গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি, নাকি শাস্তিবিধি?
বৃদ্ধার বয়স ৬৫ বছর, নাম তার খাদিজা বেগম। বাসের জন্য এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন সড়কে ফুটপাতেই। অন্যদিকে অফিসগামী লোকগুলোর অধিকাংশই গরমে ঘামতে ঘামতে হেঁটে চলছেন অফিসের দিকে। তবে চাকরিজীবী বয়স্ক লোকগুলোকে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এছাড়া অনেককেই দেখা গেছে ভারী ভারী মালামাল মাথায় নিয়ে ছুটতে। বুধবার ৬০ শতাংশ পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সকাল থেকেই এমন চিত্র ছিল গোটা রাজধানীজুড়ে।
যাত্রী পরিবহন রুটগুলোর মাঝপথের স্টপেজে সব বাস গেটলক থাকতে দেখা গেছে। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ৫০ শতাংশ যাত্রী বহন করায় এসব স্টপেজে বাস থামেনি। তবে অনেক গাড়িতেই যাত্রী দাঁড়িয়েও থাকতে দেখা গেছে। এসব বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন তুলেছেন, পরিবহনে যা শুরু হলো- তা কী স্বাস্থ্যবিধি, নাকি শাস্তিবিধি?
বিধি নিয়ে ক্ষুদ্ধ যাত্রীরা:
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গণপরিবহনের ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বুধবার (৩১ মার্চ) সকাল থেকে শুরু হয় গণপরিবহন চলাচল। তাতে অফিসগামী অনেক যাত্রী বাসে উঠতে না পারায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) নিজ সরকারি বাসভবন থেকে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানান, আগামী ২ সপ্তাহ পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভাড়া আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ- অফিসে ৫০ ভাগ কর্মী নিশ্চিত না করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া অযৌক্তিক:
শরিয়ত উল্লাহ্ নামের এক নেটিজেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন- ‘এইটুকু কমন সেন্স নাই যে বাকি ৫০ ভাগ মানুষ হুট করে কই যাবে….. অফিসের ৫০ ভাগ কর্মী নিশ্চিত না হয়ে এটা কেমন সিদ্ধান্ত’।
একই পোস্টের কমেন্টে মুকিমুল আহসান হিমেলে নামের আরেক নেটিজেন লিখেছেন, কমন সেন্স! অফিস খোলা রেখে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব না! মাঝ দিয়ে বাস ভাড়াটাই বাড়লো।
বিধিভঙ্গ, দাড়িঁয়ে যাত্রী বহন করছে তারা:
করোনা ভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ১৮ দফা নির্দেশনায় গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এ কারণে বর্তমান ভাড়ার ৬০ ভাগ বাড়ানোর নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি দুই সিটে ১ জন করে যাত্রী বহন করলেও সকালে প্রায় প্রতিটি বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলায় যাত্রীদের চরম ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। তাদের প্রশ্ন- দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া কী স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে পড়ে?
