• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাফল্য 

এবার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন

বিপ্লব বসাক, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

  ২৩ এপ্রিল ২০২১, ২০:২৩
এবার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন
এবার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষকরা বিলুপ্তপ্রায় টেংরা, গুলশা, পাবদা ও বৈরালীসহ ২৪টি দেশীয় প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের পর এবার ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনেও সফল হয়েছে। চলমান করোনার মধ্যে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দেশে প্রথমবারের মতো এই সাফল্য অর্জন করেন। ফলে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছ খুব শিগগিরই মাঠ পর্যায়ে চাষ করে খাবার টেবিলে ফিরে আসবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি গবেষণা কেন্দ্রে দুই বছর ধরে নিবিড় গবেষণায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনের সফলতা অর্জন করে।

গবেষক দলে ছিলেন কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল। স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উৎস থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। প্রতিপালনকালে ঢেলা মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া, বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়।

হিস্টোলজি পরীক্ষাকালে দেখা যায় যে, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুন। তবে এপ্রিলের শেষের দিক থেকে প্রজননকাল শুরু হয়। ঢেলা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে প্রতিগ্রামে ৭০০-৮০০টি। গবেষণাকালে দেখা যায় যে, একটি স্ত্রী ঢেলা মাছ প্রায় ৬-৮ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা মাছ আকারে অপেক্ষকৃত ছোট (৪-৫ গ্রাম) হয়। প্রকৃতিতে স্ত্রী ঢেলা মাছের চেয়ে পুরুষ ঢেলা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। বিভিন্ন উৎস থেকে ঢেলা মাছ সংগ্রহকালে দেখা গেছে, প্রকৃতিতে স্ত্রী ও পুরুষ ঢেলা প্রাপ্তির অনুপাত হচ্ছে ৪ঃ১ অর্থাৎ চারটি স্ত্রী ঢেলার সঙ্গে মাত্র একটি পুরুষ ঢেলা থাকে।

গবেষকরা আরো জানান, গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ৮-৯ ঘণ্টা পর ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। উৎপাদিত পোনা বর্তমানে ইন্সটিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে।

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘পুষ্টিসমৃদ্ধ ঢেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে এবং ঢেলা মাছকে সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেলা মাছে ভিটামিন এ ৯৩৭ আইইউ, ক্যালসিয়াম ১২৬০ মি. গ্রাম এবং জিঙ্ক ১৩.৬০% রয়েছে। যা অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশী। ভিটামিন এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যা করোনাকালীন সময়ে খুবই উপযোগী।

গবেষকদের মতে, এক সময় দেশের নদ-নদী ও হাওড় বিলে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ ও জলাশয় সংকোচনের কারণে ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এ মাছটি বিলুপ্তির তালিকায় চলে আসে। ফলে ঢেলা মাছ এখন প্রায় দুস্প্রাপ্য এবং উচ্চমূল্যে বাজারে বেচাকেনা হয়। ইন্সটিটিউট কর্তৃক কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ঢেলা মাছকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিপন্ন প্রজাতির সকল দেশীয় মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে ইন্সটিটিউটে সাম্প্রতিককালে ছোট মাছের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণসহ গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০২০ সালে গৌরবজনক ‘একুশে পদক’ লাভ করে।

পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮-২০০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিক টন। পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন অর্থাৎ গত ১২ বছরে চাষে দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে ইতোমধ্যেই পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালীসহ ইতোমধ্যে ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। ফলে এসব মাছের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সাম্প্রতিকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্সটিটিউটে বর্তমানে পিয়ালী, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রাণী ও গাং টেংরাসহ আরো ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।
পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh