• ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
logo

গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দে হরিলুট, আড়াই কোটি টাকা লোপাট 

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

  ১০ এপ্রিল ২০২১, ১৮:৪৬
Harilut in allocating houses to the homeless, looting two and a half crore rupees
গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দে হরিলুটের অভিযোগ

ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনে গৃহীত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পটি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

ঘর প্রদান নীতিমালা অনুযায়ী ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবারকে উপকারভোগী নির্বাচন না করে ৩০-৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাস জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ব্যক্তিদের বিবেচনায় নেয়নি টাস্কফোর্স কমিটি। এমনকি একই নামে দুটি ঘর বরাদ্দ দেয়ার তথ্য রয়েছে তালিকায়। এছাড়া নিম্নমানের উপকরণসামগ্রী ব্যবহারসহ রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রীর মজুরি, পরিবহন ও জ্বালানি খরচ উপকারভোগীদের প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। এতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লোপাটের তথ্য ফাঁস হয়ে পড়েছে।

ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ নীতিমালা ২০২০ এর আলোকে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের উপকারভোগীদের নামের তালিকা নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। ৩৯৪ বর্গফুটের দুই কক্ষ বিশিষ্ট পাকা ও সেমিপাকা ঘরে একটি টয়লেট, একটি রান্না কক্ষ ও ইউটিলিটি স্পেস গুণগত মানসম্পন্ন উপকরণসামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়নি। নীতিমালায় উপকারভোগী হিসেবে ‘ক’ শ্রেণি যার জমি ও ঘর কিছুই নেই, ‘খ’ শ্রেণি যার এক থেকে ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই, তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ করার কথা। আর যাদের জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্তপূর্বক ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা কমিটির সভাপতি ইউএনও, সদস্য এসি ল্যান্ড, এলজিইডি প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্য সচিব পিআইও। এ কমিটি গৃহনির্মাণ কাজের অগ্রগতি উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় ও টাস্কফোর্স কমিটির সভায় অবহিত করবে কিন্তু তা করেনি। এছাড়া সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণ উপকরণ সামগ্রীর গুণগত মান ও তৈরীকৃত গৃহের নকশা যাচাই করেনি। ঘরের নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে প্রথম ধাপে ৪৫০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহন ও জ্বালানি খরচের ১৮ লাখ ২৫ হাজার এবং দ্বিতীয় ধাপে ১১০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহন ও জ্বালানি খরচের ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ মোট ২৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫৬০টি বরাদ্দকৃত ঘরের জন্য উপকারভোগী প্রতিটি ঘরে ৩০-৪০ হাজার টাকা হারে প্রায় ২ কোটি টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এনিয়ে প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে আবেদন করেছেন ধূলাসার ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের বাদল খান নামের এক ভুক্তভোগী।

একই গ্রামের দুলাল হাওলাদারের স্ত্রী আমেনা বেগম (৩২) বলেন, ‘ঘর পেতে দুই কিস্তিতে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি।’

আব্দুস ছালাম সিকদারের মা রওশন আরা (৫৫) বলেন, ‘ঘর পেতে ৩৪ হাজার টাকা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি জসিম মোল্লার কাছে দিয়েছি। টাকা নেওয়ার সময় টিউবওয়েল ও জায়গা দেওয়ারও কথা ছিল। শুধু পঁচা ইট দিয়ে ঘর করে দিয়েছে।’

অভিযুক্ত জসিম মোল্লা টাকা উত্তোলনের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও মোস্তাক মেম্বার আমাকে ঘর প্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ বাবদ নিতে বলায় আমি টাকা উঠিয়ে তাদের দিয়েছি। পরে এসব ঘর প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে জানতে পেরে আমি অনুতপ্ত।’ যদিও ধূলাসার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল আকন ও মোস্তাক মেম্বার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

একই ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের নওমুসলিম হাসান খান বলেন, ‘ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও অফিস খরচের জন্য লতাচাপলী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ মজিবুর রহমান মুসুল্লি ১৫ হাজার টাকা নেন। ৮টি ছাগল বিক্রি করে আমি ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর ১০ দিন কাজ করে রাজমিস্ত্রী সহকারীর বেতন বাবদ ১০ হাজার টাকা নেয় ঠিকাদার মোঃ ওয়াদুদ খান। মিস্ত্রীদের দুপুরের খাবার তো আছেই।’ লতাচাপলী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আনছার উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব লেনদেনের বিষয়ে আমার জানা নেই।’

এছাড়া পার্শ্ববর্তী বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার কড়াইবুনিয়া ইউনিয়নের নীলগঞ্জ গ্রামের তৈয়ব আলী চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরবুনিয়া গ্রামের ভুয়া ঠিকানা দেখিয়ে ঘর বরাদ্দ পায়, যা তালিকার ৮ নম্বরে দৃশ্যমান। তিনি ওই ঘর আমতলীর স্থায়ী ঠিকানায় উত্তোলন করেন।

উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বাবুল খান বলেন, ‘ভূমিহীন, আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় কত ঘর এসেছে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, এটা আমাদের ব্যাপার। আমার কাছে ঘর এসেছে। এটা আপনি কে জানতে?’ বাবুল খান আরও বলেন, ‘আমি মহিপুরের একটি দুস্থ পরিবারকে তার কার্যালয়ে এনে প্রদর্শনপূর্বক আবেদনে সুপারিশ করার পরও সে ঘর পায়নি। ইউএনও কার্যালয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে গোপন বৈঠক করে ৪০-৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর দেয়া হয়েছে।’

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব পিআইও মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর সংক্রান্ত সকল ফাইলপত্র ইউএনও স্যারের কাছে। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলী মহর আলী বলেন, ‘ঘর সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখলেও কোন মিটিংয়ে আমাকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়নি। তাই এ সম্পর্কিত কোনও তথ্য আমার কাছে নেই।’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎবন্ধু মন্ডল বলেন, ‘শুধু খাসজমি বরাদ্দের আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমি ছিলাম। অন্য কোনও বিষয়ে মন্তব্য করা আমার এখতিয়ার বহির্ভূত।’

ইউএনও আবু হাসনাত মোহম্মদ শহিদুল হক আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘এ সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। তাছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য আমি কাউকে দায়িত্বও দেইনি। যদি কেউ টাকা উত্তোলন করে তার নিজ দায়িত্বে করেছে।’ এজন্য তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করার পরামর্শ দেন তিনি।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোঃ মতিউল ইসলাম চৌধুরী আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগের বিষয় তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আশ্রয়ন-২ এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে ঘর বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ নীতিমালা বহির্ভূতভাবে ঘর বরাদ্দ দেয়, সে বিপদে পড়বে।’
পি

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
দেশে যে হরিলুট চলছে তারই প্রতিফলন ব্যাংক ডাকাতি : রিজভী   
অচল গার্মেন্টসকে সচল দেখিয়ে ২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ
X
Fresh