হঠাৎ যে কারণে মদে আসক্তদের সংখ্যা বেড়ে মৃত্যুর মিছিল
নেশার পণ্য ‘বিদেশি মদ’ যেনো এখন একটি ‘বিষের’ নাম। নেশায় আসক্তদের ভেজাল যুক্ত মদ নিরূপণের সময় থাকে না বললেই চলে। তীব্র নেশায় আসক্ত হয়ে ভেজাল মদ পানের পর বিষক্রিয়ায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এরইমধ্যে কিছু ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছেছে, আবার কিছু তথ্য গোপনে হারিয়ে যাচ্ছে। ‘মদ পানে মারা গেছেন’ এমন অপবাদ থেকে বাঁচতে এ ধরনের অনেক মৃত্যু সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো গোপন রাখছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সাম্প্রতি বিদেশি মদের বোতল যেনো একেকটি বিষের বোতলে পরিণত হয়েছে। ভেজাল মদের বিষক্রিয়ায় সম্প্রতি জীবন গেছে, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী, শীর্ষ পর্যায়ের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ৩ কর্মী এবং বগুড়ার ১৬ ব্যক্তিসহ আরও অনেকরই।
আরও পড়ুন : মদ খেলে যে সব শক্তি কমে
দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি:
মহামারি করোনা ভাইরাস প্রকোপের শুরুর দিকে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও লকডাউনে ছিল। একটা পর্যায়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও, দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়নি। আর যেসব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে করোনার পূর্ববর্তী সময়ে যে স্বাভাবিকতা ছিল, তা এখন আর নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কারণে দেশে মাদকাসক্তের হার বেড়েছে।
মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ:
করোনার কারণে কেনো মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে বিপথগামী তরুণ-তরুণী ও অন্যান্যরা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
আরও পড়ুন : ‘যারা মদ কিনতে গেলেন তাদের রেশন কার্ড বাতিল করা উচিত’
সঙ্কট ও বেকারত্বে হতাশা:
করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের অনেক মানুষ। যে কারণে তারা আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বিপথগামী হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, বেকারত্বের মুখে সঙ্কটে পড়াদের একটি বড় অংশই মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষা বলছে, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রায় ২ কোটি নারী-পুরুষ এই খাতে কাজ করেন। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, করোনার কারণে পোশাক খাতের ১ লাখের বেশি কর্মী কাজ হারিয়েছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, এই সংখ্যা আরও বেশি, যা প্রায় ৩ লাখ হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। দেশে করোনায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছে।
আরও পড়ুন : মদ-গাঁজা-শূকরের মাংস খাচ্ছেন সেই সৌদি তরুণী
শিক্ষাঙ্গন বন্ধ ও অভিভাবকদের গাফিলতি:
দেশের শিক্ষাঙ্গন বন্ধ থাকায়, শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তাদের সময় অতিবাহিত করতে সুযোগ পেলেই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অভিভাবকেদের ব্যস্ততা ও গাফিলতিতে এমন সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অসৎ সঙ্গে তারা আজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই অভিবাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সঙ্কটে অন্যান্য মাদকাসক্তদের মদ-প্রীতি:
মাদক প্রতিরোধে কাজ করা সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের সিংহভাগ মাদকাসক্ত গাঁজা সেবন করে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মদে আসক্ত এবং তৃতীয় অবস্থানেই রয়েছে ইয়াবায় আসক্তদের সংখ্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় চোরাই পথে মিয়ানমার থেকে পর্যাপ্ত ইয়াবার চালান দেশে আসছে না। এর মধ্যেই মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ঘটায় ক্ষমতা এখন ওই দেশের সেনা বাহিনীর হাতে। যে কারণে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে কড়াকড়ি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় চোরাইপথে ইয়াবা প্রবেশের বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকার কথা নয়। এমন সব কারণে মদে নতুন আসক্তদের পাশাপাশি যারা ইয়াবায় আসক্ত তাদের একটি বড় অংশও মদে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন : মন্দা কাটাতে মদ কেনাবেচা শিথিল করলো দুবাই
কমে গিয়েছিলো বিদেশি মদের যোগান:
করোনায় দেশের বিদেশি মদের যে যোগান ছিল, তা সম্প্রতি শেষ হয়ে যাওয়ায় ভেজাল মদ কারবারিরা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা বিষাক্ত মিথানল বা মিথাইল, স্প্রিট এবং ক্ষতিকর রং মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করে সরবরাহ করে আসছিলো, যা পান করে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে মদে আসক্তরা।
গবেষক ও বিশেষজ্ঞের মতামত:
শিশু, কৈশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আরটিভি নিউজের কথা হয়। তিনি বলেন, দিনদিন মাদকাসক্তদের সংখ্যা বেড়ে চলছে। সম্প্রতি মদ পানের পর যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন আলামতের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মতামত দিচ্ছেন যে- বিষক্রিয়ার ফলে ওইসব ব্যক্তিরা মারা যাচ্ছে। যাতে প্রতীয়মান হয়- ভেজাল মদ পানের কারণে তাদের মৃত্যু হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি খুবই এলার্মিং (বিপজ্জনক)। এর অন্যতম কারণ বিদেশি মদের সরবরাহ কম। যে কারণে বিদেশি মদের পুরোনো বোতলে ভেজাল মদ ভরে তা বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত ইয়াবা বা অন্যান্য মাদকের সরবরাহ না থাকায় এসবে আসক্তরা মদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। করোনায় যারা বেকার হয়ে পড়েছেন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে মদসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
আরও পড়ুন : ভেজাল মদের কারখানার খোঁজ পেয়েছে পুলিশ
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যা বলছে:
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরটিভি নিউজকে বলেন, র্যাব সূচনালগ্ন থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। মাদক প্রতিরোধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। সম্প্রতি দেখা ভেজাল মদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে অনেক। যে কারণে অকালেই মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই ভেজাল মদ প্রতিরোধে আমাদের গোয়েন্দা শাখার তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশেই আমাদের বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : মদের গ্লাস হাতে ট্রোল অভিনেত্রী
সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পরামর্শ প্রদান করেন র্যাবের এই কর্মকর্তা। তিনি আরটিভি নিউজকে বলেন, আমি বলবো মানুষজন যেনো কেবল মদ নয় সকল প্রকার
মাদক থেকে নিজেকে এবং নিজের পরিজনকে দূরত্বে রাখে।
করোনায় মাদক গ্রহণের হার বেড়েছে উল্লেখ করে র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরও বলেন, করোনায় বিভিন্ন কারণে দেশের মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও বেকারত্ব মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ।
কেএফ/এমকে
মন্তব্য করুন