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, মিরপুর হয়ে আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাস পরীস্থান ও প্রজাপতি পরিবহনেও দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে।
৬০ শতাংশেরও বেশি ভাড়া আদায়:
সকাল থেকে কোনো কোনো পরিবহনে ৬০ শতাংশের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাসের হেল্পার ও কন্ডাক্টরদের তর্কবিতর্ক করতে দেখা গেছে। মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী বিকল্প পরিবহনে সাধারণ ভাড়া ফার্মগেট পর্যন্ত ১৫ টাকা আর ফার্মগেট থেকে মতিঝিল ১০ টাকা। ৬০ শতাংশের অতিরিক্ত ভাড়া হিসেবে সেখানে ভাড়া হয় ৪০ টাকা। কিন্তু কন্ডাক্টর সেখানে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪৫ টাকা ভাড়া আদায় নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু করে এই প্রতিবেদকের সামনেই। এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও বেশ কয়েকটি পরিবহনের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বুধবার সকাল থেকে সারাদেশের গণপরিবহনগুলোতে অর্ধেক আসনে যাত্রী বহন করছে। পাশাপাশি তারা সরকার নির্ধারিত ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া আদায় করছে। আমরা এরইমধ্যে দেশের সব গণপরিবহন মালিকদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবহন পরিচালনা করেন। যদি কোনো পরিবহন ৬০ শতাংশের বেশি ভাড়া আদায় করে, তাহলে ওই পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর বক্তব্য:
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, করোনা প্রতিরোধে সরকার এবারও যে সিদ্ধান্ত নিলো, তাতে কাজ হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, এর আগেও করনার প্রথম ঢেউয়ে সরকার পরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তাতে সাধারণ মানুষ কি উপকৃত হয়েছে। বরং, ভাড়া বৃদ্ধির এমন নির্দেশনায় ওই সময়ে পরিবহন মালিকরা যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে লাভবান হয়েছে। এবারও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের দোহাই দিয়ে পরিবহণ মালিকরা লাভবান হতে শুরু করেছেন। সরকার পারে কেবল ভাড়া বাড়াতে, বিধি অমান্য করলে বা এর অপব্যবহার করলে কি শাস্তি হবে, সে বিষয়ে সরকার কিছুই বলেনি। ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি যাত্রীদের ভোগান্তি ছাড়া কিছু নয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির বক্তব্য:
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরটিভি নিউজকে বলেন, দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা না করে, অথবা সাধারণ ছুটি ঘোষণা না করে জনসাধারণের চলাচল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রেখে। গণপরিবহনে অর্ধে যাত্রী বহনের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে- আমি মনে করি এটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত প্রতিপালিত হচ্ছে। আমরা পর্যবেক্ষণে দেখেছি- আজ সকাল থেকেই যাত্রীবাহী পরিবহনগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের নামে যাত্রীরা নানান হয়রানীর মুখোমুখী হচ্ছেন। নির্দেশনার মধ্যে শুধুমাত্র অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি প্রয়োগ করছে পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা। চাপে পড়ে জনগণ অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে, আর ভোগান্তির মধ্যেও পতিত হচ্ছে। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেনি যাত্রীবাহী পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। রাজধানী ঢাকায় চলাচলকারী পরিবহনগুলোর ৯৫ শতাংশকে সরকারের বেধে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বালাই আমরা দেখছি না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা সরকারকে অনুরোধ জানাবো- অগোছালো পরিকল্পনা থেকে সরে আসার জন্য। আগের মতো যতো সিট ততো যাত্রী বহনের বিষয়টি যেনো নিশ্চিত করা হয়।
নৈরাজ্যের শিকার যাত্রীরা অভিযোগ করবে কোথায়?
পরিবহনে নৈরাজ্য নিয়ে যাত্রীরা কোথায় এবং কার কাছে অভিযোগ করবে তার সঠিক কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, যাত্রীরা কোনো পরিবহনে নৈরাজ্যের শিকার হলে কার কাছে অভিযোগ করবে তার নির্দিষ্ট কোন স্থান নেই। যাত্রীরা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অভিযোগ নিয়ে গেলে বলে এটি দেখার দায়িত্ব বিআরটিএ’র। অন্যদিকে বিআরটিএ’র কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে, তারা বলে এ দায়িত্ব আমাদের না। এমন পরিস্থিতিতে চরম বেকায়দায় পড়ে যায় যাত্রীসাধারণ।
ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, বর্তমানে এ সংক্রান্তে অভিযোগ করার সুযোগ রাখার জন্য আমি ইতোমধ্য সরকারের কাছে একটা প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছি। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখ্য সচিবের তত্ত্বাবধায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। মাঠ পর্যায়ে যে কমিটির অন্যান্য সদস্যরা কাজ করবে এবং পরিবহনের নৈরাজ্য ও যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত মাফিক যথাযথ এ্যাকশনে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর মহাখালীর সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠকে ভাড়া বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন।
কেএফ
মন্তব্য করুন