• ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
logo

রাজধানীজুড়ে গৃহকর্মীদের ভয়ঙ্কর যতো কাণ্ডকাহিনী!

  ২২ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১২
Terrible domestic workers as much as the story!
ফাইল ছবি

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিছু কিছু গৃহকর্মী। এরমধ্যে কিছু রয়েছে সরাসরি অপরাধচক্রের সদস্য, যারা ছদ্মবেশে ভালো মানুষের রূপ ধারণ করে স্বার্থ হাসিল করে। এছাড়াও রয়েছে চক্রের বাইরের কিছু লোভী প্রকৃতির সুযোগ সন্ধানী গৃহকর্মী। এই গৃহকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু করে নির্যাতন, মারধর এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীরা। বাসায় রেখে যাওয়া শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ঘটে যাওয়া এমন কয়েকটি ঘটনা।

এর আগে জেনে নেওয়া জরুরি- কি কারণে এমন পরিস্থিতি? এবং এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আরটিভি নিউজ কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এএসএম আতীকুর রহমানের সঙ্গে।

যে কারণে এমন পরিস্থিতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. এএসএম আতীকুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে দু’টো কারণেই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রথমত-‘ডেমোগ্রাফিক চেইঞ্জ’ বা জনমিতিক পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত- আর্থসামাজিক উন্নয়ন। আগেকার দিনে ছেলে সন্তান অনেক হওয়ায় যৌথ পরিবার থাকার কারণে এবং উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন না হওয়ার কারণে, যে একটা পারিবারিক চক্র ছিলো সেই প্রক্রিয়ায় ঘরের শিশু, প্রতিবন্ধী, নারী ও প্রবীণদের দেখভাল পরিবারই করতো।

গবেষণার কথা উল্লেখ করে ঢাবির এই অধ্যাপক বলছেন, ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের কারণে আমাদের শিশু জন্ম নেওয়ার হার কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে প্রবীণ জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ শিশু কমে যাচ্ছে, প্রবীণ বেড়ে যাচ্ছে। এটা এতো ভয়ঙ্করভাবে পরিবর্তন হচ্ছে যে, ২০৫০ সালে শিশুদের তুলনায় প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে যাবে। শিশুদের সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে হবে ২১ শতাংশে।

বৈশ্বিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এমন পরিবর্তনের কারণে পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলো ‘ইন্সটিটিউশনাল কেয়ারে’ চলে গেছে। যে পর্যায়ে আমরা এখনও যেতে পারিনি। যেমন ওইসব রাষ্ট্রগুলোয় শিশু জন্ম নিচ্ছে হাসপাতালে এবং বেড়ে উঠছে ‘ডে কেয়ার সেন্টারে’। এবং শেষ বয়সে বৃদ্ধরা থাকছেন ‘ওল্ড হোম’ বা প্রবীণ নিবাসে। আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় যা আজও আমরা শিশু ও প্রবীণদের জন্য এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। উল্টো আজও আমরা বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে যারা রয়েছি, তারা গৃহকর্মীদের উপর নির্ভরশীল, যেটা বর্তমানে উন্নত বিশ্ব কল্পনাও করছে না। এমন একটা অবস্থা যে- আমরা গৃহকর্মী ছাড়া চলতেই পারি না।

গৃহকর্মীদের নিবন্ধন-নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ জরুরি

আমাদের দেশের গৃহকর্মীদের নিবন্ধন নেই, শ্রমিক হিসেবে ফরমাল নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও নেই। এমন অবস্থায় আমরা ভুলভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছি। এই অবস্থার পরিবর্তন আস্তে আস্তে হবে এটাই প্রত্যাশা করছি বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আতীকুর রহমান।

তিনি বলেন, গৃহকর্মীদের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব। আমাদের দেশে বর্তমানে দেড় কোটি প্রবীণদের মধ্যে প্রবীণ নিবাসে মাত্র কয়েক’শ লোকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি বৃদ্ধ নারীরা অসহায় হয়ে পড়েন। আসলে আমাদের দেশে প্রবীণ নারীরা বেশি অরক্ষিত।

পরিস্থিতি পরিবর্তনে করণীয়

অধ্যাপক আতীকুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, আমাদের গৃহকর্মীদের আচরণ ও অন্যান্য বিষয়গুলো শিক্ষাব্যবস্থায় গল্প আকারে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা সচেতন হয়। এছাড়াও ঘটে যাওয়া এমন ধরনের ঘটনাগুলো তুলে ধরে যদি নাট্য আকারে প্রচার করা যেতো, মানুষ সচেতন হতো। অন্যদিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন মসজিদের বয়ানে যদি ইমাম সাহেবরা মুসল্লিদের সচেতন করেন, সেক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে।

তিনি আরও বলেন, যাদের কোনও সন্তান নেই বা জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যারা একটি বা দু’টি সন্তান জন্ম দিয়েছেন, যে সন্তানরা বিদেশ থাকে ওই প্রবীণদের নিরাপদ কোনও আশ্রয় নেই। সেই দিকে রাষ্ট্রকেই নজর দিতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি বলেন, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ এর মধ্যে দিয়ে আমরা ঠিক হবো। তবে এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সচেতনতা তৈরিতে হিট করতে হবে- শিক্ষা ব্যবস্থায়, গণমাধ্যমে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আমাদের দেশে প্রায় ৪ লাখ মসজিদ রয়েছে। ওইসব মসজিদগুলোর ইমাম সাহেবরা বয়ানের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। এছাড়াও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ জনগণ এবং সরকার, উভয়েই সম্মিলিতভাবে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারবে।

গৃহকর্মদের লোমহর্ষক কয়েকটি ঘটনা

হত্যা, নির্যাতন চালিয়ে স্বর্ণ গহনা লুট, ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ ইত্যাদি অপরাধ সংগঠিত হয়েছে গৃহকর্মীদের দ্বারা।

মগবাজারের নির্যাতিত বৃদ্ধা ভুগছেন চরম যন্ত্রণায়

গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর মালিবাগের এক বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে বৃদ্ধাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, টাকা ও স্বর্ণ গহনা লুটের ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পরে যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ভাইরাল হয়। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র নিন্দার ঝড় ওঠে। ঘটনার পর গত ২০ জানুয়ারি ভোরে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল ও বালিয়াডাঙ্গি থানার সীমান্তবর্তী কাশিপুর এলাকা থেকে রেখা আক্তারকে (২৮) গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসে পুলিশ। আজ শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) এই রেখার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। নির্যাতনের শিকার হওয়া ওই বৃদ্ধার মেয়ে মেহবুবা জামান বলেন, ‘রেখার হাতে এমনভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। কেবল বলছেন, ‘রেখা আমাকে এভাবে......!”

ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজা হত্যায় ২ গৃহকর্মীর ফাঁসি

২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী এলিফ্যান্ট রোডে নিজ বাসায় খুন হন ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন। এ ঘটনায় তার স্বামী ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমত কাদির গামা নিউ মার্কেট থানায় মামলা করেন। ওই মামলার বিচারে এই হত্যাকাণ্ডে দুই গৃহকর্মী রিতা আক্তার ওরফে স্বপ্না ও রুমা ওরফে রেশমার ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাসায় থাকা ২০ ভরি সোনা, ১টি স্যামসাং মোবাইল ফোন এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা চুরি করতে আসামিরা মাহফুজাকে নাকে-মুখে ওড়না পেঁচিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়। মাহফুজা চৌধুরী ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। গামা ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের হয়ে জিএস প্রার্থী ছিলেন।

ধানমণ্ডিতে গৃহকর্মীর হাতে জোড়া খুন

২০১৯ সালের ১ নভেম্বর রাতে ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর (নতুন ১৫) রোডের এক ভবনের পঞ্চমতলা থেকে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান টিমটেক্স গ্রুপের এমডি ও ক্রিয়েটিভ গ্রুপের ডিএমডি কাজী মনির উদ্দিন তারিমের শাশুড়ি আফরোজা বেগম (৬৫) এবং তার গৃহকর্মী দিতির (১৮) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের দু’জনকেই গলা কেটে হত্যা করা হয়। শুরু থেকেই সন্দেহ করা হচ্ছিল গৃহকর্মী সুরভীর হাতেই তারা খুন হন। ঘটনার দিনই ধানমণ্ডির পানের দোকানদার আতিকুল হক বাচ্চুর মাধ্যমে কাজে যোগ দিয়েছিল সুরভী। হত্যাকাণ্ডের ২ দিন পর রোববার সন্ধ্যায় আগারগাঁও বস্তি থেকে গৃহকর্মী সুরভী আক্তার নাহিদাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, গৃহকর্মী সুরভী দাবি করে, বাচ্চুর মাধ্যমে শুক্রবার ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেয় সে। বাচ্চু বাসা থেকে বের হওয়ার পর সুরভীও চলে যেতে চায়। ওই সময় বাসার পুরোনো গৃহকর্মী দিতি বাধা দিলে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। তখন সুরভী রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে দিতির গলা, পিঠ আর বুকে আঘাত করে।

এরপর সুরভী বাসার অপর কক্ষে গিয়ে আফরোজাকে বলে, সে এই বাসায় কাজ করবে না। চলে যাবে। আফরোজা তখন তার কাছে জানতে চায়, অন্য ঘরে দিতি চিৎকার করল কেন। সুরভী তখন আফরোজাকে জানায়, সে চলে যেতে চাওয়ায় দিতি বাধা দিয়েছে। এ নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। এ সময় আফরোজাও তাকে বলেন, বাচ্চু তোকে এখানে রেখে গেছে। সে বলেছে তোকে যেতে না দিতে। এখন তুই যেতে পারবি না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আফরোজার গলায়, ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে সুরভী। এই ঘটনার পর সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে আসছিল, তখনও আফরোজা বেঁচে ছিলেন।

আফরোজার জামাতা কাজী মনির উদ্দিন তারিমের অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের সময় তার শাশুড়ির বাসা তছনছ করা হয়েছে। নগদ টাকা, ৩টি ফোন, সঞ্চয়পত্র, সোনাসহ অনেক মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে। মামলাতেও মালামাল খোয়া যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে।

তবে সুরভীর কাছ থেকে পুলিশ কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। সুরভী পুলিশের কাছে দাবি করেছে, ওই বাসা থেকে একটা আইফোন সে নিয়েছিল। ৪ হাজার টাকায় সেটি বিক্রি করে দিয়েছে সে। সেই টাকার অধিকাংশই সে খরচ করে ফেলেছে।

কেএফ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
X
Fresh