়হান। আইসিইউ, অক্সিজেন ও দক্ষ জনবলের অভাব গত বছর থেকেই দেশে চলে আসছে। কিন্তু গত এক বছরের এসব বিষয়ে খুব একটা সমাধান আসেনি।

করোনা রোগীদের চিকিৎসা সামাল দিতে গত সোমবারে মহাখালী ডিএনসিসির মার্কেটটি করোনা হাসপাতাল হিসেবে চালু করেন। হাসপাতালটি চালু হওয়ার পরপরেই করোনা রোগীদের ভর্তির চাপ বেড়ে যায়। সেজন্য গত মঙ্গলবার হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতালে অনেক রোগী আসছে। যে যেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, তিনি সেখানে থেকেই চিকিৎসা নিন। তারা যেন এখানে না আসেন।এলে নতুন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সংকট দেখা দেবে। আপনারা যেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেখানেই নিন।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘দেশে আইসিইউ সংকট রয়েছে, সরকার ইচ্ছে করলেও আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়াতে পারবে না। আইসিইউ বাড়ানো খুব কঠিন কারণ দক্ষ জনবল লাগে। জটিল ও গুরুতর রোগীর জীবন রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে ভেন্টিলেটর। করোনাকালেও অনেক রোগী ভেন্টিলেটরের কারণে জীবন ফিরে পেয়েছে। তবে দক্ষ জনবল সংকটে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে ভেন্টিলেটর পড়ে আছে। সহসায় আইসিইউ বেড সংকট নিরসন করতে পারবে না সরকার। এ মুহূর্তে আইসিইউ ব্যবস্থাপনা বাড়ানো ছাড়াও বিকল্প পথে এগোতে পারে। করোনা রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ভালোভাবে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে রোগীদের সহজে আইসিইউতে নিতে না হয়। এতে বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে যে আইসিইউ আছে সেগুলো দিয়েই চলবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এতে বিভাগীয় শহরের রোগীরা ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসবে না। আইসিইউ চালাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। ইচ্ছে করলেও এই মুহূর্তে দক্ষ জনবল বাড়িয়ে আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হবে না। যেসব আইসিইউ বেড রয়েছে তা সারা দেশে সমন্বয় করতে হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলী আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে সেই তুলনায় আইসিইউ বেডের সংখ্যা অনেক কম। তবে সরকার জরুরি অবস্থায় আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আইসিইউ বাড়ানোর প্রক্রিয়া একটু সময় সাপেক্ষের বিষয়। কারণ আইসিইউ বেড বাড়ালেই হবে না এরসঙ্গে দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতির দরকার রয়েছে। শুধু করোনা নয়, অন্যান্য রোগীদের জন্যেও আইসিইউ বেড লাগে।’

কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের দায়িত্বে রয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. আসাদুজ্জামান আরটিভি নিউজকে বলেন, গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই আইসিইউ বেডের চাহিদা বেড়েছে। তবে চলতি বছরের মার্চ থেকে আইসিইউর বেডের চাহিদা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। বেড ফাঁকা হওয়ার অপেক্ষায় থাকছেন রোগীর স্বজনরা। বারবার খবর নিচ্ছেন কখন আইসিইউ বেড ফাঁকা হবে। একজন মারা গেলে আরেকজনকে ভর্তি করাতে হচ্ছে। বর্তমানে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ২৬টি রয়েছে। চলতি মাস থেকে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচজন রোগী মারা যাচ্ছেন। কিন্তু আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে সাত থেকে আটজনকে।

এফএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh