• ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
logo

কালো টাকা সাদা করতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ পাত্তাই দেয় না সরকার

  ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ২৩:১৫
government, does not, follow, advice, economist, black and White money
কালো টাকা সাদা করতে অর্থনীতিবিদের পরামর্শ পাত্তাই দেয় না সরকার

করোনা মহামারিতে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষে ব্ল্যাক মানি বা কালো টাকা সাদা করার বিরোধিতা করেননি দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা কালো টাকা সাদা করতে সরকারকে বেশকিছু মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মতামত পাত্তাই দেওয়া হয়নি। উল্টো ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করতে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছে সরকার। এতে বছরে পর বছর দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালান ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যেমন উৎসাহিত তেমনি সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক আইনের আওতায় ১৯৭৫ সালে প্রথম ঘোষণা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে শুরু করে যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন তারাই দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাচালান কারবারিদের বিভিন্নভাবে সুবিধা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেন। এ পর্যন্ত ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধাগুলো যথাযথ সময়ে কাজে লাগিয়েছেন। তবে কালো টাকার মালিকরা দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, শেয়ারবাজার, বেকারত্ব দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্য খাতে মানুষের সেবামূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করেননি। তারা সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা করেছেন জমি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনে। এতে কালো টাকার মালিক নিজেরা আর্থিকভাবে বিত্তশালী হয়েছেন।

জানা গেছে, অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগে দেশে বহুবার নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কখনও ফল পাওয়া যায় না। এরপরও রাজনৈতিক সমঝোতায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কারণ রাজনীতিতে সব ধরনের লোকের সম্পৃক্ততা আছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দিলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সরকারি দলের কাছের আমলারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে সরকার।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ৬৫০ জন কালো টাকা সাদা করেছেন, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রথম ছয় মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় প্রায় সাড়ে নয়শ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কালো টাকা সাদা করতে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। প্রথমত, ফ্ল্যাট ও জমি কিনে বা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা বা নগদ টাকার ওপর নির্দিষ্ট হারে কর দেওয়া। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। এই দুই উপায়ে কালো টাকা সাদা করলে অর্থের উৎস জানতে চাইবে না এনবিআর।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট বক্তব্যে বলেছিলেন, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।

সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে গত ৬ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী বলেন, কালো টাকা সাদা হওয়ায় অর্থনীতি অনেক বেগবান হচ্ছে। টাকা আমাদের পলিসিগত কারণে কালো হয়। অনেকেই ট্যাক্স দেয় আবার অনেকেই ট্যাক্স দেয় না।

বাংলাদেশের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় দুর্নীতিকে সুরক্ষা ও প্রসার ঘটানো হচ্ছে। যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ২০ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম এম আকাশ আরটিভি নিউজকে বলেন, সরকার কালো টাকা সাদা করছে এতে অর্থনীতিবিদদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় কালো টাকা সাদা করছে, সেটি নিয়ে অর্থনীতিবদরা বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল পরামর্শগুলো পাত্তাই দেয়নি।

তিনি আরও বলেন, কালো টাকা দুই রকমের। প্রথমত, কোনও ব্যক্তি ভুল করে কর দেয়নি যা সাধারণ কালো টাকা হিসেবে চিহ্নিত। দ্বিতীয়ত, অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে লাভবান, মাদক চোরাচালান বা দুর্নীতি।এজন্য কালো টাকা সাদা করতে উৎস জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল সরকারের। কিন্তু কালো টাকা সাদা করতে যে ফরম রয়েছে, সেই ফরমে অর্থ আয়ের উৎসের অপশন রাখা হয়নি। কারণ কোনও কালো টাকার মালিক আয়ের উৎস দিতে চাইলেই আটকে যাবেন। ফলে ফরমে আয়ের উৎসের অপশনটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ আরটিভি নিউজকে বলেন, সরকার যখন কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেয় তখনই আমরা বলেছিলাম এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহীত হবেন। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অর্থনীতিবিদদের এসব মতামত কর্ণপাত করেননি। তবে আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা থাকলে কালো টাকার সঠিক সমাধান আসতো। আমাদের দুঃখ হচ্ছে- কালো টাকা সাদা করতে তেমন কোনও শর্ত আরোপ করা হয়নি।

আমাদের দেশে নিরাপত্তাহীনতার কারণে কালো টাকার মালিকরা বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করতে চান না। তারা দেশের তুলনায় বিদেশে অর্থ বিনিয়োগে বেশি উৎসাহী। এজন্য দেশের বিপুল পরিমাণ কালো টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্র আইন করে কিংবা বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ রাখতে পারেনি। এজন্য দেশের অর্থ দেশে রাখতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি জনগণকে ঐক্য আসতে হবে। কালো টাকার উৎস দুর্নীতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পথগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেকের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কোনও ভাবেই অর্থ পাচার বন্ধ রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এফএ

মন্তব্য করুন

daraz
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় এসবির রিপোর্টার নিহত
চট্টগ্রামে জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
জিম্মি জাহাজের নাবিকদের জন্য ছাগল-দুম্বা আনছে জলদস্যুরা
X
Fresh